ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শুধু কবিতার জন্য : পর্ব ৩৫


    শ্রীজাত (March 9, 2024)
     

    ম্যাপ একদিন সকলেই দেখেছে। কাজ-ফেরত ডাইনারে বসে যাওয়া ছেলেটি, যাকে অনেক দূর থেকে দেখাচ্ছিল হলুদ আলোয় স্থির মূর্তির মতো, সে দেখে নিয়েছে ম্যাপ। কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় পথ চলতি দোকানে ফ্র্যাপে হাতে বসা মেয়েটি, যার দিদা মারা গিয়েছিলেন ক’দিন আগে, ম্যাপ দেখেছে সে-ও। সদ্য চাকরি পেয়ে চলে আসা মাঝবয়সী বিরক্ত পুরুষ, অথবা মর্টগেজের কাগজ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা বৃদ্ধা, ম্যাপ একদিন দেখেছে সকলেই। গাড়ি চালাতে চালাতে সিগন্যালের ফাঁকে, অথবা মিটিং সেরে ডাউনটাউনে এসে ক্যাব ডাকার অছিলায় ম্যাপ একদিন সকলেই দেখেছে। দেখেছে, কীভাবে গোটা শহরের চারপাশ প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে গম্ভীর হাইওয়ে, যে আজও কোনও বিদেশি গুজব ঢুকতে দেয়নি এদিকের শীতে। শীত, বিনোদনের খাতিরেই এনেছে তুষারঝড় আর সতর্কবার্তার ঝালর, যা গায়ে চাপিয়ে হাইওয়েকে আরও প্রাজ্ঞ দেখায়, দূর থেকে। যত মানুষ তুমি দেখতে পাচ্ছ এখানে, প্রত্যেকেই একবার অন্তত দেখে নিয়েছে ম্যাপ। আর গোপনে, একা, কেঁদেছে। তাদের রাস্তা চেনা হয়নি আজও।



    আপনাকে আমি খুবই সম্ভ্রম করি, কেননা আপনার ওভারকোটের গায়ে লেপটে থাকে ঝাড়লন্ঠনের আলোকুচি, যা সব হোটেলে পাওয়াও যায় না। তাই আপনি যখন নিরাপদে গাড়ি থেকে নামেন, আমার ইচ্ছে হয় তোমাকে সেইসমস্ত গল্প শোনাই, যা টেলিভিশনে ভাল করে বলছেও না। তুমি ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পৃথিবী ভরে যাচ্ছে আইসক্রিম ও লেমনেডের আশ্বাসে, বাতাস ভারী হয়ে উঠছে সন্ততিদের হোমওয়ার্কে। আমার মনে হয় তোমার দু’বাহু ধরে সোফায় বসাই, কেননা আপনি ভারী ক্লান্ত তখন, আর আপনার পা থেকে জুতো খুলে নিতে নিতে তোর কানে ফিসফিস করে বলে দিই, কোথায় কী ঘটছে। বলে দিই, কেন খানসামাদের মুখে কোনও ছায়া পড়ছে না, যাতে তুই বুঝিস যে, পালানোর সময় এসেছে। আপনি যে সমস্ত চুক্তি সই করে রাতে ঘুমোতে যান, তাদের উপর থেকে আমি তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাই শহরের ছাদে ছাদে, যাতে তোর মনে না থাকে, সাদা দেওয়ালগুলো আসলে ছিল দণ্ডায়মান কবর। অথচ আমার মুখ বন্ধ করে, গুটিয়ে নিয়ে, সাইকেলে ঝুলিয়ে, ওই চলে যাচ্ছে জিপসির দল।



    কুকুর নিয়ে রাস্তা পেরনোর সময় সারা পৃথিবী থমকে যায় যেন। যেন মাংসের দোকানের ছোকরা চিঠি লেখার কথা ভাবতে ভাবতে অপলক তাকায় একবার, আর উল্টোদিকের সরকারি প্রাসাদের চুড়ো থেকে সফেদ কাগজ কেউ দেয় উড়িয়ে। বুড়ি একবার ভাবেন মাফিন খাওয়া উচিত হবে কিনা, মুশকো রাগবি খেলুড়ে ধরায় পাতলা সিগার। ঘড়ি থেমে আছে পার্কিং লটের পাশেই। অন্য দেশের সময় এসে আস্তে আস্তে বসে যাচ্ছে সেখানে। অন্য দেশের আবহাওয়ার খবরে ভরে উঠছে রেডিও, অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়ক আশ্বাসের বেলুনগাড়ি নিয়ে পাহাড়ে উঠছেন। তোমার চোখের সামনে, এক শীতকালের বিকেলবেলা, দেশটা পালটে যাচ্ছে। বাতাস, সেই দূরের দেশ থেকেই আসছে, যার পিছু পিছু আসছে দুঃসংবাদ। এই সবকিছু ঘটে গেল কেবল কুকুর নিয়ে রাস্তা পেরনোর খাতিরে। তোমার পাসপোর্ট, বাড়ি গিয়ে বাগানে পুঁতে রাখছ তুমি। কাঁটাতারের গাছ দেখবে ব’লে।



    গোলাগুলির ভয়ে আমরা বেরোলামই না হোটেল থেকে। মাতাল ছেলেদের হৈ হুল্লোড় শুনে ভাবলাম মিছিল আর স্লোগানের কথা। সারা রাত আমাদের ভারী পর্দার পিছনে, কাচের লম্বা জানলার ওপারেই কেটে গেল। কার্ফিউ-এর ভয়ে আমরা থেকে গেলাম হোটেলের ঘরেই। অথচ বাইরে তখন ফুল মাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল মেয়েরা। আমাদের ঘরেই আমরা আনিয়ে নিয়েছিলাম যথেষ্ট পানীয়, খাবার, কাজের কাগজপত্র এবং ভবিষ্যৎ। দোতলার নীচে বয়ে-চলা রাস্তায় তখন ছুটে যাচ্ছিল লাগামছাড়া হাওয়া আর দুনিয়ার খবর। বারটেন্ডারদের আক্ষেপ বদলে যাচ্ছিল গ্রামীন সব গানে। তুমি কি দৌড়ে গেলে অন্যদিকের রাস্তায়? ওরা কি অপেক্ষা করে থাকল পরের কোনও স্টেশনে? আমরা কিছু জানলাম না। কেবল দূরের টাইপরাইটারের শব্দে ভাবলাম ঘোড়ার দল চলেছে টগবগিয়ে। আমরা সারা রাত একটা ভুল পৃথিবীতে জীবন কাটালাম। হোটেলের বাইরে কোনও দিন সকাল হয় না, জেনেও।



    বহুদূর থেকে খেতে এসেছে মেয়েটি। ছোট আর সস্তা রাতের হোটেলে, সবুজ ঝালরের নীচে ভেসে উঠছে তার মুখ, তার খিদে। কী যেন নাম? মার্গারিট, না ভায়োলা? আপাতত ডিনার সারতে এসেছে সে, আর চওড়া কব্জির যুবকটির সঙ্গে তার চলছে মৃদু তর্কাতর্কি। পানীয়ের গ্লাস আর কাঁটা চামচের শব্দে ভরে আছে রাতের পৃথিবী, অন্ধকার এই দুনিয়া ভেসে রয়েছে হাসের মাংস ও ভিনিগারের সুগন্ধে। তারই মধ্যে চলছে মান অভিমান, তারই মধ্যে চলে বেড়াচ্ছে বাড়ি ফেরবার শেষ বাস। পাশের ঘোরানো রাস্তা দিয়ে মেয়েটি অনেক রাতে যখন উঠে যাবে তার ডেরায়, তখন তার রুমমেট রূপকথায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, আর ছোট শহরের আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে অল্পবয়সে নিখোঁজ হওয়া ছেলেরা। কিন্তু এই গল্প আমার নয়। রেস্তোরাঁর দরজায় যে-লোকটি পাহারা দিচ্ছে, তার। আমার গল্পের প্রধান মেয়েটি, দেরি করে আসায় কোনও টেবল পায়নি কোথাও। তার খিদে তাকে এত রাতে কোথায় নিয়ে যায়, কে জানে।



    এই স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল আগের শতকে। যখন ইঞ্জিন থেকে বেরোচ্ছিল টাটকা ধোঁয়া, আর প্রেমিকদের তুলে দিতে এসে রুমাল বার করছিল শহরের মেয়েরা। ট্রেন থেকে মুখ বাড়ানো ছেলেদের জলপাই রঙের ছিল পোশাক, আর হোল্ড-অলে লেখা রেজিমেন্টের নাম। এই স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে গেছিল আগের শতকে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সব শহরের আশপাশ দিয়ে ছুটেছিল সেই ট্রেন, যার কামরায় কামরায় লেখা শুরু হয়েছিল পৃথিবীর শেষ কয়েকখানা চিঠি। যাদের কোথাও যাবার নেই আর, তারা এখন সুটকেস গুছিয়ে এই স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। সস্তায় কফি কেনে একটা, সঙ্গে প্রিয় মাফিন। মনে করতে থাকে, কীভাবে একদিন সকালে কেবল মেয়েতে ভরে উঠেছিল এই দেশ। ধোঁয়া, কীভাবে ঢেকে ফেলেছিল সমস্ত রাস্তা। আর বিস্মিত হয়, স্টেশনের লাল রং দেখে। তারপর, গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। ছুটির দিন হপ্তায় একখানাই কিনা!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook