ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শিবকথা


    পার্থ দাশগুপ্ত (March 2, 2024)
     

    শিবের একটা ধনুক ছিল। সেটা রাম ভেঙে ফেলেছিল। শিবের বাণ ‘পাশুপত’। সেটাও অর্জুনকে দিয়ে দিয়েছিল। তাহলে শিবের আর রইল কী? এমনকী তার পরনের বাঘছালটাও আমরা খুলে নিয়েছিলাম। সাপের বেল্ট দিয়ে টাইট-ফিটিং বাঘছাল পরনে ছিল। বিয়ের আসরে গরুড়কে দেখে সাপ দিল চম্পট আর বাঘছাল খসে পড়ল কোমর থেকে। সেটাও নিলাম খুলে; ‘মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা’। এবার আর কী? দিগম্বর শিব ষাঁড়ের পিঠে সওয়ার। কালীঘাটের পটুয়া দিল এঁকে। শিঙা হাতে ঢুলুঢুলু চোখের শিবঠাকুর। শিবনেত্র। দেদার বিক্রি হত তখন। এখন কপি হয় কার্টিজ পেপারে, চায়ের লিকার লেপে। ডিজিটাল প্রিন্টও পাওয়া যায়। ১২″ × ১৮″ বা ৬″ × ৯″ সাইজে ম্যাট পেপারে। বোঝা গেল যুদ্ধের চেয়ে বিগ্রহ ভাল। ঝামেলা কম। শুধু স্ট্যাচু হয়ে থাকতে হবে। বাকি যা করার চেলাচামুণ্ডারা করবে।   

    আমার মাস্টারমশাইদের নাম শিবকুমার আর শিবপ্রসাদ। আমার এক ছাত্রের নাম শিবশংকর। আমার বছরের রাহা খরচের হিসাব রাখেন যিনি তার নাম শিবসাধন। আমার দাদার এক বন্ধুর নাম শিবেশ। ক্লাস ফাইভে ঢিল মেরে যার মাথা ফাটিয়েছিলাম তার নাম শিবকিঙ্কর; তার মাথায় চারটে সেলাই পড়েছিল। যদিও ডাক্তারবাবুর ইচ্ছা ছিল আরও ক’টা বেশি সেলাই দেওয়ার; তাহলে যদি শিবকিঙ্করের বদমায়েশি একটু কমত। ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পরে শিবকিঙ্করকে আমার মা হরলিক্স খাইয়েছিল আর আমার ছোটমামা আমায় ঢোলকলমির ডাল দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিল। সেই ডাক্তারবাবুর নাম ছিল হরিহর ব্যানার্জি— বিষ্ণু আর শিব মেলানো-মেশানো। ওই ডাক্তারবাবু ছাড়া বাকি ‘শিব’দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। শুধু শিবেশদাকে দেখলে এড়িয়ে যাই, কারণ ভীষণ বকবক করে। শুনেছি এখন একটা জ্যোতিষ চেম্বার খোলার তাল করছে।      

    শিবকে নিয়ে যা কিছু লেখা আছে পুরাণে, তার চেয়ে ঢের বেশি লেখা আছে লোককথায়, ছড়ায়, প্রবাদে। সর্বজনে সে খুবই জনপ্রিয়। একেবারে চোলপর্বের ক্লাসিক নটরাজ-এর থেকে শুরু করে আমাদের কালীতলায় অশ্বত্থ গাছের নীচে নোড়ার মতো কালো পাথরের মধ্যে তিনি বিরাজ করেন। তফাত একটাই, ব্রোঞ্জের নটরাজ দিয়ে গৃহসজ্জা হয় আর অশ্বত্থতলার কালো পাথরে পাড়ার মেয়েরা উপোস করে বেল ফাটায়। গৃহসজ্জায় ওই কালো পাথরের ঠাঁই নেই। তার জন্য ঠাকুরঘর। নটরাজের বৈঠকখানা।   

    আমার ভাগনি মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে কানেকটিকাট-এ গবেষণা করছে। আমার দিদির খুব ইচ্ছা, ও দেশে থাকতে থাকতেই যেন তার শিবের মতো একটা বর হয়। মনে মনে জানি তা অসম্ভব। বেনারসে দু-চারটে গাঁজাখোর হিপি ছাড়া আমেরিকান শিব আমি এখনও দেখিনি।

    দিন পনেরো আগে দিল্লির আর্ট মেলায় যে কাজটা নিয়ে খুব আলোচনা হল, সেটা দেখে এসেছি। এল এন তাল্লুরের করা। মধ্য পঞ্চাশের এই কন্নড় শিল্পী নটরাজের ব্রোঞ্জমূর্তির শুধু ঘেরাটোপটুকু, যেটাকে আমরা চালি বলি, সেটাকে অবিকৃত রেখে নটরাজের মূর্তিটাকে সরিয়ে দিয়েছেন। বলা ভাল ধারালো মেশিন দিয়ে কেটে তুলে নিয়েছেন। পড়ে আছে শুধু সমতল একটা ধাতুর পাত। ঝকঝকে, শুধু কর্তিত করার নিদর্শন নিয়ে। দেখলাম দর্শকরা ওটার সামনে দাঁড়িয়ে শিব-ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। যেন পুরাণ থেকে সর্বজনে দেবতার গমনপথের মসৃণতাকে কটাক্ষ করা। শিব আমাদের বড় সোহাগের, সেটা ভুলতে বসলে ভারী বিপদ।

    দক্ষিণ ভারত বা পূর্ব ভারত ঘুরে দেখা হয়নি তেমন। তবে মিউজিয়াম দেখেছি। সেখানে শিব, বিষ্ণু আর বুদ্ধের বেশ রমরমা। তবে লোকসংস্কৃতির মিউজিয়ামে আবার শিবের আধিক্য বেশি। ললিত কলা অকাদেমি-র দুটো মোটা মোটা বই আছে: ‘South Indian Bronzes’, লেখক সি শিভারামামূর্তি; আর ‘Eastern Indian Bronzes’, লেখক ড. নীহার রঞ্জন রায়। ধাতু ভাস্কর্যে দক্ষিণ ভারতে শিবের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো, চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়াম-এও কিছু আছে তার নিদর্শন। আমাদের কলকাতা পৌরসংস্থার লোগোতেও তো নটরাজের আগুনধরা ওই বাম হাতখানি; আচার্য নন্দলাল-এর কল্পনায়। ‘Eastern Indian Bronzes’-এ একটি ১২.৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার উমা মহেশ্বর-এর মূর্তি দেখলাম কুরকিহার, বিহার থেকে পাওয়া। বর্তমানে পটনা মিউজিয়ামে রাখা। আহা! ওই চার ইঞ্চিতে কী মোলায়েম বিভঙ্গ। অমন করে ডান হাতে উমার চিবুক ধরে আদর করলে ধরার রমণীকুলের বুক কাঁপবে না! ধন্য শিল্পী।    

    বাঁ দিক থেকে: বাদামি গুহার নটরাজ, ইলোরা, পটনা মিউজিয়াম-এর সংগ্রহ, ললিত কলা অকাদেমি-র ‘Eastern Indian Bronzes’ বই থেকে।

    আমার ছেলে দয়ানন্দ। যে কোনও নোটিশ পড়তে খুব ভালবাসে। ২০১৬ সালে সে আর তার দিদি দুর্গা জীবনে প্রথমবার, আর আমি ষষ্ঠবারের জন্য ইলোরা গিয়েছিলাম। মহাদেবের কোলে চড়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত এক মরাঠি দম্পতিকে গিয়ে ছ’বছরের খোকা নোটিশের পড়া বলে এসেছিল। বেচারারা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও আমার বেশ লেগেছিল ফ্রেমটা। শিব-পার্বতীর কোলে নবদম্পতি। ‘সোহাগে বাম অঙ্গে তোমার উমা হেলে র’বে’। আমরা সেবার পকেট আঁকড়ে দু-রাত, তিন দিন হোটেল কৈলাসে ছিলাম। শিবের জন্য ঔরঙ্গাবাদেও কৈলাস চলে এসেছিল। আমার শান্তিনিকেতনের আরেক মাস্টারমশাই মানিদার বাড়ির নামও কৈলাস। গ্রীষ্মকালে উনি প্রায়ই বলতেন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘আমার গরম লাগে না, আমি তো কৈলাসে থাকি।’ যা দেখেছি তাতে মনে হয় শিবের খুব গরম লাগে। এ ব্যাপারে সিদ্ধি, ধুতরো না ছাই কোনটা দায়ী তা বলতে পারব না। তবে বাদামিতে যে আঠারো হাতের নটরাজ মূর্তি আছে তার অঙ্গভূষণ অভূতপূর্ব। মুকুট থেকে নেকলেস, বক্ষবন্ধনী থেকে কোমরবন্ধনী, অনন্ত, মালার, কী যে বৈভব! আর মুকুট ছাড়িয়ে উঁচু করে বাঁধা চুল। টপনট যাকে বলে। মুকুট সমেত গোটা পোর্ট্রেটের পিছনে ডিম্বাকৃতি চালি। চন্দ্রপ্রভা। বাঁ পায়ের কাছে খর্বকায় গণেশ। সব মিলিয়ে আকাশছোঁয়া এক অনন্ত সৌন্দর্য। পঞ্চম শতকের এই অনুপম শিল্পের উত্তরাধিকারী আমরা, এমনটা ভাবলে লটারি জেতার মতো বুক ধড়ফড় করে। সরবিট্রেট হাতরাতে হয়!      

    বর্ষায় কেদারঘাটের চারটে সিঁড়ি জেগে থাকে। প্রতি সন্ধ্যায় একজনকে দেখতাম কেদারলিঙ্গ-কে মালিশ করছে, আর তারস্বরে নালিশও করছে। সারাদিন বসের রক্তচক্ষু থেকে শুরু করে কামধেনু মিষ্টান্ন ভান্ডারের রাবড়িওয়ালা, কেউই রেহাই পেত না নালিশের থেকে। পরে জেনেছিলাম ভদ্রলোক এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারী। এই মালিশ আর নালিশ তার নিত্যকর্ম, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ— সারা বছরের কাজ। কেদারঘাটে কখনও চারটে, কখনও চল্লিশটা সিঁড়ি সাক্ষী থাকে শুধু।      

    নন্দলাল বসুর আঁকা ‘শিবের বিষপান’ ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। মহার্ঘ এক নেকলেস গলায় শিব। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর তার হাত আর পায়ের আঙুলের ডগায় চাঁদের আলোর ছোঁয়া। সর্বাঙ্গে চন্দ্রালোকের পরশ নিয়ে মহেশ্বর যেন হলাহল পান করছেন। ম্যাজিক লাইট। আর গলায়, বুকে হালকা সবুজ ওয়াশ।    

    বাঁ দিক থেকে: নটরাজের হাতের মুদ্রা ও কলকাতা পুরসভার লোগো, এল এন তাল্লুরের ভাস্কর্য (দিল্লি আর্ট ফেয়ার ২০২৪), চোল আমলের ব্রোঞ্জ (ন্যাশনাল মিউজিয়াম, দিল্লি)

    জয়নগর মজিলপুরে থাকে শম্ভুনাথ দাস। বাবা ঈশ্বর পাঁচুগোপাল দাস, ঠাকুরদা ঈশ্বর মন্মথনাথ দাস। সবাই পুতুলশিল্পী— মাতাল শিব বানায় বংশ পরম্পরায়। ইঞ্চি তিনেক লম্বা। বাঁ হাতে দেহের ভর। মাথা ঈষৎ হেলানো, ঝোলা গোঁফ আর ঢোলা বাঘছাল— ঠিক যেন নেশাতুর বাংলার প্রতিনিধি! শম্ভুনাথের মাতাল শিবের বিক্রি বেশ ভাল। আমাদের ঠাকুরের আসনেও আছে। গত বছর দুর্গাঠাকুরের কাঠামোতে ওই রকম শিব দশ ইঞ্চি সাইজে দুই ডজন বানিয়ে ফিট করেছিলাম। পুজোর পরে পাড়ার লোকে যে যার ঘরে নিয়ে গেছে মাতাল শিবকে। পুজো শেষের গৃহসজ্জায় তিনি। এ শিব বিরহী শিব। বাপের বাড়িতে উমা চলে যাবার পরে সে কাঠামোর চালিতে বসে তানপুরা নিয়ে বিরহী গান গায়। বিরহী সংগীতে শুধুই শিবের এক্তিয়ার। আগমনি আর বিদায়ী গানের এক্তিয়ার যেমন উমার বাপের বাড়ির।  

    এহেন শিবকে ধোপদুরস্ত হয়ে থাকতে কোনও দিনই দেখিনি। আমি একটা জাঙ্গিয়া পরা শিবঠাকুর এঁকেছিলাম। শিবের ছোটবেলা। শিশু ভোলানাথ।

    বাঁক কাঁধে একবার তারকেশ্বরে গিয়েছি। নতুন গামছার রং উঠে সাদা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি গোলাপি হয়ে গিয়েছিল। ফেরার সময় নকুলদানা, সাদা সুতোয় লাল গুটলি দেওয়া বাবার ডোর আর একটা পাঁচ কিলো ওজনের কুমড়ো নিয়ে এসেছিলাম। ওই লাল গুটলি দেওয়া সাদা রঙের বাবার ডোর আধময়লা হয়ে যেত একদিন। খুলে ফেলতাম। তাতে শিবঠাকুর কখনই রেগে যাননি। আমার ভাগনি মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে কানেকটিকাট-এ গবেষণা করছে। আমার দিদির খুব ইচ্ছা, ও দেশে থাকতে থাকতেই যেন তার শিবের মতো একটা বর হয়। মনে মনে জানি তা অসম্ভব। বেনারসে দু-চারটে গাঁজাখোর হিপি ছাড়া আমেরিকান শিব আমি এখনও দেখিনি।

    ফিচার স্কেচ ও অন্যান্য ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook