ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ১৪


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (March 9, 2024)
     

    শাফিকা : দুই

    শাফিকা এখন আট মাসের ভরা পোয়াতি। জ্ঞান হওয়া-তক শাফিকা শুনেছে যে তার আম্মি হল বছর-বিউনি; এদিকে আব্বুর সঙ্গে তুইথুলি-মুইথুলি ক্যাচাল, ওদিকে কিন্তু বাচ্চা হওয়ারও বিরাম নেই। প্রসূতি অবস্থায় তার আম্মি এই সুর্মা-বিবি দু’বেলা পেট ভরে খেতে পেয়েছে কি না তাই বা কে জানে! শাফিকার বাপ হঠাৎ-হঠাৎ বাড়ি এসে হাজির হওয়া মানেই বড় খাসির মাংস এনে আম্মিকে রাঁধতে বলবে আব্বু; আর আম্মিও বসে যাবে কুটে-বেটে জোগাড় করতে; পুরনো ছেঁড়া কাথা-কানি চাপানো, ঝুলে পড়া দড়ির দোলনাটায় শাফিকাকে কোলে নিয়ে বসে আব্বু আদর করবে; দুই দাদা ঘুরঘুর করবে আশপাশে; কিছুক্ষণ পর বাবার গায়ের গন্ধ বদলাতে থাকবে; সে-গন্ধ মুখ থেকেও বেরোবে; ক্রমে দাওয়াটাও ম-ম করবে সেই মাতা-মাতা ঝাঁঝাল গন্ধে; আম্মি সবাইকে থালায়-থালায় বেড়ে দেবে গরম-গরম ভাত আর কাই-কাই মাংস; শাফিকাকে কোল থেকে নামিয়ে, দোলনায় ঝুলে-ঝুলেই আব্বু খাবে; কয়েক টুকরো পেঁয়াজ, দু’টুকরো পাতি লেবু আর ক-টা কাঁচা লঙ্কা আব্বুর থালায় দিয়ে, বাড়তি আদর জানাবে আম্মি। খাওয়া হলে ওখানেই থালা নামিয়ে, পাশে রাখা প্লাস্টিক মগের জল নিয়ে থালাতেই হাত ধোবে; কুলকুচি করে মুখও; সেই যে মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকবে আব্বু, আর সে নড়বে না সেখান থেকে! হাত অবসর হলে বাবাকে ধরে-ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে তোশক পাতা তক্তাটার ওপর শুইয়ে দিয়ে আসবে আম্মি। সেদিন শাফিকা আর তার দুই দাদাকে শুতে হবে ঘরের বাইরে; মাদুর-পাতা দাওয়ায়। খেয়ে, আঁচিয়ে, ঘরে গিয়ে আম্মি দোর দেবে; মাঝরাত থেকেই শোনা যাবে চিল-চিৎকারে আম্মির কান্না আর বাবার খিস্তি; সেটা গড়াবে মারপিট, বাসন ছোড়াছুড়ি অবধি; আগে-আগে আশপাশের লোক থামাতে আসত; এখন আর কেউই ঘেঁষে না; মনে হয় সকলেরই গা-সওয়া হয়ে গেছে। এভাবেই দিন দুয়েক তাদের সঙ্গে থেকে আব্বু আবার হঠাৎ করেই চলে যাবে এই ঘরটা থেকে। শাফিকার সেই কোন ছোটবেলায় কাউকে কিছু না বলে, সেই যে হঠাৎ একদিন আব্বু চলে গেছে, কখনওই আর এমুখো হয়নি সে। শাফিকার পরে আর কোনও ভাই-বোনও পেটে ধরেনি তাদের আম্মি। দিনে-দিনে মুখরা, রুক্ষ এবং ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করা ফুটের সবজিওয়ালি হয়ে গেছে তাদের আম্মি; পার্ক সার্কাস মার্কেটের অনেক লোকই তাকে চেনে; সে যেমন টাকাও ধার দেয় চড়া সুদে, তেমনই খিস্তি করে পাওনা আদায়ও করতে জানে; কিন্তু সম্মান দেখাবার বদলে লোকে তাকে ভয় পায়; পাড়াঘরের পাব্বনে তার আম্মি ডাক পায় না কখনওই; আম্মিকে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতেও দেখেনি সে। ফলে যত্নআত্তি যে কেমন হয়, সে-সম্পর্কে শাফিকার আলাদা কোনও বোধই নেই। বিয়ে হয়ে এসে, একমাত্র যা সে কাছ থেকে দেখেছে তা হল, বড়বিবিকে করা তার মিঞার দেখভাল; সমানেই ফল, মাংস, ডাল এসব না বলতেই কিনে আনা। আর দেখেছে বড়বিবির হয়রানি কমাতে বড় দুই মেয়েকে ইস্কুলে না পাঠিয়ে, সংসারের কাজে লাগিয়ে দেওয়া। তা ছাড়া বড়বিবির বাপ-আম্মি-ভাই আছে; দরকার-অদরকারে তাদের কাছেও সে চলে যেতে পারে। শাফিকার মতো উড়নচণ্ডী অবস্থা তো তার নয়; এ-সংসারটাকেই সে তাই আঁকড়ে থাকে প্রাণপণে।

    শাফিকা অপেক্ষা করেছিল; ভেবেছিল যে নিজে থেকে কিছুই বলবে না; পরে আবার মত বদলে বড়বিবিকে জানিয়েছিল যে তার মাসিক বন্ধ হয়ে আছে দু’মাস হল; বড়বিবিও শুনেই জানতে চাইল, ‘পূর্ণিমার আগে না পরে?’

    ‘পূর্ণিমা কবে গেছে, খেয়াল নেই; তবে এ-মাসেও হয়নি।’

    ‘তোর আম্মিকে জানাতে হবে তো! এসব করবে কে!’

    ‘বললে খবর পাঠাব নাহয়!’

    ‘এতে আর বলাবলির কী আছে! অবশ্য বলেই বা কী হবে? মিঞার ঘরে তোকে তুলে দিয়ে সেই যে চাল তুলেছে তোর আম্মি, আর তো এ-মুখে আসেনি।’

    ‘কাকে দিয়ে খবর দেব? আমি কি নিজে চলে যাব আম্মির ঘরে!’

    ‘সেটা কি আর মিঞার সহ্য হবে! আমার কোলেরটাকেই বা কে সামলাবে?’

    ‘আমার তো আর এখনই কিছু হচ্ছে না! তানি-বানির সঙ্গে হাত লাগিয়ে যেমন সব সারছি তাই করব।’

    ‘তানি-বানির আর কাজ কী বল! ইস্কুল নেই, নামাজ নেই; শুধু গু-মুত কাচবে আর হাত পুড়িয়ে রাঁধবে! আমার বাপ-ভাইরা শুনলে তো আর রক্ষে থাকবে না; আর আম্মি তো কেঁদে-কেঁদেই চোখ ফোলাবে।

    ‘এছাড়া আমার আর ক্ষমতা কোথায় দিদি! ওই গা-গতরে খেটে যেটুকু যা পারি!’

    ‘ভাইদেরই নাহয় বলি তানি-বানিকে নিয়ে গিয়ে ওখানেই রাখতে; আমি আর কোন চুলোয় যাব! মিঞাকে একা ফেলে বাপ-ঘরে যাবই বা কী করে! তাকে তো আর বলতে পারি না যে, হাত পুড়িয়ে খাও!’

    গজগজ করতে-করতেই অন্যদিকে পা বাড়ায় বড়বিবি। তার মুখ তখনও থামেনি; প্রবল আস্ফালনে সে বলে চলেছে, ‘যেই না চোখের আড়াল হয়েছি, অমনি মাগি পেট বাঁধিয়ে বসেছে!’ যেসব খিস্তি সে মার্কেটওয়ালিদের মুখে শুনেছে, সেই ভাষাতেই কথা বলছে বড়বিবি! মাথায় রাগ চড়লে কী বা মার্কেট আর কোথায় বা ঘর! জিভের শানে সবাই এক। মাথা নীচু করে আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে খিড়কির দিকে এগিয়ে যায় শাফিকা; মনে-মনে একইসঙ্গে সে তারিফও করে তার নিজের বুদ্ধির। ভাগ্যিস সে বড়বিবিকে নিজে থেকে সব বলেছিল; না হলে আরও শতেক কথা শুনতে হত তাকে। দু’মাস থেকে গড়িয়ে-গড়িয়ে এই আট মাসে তার আর পড়া হত না। বড়বিবি সেদিন এটাই বুঝতে চেয়েছিল যে, মিঞা সব জানে কি না; তার তো এই ভয়টাই ছিল যে তাকে বাদ দিয়ে শাফিকার সঙ্গে শলা করে মিঞা না সব কিছু ঠিক করে ফেলে; পরে অবশ্য সে নিজেই মিঞাকে বলেছিল এবং ভালমানুষ সেজে বোঝাতেও চেয়েছিল যে, শাফিকা বা সে— যে-বিবিই পেটে ধরুক না কেন, এ-হেঁশেলের সব ক’টা বাচ্চা তো সেই মিঞারই; আর সে-খোরাকের জোগানদারও তার মিঞাই। শাফিকা জানে যে মিঞাকে ভরসা দিতে বড়বিবি এ-কথাও বলেছিল যে, সবাই মিলে হাত লাগালে কী আর এমন অসুবিধে! শাফিকা জানতই যে বড়বিবি চাইলেও মিঞা তার সোমত্থ দুই মেয়েকে কখনওই কাছছাড়া করবে না। আর শাফিকা এও জানে যে, তার মিঞা প্রাণ ঢেলেই তাকে যত্নে রাখবে। শাফিকা অপেক্ষা করেছিল যে মিঞা নিজে থেকে তাকে কী বলে শোনার জন্য!

    আম্মির সংসারে থেকে সে যেমন দেখেছে দরাদরি করে মার্কেটে কেনাবেচা, এখন নিজের সংসারে বড়বিবির ভাগ থেকে মিঞাকে কাছে পেয়ে, সমানেই সে শিখে চলেছে সংসার-চালনার নিয়ম; ক্রমাগতই বুঝে চলেছে যে পায়ে-পায়ে ওত পেতে আছে সাপ; ল্যাজে পা পড়লেই আর রক্ষে নেই; মাটি খুঁড়ে গর্তে বাস করা নেউল হয়ে বাঁচাটাই শিখতে হবে তাকে। আম্মির মতো রুদ্রমূর্তি ‘মার্কেটওয়ালি’ পরিচয়ে বাঁচতে চায় না শাফিকা; বিয়ে যখন হয়েই গেছে, তখন সে চায় সংসারেই থাকতে। তার ঠাঁই হয়েছে গোয়ালঘরের চাতালে; হোক গে যাক; ঘর তো বটে! একটেরে হলেও মিঞার সীমানার বাইরে তো নয়! নাহয় এই ঘরেই শুরু হবে তার আর মিঞার আরও এক সংসার— যার বাইরের দেওয়ালটা সাজানো থাকবে শাফিকার দেওয়া সমান মাপের অজস্র ঘুঁটের বাহারে! তার আম্মি তো এটুকুও পাইনি। পেয়েছে কি এমন একটা মস্ত দেওয়াল!

    শাফিকার মতো গা-গতরে খাটা যুবতীকে কেউ মেরে ফেলবে না; কারণ তার শ্রমের দাম আছে। কিন্তু তার গর্ভে সন্তান আসা মানেই তো দ্বিতীয় বিবি হিসবে এই সংসারেই স্বীকৃতি, সম্মান এবং অধিকার বিস্তারের সুযোগ।

    .

    সেদিন রাতের বেলা তানি-বানিকে রোজকার মতো তার ঘরে শুতে আসতে দেখে মনে-মনে স্বস্তিই পেয়েছিল শাফিকা; সে-সময়টা বড় ক্লান্ত লাগত তার; শরীরে বমি ভাব; খাওয়াতে রুচি নেই; সারাটা দিন ধরে খাটা-খাটুনিরও তো শেষ থাকে না কোনও; রাতে মিঞা আবার এ-ঘরে শুতে আসা মানেই তো ঘুমের দেরি, অসময়ে জেগে থাকা আর ধামসা-ধামসি; মিঞা চলে গেলে বিছানা ছেড়ে আবার উঠে দোর দিয়ে তারপর শুতে আসা। তখন কি আর ঘুম আসে ছাই! ভোররাতে চোখে আঠা লাগে। বিছানায় পড়ে যে একটু গড়াগড়ি খাবে, সে-উপায় কই! চারিদিকে সবাই তো তখন জেগে পড়েছে। সে-রাতে তানি-বানি যখন ঘরে ঢুকল, শাফিকা সবে নামাজ  সেরেছে; অসময়ে তাকে নামাজের আসনে দেখে, তানি-বানি অবাক চোখে তাকাল; এ-নামাজের রীতি যে গর্ভসঞ্চারের কারণ, সে ওরা ভাল ভাবেই জানে; কোনও কথা না বাড়িয়ে শাফিকার তক্তায় উঠে, উলটোদিকে মাথা করে শুয়ে পড়েছিল, দুই বোনে। এইভাবে আড়াআড়ি শুলে শাফিকার পেটে চাপ লাগার ভয় আর থাকবে না। ফলে শাফিকার মুখের সামনে তখন আর ওদের মাথার আড়াল ছিল না; ওদের দুজনের পা-জোড়া টান টান হয়ে তার বুকের কাছে থাকলেও আড়ালটা সরে গিয়েছিল চোখের ওপর থেকে। সে-রাতে, অন্ধকারে ডুবেও জেগেই ছিল শাফিকা; বুঝেছিল যে এতক্ষণে নিশ্চয়ই মিঞার কানে তোলা হয়ে গেছে যে, শাফিকার পেট হয়েছে। কিন্তু শাফিকা ভাবছে একেবারে অন্য এক কথা; বড়বিবির ওই প্রশ্নের অর্থ সে জানে; পূর্ণিমার আগে তার মাসিক বন্ধ হলে ছেলে হবে, আর তার পরে হলে মেয়ে; বড়বিবির দুই মেয়ের পর অনেক কষ্টে সবে তার একটা ছেলে হয়েছে; এই অল্প সময়ের ব্যবধানে শাফিকারও ছেলে হলে তার ভাগে কম হতে পারে; আবার মেয়ে হলেও নিস্তার নেই; কারণ মিঞার ওপর বোঝা বাড়বে বই কমবে না। শাফিকা মনে-মনেও যে ছেলে বা মেয়ে এমন বিশেষ কিছু কামনা করে এমনও নয়। কিন্তু বড়বিবির সঙ্গে ছেলের ভাগ নিয়ে বচসা বা আকচা-আকচি হোক এটা সে কোনও মতেই চায় না; অনেক ভেবেই সে তাই বলেছিল, পূর্ণিমা যে কবে এসেছে বা কোথায় গেছে সে-খেয়াল শফিকার নেই। কেন তার মনে হয়েছিল, যে-কোনও সময়ে নষ্ট করে দেওয়া হতে পারে তার গর্ভ-ভ্রূণ। শাফিকার মতো গা-গতরে খাটা যুবতীকে কেউ মেরে ফেলবে না; কারণ তার শ্রমের দাম আছে। কিন্তু তার গর্ভে সন্তান আসা মানেই তো দ্বিতীয় বিবি হিসবে এই সংসারেই স্বীকৃতি, সম্মান এবং অধিকার বিস্তারের সুযোগ। গর্ভস্থ ভ্রূণকে সুরক্ষা দিতেই ঘুম চলে গিয়েছিল শাফিকার। ফলে মাথায় উঠেছিল খাওয়া-বিশ্রাম বা অন্যান্য যত্নের ভাবনা।

    ওইদিনও মধ্যরাতে গোয়ালের ধারে শেয়াল আর ভামের চলাফেরার আভাসে, দাওয়ায় শুয়ে থাকা কুকুরগুলো তারস্বরে ডাকতে শুরু করছিল; ডেকে উঠেছিল গোয়ালঘরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘুমানো গরুদুটোও। বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে বানানো হাঁস-মুরগিগুলোর ঘরের দিক থেকে ভেসে আসছিল ডানা ঝটাপটির আওয়াজ। আর এদিকে মুখে কোনও ‘রা’ না কাড়লেও শাফিকা শুনতে পাচ্ছিল তার বুকের মধ্যে গুমরে ওঠা বাজের শব্দ। কেউ যেন হাপর টানছিল তার পাঁজরে আগুন জ্বালিয়ে। খোলা জানলার মধ্যে দিয়ে শাফিকা দেখছিল জোনাকি-ওড়া গাঢ় অন্ধকার। হঠাৎই তার চোখের ওপর ভেসে উঠল একটা ছবি। দেওয়ালের গায়ে সাঁটা, তার দেওয়া টাটকা ঘুঁটেগুলোতে কে যেন জোনাকি গেঁথে দিচ্ছে। প্রত্যেকটা ঘুঁটের ঠিক মাঝখানটাতে একটা করে আগুনের ফুটকি। এক আকাশ তারার মতোই আলোয় আলো হয়ে গেছে তার ঘুঁটের দেওয়াল। হুরি-পরি না কি আল্লা! কে নেমে এল? কাকেই বা দোয়া জানাতে এল তারা! শাকিলার মনে হল, এটাই তো আসল ক্যানভাস! অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল— ‘বাবা’— ‘ডিম-বাবু!’ ঘুমের মধ্যে তলিয়ে না গিয়ে, আসন পেতে নামাজ পড়তে বসল শাকিলা— একেবারে নিঃশব্দে।

    .

    তার মিঞা ইসমাইলের কাছে খবর পেয়ে ক-টা দিন পরেই এসেছিল তার আম্মি, সুর্মাবিবি। লোকদেখানি আহ্লাদে শাফিকাকে নিয়েও যেতে চেয়েছিল নিজের কাছে। মিঞার হয়ে বড়বিবি আপত্তি করায় হাড় জুড়িয়ে শ্বাস নিয়েছিল তার আম্মি। ইসমাইলের হাতে মাঝে মাঝেই ফল, মুড়ি, রেউড়ি এসব পাঠানোও করে গেছে নিয়ম করেই; সেসব খাবার শাফিকাও ভাগ করেই খেয়েছে। আজ আবার আম্মি এসেছে তাকে ন-মাসের সাধ খাওয়াতে। মিষ্টির হাঁড়ি এবং নতুন একখানা সুতি-ছাপা হাত থেকে নামিয়ে দাওয়ায় বসতেই শাফিকা বুঝল যে, তার নয় মাসের সাধ এই বাড়িতেই হবে। ইসমাইল আর বড়বিবির কাছে মনে-মনে কৃতজ্ঞ থাকল শাফিকা। পরদিনই বড়বিবি আর আম্মি দুজনে মিলে তাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড়খানা পরিয়ে মাথা আঁচড়ে গুছিয়ে দিল তাকে। বড়বিবির হেঁশেলে গিয়েই তার মা রেঁধেছে বড় খাসির কাই-কাই মাংস আর নানা রকমের তেলেভাজা। বড়বিবি বানিয়েছে সিমাই। সকলে মিলে নামাজ পড়ার পর সাধ খেল শাফিকা। আব্বুর কথা মনে পড়ে চোখ ভিজে উঠল তার। এখন তো মিঞাই তার আব্বু!

    এই ক-মাস খুব কমই কাছে পেয়েছে মিঞাকে। বড়বিবিই ব্যবস্থা করেছে, মাঝে মাঝে তানি-বানিকে নিজের ঘরে শুতে ডেকে। ভোররাতে উঠে মিঞাকেও আর ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। দুই বিবি নিয়ে থাকাটায় অভ্যস্ত হয়েছে প্রায় সকলেই; কিন্তু সবটাই ঘটেছে বড়বিবির হুকুমে। কত যে সোহাগ করেছে তার মিঞা! সাবধানে জড়িয়েছে তাকে। একসঙ্গে নামাজ পড়েছে বার বার; মাথার চুলে তেল মাখিয়ে দিয়েছে; লুকিয়ে কিনে আনা মালিশ-তেল নিজের তেলোতে লাগিয়ে, ধীরে-ধীরে তা বুলিয়ে দিয়েছে শাফিকার তলপেট, কোমর আর পিঠে। প্রতিদিন লুকিয়ে তার ঘরে এসে রেখে গেছে এক জোড়া সেদ্ধ ডিম আর কাগজে মোড়া কেক; বার বার বারণ করেছে এক ঠায় দাঁড়িয়ে ঘুঁটে দিতে, ভারী কিছু তুলতে আর গরুর জাবনা কাটতে। শাফিকা শুধু তাকিয়ে-তাকিয়ে পড়েছে তার মিঞার দু’চোখের ভাষা। মায়া আর মায়া— গভীর মমতায় উপচে আছে যেন! শাফিকা আন্দাজ করতে চেষ্টা করে, এই মায়াটাই কি প্রেম! শরীর ছাপিয়ে ভালবাসা?

    *

    আমি শাফিকা। নয় মাসের সাধ খাওয়ার পরদিনই ব্যথা উঠে খোকা হল আমার। বড়বিবি আর তার আম্মি দুজনে মিলেই নিয়ে গেল সরকারি হাসপাতালে; কার্ড করাই ছিল। ভর্তি করে দিয়ে হাসপাতালের চাতালে বসেই নামাজ পড়ল তারা; ব্যথায় ছারখার হয়েও ছেলের মুখ দেখলাম। সন্ধেবেলা দূর থেকেই দেখতে পেলাম যে মিঞা আসছে ছেলের মুখ দেখতে। কাছে এসে দাঁড়াতেই তার হাতটা চেপে ধরলাম আবেগে; এই প্রথম নিজেকে মনে হল আমি তার বিবিই বটে! তার ছেলের মা। গভীর আবেগে আমার চিবুকে টুসকি মেরে আদর জানাল মিঞা। আবার বেরিয়ে গিয়ে বোতলে করে গরম চা আর চপ-মুড়ি কিনে আনল। চা খাওয়ার জন্য সেইসঙ্গে কাগজের দুটো খালি কাপও। ছেলেকে পাশে শুইয়ে দিয়ে দুজনে বসে চা-চপ-মুড়ি খেতে-খেতে মনে হল, কত কথাই তো বলে চলেছি দুজনে। আসলে কিন্তু আমরা দুজনেই চুপ করে বসেছিলাম মুখ নীচু করে; সে যে কী গভীর আনন্দ!

    মিঞা চলে যেতে হঠাৎই আক্ষেপ হল; কেন যে লিখতে শিখলাম না! ‘বাবা’কে তো একখানা চিঠি লিখেও জানাতে পারতাম! হররোজ ‘বাবা’র ঠিকানায় আসা পোস্টকার্ড বা নীল রঙের ভাঁজ করা চিঠিগুলোর মতো! ‘বাবা’র কথা মনে আসতেই, কয়েক মাস আগে অন্ধকারে দেখা সেই রাশি-রাশি ঘুঁটের মধ্যে একরাশ জোনাকি-জ্বলা আলো আবার যেন দপ করে ভেসে উঠল চোখের ওপর। ক্যানভাস! কুচি-কুচি কাগজের বদলে তালতাল গোবর। তাতে কী! ছবির মতোই তো দেখাল আমার চোখে! মনে হল এই খোকাও তো একটা মাসের সঙ্গে আর একটা মাস জুড়ে তবে না পেয়েছে তার সম্পূর্ণ শরীর; সবই তো টুকরো-টুকরো; আবার নিপুণ করে জুড়ে নিলেই সবটাই যেন ছবি।

    ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মজার এক খেলায় যেন পেয়ে বসল আমাকে; খোকাকে এই দেখছি টুকরো-টুকরো; পরক্ষণেই আবার দেখছি তার জুড়ে যাওয়া পুতুল শরীরটা; তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে খোকার কান্না, আড়মড়ি ভাঙা, টুকটুকে লাল জিভ থেকে গড়িয়ে পড়া লালা। আহা! সব মিলিয়ে যেন কুচি-কুচি আনন্দ জুড়ে-জুড়ে এঁকে চলেছি এমন এক ক্যানভাস, যা আমি ছাড়া আর কেউই বুঝবে না; সন্তানের জন্ম-যন্ত্রণা পেরিয়ে আমি যেন হেঁটে চলেছি এমন একটা ক্যানভাসের দিকে, যেখানে অপেক্ষা করে আছে আমার এই গোটা জীবনটাই। খোকাকে কোলে নিয়ে, ওর কপালে চুমু দিয়ে বিড় বিড় করে বলতে লাগলাম… ‘ক্যানভাস— ক্যানভাস— ক্যানভাস— আমার ক্যানভাস।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook