শিকার ও স্বীকার
মিশিগানের স্কুলে ২০২১-এ একটি ১৫ বছরের ছেলে করিডোরে হাঁটতে-হাঁটতে গুলি চালিয়ে চারজনকে মেরে ফেলল, সাতজন আহত হল। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, একইসঙ্গে তার মা-বাবার অন্তত ১০ বছরের জেল হল, ২০২৪-এর এপ্রিলে। যদি ১০ বছর পর কর্তৃপক্ষের মনে হয় তাদের এখনও ছাড়া যাবে না, তবে ১৫ বছর অবধি জেল খাটতে হবে। এই বন্দুক মা-বাবাই কিনে ছেলেকে উপহার দিয়েছিল ঘটনার চারদিন আগে, এবং সেটা কোনও বাক্সে তালাবন্ধ-টন্ধ করে রাখা হত না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, বেশ কিছুদিন হল ছেলের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যের কিছু অভাব দেখা যাচ্ছিল, যা তারা দেখেও দ্যাখেনি। আমেরিকায় ইস্কুলে গুলি চালিয়ে নিরীহ শিক্ষক-ছাত্রকে মেরে ফেলা এখন তো প্রায় নিয়ম হয়ে গেছে, প্রতি বছর আমরা ঘটনাগুলো পড়ে শিউরে উঠি বটে কিন্তু বিস্মিত হই না। কিন্তু এই প্রথম একজন সন্তানের কুকাজের দায় তার অভিভাবকদের নিতে হল, আইনিভাবে তাদেরও দণ্ডিত করা হল।
যে-সন্তান বয়ঃসন্ধির দিকে যাচ্ছে বা তা পেরিয়ে আরও একটু এগিয়েছে, তার মনের মধ্যে কী চলছে, তা কোনও মা-বাবার পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এক্ষুনি ডাইনিং টেবিলে বসে মেসি আর রোনাল্ডো নিয়ে যে-ছেলেটা বা মেয়েটা গলা ফাটাচ্ছিল, সে সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে ঘরে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে পারে। যে-ছেলেটা তার বন্ধুর সঙ্গে মিলে অনেককে গুলি করে মেরে নিজেও আত্মহত্যা করল, তার মা হয়তো তাকে নিয়মিত সঙ্গ দিয়েছেন বন্ধুর মতো মিশেছেন ও বার বার বলেছেন, তোর কোনও সমস্যা হলে আমাকে বলবি, আমি সাহায্য করব। তাই অনেকে প্রশ্ন করছেন, ছেলে যদি এমন সাংঘাতিক একটা কাণ্ড করে, তার জন্য মা-বাবা কী করে দায়ী হন? কে বলে দেবে, কতটা সাহচর্য কতটা নজর কতটা শাসন আইসম্মত রকমের ভাল? কেউ যদি সারাক্ষণ সন্তানের মাথার ওপর ভনভনিয়ে উড়তে থাকে এবং চোখ পাকিয়ে বকুনি দেয়, তাকে ভাল বাপ-মা বলে? না কি যে সন্তানকে অনেকটা স্বাধীনতা দেয়, নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে এবং নিজের সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করতে দেয়, সে আরও ভাল? যখন কেউ কোনও অপরাধ করে, তখন তার গোটা পরিবারকে ধরে যদি টান মারা যায়, স্ত্রী কেন খেয়াল করেনি তার নিষ্ঠুরতা, বাবা কেন খেয়াল করেনি তার বিষণ্ণ বসে থাকা, সন্তান কেন খেয়াল করেনি অযথা রেগে ওঠা, বন্ধু কেন খেয়াল করেনি ক্যারমের আড্ডায় অনুপস্থিতি, প্রতিবেশী কেন খেয়াল করেনি তার বাজার গিয়ে চিল্লিয়ে তরকারিওলার সঙ্গে অবান্তর কলহ, তাহলে কি কোনও মানুষই অভিযোগ-বৃত্তের বাইরে থাকবে? একটা ছেলে হিংস্র ও হত্যা-কিলবিল ভিডিও গেম দেখছে, বা বন্ধুকে এমন ছবি পাঠাচ্ছে যা হিংসামূলক, তা বুঝতে গেলে ১৫ বছরের ছেলের মোবাইলটা কেড়ে সব মেসেজ-টেসেজ দেখতে হয়। সেটা অন্তত মার্কিন সমাজে কক্ষনও উচিত-কাণ্ড বলে গণ্য হতে পারে না, কারণ ওখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকারকে প্রবল মূল্য দেওয়া হয়, এবং ওই বয়সে একটি ছেলের তো প্রণয়-সম্পর্ক, যৌন সম্পর্কও হয়ে যেতে পারে, তার মোবাইল নিয়ে ওগুলো নাড়লে-চাড়লে বরং সে-ই আদালতে মামলা ঠুকে দিতে পারে, ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য।
কিন্তু ব্যাপার আরেকটু গভীর। ছেলেটির যে মনের গোলমাল শুরু হয়েছিল, তা সে বুঝেছিল। আচমকা তার মনে হল বাড়িতে কেউ ঢুকেছে, কেউ বাথরুমে গেল এবং ফ্লাশ করল, বাথরুমের আলোও জ্বালানো আছে এখনও। অথচ সে ঘুরেফিরে দেখল, বাড়িতে কেউ নেই। আবার তার মনে হল রান্নাঘরে একটা দৈত্য এসেছে, সে ঘটিবাটি ছুড়ছে, ছেলেটি তার ছবিও তুলল। এই ব্যাপারগুলো যে স্বাভাবিক নয়, ছেলেটি তা পুরোপুরি অনুভব করেছিল, তার মাকে মেসেজ করে জানিয়েছিল, বার বার মা-বাবাকে বলেছিল: আমাকে মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। কিন্তু তারা গা করেনি। বাবা বলেছিল এই ওষুধটা খা, ওসব ঠিক হয়ে যাবে, আর একটু মনের জোর কর। আর মা কথাগুলো শুনে হেসেছিল। ছেলে মা’কে বার বার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে বলত, কিন্তু মা বাড়িতে খুব একটা থাকত না। অফিসের পর, পোষা ঘোড়ার দেখভাল করতে যেত। ছেলেটি তার বন্ধুকে মোবাইলে বহু মেসেজ করেছে, আমি রকম দৃশ্য দেখছি, কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, কতবার বলেছি আমার মানসিক চিকিৎসা দরকার, কিন্তু মা-বাবা কিছুতেই শুনছে না। কখনও বন্ধুকে লিখেছে, জানিস আমি চান করতে গিয়ে হাসছি আবার কেঁদে ফেলছি। কখনও বলেছে, মনে হচ্ছে আমি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে মরে যাচ্ছি। কখনও বলেছে, আমার ইচ্ছে করে নিজেই 911 ডায়াল করি কিন্তু তাতে বোধহয় মা-বাবা খুব রেগে যাবে। ছেলেটি এক সময়ে ছোট-ছোট পাখির ছানা ধরে তাদের অত্যাচার করে গলা কেটে ফেলতে শুরু করে, যদিও এ-ব্যাপারটা বাবা-মা’র জানার কথা নয়। বন্ধুকে একদিন লিখেছিল, পাখির কাটামুন্ডু সে একটা বয়ামে ভরে বিছানার চাদরের তলায় রেখেছিল, মা চাদরটা একদিন তুলল, কিন্তু কে জানে কী করে বয়ামটা দেখতেই পেল না! তার বন্দুক হাতে ভিডিও সে বন্ধুকে পাঠিয়েছিল। বন্ধু তার উত্তরে লেখে, দারুণ, এবার ঢিসুম ঢিসুম ঢিসুম। ছেলেটি লেখে, এবার স্কুলে গিয়ে ঢিসুম-ঢিসুম করার পালা।
ছেলেটি ওয়েবসাইটে গিয়ে মানুষ-হত্যা, স্কুলে গুলি চালিয়ে হত্যা ইত্যাদি দেখতে শুরু করে। ঘটনার আগের দিন, স্কুলে ফোনে বিভিন্ন ধরনের বুলেটের ছবি দেখছিল বলে শিক্ষক তাকে একজন কর্তাব্যক্তির কাছে পাঠান, তিনি কথা-টথা বলে ছেলেটির মা’র কাছে একটা ভয়েস-মেল পাঠান। তাই শুনে মা ছেলেকে টেক্সট করে, তুমি স্কুলে বুলেটের ছবি সার্চ করছিলে? ছেলে উত্তরে যা লেখে, তার সারাংশ: স্কুলের অফিসে ডেকেছিল, কথা হয়েছে, এটা নিয়ে কোনও শাস্তি পেতে হবে না। মা রসিকতা করে লেখে, তোর নতুন বন্দুকের ছবিটা ওদের দেখিয়েছিস? লেখে, তোকে তো ধরা না-পড়া শিখতে হবে। পরের দিন (ঘটনার দিন), ছেলেটা তার অঙ্ক খাতায় ছবি এঁকেছিল: একটা বন্দুকের, যা ঠিক তার বন্দুকটার মতোই দেখতে; একটা লোকের, যে রক্তাক্ত, যার গায়ে গুলি লেগেছে; একটা মুখের, যা হাসছে আর তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আর লিখেছিল ‘The thoughts won’t stop. Help me’. এবং ওই পাতারই অন্য তিনটে জায়গায়: ‘My life is useless’. ‘Blood everywhere’. ‘The world is dead’. শিক্ষক তার ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে এসব দেখতে পেয়ে তক্ষুনি মোবাইলে ওই পাতার একটা ছবি তোলেন আর সেটা ডিন-এর কাছে নিয়ে যান। যতক্ষণে ক্লাসে ফিরে আসেন, ততক্ষণে ছেলেটি বন্দুকের ছবি, রক্তাক্ত লোকের ছবি, ওই লেখাগুলো কেটে লিখে রেখেছে ‘OHS Rocks!’ (ওর স্কুলের নাম ওএইচএস) এবং ‘I love my life so much!!!!’, ‘We’re all friends here.’ এবং ‘Harmless act’. ছেলেটিকে স্কুল কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, এর মধ্যে জানা যায় সে ফার্স্ট পিরিয়ডেও গুলি করে হত্যার ছবি দেখছিল। ছেলেটি বলে সে বড় হয়ে ভিডিও গেম তৈরি করবে, তাই ভিডিও গেম দেখছিল, অঙ্কের পাতায় আঁকা ছবিগুলোও সব ভিডিও গেমেরই, আর কোভিডের সময়ে তার আত্মীয় মারা গেছে, একটা পোষা কুকুর মারা গেছে, তাই খুব মনটা খারাপ। কাউন্সেলর তক্ষুনি মা-বাবাকে ডেকে পাঠান। তারা আসে, খাতাটা দ্যাখে, কথা বলে, কিন্তু কাউন্সেলর যখন বলেন, আপনারা আজই একজন মনোবিদকে দেখান, ওর মধ্যে কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, তারা বলে, আজ হবে না, আজ অফিসে কাজ আছে। তখন কথা হয় দু’দিনের মধ্যে দেখাতে হবে এবং কাউন্সেলরকে জানাতে হবে, কী হল। এরপর ছেলেটি ক্লাসে যায়, এক সময়ে মা তাকে মেসেজ করে, ঠিক আছিস তো? ছেলে লেখে, হ্যাঁ, এক্ষুনি লাঞ্চ থেকে ফিরলাম। সেইদিন মা অবশ্য অফিসে গিয়ে ভাল মন-চিকিৎসকের খোঁজ করে, একজন সহকর্মীকে অঙ্ক খাতাটা দেখিয়ে বলে বাপ-মা হিসেবে তারা হয়তো ব্যর্থ, এবং ছেলেকে ওই টেক্সটের পরেই লেখে, তুই আমাদের সব কথাই বলতে পারিস, আমরা তোকে খারাপ ভাবব না। ছেলে লেখে, আমি জানি। ধন্যবাদ। যা হয়েছে তার জন্য দুঃখিত। আমি তোমায় ভালবাসি। তারপর বাথরুম যায়, ফেরার পথে করিডোরে ব্যাগ থেকে বন্দুকটা বের করে।
তার মানে সন্তান মানসিক রোগের লক্ষণগুলো গোড়ার দিকে নিজেই শনাক্ত করছে, মা-বাবার কাছে আর্তনাদ করে অনবরত সাহায্য চাইছে, অভিভাবকরা তা উপেক্ষা করছে। শুধু তা-ই নয়, এক সময়ে ছেলের মনে হচ্ছে আকুল হয়ে ইমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাই, শুধু বাবা-মা’র ভয়ে সে তা করতে পারছে না— তার মানে বাড়ির পরিস্থিতি আলোচনার অনুকূল নয়, এবং অভিভাবকের মেজাজ সন্তানকে ত্রস্ত করে রেখেছে। তারা তার দিকে তেমন যত্নসিঞ্চিত লক্ষও রাখে না। নইলে চাদর তুললেও অ্যাক্কেবারে সামনে পড়ে থাকা বয়ামের ভেতর পাখির কর্তিত মাথার মতো উদ্ভট বস্তু মায়ের চোখ এড়িয়ে যায় কী করে? ছেলে ক্রমশ অশান্তিতে ডুবছে, বলছে মা তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো, আর মা ঘোড়ার পরিচর্যা করছে, ছেলের নয়। ইনস্টাগ্রামে ছেলে দিনের পর দিন বিকৃত মুখের ছবি পোস্ট করছে (মা-বাবা তার সেই অ্যাকাউন্টটা ফলো করত) কিন্তু কেউ তা নিয়ে ভাবছেই না। তার ওপর, সেই অভিভাবকরা এমন সমস্যাপীড়িত বিপন্ন ছেলেকে কী উপহার কিনে দিচ্ছে? বন্দুক! যা কিনা যে-কোনও অপ্রাপ্তবয়স্কের নাগাল থেকে সরিয়ে রাখাই বিধেয়। মানে, এই মা-বাপ চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। এমনিতেই তারা কিছুটা নির্বোধ ও সাধারণ নীতিগুলোর প্রতি উদাসীন গোছের। ছেলে ক্লাসে বুলেটের ছবি দেখছিল বলে বকুনি খেল, মা রসিকতা করে বলল, তোর বন্দুকের ছবিটা ওদের দেখালি? এবং, ধরা না-পড়াটা তোকে শিখে নিতে হবে। মানে, যতক্ষণ না শাস্তি পাচ্ছিস, এসব দোষারোপ স্রেফ হাসির বিষয়। ‘কেন তুই ক্লাস চলাকালীন আদৌ মোবাইল দেখছিলি?’ এই বকুনির কথা মায়ের মাথাতেই এল না। যখন স্কুল থেকে ডেকে বলা হল, খাতায় এইসব এঁকেছে-লিখেছে, তখনই তারা ছেলেকে বাড়ি নিয়ে গেল না, মনের ডাক্তারের কাছে তো নয়ই, বলল, কাজ আছে। যেই শোনা গেল স্কুলে একটা কেউ গুলি চালিয়েছে, সব অভিভাবক ছুটেছিলেন স্কুলে, কিন্তু এই ছেলেটির বাবা ছুটেছিল বাড়িতে, বন্দুকটা বাক্সে আছে কি না দেখতে। তার মানে, তাদের আন্দাজ ও আশঙ্কা ছিল, ছেলে কোনদিকে যাচ্ছে, কিন্তু সেই খাদ থেকে তাকে ত্রাণের দায় যে তাদেরই, সেই সরল কর্তব্যবোধটা ছিল না। ক্যালাস, নির্বিকার, স্বার্থপর বাপ-মা।
এবার কথা হল, বহু বাপ-মা’ই কি তা-ই নন? আমাদের বাড়িতে ছেলে যদি বলে, আমি কীসব আবোলতাবোল দেখছি-শুনছি, আমরা তাকে নিয়ে তক্ষুনি ডাক্তারের কাছে দৌড়ই? না কি বলি, ধুস, মনের জোর কর তো, ওরকম ভেঙে পড়িস না। যদি স্কুলে সে হিংসাত্মক কিছু আঁকে, আর স্কুল থেকে বলে মনের ডাক্তার দেখান, আমরা তক্ষুনি অফিস-টফিস ফেলে দৌড়ঝাঁপ করে তাকে চেম্বারে নিয়ে যাব, না কি বলব, আজ বড্ড কাজ, আমি ছুটির পর বরং ফোন-টোন করে দেখছি? সন্তান যদি এসে আমাকে বলে, সে পরীক্ষায় টুকেছে, কিন্তু ধরা পড়েনি, আমি কি তাকে কান ধরে টানতে-টানতে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে যাই? না কি তার উপস্থিত বুদ্ধির গল্প পারিবারিক জমায়েতে রসিয়ে বলি? নিজেদের জীবনের ঝামেলায় বিদ্ধ হয়ে আমরা কি সর্বক্ষণ তিতকুটে বিরক্ত রগচটা হয়ে থাকি না, যেজন্য সন্তান ফেল-করা খাতা না-দেখিয়ে লুকিয়ে রাখে, শেষমেশ কাঁপতে-কাঁপতে এসে দেখায় এবং তক্ষুনি আমাদের প্রকাণ্ড ধমক খেয়ে অধিক কেঁপে ওঠে? বা সই নকল করে ম্যানেজ করে দেয়? সন্তান চাইলেই কি আমরা অফিস ফেলে বা আড্ডা ফেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসি? নিজে আইপিএল না দেখে তার সঙ্গে লুডো খেলি? সন্তানকে রেখে কি বন্ধুর পার্টিতে যাই না ও মাঝরাতে ফিরে তাকে মোবাইল-রত দেখে বাড়ি মাথায় তুলি না? আমরা অনেকেই কি ক্যালাস ন্যাকা ও উদাসীন বাপ-মা নই? হ্যাঁ, এ-সত্ত্বেও বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যায় না, কারণ আমরা বন্দুক কিনে দিই না। নিজেরাও বন্দুক কিনি না। ঘরে-ঘরে বন্দুক থাকবে, আর বন্দুক রাখার অধিকার নিয়ে ফলাও করে লম্বাচওড়া বাতেলা হবে, আমাদের সংস্কৃতিতে সেই চল নেই। তার মানে, খতিয়ে দেখলে, অভিভাবকেরা এই শাস্তি পাচ্ছে কী জন্যে? খারাপ বাপ-মা হয়েছে বলে নয়। এমন একটা দেশে ও সমাজে বাস করার জন্য, যেখানে বন্দুকবাজিকে শৌর্য বলে মনে করা হয়, এবং বছরের পর বছর এরকম অগুনতি গুলিচালনার ঘটনা ঘটার পরেও যেখানে রাজনীতিবিদরা এবং বন্দুক-ব্যবসায়ীরা কোনওভাবেই এর সঙ্গে বন্দুক-সুলভতার কোনও যোগ স্বীকার করতে রাজি নন। সহস্র প্রতিবাদ অজস্র পরিসংখ্যান সত্ত্বেও যাঁরা অনড়: বন্দুক ঢালাও বিক্রি হবে। তাহলে জেল হওয়া উচিত কাদের?
যদিও আদালত বলেছে, আমরা খারাপভাবে ছেলে মানুষ করার জন্যে এদের এই শাস্তি দিচ্ছি না, এরা একটা নিয়্ন্ত্রণহীন ট্রেনকে থামাবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও থামায়নি, এইজন্য শাস্তি দিচ্ছি। সত্যিই, এতগুলো লক্ষণ জেনেও উপক্ষা করা এবং রোগীকে সাহায্য না করা অপরাধ। বন্দুক হাতের নাগালে রাখা তো চূড়ান্ত অপরাধ। এই কাজটুকু না করলে আজ চারটে প্রাণ এখনও শ্বাস নিত। কিন্তু অনেকে বলছেন, স্কুলের শাস্তি হবে না কেন? স্কুল যখন দেখছে, ছেলেটা অঙ্ক পাতায় এরকম ছবি এঁকেছে ও এসব বাক্য লিখেছে, তারপর বাপ-মা তাকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে না, তারা জোর করল না কেন? তারা তার ব্যাগটা সার্চ করল না কেন? স্কুলে ১৮০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য চারজন মাত্র কাউন্সেলর ছিলেন কেন? হিসেবে দেখা গেছে, খুব বড় কোনও সংকট না হলে, এতে একজন কাউন্সেলর একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন মাত্র ১০ মিনিটের জন্য। তাতে কী করে কারও মানসিক সমস্যা বোঝা যাবে? কেন ১৯৯০-এর দশকে এক গভর্নর মিশিগানের বহু মানসিক চিকিৎসার হাসপাতাল বন্ধ করে দেন ব্যয় কমাবার জন্য? এখন ইচ্ছুকরাও অনেক সময়ে জানেন না মনের রোগ সারাতে ঠিক কোথায় যেতে হবে, আর গেলেও সেখানে ওয়েটিং লিস্ট এত লম্বা, প্রথমবার দেখাতেই হয়তো চার মাস লেগে যাবে। সমাজের কতগুলো স্তরে যে শিশু-কিশোর-যুবকের প্রতি অবহেলা বোনা আছে, সে হিসেব পাব কোত্থেকে? আরও বড় কথা, একজন টিন-এজার অনেক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বোঝা, আর সে এইরকম একটা ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে বোঝার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। কেউ কি ভাবতে পারে, আমার ছেলে খুন করবে? কেউ কি ভাবতে পারে, আমার মেয়ে আত্মহত্যা করবে? সব মা-বাপই ভাবে, ধুর, ও খারাপ হতে পারে, কিন্তু এত বদ নয় যে একেবারে মানুষকে মেরে ফেলবে। আরও বড় কথা, আইন বলে, অন্যের দোষের জন্য আমি শাস্তি পেতে পারি না। অমনোযোগী হওয়ার জন্য, ভবিষ্যৎ আন্দাজ না করার জন্যে জেল হয়? ১০ বছরের? লোকগুলো খারাপ হতে পারে, তাদের ঘরদোর অপরিষ্কার, চরিত্র অবিন্যস্ত, সন্তানপালন শিথিল হতে পারে, তাদের ক্যাবলামি ও অসচেতনতা আমাদের মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু তাতে তারা জেল-খাটার মতো অপরাধী হয় কি? ছেলেটির ডাইরিতে লেখা আছে, ‘বেশ ক’বছর আমার অন্ধকার দিকের সঙ্গে লড়াই করে, আমি পুরোপুরি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছি, আমার মা-বাবা কিছুতেই শুনল না যে আমায় একজন থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।’ পড়লে বুক মুচড়ে ওঠে, মনে হয় এই বাবা-মা’র কড়া শাস্তি হোক। তা-ই হয়েছে। আমরা নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমরা আবেগকে যুক্তির চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিলাম না তো? অনভিপ্রেত ঘটনার দায় নির্দিষ্ট কারও ওপর চাপিয়ে, তার গর্দান চাওয়ার মানসিকতা থেকে আমরা এই লোকগুলোর ওপর রাগ করছি না তো? বা, আরও বড় কথা, পাথর ছুড়ে মারার সময়ে নিজেদের দিকে তাকাতে ভুলে যাচ্ছি না তো? আদালতের সওয়াল শেষ হলেও, এই প্রশ্নগুলোর কামড় আমাদের স্বেচ্ছায় খাওয়া প্রয়োজন।