ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সুস্থ বায়ুর সন্ধানে


    শুভময় মিত্র (March 4, 2023)
     

    ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনে শুভময় মিত্র 

    [স্পিতির সেই ইলিউসিভ স্নো-লেপার্ডকে যদি-বা দেখা যায়, ছবিও তোলা যায়, ধৃতিমানকে ধরা অসম্ভব, প্রায়। ফোনে না পাওয়াই দস্তুর। কিছু পরে নিশ্চিতভাবে কলব্যাক করলে যে-কারণে আগেরটা রিসিভ করা যায়নি তা শুনলে গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসবে। ফোনে কথা বলতে, শুনতে চাইলে এক কলেই হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। হয়তো দেশের কয়েকটা রাজ্য, জঙ্গল, শহরের উপকণ্ঠ পেরিয়ে যাবে কথা ফুরোতে-না-ফুরোতে। আন্তর্জাতিক সীমানা পেরোলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবারের কথোপকথন ‘ধৃতিমানের সন্ধানে’ নামে যেতে-যেতেও যায়নি। স্বদেশ, বিদেশ ও ব্যাক টু স্বদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক কথা ভেসে এসেছিল কয়েকদিন ধরে। তার নির্যাস এই প্রতিবেদনে।]

    ভারতীয় সভ্যতার, ইতিহাসের একটা বড় অংশ যাদের জন্য একদা বদলে গিয়েছিল, এই মুহূর্তে আমি রয়েছি তাদের দেশে। হাইড পার্ক, রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, ইম্পিরিয়াল কলেজ বা হ্যারডস, লন্ডনের অতি বিখ্যাত সব জায়গা, এর কাছেই। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ভেতরে রয়েছি আমি। যার গুরুত্ব আমার কাছে উক্ত সব ক’টি এবং আরও যা যা আছে, যেমন মাদাম তুসো, টেমস নদী, লন্ডন আই, বাকিংহ্যাম প্যালেস, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে, বিগবেনের চেয়ে ঢের বেশি। এই সেই পুণ্যস্থান, যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাস। এর মধ্যে যে বা যারা আজও জীবিত, বহাল তবিয়তে অথবা মুস্কিলে, তাদের ছবি তোলা, চর্চা করা আমার অন্যতম কাজ। এককভাবে শুরু করলেও আমি জড়িয়ে পড়েছি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সমমনস্ক, অ্যাক্টিভ পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে। উনষাটতম আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতার অন্যতম বিচারক হিসেবে এখানে ডেকে আনা হয়েছে আমাকে। ওয়াইল্ডলাইফ বলতে ব্যাপারটা স্রেফ বাঘ, ভাল্লুক, পাখির গল্প নয়। এর চেয়ে অনেক বড় কিছু। আসব সে-প্রসঙ্গে। 

    জ্বলতে-পুড়তে থাকা দুনিয়ার নিত্যনতুন ভয়ংকর ছবি দেখতে-দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ শুরু হয়ে যাচ্ছে প্রলয়, যত্রতত্র। মাইলের পর মাইল জুড়ে দাবানল। ভূমিকম্পে একটা দেশ ভাগ হতে চলেছে, প্রায়। লাগাতার ঝড়, তুফান, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি। শেষ কয়েক দশকে প্রকোপটা বেড়েছে মাত্রা ছাড়িয়ে। কেন, তা ইস্কুলের ছাত্র অবধি জানে। জানে রাষ্ট্র। জানে শিল্পের লোক। জানি আমরা সবাই। আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাবে না, এই স্বার্থপর বিশ্বাসে নির্বিকার থাকছে অধিকাংশ লোক। বিজ্ঞানীদের বারংবার সাবধানবাণী সত্ত্বেও। গ্রেটা থুনবার্গের মতো তেজস্বিনী চ্যালেঞ্জ করছেন ইরেস্পন্সিবল ক্ষমতাবানদের, যাদের সামান্য অঙ্গুলিহেলনে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসলীলা মোকাবিলার কাজটা শুরু করা যেত। কিছুতেই তা করা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ থেকে শুরু করে একের পর এক আলোচনা সভা ডেকে পরিবেশ বাঁচানোর সংগঠিত চেষ্টা চলছে দুনিয়াজুড়ে। নড়েচড়ে বসছেন অনেকেই। নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে কয়েকদিন গাড়ির তেল অযথা না পুড়িয়ে, বাজারে প্লাস্টিক ব্যাগ না জুটিয়ে চললে দায়িত্বটা ফুরোয় না। দরকার পড়ে আরও কিছুর। আন্দোলনটা রাস্তায় নামার পাশাপাশি নিজের মাথার মধ্যে প্রবাহিত হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটা বাঁচার উপযোগী দুনিয়া পাবে। প্রত্যেকের ভূমিকা আছে এখানে। সারা দুনিয়ায় বুদ্ধিমানরা একজোট হচ্ছেন। পলিসি ঠিক হচ্ছে। আইন বদলাচ্ছে। আমাদের দেশ এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। একদিকে যেমন ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশনের কাজ, অন্যদিকে অল্টারনেটিভ এনার্জিতে মাথা ঘামিয়ে ফসিল-ফুয়েল-এমিশনকে কমানোর চেষ্টা চলছে ব্যাপক হারে। অদূর ভবিষ্যতে এর সুফল দেখা যাবে এমন আশা করা যায়। ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই ব্যাপারে।

    একটু পিছিয়ে শুরু করি। এই কাজে আমি যে সামিল হয়েছি, তা বুঝতে আমার নিজেরই কিছুটা সময় লেগেছে। আমি একজন আলোকচিত্রী। বন্যপ্রাণ আমার বিষয়। দু’দশকের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীদের চেহারা, জীবন, বেঁচে থাকা নিয়েই আমার ছবির কাজ। বারাসাতের মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, মোটামুটি লেখাপড়া করেছি, শিক্ষক হব, পড়াব, এমন ভেবেছিলাম। এতে বাধা ছিল না কোনও। ভাল লাগত বনেবাদাড়ে, পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে। প্রকৃতিকে খুব নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেখতে। ঝুলে পড়লাম রক ক্লাইম্বিং, পরে ট্রেকিং, এইসব মজায়। ছবিও তুলতাম অল্প। একদিন দেখি, সেসব ছবির একটা চাহিদা রয়েছে। হয়তো স্রেফ বেড়ানোর ছবি নয়, তাই। ওই সামান্য রোজগারগুলো আমাকে উৎসাহিত করেছিল তা একেবারেই অস্বীকার করব না। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছিলাম যে, অন্য একটা দুনিয়া আমাকে টানছে। আমাদের দেশে জীবজন্তু-জঙ্গলের অভাব নেই। ওই বিষয়ে ভাল ছবি তুলে চলেছেন অনেকে। সে-ছবির একটা বাজারও রয়েছে। মুশকিল হল, এই লাইনে ‘ভাল ছবি’ তোলার হ্যাপা প্রচুর। গরু, হাঁস, মুরগি তো নয়। পৌঁছতে হবে, ঢুকতে হবে ঘাঁটিতে। অর্থাৎ ফরেস্টে। যা সরকারি সম্পত্তি। সুরক্ষিত অঞ্চল।

    চাই যথেষ্ট পড়াশোনা, জঙ্গল চেনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ঝট করে এসব করে ফেলা যায় না। ধীরে এগোলাম। বুঝতে পারছিলাম, ভাল লাগাটা ভালবাসায় পরিবর্তিত হচ্ছে। পাশাপাশি এটিও অনুভব করছিলাম, এই হতে চলেছে আমার জীবন। ফোটোগ্রাফিতে চোখটাই আসল, যন্ত্র নয়। ঠিক কথা। আমি যে-ধরনের ছবির জগতে ঢুকে পড়েছিলাম, সেখানে ওই কথার আক্ষরিক অনুবাদ করলে ধারণাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সাধারণের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ক্যামেরা ও লেন্স ছাড়া এ-কাজ অসম্ভব। আকাশছোঁয়া দাম এর। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান, ওই খরচ বহন করার সাংঘাতিক প্রারম্ভিক রিস্ক নিয়েছিলেন আমার বাড়ির লোক। 

    পরিস্থিতি গিয়ে দাঁড়াল বাঘের পিঠে চাপার মতো। নামার উপায় নেই। শুধুমাত্র যন্ত্র নয়, অকুস্থলে পৌঁছনো, স্পিসিসকে স্পট করা, এই পর্যন্ত অসম্ভব নয়। ছবি তোলার আসল মুশকিল হল, এরা কেউই সেজেগুজে পোজ দিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। যেখানে থাকে, যেমন টাইগার সাফারির সময়ে, সেখানে ব্যতিক্রমী ভাল ছবি পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়াল। সবার একই জায়গা থেকে তোলা, একই ছবি। রেয়ার, দারুণ ছবির জন্য অনুমতিহীন জায়গায় ঢুকে পড়ার প্রশ্ন উঠছে না। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, আমাকে নতুন ছবির রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। নতুন প্রাণী তো আর নেই। অবলুপ্তির মুখে দাঁড়ানো এনডেঞ্জার্ড স্পিসিস, যাদের ছবি মানুষ কম দেখেছে, সর্বোপরি যে-স্টাইলের ছবি জনগণের কাছে নতুন, তা করতে হবে আমাকে। এর মধ্যেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেল ফোটোগ্রাফি প্রযুক্তিতে। ফিল্মের বদলে ডিজিটালের মৌরসিপাট্টা শুরু হল। কিছুদিন চলে গেল ব্যাপারটা থিতু হতে। এক সময়ে ডিজিটাল ছবির মান, অর্থাৎ টোন, ডিটেল, রং, আলোছায়ার সমতা ছাপিয়ে গেল ফিল্মকে। ফিল্মের সনাতন সার্বভৌমত্বকে আঁকড়ে ধরে রইলেন অনেকে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি, যেমন খুব কম আলোয়, অতি দ্রুত, প্রচুর ছবি তোলার দরকার পড়লে ডিজিটাল প্রযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠল। আমার মতো আরও অনেকেই এই কাজ করছে। কড়া প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে গরুর গাড়ি নিয়ে রোম্যান্স বেশি দূর যেতে পারে না। ক্যামেরা লেন্সের আপগ্রেডেশনটা একদিনে করা সম্ভব হয়নি। নিজেকে সবসময় বুঝিয়েছি, যা রয়েছে, তা দিয়ে ছবিটা ‘উঠছে তো’! ধৈর্য ধরতেই হবে, হঠকারিতার জায়গা নেই। 

    বিভিন্ন ছবির প্রফেশনে যেভাবে ছবি তুলে রোজগার করতে হয়, এখানে তা নয়। স্টুডিওতে মানুষ আসেন ছবি তোলাতে। বিয়েতে নিয়ে যাওয়া হয় ফোটোগ্রাফারকে। ইন্ডাস্ট্রি যোগাযোগ করে অভিজ্ঞ লোককে, নিয়ে যায় তাদের কলকারখানায়। আমাদের কাজের ক্ষেত্রে, ‘চলুন তো, আমার বাগানে প্রচুর পাখি, এক-আধটা নেকড়েও বেরোতে পারে, ছবি তুলে দিন দেখি!’ এমন হয় না। প্রথম ভরসা পত্রিকা। তারপর প্রাণীতত্ত্ব বিষয়ক কাজের ডকুমেন্টেশনে সরকারি বা বেসরকারি অ্যাসাইনমেন্ট। প্রশ্ন হল, কাউকে ডাকা হবে কেন? ডাকা তখনই হবে, যখন তার একটা দুর্দান্ত পোর্টফোলিও থাকবে। ‘লেপার্ড আছে? আছে। ডলফিন হবে? হবে। গোখরো? পাবেন।’ কতদিন ধরে, কতখানি সময় নিয়ে, কতখানি খরচ করে একটা মানুষ এই কাজ করে যেতে পারে, যাতে তার অল-ইন-ওয়ান-স্টোর ওয়াইল্ডলাইফ শপিং মল-টা রেডি হয়ে যায়? এই কাজটিই কিন্তু করে যেতে হয়েছে আমাকে। এমন নয় যে আমি এমন দুর্লভ কিছুর ছবি তুলতে পেরেছি যা অন্যদের কাছে নেই! চেষ্টা করতাম অন্যভাবে তোলার, নতুন চোখে দেখানোর। নাটকীয় কম্পোজিশনে প্রেজেন্ট করা। অথেন্টিক ডিটেল-সহ। শৌখিন হবিইস্ট-দের মতো স্রেফ জিপ, জ্যাকেট, টুপির বাহারে জলে-জঙ্গলে কিছুক্ষণ ট্রিগার হ্যাপি খেলাধুলোর কালচারটা পছন্দ হত না। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে, দল, সংগঠন, মিটিং, মিছিলের স্রোতে কিছুতেই ভেসে গেলে চলবে না, এইটুকু নিশ্চিত জানতাম। জানা ছিল নিজের সীমাবদ্ধতা। প্রতিযোগিতায় এনার্জি নষ্ট না করে চেষ্টা করতাম তা অন্য জায়গায় ইনভেস্ট করতে। আধ ডোবা নয়, প্রায় ডোবা অবস্থায় একটা সোয়াম্প সুন্দরীর ছবি তুলতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় সারাটা দিন, একই অবস্থায় চোখটুকু তুলে রেখে। 

    জীবজন্তু, পাখি সাধারণত মানুষের কাছে আসে না। তাই টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। আমার মাথায় ঘুরত অন্য একটা বিষয়। নিজে আড়ালে থেকে আমার টার্গেটের খুব কাছে ক্যামেরাকে পৌঁছে দিতে পারলে কেমন হয়? এই কাজের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি আসতে শুরু করেছে বাজারে। নিজের মতো একটা দামড়া মানুষকে প্রাণীচক্ষুর আড়ালে রাখা প্রায় অসম্ভব। নিজের ক্যামেরাকে ক্যামোফ্লেজ করলে মন্দ হয় না। অর্থাৎ ক্যামেরার ফাঁদ পেতে জীবজন্তুর ছায়া ধরা। করতে গিয়ে দেখলাম কাজটা শক্ত। যা ঘটার তা মোটেই ঘটল না। যার ছবি তুলতে চাইছি তার প্রাত্যহিক জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট জানা দরকার অর্থাৎ স্টাডি চাই। সাফল্য আসতে সময় লাগল। রিমোট সিস্টেমে এই ছবি তোলা। টেলিফোটোর বদলে ওয়াইড-অ্যাঙ্গল লেন্স ব্যবহার করে ড্রামাটিক ফল পেলাম। নিশ্চিতভাবে যেখানে পাখি নামবেই, চারপেয়ে শ্বাপদ আসবেই, মুভমেন্ট নিশ্চিত, সেখানে চান্স নিতাম। কালেভদ্রে পেতাম ছবি এবং তা দারুণ ছবি। নেভার সিন বিফোর পার্সপেক্টিভ। এর সৌন্দর্য, চমক, ডিটেল সনাতন পদ্ধতিতে তোলা ছবির থেকে একেবারে আলাদা। যদিও সবসময় একই টেকনিক খাটবে এমন নয়। লাদাখের স্নো-লেপার্ডের সন্ধানে বেরিয়ে অনেক কাণ্ড ঘটেছিল। এই সেই অপূর্ব ইলিউসিভ প্রাণী যাকে খুঁজে বের করা, পাথরের রং টেক্সচারে মিশে থাকা অবস্থায় দেখতে পাওয়াটাই বিশাল অ্যাডভেঞ্চার। আবারও বলছি সৌন্দর্যের আকর্ষণ এড়ানো যায় না। শুকনো ডকুমেন্টেশনের পরিবর্তে স্টাইলিশ পিকটোরিয়ালিজম এই গোত্রের ছবিতে নতুন মাত্রার রক্ত সঞ্চার করে বলেই আমার বিশ্বাস। মনে রাখা দরকার, এই করতে গিয়ে অনেকে ছবিতে মাত্রাতিরিক্ত ডিজিটাল মেক-আপ দিয়ে সবার কাছে হাস্যস্পদ হয়েছেন। ওয়াইল্ডলাইফ ছবিতে সত্যের গণ্ডির এক মিলিমিটার বাইরে যাওয়া রীতিবিরুদ্ধ। একটা সময় ছিল, স্রেফ দারুণ ছবির ধান্দায় অনেকে মারাত্মক আইন বহির্ভূত, অমানবিক কাজ করেছেন। আমার ধারণা কড়া আইন বলবৎ হওয়ায় সেসব কমেছে। যাই হোক, কেন, কীভাবে ছবি তুলি তার সম্পর্কে কিছুটা বললাম। এবারে জানাব এই প্রয়োজনের বাইরে আমার নিজের পৃথিবীর কথা। 

    আমি অনুভব করছিলাম, প্রাণীজগতের আরও কাছে পৌঁছনো চাই। স্রেফ আলট্রা ক্লোজ-আপ ছবির জন্য নয়। আমার ইচ্ছে করত ওদের রান্নাঘর অবধি পৌঁছতে। শুনেছি, পড়েছি বহুবার। কিন্তু আমার সাবজেক্টরা কেউই আসলে আমাদের ক্ষতি করতে উৎসাহী নয়, অতএব অযথা বিরক্ত না হলে বা ভয় না পেলে, তাদের কাছে যেতে চাইলে ‘মাইন্ড করবে না’ এই বিশ্বাস আমার হয়েছিল। ধারণা আরও পোক্ত হয় আন্ডারওয়াটার ছবি তোলা শুরু করার পর। জলের তলার জীবন, চলন, যাবতীয় সব কিছুর সঙ্গে ডাঙ্গাবাজির আকাশ-পাতাল তফাত। এই ধরনের ছবি তোলার জন্য উন্নত প্রযুক্তির দরকার। হাতে এল সব কিছুই, একে-একে। ডুব মেরে দেখি মেরিন লাইফ এক অদ্ভুত স্বপ্নপুরী। সাউথ ইস্ট এশিয়া, সুন্দরবন, আন্দামান থেকে শুরু করে বরফ ঠান্ডা আর্কটিক, সর্বত্র আজব এক একটি স্বতন্ত্র কিংডম। মূল উদ্দেশ্য ছবি তোলা হলেও স্রেফ ডাইভিং এক্সপ্লোরেশনের এক্সপিরিয়েন্সটা অদ্ভুত। এত নিবিড়ভাবে প্রকৃতিকে আমি কম-ই পেয়েছি। সাম্প্রতিককালে জলের তলার ভয়ংকর প্রাণীদের, হাঙর, কুমিরদের, প্রায় টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে উপযোগী ছবি দেখে অনেকে শিহরিত হয়েছেন। এটুকু জানাই, নিজের সেফটি সর্বাগ্রে, যা আমি বরাবরই মেনে চলি। দ্বিতীয় বিষয়, আমি যার খুব কাছে পৌঁছে গেছি, আমি তার জন্য ভীতির কারণ না হলে সমস্যা হবে না। সময় লাগে, এই দুশ্চিন্তাহীন নির্ভরযোগ্যতা তৈরি করে নিতে হয়। আমি অনুভব করেছি, যে বিস্ময়, আগ্রহ নিয়ে আমি তাদের দেখছি, তারাও একই ভাবে আমাকে দেখে চলেছে। অথচ মানুষের কথা ধরুন। অচেনা লোক খুব কাছে এসে পড়লে আমরা অস্বস্তি বা আতঙ্কে ভুগতে শুরু করি। এর একটাই কারণ। বহু বছর ধরে মানুষ পরস্পরের কাছে অযথা শত্রু হয়ে উঠেছে। এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না আর। এক শতকের ইতিহাস দেখুন। স্রেফ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ লাগামহীন নরহত্যায় সামিল হয়েছে অজস্রবার। দরকার ছিল না কিন্তু। জীবজগতের দিকে তাকান। খাদ্যের প্রয়োজনটুকু বাদ দিলে ভায়োলেন্সের প্রমাণ পাবেন না। খোলা জায়গায় ভদ্র, সভ্য সহাবস্থান সবার। ‘মানব সভ্যতা’ কথাটা এদের পাশে প্রহসনসম। 

    স্পিসিসদের যথেষ্ট কাছে পৌঁছনো, তাদের সঙ্গে বিচিত্র ক্লোজ এনকাউন্টারের সঙ্গে আমার ভাবনার পরিসরটা অনেকখানি বেড়ে গেছে তা বুঝতে পারছিলাম। আসল ব্যাপার হল হ্যাবিট্যাট। অর্থাৎ বাসভূমি ও তার চরিত্র। আধা জলে, আধা আকাশে নিশ্বাস নেওয়া ম্যানগ্রোভ যাদের বাড়ি, তাদের সঙ্গে বাওবাবের ওপরের বাসিন্দাদের ফারাক অনেকখানি। ‘বায়ো ডাইভার্সিটি’ কথাটা অংশত হৃদয়ঙ্গম করলেই হাত-পা শিরশির করতে শুরু করে। বিপুলা এ-পৃথিবীর কিছুই জানি না। সেই কবে কোন মহাজাগতিক সংঘর্ষের এক টুকরো ঠান্ডা হয়ে, জলময় হয়ে, প্রাণ সঞ্চার করে পৃথিবী হয়ে উঠেছিল। কার প্ল্যানিং? কার ডিজাইন? এমনই ধরে নেওয়া ভাল কি, অজস্র অতি বুদ্ধিমান, রুচিশীল সত্তারা এই কাণ্ডটা করে গিয়েছিল? পৃথিবীর ইতিহাস লেখার অনেক আগেই, অ্যালগিরা কি এদের দেখেছিল? না কি মহাকাণ্ড ঘটেছিল সবার অগোচরে, নিঃশব্দে? প্রত্যেক প্রজাপতির ডানার নকশা, কালার কোড আলাদা। মাইক্রোস্কোপের তলায় আমরা এখনও খুঁজছি জীবনবিজ্ঞানের গোড়ার কথা। পাচ্ছি কিছু। কম্পিউটার প্রযুক্তি সাহায্য করছে মানুষের ব্রেনের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে আরও গভীরে নিয়ে যেতে। মনুষ্যপূর্ব পৃথিবীতে সবার চরিত্র, প্রয়োজন তার বসতভূমির সঙ্গে নিখুঁতভাবে সাজানো ছিল। শান্তি ছিল সবার প্রাণে। মানুষের চরিত্রই হল প্রয়োজন সৃষ্টি করা। তা মেটাতে প্রাকৃতিক সম্পদকে আহরণ করা। ধরে নেওয়া যাক এই অধিকার তার আছে। এর পরিমিতি সম্পর্কে কোথাও কিছু বলা ছিল না। অথচ আজ এই নিয়ে কথা হচ্ছে, শোরগোল হচ্ছে, অশান্তি হচ্ছে। মাত্রা ছাড়ানো নিষ্কাশন, ডিপ টিউব ওয়েলের জল থেকে শুরু করে ফসিল-ফুয়েল, তার অতি ব্যবহারের কুফল পাচ্ছি আমরা। প্রতিনিয়ত। তুমুল এক নিম্নগামী গতিতে গড়িয়ে চলা প্রলয়ের দ্রুত বর্ধমান সম্ভাবনাগুলোকে থামাতে পারছি না। এরপরেই এসে যাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রসঙ্গ। আমি সেখানে ঢুকছি না। ওটা আমার বিষয় নয়।

    আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকৃতি, পরিবেশ, সুষ্ঠ জীবনের ব্যালান্স ফিরে পেতে দরকার একটি সহজ বোধ ও  চেতনার। যা আছেই, কিন্তু জাগ্রত হয়ে উঠছে না বিভিন্ন কারণে। চালু পলিটিক্স বা রিলিজিওনের নিদান আজ আর বিশেষ কাজে লাগার কথা নয়। নিজের ভাঙাচোরা আইডেন্টিটি, লক্ষহীন টার্গেটের দিকে উন্মত্তের মতো দৌড়োতে  থাকা, অধৈর্য, অসহিষ্ণু বিশাল সংখ্যক মানুষের মন ঘোরানো প্রায় অসম্ভব। কে বোঝাবে? কেনই-বা কেউ বুঝতে চাইবে যে প্রকৃতি পরিবেশকে বুঝে বা না বুঝে ধ্বংস করাটা মূর্খামি? সামান্য কয়েকটা লাল-নীল পাখি চিরতরে হারিয়ে গেলে তা আমাদের ধ্বংসের সূচনা মাত্র। কীভাবেই বা বুঝবে? একটাই রাস্তা, কম্প্যাশন। পরস্পরের প্রতি। নিজেদের চারপাশের প্রতি। সামান্য অবসরে চারপাশে দেখলেই ব্যাপারটা দিব্যি বুঝতে পারা যায়। আন্দাজ করতে পারি, আপনারা যারা এই লেখা পড়ছেন, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন যে, প্রলয়ের মধ্যেও পুরনো পাতা ফেলে দিয়ে নতুন সাজে সেজে প্রকৃতি নিজের বসন্তোৎসব শুরু করে দিয়েছে। নেহাত কেটে, উপড়ে ফেলে না দিলে এই নিঃশব্দ আনন্দটা এরা করে চলেছে, চলবেও, অনন্তকাল ধরে। মানুষ ছাড়া সব প্রাণীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখে আমরা এক মুহূর্তের জন্য থামলেও থামতে পারি। ভাবতে পারি এর পর কী করব। বা কোথায় থামব। জীবজন্তু, বনবাদাড়ে ছবির চাষ করা লোকের এই আবেদন কেন শুনবেন আপনি? তাহলে একটা ঘটনা বলি। 

    খবর পেয়ে গিয়েছিলাম একাধিকবার। স্রেফ এক ধরনের পাখির সন্ধানে। বড়সড়, মাটিতে চরা পাখি। দুর্লভ বললে কম বলা হয়। অপূর্ব রঙিন শরীর তার। থাকে হিমালয়ের অন্দরমহলে, রোডোডেন্ড্রনের জঙ্গলে। আমি দেখেছি তাদের, বহু দূর থেকে। ছবি তুলতে পারিনি। এদের নাম স্যাতির ট্র্যাগোপ্যান। আর আছে মোনাল। মানুষের ধারেকাছে আসে না। ২০১৩ সালে প্রথমবার এদের ছবি তুলতে পেরেছিলাম বহু কসরত করে। আর ২০১৯ সালে আমার চোখের সামনে যা ঘটেছিল, তা আমার বুদ্ধির বাইরে। ভুটানের পুনাখা থেকে কিছু দূরে এক মোনাস্ট্রির সামনে দেখি তারা নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পোষা মুরগির মতো। স্থানীয় মানুষ, লামারা তাদের ভয়ের কারণ নন, কেউ-ই নন। আমিও নই। তারা নিশ্চিন্তে মিশে গেছে স্বভাবজাত দয়াপ্রবণ, শান্তিকামী, মেইনস্ট্রিম জীবনের হাঙ্গামার ঊর্ধ্বে থাকা মানুষের সঙ্গে। স্রেফ এই দৃশ্য দেখে আমার একটি সহজ কথা মনে হয়েছিল। এমন অকল্পনীয় সুন্দর, শান্তির সত্যিটা দেখতে পেলে যে-কোনও মানুষ প্রভাবিত হবেন। ডেকে এনে, মাইক বাজিয়ে বিশেষ কিছু বোঝানো, কড়া আইনকানুন, কিছুর দরকার পড়বে না। পরিবেশ বন্ধুত্বের হৃদয়গ্রাহী আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে আমাকে অংশীদার করতে চাইছেন অনেকে। আমিও শিখে চলেছি ক্রমাগত। একজন ছবি করিয়ে হিসেবে আমার ভাবতে ভাল লাগে যে, সারা দুনিয়া আমার বা আমাদের মতো কর্মীদের তোলা ছবি দেখছে। দেখে, এখনও সুন্দর এই পৃথিবী সম্পর্কে তাদের ভালবাসা কিছুটা ফিরে এলে আমরা সবাই হয়ে উঠব ঈশ্বর। আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।

    লেখক পরিচয় : বন্যপ্রাণ, পরিবেশ ও মানবজীবন চিত্রায়নের দুনিয়ায় ধৃতিমান মুখার্জি সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপ্রাপ্ত এক বিরল বঙ্গসন্তান। তিনি ভালবেসে চলেছেন নিজের কাজ ও চারপাশের জীবন্ত দুনিয়াকে। বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে হাজির হয়েছেন বিচিত্র জল-স্থল প্রান্তে। প্রকৃতি রূপ উজাড় করে সাড়া দিয়েছে তাঁর অনুসন্ধিৎসু লেন্সের সামনে। আমরা দেখে চলেছি অপরূপ পৃথিবীর বুকে তাঁর তোলা স্বপ্নসম ছবি। স্বপ্ন হলেও যা সত্যি। এই সৌন্দর্য, সচেতনতা একদিন মানুষকে সুস্থতার দিশা দেখাবে এই বিশ্বাসে ধৃতিমান চষে ফেলছেন এক গোলার্ধ থেকে অন্য।

    ছবি : ধৃতিমান মুখার্জি  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook