ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিভাজন, বৈষম্য আর একটি হাইফেন


    সুস্নাত চৌধুরী (March 4, 2023)
     

    আমরা-ওরা’ কথাটি বঙ্গ-রাজনীতিতে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছিল প্রায় দেড় দশক আগে। এখনও সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে প্রায়শই এই শব্দদ্বয়ের দেখা মেলে, তবে তারা থাকে উদ্ধৃতিচিহ্নের ঘেরাটোপে— বয়ে বেড়ায় অতীতের রেফারেন্স। সময়ের সঙ্গে এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়েছে কি না, সে-ব্যাপারে রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলতে পারবেন; কিন্তু মুছে যে যায়নি, তা বেশ বুঝতে পারা যায়। কেবল কালক্রমে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ তাদের অবস্থান বদলে নিয়েছে। শুধু তো রাজনীতি নয়, সমাজের নানা ক্ষেত্রেই এই ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন বর্তমান। সবসময় যে তাদের অবস্থান বদলায়, এমন নয়। কেউ ‘ওরা’ হয়েই রয়ে যায় আমৃত্যু, কেউ-বা আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ‘ওরা’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে উঠার সিঁড়িভাঙা অঙ্ক মেলাতে। আর এই বিভাজন থেকে জন্ম নেয় বৈষম্য। তবু সেসব বৈষম্য আর বিভাজনের মাঝেই থাকে এক প্রায়-অদৃশ্য হাইফেন, যে চায় ‘আমরা’ আর ‘ওরা’-কে জুড়ে দিতে, সমাজের মূল থেকে যাবতীয় ভেদ-বিভেদ দূর করতে।

    এমনই এক হাইফেন পয়লা মার্চ তারিখটি। ‘জিরো ডিসক্রিমিনেশন ডে’। সব বৈষম্য মুছে, সব বিভেদ ভুলে মানবতার সপক্ষে একজোট হওয়ার দিন। এই উদ্‌যাপনের শুরু অবশ্য ওই রাজনীতির ‘আমরা-ওরা’-র চেয়েও নিকৃষ্টতর, সমাজের নির্দিষ্ট কিছু বৈষম্যের দগদগে কালো দাগ অপসারণের উদ্দেশ্যে; ক্রমে তা আরও ব্যাপ্তি লাভ করে। ২০১৪ সাল থেকে দিনটি পালন করা শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। ওই বছরই ২৭ ফেব্রুয়ারি UNAIDS বা রাষ্ট্রপুঞ্জের এইচআইভি এবং এডস বিষয়ক কার্যক্রমের তরফে এক সুবিশাল আয়োজন করা হয় চিনের বেজিং-এ। সেই শুরু। তারপর থেকে বিশ্বের বিবিধ প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দিনটি পালন করে আসছে। নানা বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাইছে ভাজ্য-ভাজক-ভাগফলের এই পৃথিবীতে। আর নিজের উপস্থিতি আরও জোরদার করে এক অনিবার্য ভাগশেষ হয়ে উঠতে চাইছে #zerodiscriminationday। যাকে আর ভাঙা যায় না। সামাজিক মাধ্যমে খুঁজে দেখলে এই হ্যাশট্যাগ খচিত শব্দবন্ধ তামাম দুনিয়াজুড়ে ঘটে চলা সেসব ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কিছু নিদর্শন তুলে ধরতে পারে।

    বর্ণের বিভাজন, ধর্মীয় বিভেদ, জাতপাতের তারতম্য কিংবা লিঙ্গবৈষম্য— এসবের বিরুদ্ধে যে আজ সোচ্চার হয়ে উঠছেন বহু মানুষ, তা এই সময়ের শুভ লক্ষণ। জনসাধারণের মধ্যে ক্রমে সচেতনতা বাড়ছে, এ অতিশয় আশার কথা। এই বছর ‘জিরো ডিসক্রিমিনেশন ডে’-র থিম নির্ধারিত হয়— ‘সেভ লাইভস: ডিক্রিমিনালাইজ’। এইচআইভি নিয়ে যাঁরা ক্রমাগত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন, যাঁদের সংক্রমণের হার খুব বেশি— এর মধ্যে সমকামী, রূপান্তরকামী, যৌনকর্মী, এমনকী মাদকাসক্ত কিংবা জেলবন্দিরাও পড়তে পারেন— এঁদের অপরাধী হিসেবে দাগিয়ে না দিয়ে, আইনের ফাঁস আলগা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই মূল লক্ষ্য। এই প্রস্তাবে প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার সমান অধিকারের কথা যেমন আছে, তেমনই সারা বিশ্বকে এইচআইভি-র মতো মারণ রোগের হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার প্রয়াসও রয়েছে। আমাদের দেশেও আজ অনেক মানুষ এই প্রয়াসে শামিল।

    সমাজের নানা ক্ষেত্রেই এই ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন বর্তমান। সবসময় যে তাদের অবস্থান বদলায়, এমন নয়। কেউ ‘ওরা’ হয়েই রয়ে যায় আমৃত্যু, কেউ-বা আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ‘ওরা’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে উঠার সিঁড়িভাঙা অঙ্ক মেলাতে। আর এই বিভাজন থেকে জন্ম নেয় বৈষম্য। তবু সেসব বৈষম্য আর বিভাজনের মাঝেই থাকে এক প্রায়-অদৃশ্য হাইফেন, যে চায় ‘আমরা’ আর ‘ওরা’-কে জুড়ে দিতে, সমাজের মূল থেকে যাবতীয় ভেদ-বিভেদ দূর করতে।

    তবে কিনা ভাবলে অবাক লাগে, আর দেখলে হতাশ— যখন বিভাজন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষ ঘোষিতভাবে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছেন, তখন সমাজের একটা বড় অংশই আঁকড়ে ধরে থাকছেন অন্ধ বিশ্বাস, বদ্ধ জলার মতো পুরনো ধ্যান-ধারণা। তাঁদের পিছনে মদত দেওয়ার লোকেরও বড়ো একটা অভাব নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থ, রাজনৈতিক ধান্দাবাজি, ক্ষমতার আধিপত্য— এইসব হাসিল করতে ওই বৈষম্যটুকুই তাঁদের প্রধান পুঁজি। তাকে সার-জল দিয়ে জিইয়ে রাখা। তা নইলে মিথ্যাচারের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক আসনই যে টলে যাবে।

    সমাজের যে-কোনও ধরনের বৈষম্য দূর করতে প্রথম যা করণীয়, তা হল ওই বৈষম্য যে ভীষণভাবে উপস্থিত তা মেনে নেওয়া। অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকবে না। মুখ ঘুরিয়ে নিলে অপ্রিয় সত্যকে হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যায়, অতিক্রম করা যায় না। অথচ আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি সমাজে কখনও-কখনও তেমনটাই দস্তুর হয়ে ওঠে বলে বোধ হয়। বিশেষত ধর্ম আর জাতপাতের বিভেদের ক্ষেত্রে। সমাজের নানা স্তরে তা কী প্রবলভাবে আজও গেড়ে বসে রয়েছে, তা বুঝতে না পারলে, সেই রূঢ় বাস্তবকে স্বীকার না করলে, তার মূলোচ্ছেদ কি আদৌ সম্ভব? সেই কবে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছিলেন— ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ‘ফুটবল ম্যাচ’। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি।’ ভাবনার স্তরে বিভাজন ও বৈষম্যের এই নির্মাণ যে হিন্দু বাঙালির ভিতরে আজও গেঁথে রয়েছে, সেই নগ্ন সত্যটিকে মেনে নিয়েই তা দূর করার পথে আমাদের হাঁটা দরকার। নয়তো ধর্মীয় আগ্রাসন ও রাজনৈতিক ফায়দায় ধর্মকে ব্যবহারের বিবিধ কৌশল হয়তো আরও দীর্ঘদিন আমাদের মগ্ন হয়েই দেখে যেতে হবে।

    এর সঙ্গে আছে সমতারূপী মুখোশ। তাকেও চিনে নিতে পারা জরুরি। অনেকটা ওই ‘অ্যানিমাল ফার্ম’-এর দেওয়াল লিখনের মতো— ‘All animals are equal, but some animals are more equal than others’। ক্ষমতাবৃত্তের কেন্দ্র বরাবর এই ছদ্মসমতার আনাগোনা যে সর্বাধিক, তা আমরা পরিধির বাইরে থাকা আমআদমিরা কি টের পাই না! আবার কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রও হয়ে ওঠে এর অন্যতম পোষ্টা। ওই মেকি সমতাকে ছুড়ে ফেলতে পারাও দরকার, উঁচু-নীচু ছোটো-বড়োর যাবতীয় বিভেদের ঢের বাইরে প্রকৃত সমতার রূপটির কাছাকাছি পৌঁছোতে। হোক না তা খানিক স্বপ্ন, খানিক বাস্তব। ছেলেবেলার পাঠ্যবইয়ে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ মুখস্থ করার পর বড়বেলার দুনিয়ায় পা রেখে যখন বৈচিত্র্যের বদলে খুঁজে পাওয়া যায় বৈষম্য, সেই অনিবার্য হোঁচট কি এতে খানিক মসৃণই হয় না?

    ‘জিরো ডিসক্রিমিনেশন ডে’ আসলে এক বদলের স্বপ্ন দেখাতে চায়। একদিন মানুষে-মানুষে আর কোনও ফারাক থাকবে না; দেখো, আমাদের পৃথিবীটা একদিন ঠিক এমনই সুন্দর হবে— এই আশাবাদ সে-স্বপ্নের মূলমন্ত্র। এই বদলে যাওয়া দুনিয়ার ছবি সে অন্তরে লালন করতে চায়। তাই তার প্রতীক প্রজাপতি— রূপান্তরেই যার মুক্তি। শরীরে পুরুষ, মনে নারী কিংবা এর বিপরীত অবস্থানে থাকা মানুষটি যেমন প্রতিনিয়ত খুঁজে পেতে চান তাঁর মুক্তিও। এমন সব বদলের স্বপ্নই লেখা থাকে প্রজাপতির ডানার কারুকাজে। এই পৃথিবীর আরও লক্ষ-কোটি মানুষ, যাঁরা ‘জিরো ডিসক্রিমিনেশন ডে’ নামটুকু পর্যন্ত শোনেননি, তাঁরাও কি এই আক্ষেপটিকে মিথ্যে প্রমাণ করেই উঠে দাঁড়াতে চান না— ‘কেন স্রেফ শুঁয়োপোকা হতে পারে প্রজাপতি, আর মানুষ পারে না!’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook