ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢপবাজ : পর্ব ১


    অনুপম রায় (March 10, 2023)
     

    হাতের মুঠোয়

    আজকে হাতে-নাতে ধরেছে। কবরের পাশের গলি দিয়ে ফুল স্পিডে হেঁটে যাচ্ছিল বাবুদা। ওঁত পেতে বসেছিল সৌমিত্র। গত সাতদিন ধরে পিছু নিয়েছে সে কিন্তু শেষে গিয়ে ঠিক এমন একটা কিছু ঘটেছে যে কেস হাতের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্যে গত তিনদিন তো নিজের বাড়িতেই ফেরেনি হতচ্ছাড়া। প্রতিদিন অন্য-অন্য বাড়ি। কোনটা যে কার, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি সৌমিত্র। সারা জীবন জেনে এসেছে যে টালিগঞ্জ মেট্রোর কাছেই কোথাও বাবুদার বাড়ি, তবে কেউই ঠিক বলতে পারে না কোথায়। আসলে কেউ চেনেই না, বলবে কী করে? মেট্রো থেকে নেমে সাঁ-সাঁ করে হেঁটে বাঙ্গুর হাসপাতালের দিকে কোথায় মিলিয়ে যেত। এতদিন মিশছে বাবুদার সঙ্গে, একদিনের জন্যেও কাউকে কোনওদিন নিজের বাড়ি নিয়ে যায়নি লোকটা।

    তবে আজকের দিনটা স্পেশাল। আজকে সে ঝোপে লুকিয়ে দেখছে, বাবুদা পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা বের করল। এইবার গ্রিলের গেটের তালা খুলে এই টানল। তারপর বড় দরজাটা আনলক করে ঠেলতে যাবে, এমন সময়ে ছুটে এসে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সৌমিত্র, ‘বাবুদা!’

    মাঝরাতে অতর্কিতে এরকম আলিঙ্গন পেয়ে চমকে ওঠা স্বাভাবিক কিন্তু বাবুদা একদম কুল, ‘ও সোমু, কী ব্যাপার এত রাতে?’

    সৌমিত্র : চলো ভেতরে যাই?

    বাবুদা : হ্যাঁ, আয়। দাঁড়া আলোগুলো জ্বালি।

    সৌমিত্র বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, সে শহরের প্রথম বাঙালি যে বাবুদার ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছে। অনেকটা মুন ল্যান্ডিং-এর মুহূর্তের মতো। দু-তিন পা এগিয়ে নিজেকে নিল আর্মস্ট্রং ভাবতে শুরুর করার আগেই বাবুদার গলার আওয়াজে বাস্তবে ফেরে।

    বাবুদা : আরাম করে বস। মিউজিক ম্যাগের নতুন এডিশনটা পড়, আমি দু-মিনিটে আসছি।

    সৌমিত্র : না বাবুদা। সেটা হচ্ছে না। তুমি কোথাও যাবে না। তুমিও বসো।

    বাবুদা : আরে না। একটু বাথরুম যেতে হবে।

    সৌমিত্র : চলো তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

    বাবুদা : এই কী সব বলছিস, ধ্যাৎ!

    বলেই নিজের বিশ্রী দাড়ির মধ্যে থেকে ফ্যাক-ফ্যাক করে টিপিক্যাল হাসিটা হাসে।

    বাবুদা : আমাকে পাঁচ মিনিট দে সোনা, এখুনি আসছি।

    সৌমিত্র আজকে অন্য মুডে। সে ছাড়ে না বাবুদাকে। সঙ্গে-সঙ্গে টয়লেটে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে, কুল-কুল করে কমোডে ঝরে পড়া বাবুদার হিসির আওয়াজ শোনে। এক সময়ে তা শেষ হয় কিন্তু বাবুদা বেরোয় না।

    সৌমিত্র : বাবুদা? ও বাবুদা?

    দুম-দুম করে দরজায় ধাক্কা মারে। বাবুদা ভেতর থকে জানান দেয়, সে কোথাও যায়নি, ভেতরেই আছে। আর একটু সময় লাগবে। বাইরে যেখানে সৌমিত্র দাঁড়িয়ে সেখানে ফ্যান নেই, আলোও নেই। চারিদিকে অস্বাভাবিক ধুলো। একজন সঙ্গীতকারের বাড়ি বলে মনে হয় না। একটা বাদ্যযন্ত্রও ওর চোখে পড়েনি এখনও। এত নোংরার মধ্যে মানুষ থাকে কী করে? গলগল করে ঘামতে-ঘামতে মাঝে মাঝেই দরজায় টোকা দিতে থাকে। শেষমেশ বাবুদা বেরোয়।

    বাবুদা : উফ! কী হয়েছে কী তোর? এরকম করছিস কেন?

    সৌমিত্র : তুমি জানো না? ন্যাকা সাজছ?

    বাবুদা : চল চল, ওই ঘরে চল। তুই টয়লেট যাবি?

    সৌমিত্র : আমি কোথাও যাব না, তুমিও কোথাও যাবে না। চলো।

    দুজনে বাইরের ঘরে সোফায় গিয়ে বসে। বাবুদা একটা হলুদ প্লাস্টিকের বোতল (যার এক কালে অন্য রং ছিল নিশ্চয়) থেকে গলায় ঢেলে জল খায়। সারা গায়ে ফেলে।

    সৌমিত্র : আমি রোহিতকে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছি, ও এসে পড়বে একটু বাদেই। আজকে আমি গিটারটা না নিয়ে বাড়ি ফিরব না।

    বাবুদা : ওহ্‌! ওই গিটারটা? (আবার সেই ফ্যাকফ্যাকে হাসি)

    সৌমিত্র : হাসির কিছু হয়নি বাবুদা, গিটার আজকে তুমি আমাকে ফেরত দেবে।

    বাবুদা : কেন, ওই গিটার যে তোকে সেদিন সাকিব দেখাল ওটা ভাল লাগল না?

    সৌমিত্র : ওটা গিটার? একটা ভাঙা কবেকার থার্ড ক্লাস গিটার দিয়ে গুপি দিচ্ছ?

    বাবুদা : তোদের নিয়ে হয়েছে জ্বালা। তোরা কোনও খবর রাখিস না। ওটার ইতিহাস জানিস?

    সৌমিত্র : আমি ইতিহাস জানতে চাই না, তুমি আমার গিটার আজকে ফেরত দেবে।

    বাবুদা : বিটল্‌স একবার ইন্ডিয়া এসেছিল জানিস তো না কি বলবি তাও জানিস না?

    সৌমিত্র : হ্যাঁ হৃষিকেশ না কোথায় একটা এসেছিল আশ্রমে।

    বাবুদা : কারেক্ট মাই বয়! ওটা জর্জ হ্যারিসনের গিটার ছিল।

    বাবুদার দিকে তাকালে, এক মুখ দাড়ি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না তেমন। রাত বারোটা বাজছে। ধুলোয় ঢাকা ঘরে, বাবুদার মুখোমুখি দাঁতে দাঁত চিপে বসে আছে দুই তরুণ। একটা এস্পার-ওস্পার মনে হচ্ছে হবেই।

    সৌমিত্র : যত বাজে কথা। ওটা একদম লোকাল তৈরি মাল। হ্যারিসন নাকি ওই ফালতু গিটারটা বাজাবে!

    বাবুদা : আরে গাধা। ওরা কি বয়ে-বয়ে গিটার নিয়ে আসবে পাহাড়ে? ওরা লোকাল জিনিসই খুঁজছিল।

    সৌমিত্র : মদ খাও না বলেই তো জানতাম, গাঁজা ধরেছ না কি? তুমি পাও কোত্থেকে এই ঢপের গল্পগুলো?

    বাবুদা : তোরা তো জানিসই আমি পঞ্চমদার সঙ্গে কতদিন কাজ করেছি!

    সৌমিত্র : এই গিটারের ঢপের ইতিহাসে এবার কি আর.ডি.বর্মণও ঢুকছেন?

    বাবুদা : তোরা বড্ড স্কেপ্টিক্যাল হয়ে গেছিস জানিস! ভাল মিউজিক করার জন্য কিন্তু ফেইথ মানে বিশ্বাস রাখাটা খুব প্রয়োজন। ধর তুই সা-টা ধরে আছিস। চোখটা বন্ধ করে রাখ। মন চঞ্চল। সে চাইছে তুই সা থেকে সরে যাবি। যা! যা! কিন্তু তোর ফেইথ তোকে রাখবে। তুই সা-এই থাকবি। থাকতেই হবে তোকে। কিন্তু যদি তোর সেই বিশ্বাস, সেই কনভিকশন-টাই না থাকে, থাকবি কী করে?

    সৌমিত্র : এই প্লিজ, আর পারছি না। তুমি আমার গিটারটার কী করেছ? 

    বাবুদা : শোন, পঞ্চমদা পরে কয়েক লক্ষ টাকায় ওই হ্যারিসনের বাজানো গিটারটা কেনে।

    সৌমিত্র : আর তুমি বাজাতে না কি তারপর ওই গিটারটা ওর সব রেকর্ডিং-এ?

    বাবুদা : সে-সৌভাগ্য আমার একবার মাত্র হয়েছিল। ওটা উনি কাউকে বাজাতে দিতেন না।

    সৌমিত্র : আমরা তো জানতাম তুমি আর.ডি.বর্মণের কয়েকটা গানে ঝুমঝুমি বাজিয়েছ। গিটারটা আবার কবে বাজালে?

    বাবুদা : তোদের নিয়ে হল এই প্রবলেম। এই বাঙালি জাতটার প্রবলেম। নিজেরা যদি নিজেদের সম্মান না করতে পারি, তাহলে কী করে অন্য লোকে আমাদের করবে বল? যা এখন বাড়ি যা। আমার অনেক কাজ আছে।

    এবার বেল বাজে। বাবুদা উঠতে যায়, সৌমিত্র বাধা দেয়। নিজে গিয়ে দরজা খুলে রোহিতকে ঢোকায়। বাবুদা মেরে-কেটে পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চি। পাঞ্জাবি, চশমা, জুতো সব মিলিয়ে ওজন খুব বেশি হলেও ষাট। বয়সও হয়েছে। বাবুদার দিকে তাকালে, এক মুখ দাড়ি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না তেমন। রাত বারোটা বাজছে। ধুলোয় ঢাকা ঘরে, বাবুদার মুখোমুখি দাঁতে দাঁত চিপে বসে আছে দুই তরুণ। একটা এস্পার-ওস্পার মনে হচ্ছে হবেই।

    এন্টার দ্য ড্রাগন

    দশ-বারো বছর আগের কথা। তখন বাবুদাকে যে-কোনও সিনেমার প্রিমিয়ারে, মিউজিক আড্ডায় দেখা যেত। তার আগে বম্বেতে নাকি দীর্ঘদিন কাজ করেছে বিজ্ঞাপন জগতে। সবাই বাবুদার স্পিরিটটাকে খুব পছন্দ করত। আড্ডা জমিয়ে দিতে পারত। মিছিলে স্লোগান দিতে পারত। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, কখনও জার্মান পরিচালকের সঙ্গে ভাঙা জার্মানে আবার কখনও লাতিন আমেরিকান মহিলার সঙ্গে আধা স্প্যানিশে, এক মুখ দেড়েল হাসি নিয়ে বাবুদাকে নন্দনচত্বরে ঠিক পাওয়া যেত। মিডিয়ার পার্টিতে, আর্ট ফিল্ম ডিরেক্টরের হাউস পার্টিতে, আন্ডারগ্রাউন্ড মেটাল ব্যান্ড ফেস্টে— বাবুদা সব জায়গায়। একবার শোনা গেল বাবুদা ওয়াং কার ওয়াই-এর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করবে। খবরের কাগজে বেরিয়ে পর্যন্ত গেল। তবে সে-ছবি আজ পর্যন্ত কেউ দেখতে পায়নি। ওয়াং কার ওয়াই নিজে জানত কি না সেটা নিয়েও মানুষের সন্দেহ রয়ে গেছে।

    সৌমিত্র-রোহিতদের তখন নতুন ব্যান্ড। কলেজে-কলেজে শো করে বেড়ায়। বাবুদা ওদের কাছে একটা বড় ইন্সপিরেশন। সব সময়ে উৎসাহ দেয়, মাঝে মাঝে কনসার্টে আসে, চিৎকার করে, কতরকম দেশ-বিদেশের গল্প বলে। কখনও রাশিয়ায় স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা রেকর্ড করার গল্প, কখনও আলি আকবর খাঁ-এর সরোদের তার পরিয়ে দেওয়ার গল্প। ওদের কাছে বাবুদা তখন সঙ্গীতের এক অন্য অধ্যায়। একদিন তো ওদের বানানো ‘শঙ্খচিল’ গানটা শুনতে-শুনতে কেঁদেই ফেলল। সে কী কান্না স্টুডিওতে! রেকর্ডিং করা মাথায় উঠল। ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বাবুদা শুধু বলছে, ‘অন্তরা থেকে আরেকবার চালা।’ ওরা অন্তরা থেকে চালায়। বাবুদা মাথা ধরে মাটিতে বসে পড়ে। হাউ হাউ করে কাঁদে। তারপর আবার চালাতে বলে। আবার কাঁদে। কাঁদতে-কাঁদতে বলতে থাকে, ‘তোরা জানিস না কী গান বানিয়েছিস তোরা!’ থেকে-থেকে কেঁপে উঠছিল বাবুদা। সৌমিত্র-রোহিত কলার তুলে বাড়ি ফেরে। বাবুদা এভাবে ভাল বলেছে মানে লাইফে কিছু একটা হচ্ছে। অন্যদিকে বাবুদার লাইফ ওদের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে। স্যাট-স্যাট করে কাজ ধরে ফেলছে বাবুদা। ওদের মেরে-কেটে তিন বছরে একটা সেমি হিট গান আর বাবুদা ওই তিন বছরে দশটা ছবি প্লাস কুড়িটা বিজ্ঞাপনের কাজ নামিয়ে ফেলে। ওই দশটা ছবির একটা গানও কারো মনে থাকেনি কিন্তু ব্যস্ততা বাবুদার কমে না। বরং বাড়তেই থাকে।

    এভাবে মাসখানেক কাটে। শোনা গেছে বাবুদা শহরে ফিরেছে কিন্তু কিছুতেই দেখা হচ্ছে না। যে-আড্ডাতেই বাবুদার থাকার কথা, সৌমিত্র ঢোকার আগেই নাকি বাবুদা বেরিয়ে গেছে! তবে একদিন গোলপার্কের মোড়ে বাবুদাকে দেখা গেল। হন্তদন্ত হয়ে ময়লা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে কোথায় চলেছে।

    যাই হোক, দু-বছর আগে সৌমিত্ররা কেরিয়ারে প্রথমবার আমেরিকার বাঙালিদের কয়েকটি শহরে গান শোনানোর ডাক পায়। সেখানে গিয়ে প্রায় দু-লক্ষ টাকার একটি দামি মার্টিন কোম্পানির গিটার কিনে দেশে ফেরে। শহরের সঙ্গীতমহলে হইহই পড়ে যায়। অনেক মিউজিশিয়ান দেখতে আসে। বাবুদাও একদিন আসে ওর বাড়ি। টুং টাং করে কীসব বাজায়। তারপর খুব গম্ভীরভাবে বলে, ‘তুই গিটারটা ভাল কিনেছিস কিন্তু তারগুলো ঠিক জমছে না। একটা টেক্সাস সাউন্ড আমি এক্সপেক্ট করছি কিন্তু তারগুলো না পাল্টালে সেটা পাওয়া যাবে না।’

    সৌমিত্র : এখন চলছে চলুক না। পরে…      

    বাবুদা : না সোনা, না! পরে হলে হবে না। তারের টেনশনে পুরো গিটারের বডি বেঁকে যাবে। এখুনি পাল্টাতে হবে।

    সৌমিত্র : কী তার খুঁজছ তুমি?

    বাবুদা : টেক্সাস গোল্ড।

    সৌমিত্র : সেটা আবার কী?

    বাবুদা : আমার উপর ছেড়ে দে। আমি আজকে তোর থেকে এই গিটারটা নিলাম। সন্ধেবেলা একটা রেকর্ডিং আছে। তার পাল্টে কাল সকালে তোর বাড়ি দিয়ে যাব।

    সৌমিত্র : এই না, মানে তোমার কি আজকেই লাগবে?

    বাবুদা : আহ্‌, তোরা না! আজকে শিবু আসবে তো বাজাতে। রেকর্ড করেই তোকে ইমেল করে দেব। কাউকে পাঠাবি না কিন্তু। শুধু তোর শোনার জন্যই পাঠাব। খালি টোনটা শুনবি। পুরো বিদেশ। আ ভেরি গুড ইনভেস্টমেন্ট! সারা জীবনের সঙ্গী।

    বিরিয়ানি হাউস

    এরপর? এরপর বাবুদা হাওয়া। প্রায় এক-দু’সপ্তাহ সাড়াশব্দ নেই। ফোন ধরছে না। স্টুডিওতে খোঁজ করলে কেউ বলতে পারছে না। যে-মানুষটাকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সব জায়গায় দেখা যেত, সে গেল কোথায়? কিছুদিন বাদে সৌমিত্র খবর পেল, বাবুদা বর্ধমান গেছে। বাবুদার মায়ের খুব শরীর খারাপ। নিজের উপর খুব রাগ হল সৌমিত্রর। ছি ছি। একজন মানুষের বিপদ হয়েছে আর সে তাকে বৃথা সন্দেহ করে চলেছে।

    এভাবে মাসখানেক কাটে। শোনা গেছে বাবুদা শহরে ফিরেছে কিন্তু কিছুতেই দেখা হচ্ছে না। যে-আড্ডাতেই বাবুদার থাকার কথা, সৌমিত্র ঢোকার আগেই নাকি বাবুদা বেরিয়ে গেছে! তবে একদিন গোলপার্কের মোড়ে বাবুদাকে দেখা গেল। হন্তদন্ত হয়ে ময়লা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে কোথায় চলেছে।

    সৌমিত্র : ও বাবুদা! ও বাবুদা!

    বাবুদার চোখে শিশুদের উচ্ছ্বাস, ‘আরে সোমু! তুই এখানে!’

    সৌমিত্র : আরে তোমাকে আমি কতদিন ধরে খুঁজছি!

    বাবুদা : কেন রে? খুঁজছিস কেন? কোনও কম্পোজিশনে আটকে গেছিস না কি?

    সৌমিত্র : আরে না রে বাবা! আমার গিটারটা!

    বাবুদা : গিটার?

    সৌমিত্র : বাহ্‌ রে! আমার মার্টিন গিটারটা! তার পাল্টাবে বলে নিয়ে গেলে!

    বাবুদার সেই হাসি : আরে গিটার! দেখো কাণ্ড! আসলে এত কিছুর মধ্যে মাথা থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছিল। তুই বিরিয়ানি হাউস চিনিস?

    সৌমিত্র : ওই নতুন দোকানটা? যাদবপুরে?

    বাবুদা : ইয়েস মাই বয়। আমার রেস্টুরেন্ট।

    সৌমিত্র : তুমি রেস্টুরেন্ট খুলে ফেললে এর মধ্যে?

    বাবুদা : আরে এটা আমার অনেকদিনের প্যাশন। ফাইনালি হল। নিউজ দেখিসনি? বেরিয়েছিল তো!

    সৌমিত্র : রাইট! তোমার ছবি বেরিয়েছিল তো কিছুদিন আগেই!

    বাবুদা : সামনের সপ্তাহে সানডে রাতে তাহলে তোর ইনভিটেশন রইল। ওটার দোতলায় একটা কোজি স্পেস আছে। রাতে ওখানে বিরিয়ানি খাবি আর তারপর আমরা একটু গানবাজনা করব।

    সৌমিত্র : কিন্তু গিটারটা?

    বাবুদা : আরে হাঁদা ছেলে, ওখানেই তো রাখা আছে। এখন আমাকে আর আটকাস না সোনা। একটা মিটিং আছে। চলি রে।

    এই বলে বাবুদা গুচ্ছের মানুষের মধ্যে মিলিয়ে যায়। সৌমিত্র মনে অল্প আশা নিয়ে বাড়ি ফেরে। দিন গোনে, কবে রবিবার আসবে। রবিবার যেদিন আসার, সেদিনই এল। সৌমিত্র সময়মতো পৌঁছে গেল বিরিয়ানি হাউসে। বাবুদা নেই। ফোন করল ওখান থেকেই। বাবুদা ধরল। ধরে বলল, ওখানে মনোজের সঙ্গে কথা বলতে। সৌমিত্র মনোজকে জানায় যে সে বাবুদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

    মনোজ : বাবুদা আসবে আজ?

    সৌমিত্র : হ্যাঁ, তাই তো বলেছেন।

    মনোজ : ও চিড়িয়া আসলে, আমাকেও একটু কথা বলতে হবে…

    সৌমিত্র : দোকানের মালিক সম্বন্ধে এইরকম বলা কি আপনার উচিত?

    মনোজ : লে! উনি আপনাকেও বলেছেন মালিক?

    সৌমিত্র : উনি মালিক নন?

    এরপর সৌমিত্র জানতে পারে দোকানের মালিক মিস্টার বাগারিয়া। দোকানের ওপেনিং-এর দিন কোন এক সেলেব্রিটির সঙ্গে এসেছিল বাবুদা। মিস্টার বাগারিয়াকেও কোন এক সূত্রে নাকি চিনত বাবুদা! পাঁচ প্যাকেট বিরিয়ানি প্যাক করায়। পরদিন সেই সেলেব্রিটির সঙ্গে বাবুদার ছবিও পেপারে বেরোয়। তারপর থেকে বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে আসে মাঝে মাঝে, নিজের দোকান বলে ফ্রি-তে খায়, গেস্টকেও খাওয়ায়। কর্মচারীরা টাকা চাইলে বলে, বাগারিয়ার সঙ্গে বুঝে নেবে। ওরা যেন এসবের মধ্যে না ঢোকে। বাগারিয়া ক-দিনের মধ্যেই জানতে পারে। প্রথম ক-দিন হালকা সেলেব বলে ফ্রি চলেছে কিন্তু সারা জীবন তো চলতে পারে না! কর্মচারীরা ধমক খায় বাগারিয়ার থেকে। ফ্রি-তে খাওয়া বন্ধ করতে বলে। তার মধ্যে বাবুদা আর একটা কাজ করেছে। সেদিন দোকান থেকে একটা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে চলে গেছে। বলেছে ফেরত দিয়ে যাবে কিন্তু এখন দশদিন হয়ে গেল খবর নেই। এরপর সৌমিত্র ওপরের ঘরের কথা জিজ্ঞেস করে। মনোজ সাফ জানায়, ওপরে কোনও ঘর নেই। রেস্টুরেন্ট শুধু গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সৌমিত্র তাও দমবার পাত্র নয়, পাক্কা এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে। তারপর যখন বাবুদার ফোন সুইচড অফ হয়ে যায়, তখন খালি পেটে এক গ্লাস জল খেয়ে, ভেজা ন্যাতার মতো মন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook