ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাবান ও সুন্দরী


    আবীর কর (July 14, 2023)
     

    ‘সাবান পেয়েছে আজ স্নানঘরে যুবতীরে একা।’— এই কবিতা-পংক্তি কোনও এক অজ্ঞাত কবির। এখানে কবিতাটি কার বা কবিতাটি কেমন, এসবের থেকেও বড় কথা এর কল্পনাচিত্র সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার। আমার যখন একুশে পা, তখন শোনা ওই কবিতা-পংক্তির অভিঘাত হয়েছিল মাত্রাহীন। ধরা যাক, যেদিন ওই কবিতার লাইনটি শুনেছি, সেদিনই সান্ধ্য টেলিভিশনে সেই সময়ের এক জনপ্রিয় সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখি পাহাড়ি নীল ঝরনার জলে এক স্বল্পবসনা সুন্দরীর খোলামেলা স্নানের অনুপম উচ্ছ্বলতা। এক ধাক্কায় তখন কবিতায় থাকা ‘স্নানঘর’ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যায়। এই যে সবুজ বনানীর মাঝে পাহাড়ি স্রোতায় আকাশ-নীলের নীচে একটি সুগন্ধি সাবানের সঙ্গে সম্পূর্ণ একা-একা এক সুন্দরীর প্রীতি-ঘন স্নান, সেও তো এক স্বতন্ত্র কবিতাই! আবার অবগাহনে উচ্ছ্বসিত সেই সুন্দরী যখন হাসে, তার গালে টোল পড়ে। সেই টোল, যার জন্য ওই বয়সে যে-কোনও বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিতে চায় মন। তখন ‘ফাস্ট-ট্যাগ’ ছিল না, ছিল শুধু ত্যাগের নিষ্পাপ আনন্দ। যাই হোক, প্রীতির প্রতি প্রেম ওই লিরিল সাবানের ছন্দসূত্রে গাঁথা। আর তখনই মনে-মনে প্রীতি ও শুভেচ্ছা, লিরিল সাবান শুদ্ধতার স্নানে আরও সুগন্ধ ছড়াক সুন্দরীর বাহান্নপীঠে। তারপর তো একে-একে দীপিকা পাডুকোন, হৃষিতা ভট্ট, পূজা বাত্রার মতো রিলে-সুন্দরীরা লিরিলের স্নানে দুগ্ধফেননিভ দৃশ্য রচনা করেছেন। এক সময়ে, লিরিলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন ঐশ্বর্যা রাই। ক্রমে-ক্রমে লিরিলও তার রঙে-রূপে গেরুয়া, সবুজ, নীল, সাদা— নানা বর্ণে-গন্ধে হাজির হয়েছে। তবে মনে জারি আছে গালে টোল পড়া সুন্দরীর স্নান-জলে সুনীল সৌন্দর্য।

    তবে সাবানের সঙ্গে সিনে-সুন্দরীদের সোহাগের সম্পর্ক স্থাপনের শুরুটা হয়েছিল লাক্স টয়লেট সাবান গায়ে মেখে। সময়কাল ১৯২৯, লাক্স সাবানের প্রথম তারকা-সুন্দরী লীলা চিতনিস। তখন লাক্স সাবানের দাম দু’আনা। যদিও লাক্সের পথ চলা তারও তিন দশক আগে। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে ১৮৯৯-এ, ইউনিলিভার নিয়ে আসে ‘সানলাইট প্ল্যাক’ নামে এক লন্ড্রি সোপ, ১৯২৫-এ তা রূপান্তরিত হয় ‘লাক্স টয়লেট সোপ’ নামে। তারপর সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তা হয়ে উঠে ‘চিত্রতারকাদের সৌন্দর্য সাবান’। দীর্ঘদিনের সেই লাক্স-চিত্রতারকার ভিড়ে, কে না ভিড়তে চেয়েছেন! টলি-বলির সেরা সুন্দরী নির্বাচন হয়েছে, লাক্সের বিজ্ঞাপনী-মুখের নিরিখে। ১৯২৯-এ লীলা চিতনিসকে দিয়ে যে এক বিজ্ঞাপন-ঘরানার শুরু, আজও আসন্ন শতবর্ষের মুখে তার জয়যাত্রা অব্যাহত। ১৯৫৫-তে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন যে সাবানের ‘শুভ্রতা ও বিশুদ্ধতার জন্য’ প্রচারের মুখ হন, যে-সাবান মেখে কানন দেবী বলেন, ‘কমনীয় ত্বক, সহজেই পাওয়া যায়’। মীনাকুমারী যখন ‘পাকিজা’-খ্যাত অভিনেত্রী, তিনি তাঁর সৌন্দর্য ও ত্বক-লাবণ্যের যত্ন নেওয়ার গোপন উপায়স্বরূপ ‘সর্বদা বিশুদ্ধ শুভ্র লাক্স’ সাবান ব্যবহারের কথা বলেছেন। পরবর্তীতে অপূর্ব দেহ-লাবণ্যের অধিকারী মালা সিনহার অভিমত, ‘স্নানের সময় লাক্স সত্যিই আনন্দদায়ক’। এই আনন্দদায়ক অবগাহনে তৃপ্ত হয়েছেন মধুবালা, সায়রা বানু, আশা পারেখ। লাক্সের হয়ে ১৯৮৩ সালে মিস ইন্ডিয়া হেমা মালিনী লাক্সের বিজ্ঞাপনী-মডেল হন; তাঁর বিবৃতি ছিল, ‘আমি যা চাই, পেয়ে গেছি, থ্যাংকস লাক্স’। লাক্সের সঙ্গে স্নান করে সতেজ ও তরতাজা সুন্দরীর দলে আছেন রেখা, শ্রীদেবী, জিনাত আমন, জয়াপ্রদা। সপ্রতিভ বিদূষী-সুন্দরী অপর্ণা সেনের বক্তব্য, ‘নিজের ওপর আমার, নেই কোনো অধিকার’। এরপর এই অনধিকারের বিশ্লেষণে শেষমেশ বলা হচ্ছে, লাক্স ‘সবসময় আমার রঙরূপের পরিচর্যা করে’। অভিনেত্রী শোভা সেন বলছেন, লাক্স সরের মত মোলায়েম, সুগন্ধী এই ফেনা আপনার ত্বকের যত্ন নেয়। ‘নতুন ফসল’ ছায়াছবির নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরীর বিজ্ঞাপন-বক্তব্য, ‘চেহারায় আমার রূপের ছোঁয়া লেগেছে লাক্সের কোমল পরশ পেয়েছে বলেইতো’। সমকালীন অভিনেত্রী সাবিত্রীর অভিমতে, ‘আমার ত্বককে এটি মোলায়েম আর মসৃণ রাখে’। লাক্স-সুন্দরী সিরিজের অন্যতমা ওয়াহিদা রহমান জানিয়েছেন, ‘সৌন্দর্য্যের গোপন কথা হলো ত্বকের কুসুমসম কোমলতা’, যা দিতে পারে একমাত্র লাক্স সাবান। সময়ের সরণি বেয়ে সব চিত্রতারকা সুন্দরীই লাক্স মেখে স্নান করেছেন। লাক্স-সুন্দরী হয়েছেন মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, করিশমা কাপুর, রানি মুখার্জি, করিনা কাপুর, ঐশ্বর্যা, আমিশা, ক্যাটরিনা। এই সুদীর্ঘ সুন্দরী-সারিতে কতিপয় সুন্দরের মুখও নজর কেড়েছে। নিশ্চয় অনেকের স্মরণে আছে লাক্সের দুধসাদা-ফেনাভরা গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বাথটাবে টলিউড বাদশা শাহরুখ খান, আর তাঁকে ঘিরে হেমা মালিনী ও শ্রীদেবী যেমন আছেন, তেমনই আছেন জুহি চাওলা, করিনা কাপুর। তারপর লাক্স রোজ অ্যাওয়ার্ডের বিজ্ঞাপনেও প্রধান পুরুষ-মুখ শাহরুখ খান, আর সঙ্গে করিনা, করিশমা এবং শর্মিলা ঠাকুর। লাক্সের বিজ্ঞাপনে এক সময়ে শাহরুখের সঙ্গিনী হয়েছেন সুন্দরী ক্যাটরিনা। পরবর্তীতে এই জুটির ধারায় লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, রিল ও রিয়েলের জুড়িতে সইফ আলি খান-করিনা এবং ইদানীং বিরাট-অনুষ্কা। উভয়ক্ষেত্রেই লাক্সের ছোঁয়ায় সুন্দরী জীবনসঙ্গিনীদের মুখমণ্ডলে চাঁদের আলো ফুটে ওঠা বিভা তাদের সঙ্গীদের বাধ্য করছে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতে। সময়ের সাথে-সাথে লাক্সের রঙে-রূপে এসেছে বৈচিত্র্য। সাদা থেকে গোলাপি, নীল, সবুজ, এমনকী হলুদ পর্যন্ত।

    লাক্স-সুন্দরী অপর্ণা সেন
    লাক্স-সুন্দরী ওয়াহিদা রহমান

    পিয়ার্স সাবানকে একান্ত-আপন জ্ঞানে বিজ্ঞাপনে নেমেছেন সেরা সুন্দরীরা। পিয়ার্স সাবান কোম্পানিতে কাজ করতেন লন্ডনের টমাস জে ব্যারাট, যাকে আধুনিক বিজ্ঞাপনের এক অন্যতম হোতা বলা হয়। পিয়ার্স সাবানের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী বক্তব্য, ‘সুপ্রভাত, তুমি কি পিয়ার্স সাবান ব্যবহার করেছ?’ ১৮৯১ সালে ব্যারাট মিস পীয়ার্স-এর ভাবনা ভাবেন এবং পণ্যের প্রচারে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর-এর ভাবনাও তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। ব্রিটেনের এক হোটেল গায়িকা ছিলেন লিটল ল্যাংট্রি, তাকে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপনে আনেন টমাস জে ব্যারাট। প্রখ্যাত আর্টিস্টদের আর্টওয়ার্ককে ভিত্তি করে পিয়ার্স সাবানের একাধিক বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেন, যা একাধারে রুচিশীল এবং পুরোদস্তুর আধুনিক। পণ্যের প্রচার, প্রসার ও পসারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা বিষয়ে ব্যারাটের বক্তব্য ছিল— রুচি পাল্টায়, ফ্যাশন পাল্টায়, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিজ্ঞাপনের বয়ান পাল্টানো জরুরি।

    পিয়ার্স : সুন্দরী নারীদের ঐতিহ্য

    পিয়ার্স সাবানের সুন্দরী-সংযোগস্বরূপ একটি বিজ্ঞাপন, যেখানে বড় হরফে মুদ্রিত— ‘পিয়ার্স… সুন্দরী নারীদের ঐতিহ্য’। তারপর মূল বক্তব্যের বিশ্লেষণে ছোট হরফে লেখা— ‘‘‘পিয়ার্স’’ নামটি সারা পৃথিবীর সুন্দরী নারীদের কাছে অতুলনীয় গুণাবলীর প্রতীক— মোলায়েম এবং ভাল পিয়ার্সে তাদের সৌন্দর্য্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।… পিয়ার্স আসল গ্লিসারিণ যুক্ত সৌন্দর্য্য সাবান’। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপনী মুখ ছিলেন সেই সময়ে মডেলিং-এ আসা সুহাসিনী মুলে। আর এই বিজ্ঞাপনচিত্রেই সুহাসিনী নজরে পড়েন পরিচালক মৃণাল সেনের। সেই সূত্রে ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেন সুহাসিনী। পরবর্তীতে তিনি ‘জন অরণ্য’ ছবিতে সত্যজিতের সহকারী এবং ‘মৃগয়া’তে মৃণাল সেনের সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন।

    গত শতকের, পাঁচ/ছয় দশকের ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রী মধুবালা, লাক্স সাবানের পাশাপাশি হামাম সাবানের বিজ্ঞাপনী-মুখ হয়েছিলেন। গোদরেজ কোম্পানি তাদের পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিযুক্ত করেছিল এই সুদর্শনা অভিনেত্রীকে। মধুবালার সুন্দর হাসিমুখ-যোগে পোস্টার-বিজ্ঞাপন ছিল, ‘মধুবালার সৌন্দর্যের গোপন কথা— হামাম সাবান’। ১৯৩১ সালে টাটা কোম্পানির উদ্যোগে, বাজারে এসেছিল স্নানঘরের প্রতিশব্দে ‘হামাম’ নামের সাবান, যা সুগন্ধের দিকে না ঝুঁকে সাবানকে ভেষজগুণে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস নেয়। এই প্রচেষ্টায় জড়িয়ে ছিল বিদেশি সুগন্ধি সাবানকে অন্ধ অনুসরণ না করে দেশীয় ভেষজদ্রব্যকে কাজে লাগানোর অঙ্গীকার। এবং বাস্তবে দেখা যায়, বিদেশি সাবানকে সেই সময়ে পিছনে ফেলে পসার জমিয়েছিল ‘হামাম’। বিজ্ঞাপনে লেখা হত, ‘Tata’s  Humam is bigger soap— it’s truly Swadeshi  too…’। দেশীয় উদ্যোগ হিসেবে নোট থাকত, ‘১৮৮৬ সালে জামশেদজী টাটা স্বদেশী মিল কোম্পানী চালু করেন। আপনারা সবাই স্বদেশী জিনিস কিনুন ও আন্দোলনে অংশ নিন’। সেই সময়ের দেশীয় শিল্পোদ্যেগে নিবিড় ভাবে যোগ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভূবিজ্ঞান প্রমথনাথ বসু মহাশয়। যিনি স্বদেশি শিল্পের প্রচার-প্রসারে ১৮৯১-এ গড়েছিলেন ‘ভারতীয় শিল্পোদ্যেগ সম্মেলন’। তাঁর খনিজ অনুসন্ধানে ও উৎসাহদানে ঝাড়খণ্ডের সাকচিতে লৌহ ইস্পাতের কারখানা খোলেন জামশেদজি টাটা। এমনকী আজকের আধুনিক পদ্ধতিতে সাবান তৈরির কারখানার স্থপতি হলেন ভূবিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তাঁর পুত্র পরিচালক মধু বসুর স্ত্রী অভিনেত্রী সাধনা বসু এক সময়ে ‘চিত্রতারকার সৌন্দর্য সাবান’ লাক্সের বিজ্ঞাপনী-মুখ ছিলেন।

    লাক্স-সুন্দরী সাধনা বসু

    স্বদেশি পণ্য উৎপাদনে গায়ে-মাখা সাবানের ক্ষেত্রে টাটার হামাম-এর তুলনায় পূর্বসূরি হল ‘মাইসোর স্যান্ডেল’, ‘গোদরেজ’ এবং ‘মার্গো’। ১৯১৬ সাল, মহীশূরের রাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মাইসোর স্যান্ডেল সোপের কারখানা। এই সাবানের মূল উপাদান চন্দন কাঠের তেল। সাবানের সমান্তরালে মহীশূরের চন্দন কাঠের গন্ধ-জড়ানো ধূপ এবং ট্যালকম পাউডার দেশীয় বাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে মাইসোর স্যান্ডেল সাবানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিযুক্ত হন ক্রিকেট তারকা মহেন্দ্র সিং ধোনি। দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ভেনুগোপাল পার্বতী নায়ার এক সময়ে মাইসোর স্যান্ডেলের হয়ে বিজ্ঞাপনের মুখ ছিলেন।

    লাক্স-সুন্দরী সুচিত্রা সেন

    স্বদেশি পণ্যের প্রসারে মহীশূরের কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার কিংবা টাটা কোম্পানির পথেই হেঁটেছিল সেই সময়ের খ্যাতনামা গোদরেজ কোম্পানি। তখন গোদরেজ দেশের ও দশের সম্পদ সুরক্ষার মহান দায়িত্ব পালনে তালা-চাবির প্রস্তুতকারক হিসেবে খুব পরিচিত। এরপর বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে দেশীয় পণ্যদ্রব্য ব্যবহারের গভীর ভাবাবেগকে অবলম্বন করে গোদরেজ নামল সাবান তৈরির ব্যবসায়। ততদিনে ‘বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী’র মূল চাবিকাঠিটি তাদের জানা। তাই ‘চাভি’র ছবি-যোগে ১৯১৮ সালে গোদরেজ নং ২ নামে কাপড়-কাচা সাবান এবং ১৯২০ সালে গোদরেজ নং ১ নামে স্নানের সাবানকে তারা বাজারে আনল। দীর্ঘ গবেষণায় গোদরেজই প্রথম সাবান তৈরির ক্ষেত্রে কোনওরকম চর্বি ব্যবহার ছাড়াই শুধুমাত্র উদ্ভিজ তেল-যোগে সাবান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তার প্রস্তুত-প্রণালীকেও প্রকাশ্যে এনেছিল। দেশের মধ্যে প্রথম চর্বিমুক্ত তথা অহিংস সাবান হিসেবে গোদরেজ দেশবাসীর বিপুল সমাদর পায়। পার্সি ভাতৃদ্বয় আদর্শি গোদরেজ ও পিরোজশা গোদরেজের এই স্বদেশি উদ্যোগকে আন্তরিক সমর্থন জানিয়ে গোদরেজ সাবানের প্রচারে আসেন অ্যানি বেসান্ত, রাজাগোপালাচারীর মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। তখনও প্রয়োজন বা প্রসাধন সামগ্রীর প্রচারে সুন্দরীদের সেভাবে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি, তবে গোদরেজ সাবান তার সম্পর্কে সুখ্যাতির প্রচারে পাশে পেয়েছিল সেই সময়ের এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষকে। যিনি বিদেশি সাবান আর গোদরেজ সাবানের তুলনায় এগিয়ে রেখেছিলেন স্বদেশি দ্রব্য গোদরেজকে। তিনি হলেন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি সেই সময়ে মনে করেছিলেন দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য, বাণিজ্যক্ষেত্রে দেশীয় উদ্যোগকে সমর্থন জানানো তাঁর জাতীয় কর্তব্য। বাস্তবিকই দেখা যায়, স্বদেশি প্রেমকে অবলম্বন করে উচ্চ-মধ্যবিত্তের স্নানঘরে সেদিন যেসব সাবান জায়গা করে নিয়েছিল, তার মধ্যে এগিয়ে ছিল গোদরেজ, মাইসোর, হামাম। আর তখন অধিকাংশ মধ্যবিত্তের কলতলা, কুয়োতলা বা পুকুর-ঘাটের স্নানে সহযোগী হয়েছিল চিরচেনা লাল রঙের লাইফবয় এবং পরে-পরে কোথাও বা নিমপাতা-সমৃদ্ধ তিতকুটে মার্গো। সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে মেহনতী মানুষের গা-ধোওয়া সাবান হিসেবে লাইফবয়ের দীর্ঘকালীন ভূমিকা আজও স্নাত-স্মরণীয়। লাইফবয় সাবানের বিপুল ব্যবহারের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিল এর দাম। এই সাবানের বিজ্ঞাপনে বরাবর দেখা গেছে সুঠাম চেহারার অধিকারী পুরুষদেরই। যদিও তারই মধ্যে উল্লেখ্য সেই বিজ্ঞাপন, যেখানে স্কুল-ফ্রক পরা এক স্মার্ট কিশোরী রিনরিনে গলায়, তার বন্ধুকে ছুড়ে দেয় সেই জিজ্ঞাসা, ‘বান্টি, তোর সাবান স্লো না কি?’ খুব হিট হয়েছিল সেই ফিচেল হাসি-জড়ানো উচ্ছল স্কুল-বালিকার প্রশ্নচিহ্নিত এই বিজ্ঞাপনটি। পরবর্তীতে লাইফবয়ের ওই কিশোরী কন্যা অবনীত কাউর, লাস্যময়ী অভিনেত্রী রূপে আত্নপ্রকাশ ঘটান ‘মর্দানি’ ছবিতে। লাইফবয়ের বেশ কিছুকাল পরে মধ্যবিত্তের ব্যয়সংকোচ আর স্বাস্থ্য-সচেতনতার পথ বেয়ে সিনান-জলে মিলেমিশে গেল চোখে জ্বালা ধরানো, তেতো-বদখত মার্গো। বিশৃঙ্খল, বেহিসাবী ছোটোদের না-পসন্দ হলেও বড়দের হিসেবে মার্গোর স্থান অটুট থেকেছে স্বাস্থ্যকর প্রতিষেধক সাবান বিচারে। মার্গোর বিজ্ঞাপনে এক কথায় শেষকথা বলে গেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভালো’। ১৯৭০ সালে মার্গো সাবানের বিজ্ঞাপন-পোস্টারে সত্যজিৎ রায় রেখে গেছেন আড়াআড়ি ভাবে লেখা ‘মার্গো সোপ’ শব্দদ্বয়ের সুতীক্ষ্ণ ক্যালিগ্রাফি। মার্গো সাবানও মাইসোর স্যান্ডেল সাবানের সমবয়সি। ১৯১৬ সালে ক্যালকাটা কেমিক্যাল-এর প্রতিষ্ঠাতা খগেনচন্দ্র দাশ মার্গোর পাশাপাশি নিমপাতাযুক্ত টুথপেস্ট, মহাভৃঙ্গরাজ তেল, ল্যাভেন্ডার সুগন্ধি প্রস্তুতিতে খ্যাতি লাভ করেন।

    গোদরেজ সাবান এবং রবীন্দ্রনাথ
    গোদরেজ সাবান এবং অ্যানি বেসান্ত

    গত শতক থেকে শুরু করে এই শতকের এই সময় অবধি সাবানের বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি স্নান সেরেছেন সুন্দরীরা। জনপ্রিয় অভিনেত্রী নতুবা উঠতি মডেল। সাবান প্রসাধনী সামগ্রী নয়, প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তারপরও বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে সতেজ স্নিগ্ধতার তুলনায় বেশি জোর দেওয়া হয় ফর্সা হওয়ার, মোহিনী সুন্দরী হয়ে ওঠার দিকে। এই একুশ শতকেও এহেন বর্ণবৈষম্যের ইঙ্গিতবাহী বিজ্ঞাপন পাতায়-পর্দায় দিব্য প্রসার-প্রচার পেয়ে চলেছে। সাবান মেখে সুন্দরী হয়ে ওঠার বিষয়টি বিতর্কিত হলেও, সুন্দরীর সাবান মেখে স্নান করে ওঠা বিজ্ঞাপনচিত্র বা চলচ্চিত্র তর্কাতীত। সাবানের সেই সনাতন কাল থেকেই বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় সাবানের সঙ্গে সুন্দরীর মাখো-মাখো সম্পর্ক। এই সময়কালের নজরকাড়া বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায়, সন্তুর সাবানের ফেনিল স্রোতে গা ভিজিয়ে সেই পণ্যের প্রচারে নেমেছেন আলিয়া ভাট। সন্তুরের বিজ্ঞাপনে মুখ হয়েছেন আকাঙ্ক্ষা শর্মা, সঙ্গী বরুণ ধবন। আর সন্তুর সাবানের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন-সিরিজ, সেখানে মূল কথা, মায়েদেরকেও মেয়েদের মতো দেখায়। এখনকার জনপ্রিয় সাবান ভিভেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন করিনা কাপুর, কৃতী শ্যানন। ভিভেলের বিজ্ঞাপনে কলকাতা নাইট রাইডার্স ক্রিকেট টিম ও অভিনেতা দেবের সঙ্গে তুমুল নাচানাচিতে সামিল ছিলেন বাংলার অভিনেত্রী শুভশ্রী। মেডিমিক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তন্বী সুহাসিনী সুন্দরী বিদ্যা বালানকে। ফিয়ামা জেল ও বারের প্রচারে পণ্যদূতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে দীপিকা পাডুকোন, সারা আলি খান।

    সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে স্নানের গা-ধোওয়া সাবানের বৈশিষ্ট্য পাল্টেছে বার বার, সুগন্ধি সাবান থেকে ভেষজ আয়ুর্বেদিক, মূল উপাদান হিসেবে নাশপাতি, কমলালেবু, চন্দন, নিম…। কিন্তু অধুনা দেখা যাচ্ছে আমাদের আধুনিক জীবনযাপনের স্নানঘরে আমাদের সাবেকি সাবানের তুলনায় জেল, সাওয়ার সোপ, সোপ লিকুইডের জায়গা হচ্ছে পাকাপোক্ত। কিন্তু সেই বদলে যাওয়া তরল সাবানের ক্ষেত্রেও তার প্রচার-প্রসারের মূলে থাকছেন সুন্দরীরা। কেননা বিজ্ঞাপনের জগতে সাবান, শ্যাম্পু, সুগন্ধি ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর সম্প্রচারে, জনগণের মনে পণ্যের চাহিদা তৈরিতে জনপ্রিয় সুন্দরীরাই বরাবর হয়েছেন প্রিয়জন!

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook