ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীলা-নীলাব্জ : পর্ব ১০


    অনুপম রায় (January 11, 2025)
     

    কাজ

    কসবার একটা গলি দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল নীলা। আকাশে মেঘ করেছে। যে-কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। যা গরম ধরেছিল, একটু বৃষ্টি নামলে মন্দ হয় না। কিন্তু এখন যে বাড়ি ফেরার তাড়া! ঠিক তখনই রিকশা থেকে মুখ বাড়িয়ে, ‘আরে! নীলা যে!’

    নীলা : নীলাব্জ, একদম আটকাবার চেষ্টা করবে না। বৃষ্টি নামবে এখুনি।

    নীলাব্জ : এই রিকশা, দাঁড়াও, দাঁড়াও!

    রিকশাওয়ালা : এখানে নামবেন? ভাড়াটা কিন্তু পুরো লাগবে!

    নীলাব্জ : আমি কি বলেছি দেব না?

    নীলা : ঝামেলা কোরো না নীলাব্জ। তোমার যেখানে যাওয়ার সেখানে যাও। আমার তাড়া আছে।

    ততক্ষণে নীলাব্জ নেমে পড়েছে।

    নীলাব্জ : তাড়া তো তোমার রোজ লেগেই আছে। একদিনও তো তোমাকে দেখিনি যেদিন তোমার তাড়া নেই।

    নীলা : আকাশটা দেখেছ? এই দ্যাখো গায়ে এক-দু’ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে।

    নীলাব্জ : এই সময়টারই তো প্রয়োজন ছিল। আগেও কোনওদিন এরকম মুহূর্তে আমাদের দেখা হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তাই আজকেই…

    নীলা : এমন একটা হাবভাব করছ যেন তুমি আমার প্রেমিক। তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানেই যাও।

    নীলাব্জ : আমার প্ল্যানগুলো আমি এখুনি ক্যান্সেল করে দিলাম। আর তুমিও আমার প্রেমিকা নও কিন্তু এমন অসাধারণ একটা বৃষ্টিভেজা সন্ধে আমরা তো একসঙ্গে কাটাতেই পারি।

    নীলা : আর কেউ নেই তোমার এইসব ফালতু কথা শোনার? ফালতু কাজ করার?  

    নীলাব্জ : ফালতু কাজ? সব কাজই তো ফালতু! তোমার কোন কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

    এর মধ্যে বৃষ্টি নেমে গেছে। চারিদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেছে। এক ফুচকাওয়ালা নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ওদের ধাক্কা মেরে ছাউনিতল খুঁজতে দৌড় লাগাল।

    নীলা : ওরে বাবা রে! দেখলে! দেখলে! এই তোমার জন্য কী ঝামেলায় পড়লাম এবার! গেল আমার ব্যাগটা ভিজে।

    নীলাব্জ : কী আছে? ল্যাপটপ?

    নীলা : আরে ধুর বাবা! এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে নাকি?

    পাশেই একটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির কাজ হচ্ছিল। দোতলাতে মিস্ত্রিদের জামাকাপড় মেলা। চারিদিকে ইট, বালি, স্টোনচিপ ছড়ানো। নীলাব্জ হাসিমুখে সেই আধখানা বাড়ির নীচে প্রবেশ করল। টিনের একটা টেম্পোরারি গেট। খোলাই ছিল।

    নীলাব্জ : এদিকে এসো।

    নীলা ভিজতে-ভিজতে ওখানে এসে জলের হাত থেকে অন্তত বাঁচল। গিয়ে দেখে নীলাব্জ মিস্ত্রিদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

    নীলাব্জ : চলো ওপরে। বারান্দায় বসব।

    নীলা : মানে?

    আরও পড়ুন : নিজস্ব ফিলোজফি নিয়ে তর্কে মাতে নীলা ও নীলাব্জ, তারপর দুজনেই এক সময়ে হেসে ফেলে…

    নীলাব্জ : নীচে এই অন্ধকারে মশার কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? চলো। বৃষ্টি দেখতে-দেখতে আড্ডা দেব।

    নীলা বুঝতে পারে, বৃষ্টি না থামলে এখান থেকে বেরনো মুশকিল। টুক করে উবার-ওলা দেখে নিয়েছে। যা খুশি দাম চাইছে। বাড়িটার সবে ঢালাই হয়েছে। একটা-দুটো দিকে অল্প দেওয়াল উঠেছে।

    নীলা : এখানে যে বসলে, গায়ে তো জল লাগছে।

    নীলাব্জ : ওই একটু। না লাগলে ফিলটা পাবে না তো! জল লেগে গলে তো যাচ্ছ না?

    নীলা : একে তো ঝামেলায় ফেললে, তার ওপর কথা শোনাচ্ছ!

    নীলাব্জ : আহা! সরি, সরি! বলো, কী এত কাজ-কাজ করতে থাকো তুমি? তুমি এক ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরলে কী এমন হয়ে যাবে?

    নীলা : সেই এক প্রশ্ন। তুমি বুঝবে না। আমাকে গিয়ে এআই নিয়ে একটা কোর্স করতে হবে। তার সার্টিফিকেশান…

    নীলাব্জ : অফিসের কাজ তো? সোমবার করলেই পারো। অযথা শনিবারের সন্ধেটার পিণ্ডি কেন চটকাবে?

    নীলা : না সোনা, তা হয় না। সোমবার আমার অন্য আরও কাজ থাকবে।

    নীলাব্জ : আচ্ছা এই যে এআই নিয়ে কোর্স করবে, এআই তোমার বন্ধু না শত্রু বলে মনে হয়?

    নীলা : মানে? এটা কী ধরনের কথা?

    নীলাব্জ : মানে তোমার ক্ষতি করবে না সাহায্য করবে?

    নীলা : অবশ্যই সাহায্য করবে।

    নীলাব্জ : তাহলে এআই তোমার বন্ধু না ভৃত্য?

    নীলা : এটাই বা কী কথা হল?

    নীলাব্জ : মানে এআই তোমার ফাইফরমাশ খেটে দিলে বিনীতভাবে ধন্যবাদ দেবে, না কি আচ্ছা ঠিক আছে বলে এগিয়ে যাবে?

    নীলা : জানি না। ভেবে দেখিনি। ধন্যবাদ তো দিই না।

    নীলাব্জ : তার মানে চাকর।

    নীলা : ধুর বাবা! চাকর কেন হতে যাবে? এখন এই ভাঙা বাড়িতে বৃষ্টির মধ্যে বসে এইসব ফালতু কথা বলতে তোমার…

    বৃষ্টি একটা রূপকমাত্র। তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে জীবনটা দ্যাখো নীলা। মুহূর্তগুলো চলে যাচ্ছে। কিছু পড়ে থাকবে না। তোমার প্রতিটা মুহূর্ত তোমার! শুধু তোমার। সব ঝরে যাচ্ছে। তুমি না বাঁচতে চাইলে সেগুলো বৃথা যাবে! নষ্ট হবে। তুমি দু’ফোঁটা গায়ে মেখে নাও। এখুনি নাও।

    নীলাব্জ : তাহলে বৃষ্টি দেখো। দেখো এই শহরে, এই অসময়ে বৃষ্টি মানুষকে কেমন অকেজো করে দিয়েছে।

    নীলা : এই শহরে একটু ঝিরঝির করে জল পড়লেই সব অকেজো হয়ে যায়। সময়-অসময়ের কিছু নেই। তার চেয়ে বরং উবার দেখি। কত জলদি বাড়ি ফেরা যায়।

    নীলাব্জ : আচ্ছা আমাদের জীবনের কি কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে তোমার মনে হয়?

    নীলা : না, একদমই না।

    নীলাব্জ : আমিও তো তাই বলছি। উদ্দেশ্য যখন নেই, তখন এই কাজ, সেই কাজ, এত কাজের কথা উঠছে কোথা থেকে?

    নীলা : যাব্বাবা! কাজ তো মানুষ তাই জন্য তৈরি করেছে যাতে একটা উদ্দেশ্য দেওয়া যেতে পারে জীবনের। মানুষ সবাই মিলে এই কাজ করতে-করতে একদিন সমস্ত জ্ঞান অর্জন করে ফেলবে। সেদিন মানুষের কাছে তোমার এইসব প্রশ্নের উত্তর থাকবে।

    নীলাব্জ : কী যে বলো! একটা যুদ্ধ লাগলে বা প্রকৃতিক দুর্যোগ আসলেই তো সব জ্ঞান উড়ে যাবে। তখন এতজনের, এতদিন ধরে করা পরিশ্রম হুস করে সব নষ্ট। কবে মানুষ কী করবে, সেই ভেবে তো আজকের সন্ধেটা নষ্ট করা যায় না। এত লং টার্ম ভাববে কেন তুমি? তোমার কোনও কাজের কোনও তাৎপর্য নেই। তুমি এই পৃথিবীতে না থাকলেও পৃথিবী ঘুরবে। মহাবিশ্বের কিছু যায় আসবে না।

    নীলা : নিজেকেই তো কন্ট্র্যাডিক্ট করছ। আমার কাজের লং টার্ম কোনও গুরুত্ব নাই থাকতে পারে কিন্তু শর্ট টার্ম তো আছে। আমার মাইনে বাড়ে। অফিসে সবাই আমাকে সম্মান করে। আমার বাড়ি হয়, গাড়ি হয়। আমার মন ভাল থাকে।

    নীলাব্জ : ছাই থাকে। সারাক্ষণ মুখটা প্যাঁচার মতো করে রাখো। যেন ঘুম থেকে উঠে চিরতার জল খেয়ে বেরিয়েছ। কবে মাসের শেষে একটা ম্লান হাসি হাসব বলে বাকি তিরিশ দিন ধরে এরকম মনমেজাজ নিয়ে ঘুরব কেন? খেটে-খেটে মরে যাচ্ছ, আর লং টার্ম স্বপ্ন দেখছ। যখন দেখবে তোমার হাসতে ইচ্ছে করছে, তখন শরীর ভরে গেছে রোগে। ইচ্ছে থাকলেও পারবে না। জিমে গিয়ে আর দারুণ স্বাস্থ্যকর ডায়েট করে ভেবেছিলে কোলেস্টেরল কমাবে কিন্তু জীবনে এত স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছ যে সে-গুড়ে বালি।

    নীলা : সলিউশন কী? সব ছেড়ে তোমার মতো ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াব? এই ঢপের বৃষ্টি দেখব?

    নীলাব্জ : দ্যাখো, বৃষ্টি একটা রূপকমাত্র। তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে জীবনটা দ্যাখো নীলা। মুহূর্তগুলো চলে যাচ্ছে। কিছু পড়ে থাকবে না। তোমার প্রতিটা মুহূর্ত তোমার! শুধু তোমার। সব ঝরে যাচ্ছে। তুমি না বাঁচতে চাইলে সেগুলো বৃথা যাবে! নষ্ট হবে। তুমি দু’ফোঁটা গায়ে মেখে নাও। এখুনি নাও।

    নীলা : আমার বৃষ্টি ভাল লাগে না।

    নীলাব্জ : তাহলে কী ভাল লাগে? কবে একটা সূর্যোদয় দেখবে বলে বাকি দিনগুলো মুখ বুজে খেটে যেতে?

    নীলা : শচীনকেও তাই করতে হয়। কবে একটা খেলা হবে বলে রোজ প্র্যাকটিস।

    নীলাব্জ : কিন্তু শচীনের হয়তো প্র্যাকটিস করতে দারুণ লাগে। ওর কাছে ওটাই ওর বৃষ্টির জল।

    নীলা : প্র্যাকটিস করতে মনে হয় না পৃথিবীতে কারোর দারুণ লাগে। তবে যাক গে, আমি শচীন নই। আমার অত ক্যালি নেই। আমার আপাতত ওই ফ্ল্যাটটার ইএমআই-টা…

    নীলাব্জ : ওই একটা ইএমআই-এর জন্য আগামী দশ বছর খিটখিটে মেজাজে দিনরাত এক করে কাজ করব। সারা শরীরে রোগ ধরিয়ে ফেলব। ইএমআই মিটিয়ে ফেললে তখনই আবার একটা অপ্রয়োজনীয় চ্যালেঞ্জ নিজের জীবনে নিয়ে আনব।

    নীলা : তুমিই তো বললে অত লং টার্ম না ভাবতে। আমিও ভাবছি না। আপাতত বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হয়। তাই না?

    নীলাব্জ : উঠলে নাকি?

    নীলা : সারাজীবন এই ধুলোবালির মধ্যে বসে থাকতে তো আসিনি।

    নীলাব্জ : তুমি শুধু ধুলোবালিটাই দেখলে। এই যে একটা অর্ধসমাপ্ত বাড়ি, তার মালিক এই বারান্দায় বসার আগেই কিন্তু আমরা এখানে বসে গেলাম, একটা সন্ধে কাটিয়ে গেলাম। সে জানতেও পারল না। প্লাস্টারহীন এই ইট-বের-করা দেওয়ালগুলো শুনে রাখল আমাদের ঝগড়া। যে-পরিবার এখানে থাকবে, তারাও নিশ্চয় ফাটাফাটি ঝগড়া করবে একদিন। আমরা একটা হালকা সূচনা করে রেখে গেলাম।

    নীলা মৃদু হাসে। হাত নেড়ে বিদায় জানায়।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook