ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আঞ্চলিকতার ময়দানে পথহারা ফুটবল


    শান্তনু চক্রবর্তী (May 18, 2024)
     

    মেলবোর্ন অলিম্পিক পার্ক স্টেডিয়ামের টানেল দিয়ে দু-দলের ফুটবলাররা তখন মাঠে নামছেন। সেই ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জেতা মোহনবাগান ক্লাবের অন্যতম ডিফেন্ডার রেভারেন্ড সুধীন চ্যাটার্জি বুট পরে খেললেও, এই ১৯৫৬-তেও বুট নিয়ে এদেশি ফুটবলারদের একটা কিন্তু-কিন্তু অস্বস্তি রয়েই গেছে। বিশ-তিরিশের দশকে গোষ্ঠ পালের মতো খালি পায়ে মহা ট্যাকলে গোরা-সাহেবদের ঠ্যাং ভেঙে দেওয়াটা যেমন বিরাট বীরত্বের কাজ বলে মনে করা হত, সেটা হয়তো এখন আর করা হয় না। তবু ময়দানের সবুজ ঘাসের ওপর বুটহীন টাটকা-স্বতঃস্ফূর্ত স্কিলের আলপনা এঁকে দেওয়ার জন্য ভারতীয় ফুটবলারদের তখনও বেশ পা সুড়সুড় করত। কিন্তু ১৯৫২-র হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে, ফিনল্যান্ডের কনকনে ঠান্ডায়, খালি পায়ে, হি-হি করে কাঁপতে-কাঁপতে, যুগোশ্লোভিয়ার কাছে ১০ গোল খাওয়ার লজ্জা তখনও টনটনে-টাটকা! এই যাত্রায় তাই কোচ-সাহেব বুট পরা নিয়ে খেলোয়াড়দের কোনও ট্যাঁ-ফোঁ বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না। একমাত্র বুটের ঘষায় ফোস্কা পড়লে, খালি পায়ে খেলার একটা অনুমতি নাকি অলিম্পিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম নেওয়া ছিল। যদিও সিনেমার ‘ময়দান’-এ এ-নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য শোনা যায়নি। তবে বিতর্কের বুট-জোড়াটি গোড়া থেকেই ছবিটার মাথার ওপর ঝুলে থেকেছে।

    ‘ময়দান’ শুরুই হচ্ছে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের ওই ১০-১ গোলে ভারতীয় ফুটবলের ধ্বংস হওয়ার খবর দিয়ে। তারপরেই দেখা যাচ্ছে কলকাতায় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভায় সেই হারের কাঁটাছেঁড়া হচ্ছে। কাঠগড়ায় দলের কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম। ভারতীয় ফুটবল গভীর শ্রদ্ধায় বা গোপন হিংসেয় যাঁকে বরাবর রহিম সাহেব বলেই ডেকে এসেছে। এই ১০ গোলের ভূমিকম্প প্রসঙ্গেও ময়দানি তথ্য হল, যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে ওই ‘ঘাতক’ ম্যাচের আগে রহিমসাহেব ফ্লু আর ধুম জ্বরে এতটাই কাহিল ছিলেন, সেদিন তিনি ভারতীয় ডাগ-আউটের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি। তাঁর বকলমে সেই ম্যাচে কোচের দায়িত্বে ছিলেন বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়। ইনি ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকে টি.আও-শৈলেন মান্নাদের কোচ ছিলেন। ১৯৬২-তে ওঁকে ফুটবল কোচ হিসেবে পাঠাতে না পেরে, কর্তারা বক্সিং টিমের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, খেলোয়াড়-জীবনেও নাকি উনি বক্সিং আর ফুটবল প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতেন। মোহনবাগানের হয়ে এক কিকে বল ওড়ানোর পাশাপাশি এক ঘুসিতে গোরা স্ট্রাইকারের নাক ফাটানোই ছিল তাঁর ইউ.এস.পি.। সে যাই হোক, ময়দানি গসিপ হল এহেন বলাইবাবুই নাকি সেদিন রিজার্ভ বেঞ্চ-এ বসে জাতীয় দলকে ডোবানোর পাকা বন্দোবস্ত করেছিলেন।

    সিনেমা স্বাভাবিক ভাবেই এইসব বিতর্কিত বখেড়ায় ঢোকেনি। সেখানে ‘আসামি’ রহিম সাহেবকে কাঁচুমাঁচু হয়ে হারের কৈফিয়ত দিতে দেখা যায়। একজন বেশ প্যাঁচালো-পাটোয়ারি ভিলেন গোছের বাঙালি কর্মকর্তাকে দেখানো হয় (কলকাতার প্রবীণ সাংবাদিকরা অনেকেই বলছেন চরিত্রটা নাকি একদা দাপুটে ক্রীড়াকর্তা মণীন্দ্র ওরফে বেচু দত্তরায়ের আদলে তৈরি)। ছবিতে দেখা যায়, বেশ গা-জ্বালানো হাসি-হাসি মুখে, চিবিয়ে-চিবিয়ে তিনি রহিমকে বিঁধছেন। কোচের চাকরি খেয়ে নেওয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লাগলেও, শেষ অবধি আরেকজন ভাল, ভদ্র, কম পলিটিক্সবাজ বাঙালিবাবু (ইনি হতেও পারেন পঙ্কজ গুপ্ত!) রহিমসাহেবকে উদ্ধার করেন। তাঁর চাকরি বেঁচে যায়। তিনি আবার নতুন উৎসাহে আসমুদ্রহিমাচল ছানমিন করে, ফুটবলার রতন খুঁজেপেতে এনে, একটা জবরদস্ত নতুন জাতীয় দল বানিয়ে ফেলেন। দেশপ্রেমে টগবগ এই ‘টিম ইন্ডিয়া’-কেই আমরা অলিম্পিক পার্ক স্টেডিয়ামের টানেলে দেখি। না, পর্দার রহিমসাহেব এখানে ‘চক‌ দে ইন্ডিয়া’-র ভারতীয় মহিলা হকি দলের কোচ কবীর ‘শাহরুখ খানের’ মতো অমন ভয়ানক রাষ্ট্রবাদী নন যে, নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কেউ পঞ্জাব, মণিপুর, ঝাড়খন্ড বা হরিয়ানা বলে ফেললে কোচসাহেবের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাবে। তবে সেকেন্দ্রাবাদের আলো-আঁধারি, গলি-ঘুঁজি থেকে তুলসীদাস বলরাম, সাবেক বোম্বাইয়ের সমুদ্রবেলা থেকে নেভিল ডি-সুজা, কলকাতার লিগ ম্যাচ থেকে পি কে ব্যানার্জিদের খুঁজেপেতে আনার সময়ে, তিনি দুটো জিনিস সবার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এক নম্বর— ব্যক্তিগত কেরদানি নয়, দলের কথা মাথায় রেখে খেলতে হবে; দুই— পা ঘষে-ছিঁড়ে-কেটে-ছুলে যা-ই হোক না কেন, বুট খোলা যাবে না। তাই স্টেডিয়ামের টানেলে বুটের ফিতে বাঁধা নিয়েই তো একটা ঘোর জাতীয়তাবাদী ক্যাচাল হয়ে গেল!

    মেলবোর্নে ভারতের প্রথম ম্যাচ ছিল হোম-টিম অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেই। মাঠে নামার সময়ে এক অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলার-পুঙ্গব, সাদা চামড়ার দেমাকে, তার বুটের খোলা লেস-‌টা ভারতের নেভিল ডি-সুজাকে দিয়ে বাঁধিয়ে নেয়। ভারতীয় ভদ্রতাবোধ ও সৌজন্যের খাতিরে নেভিল ফিতে বেঁধে দিলেও, শ্বেতাঙ্গ-ব্রিগেডের শরীরী ভাষায়, বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যে, সদ্য-স্বাধীন ভারতের ‘কলোনিয়াল’ অতীত নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে গোটা দলই চেগে ওঠে। মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে চার গোল দেয় ভারত! নেভিল হ্যাটট্রিক করেন। তারপরেও সাংবাদিক সম্মেলনে এসে হেরো টিমের কোচ-কর্মকর্তারা যখন বারফট্টাই করছে, ভারতের জয়টাকে ‘ফ্লুক’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন রহিমসাহেব বিলকুল বলিউড স্টাইলে একটা চোখা-তুখোড় ফিল্মি ডায়লগ ঝেড়ে দেন! তাঁর বাক্যবাণে ঝলসে ওঠে ‘হম হিন্দুস্তানি’— হম সে জো টকরায়েগা, উও চুরচুর হো যায়ে গা— গোছের জাতীয়তাবাদী চেতাবনি। আজকের ‘বিশ্বগুরু’ ভারতের বিদেশমন্ত্রক প্রতিবেশী দেশগুলোকে (চিনকে কম, পাকিস্তানকে বেশি!) প্রায়ই যেমন বাণী শুনিয়ে থাকে। এখন কথা হল ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’কে দিয়ে সাহেব ফুটবলারদের জুতোর ফিতে বাঁধিয়ে নেওয়া, কিংবা সেই ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক্সের মতো পুরোদস্তুর অ-পেশাদার একটা প্রতিযোগিতায় ম্যাচের শেষে প্রেস মিট, আবার সেখানে দুই কোচের ‘দেশপ্রেমিক’ তাল-ঠোকাঠুকি কতটা সম্ভব ছিল, সে-ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

    তবু পর্দায় এসব ঘটাতে হয়েছে, কারণ এটা না করলে, ভারতের ফুটবলকে ঘিরে জাতীয়তাবাদী ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’টা ঠিক তৈরি করা যাচ্ছিল না। মেলবোর্নে প্রথম ম্যাচেই আগেরবার ১০ গোল খাওয়া ভারত অস্ট্রেলিয়াকে ৪-২ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল, অলিম্পিক্সে প্রথম এশীয় ফুটবলার হিসেবে নেভিল ডি-সুজা দুর্ধর্ষ হ্যাটট্রিক করেছিলেন— এসব তো ফুটবল ইতিহাসের তথ্য। যেমন, তথ্য বলছে ঔপনিবেশিক পর্ব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো ছুঁইছুঁই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে, ১৯৫৬ এ-যাবৎ সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্টের বছর। ভারত সেই প্রথম ও শেষবার অলিম্পিক্স ফুটবলের সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল। যদিও সেমিফাইনালের মতোই তৃতীয় স্থান নির্ণায়ক ম্যাচেও হেরে গিয়ে শেষ অবধি চার নম্বরেই তাদের দৌড় শেষ হয়ে যায়। তবু আন্তর্জাতিক এক্সপোজারের হিসেবে এর থেকে বেশি কিছু ভারতীয় ফুটবল কোনওকালে অর্জন করেনি। ‘ময়দান’ সিনেমায় জানানো হয়েছে, মেলবোর্নে ভারতের খেলা দেখে মুগ্ধ ফিফা-র প্রধান স্ট্যানলি রাউস নাকি ভারতকে ‘এশিয়ার ব্রাজিল’ বলেছিলেন। যদিও সেটা কতটা সত্যি, তা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। তবু ওই অলিম্পিকে ভারতীয় সাফল্যের যেটুকু বাস্তব, তা এতটাই টাটকা, তরতাজা, জ্যান্ত ছিল যে, তাকে সাদা চামড়াওয়ালাদের ঔপনিবেশিক বুটের ফিতে বেঁধে দেওয়ার গোছের অসম্ভব, হাস্যকর, অবাস্তব চালচিত্র টাঙিয়ে উজ্জ্বল করার দরকার ছিল না।  

    তবু যে দরকার পড়ল, তার কয়েকটা কারণ আছে। অমিত আর শর্মা পরিচালিত, বনি কাপুর প্রযোজিত ‘ময়দান’-ই প্রথম ফুটবল নিয়ে বড় ব্যানারের বড় বাজেটের বলিউড ছবি। বলিউডে যে-ধরনের স্পোর্টস ফিল্ম হয়, কখনও-সখনও ‘লগান’ বা ‘চক দে ইন্ডিয়া’ বাদ দিলে প্রায় সবই বায়োপিক, আর সেই মানচিত্রের ধারেকাছেও ফুটবল বা ফুটবলারদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘ময়দান’ সেখানে কাচের দেওয়ালটা অবশ্যই ভাঙতে চেয়েছে। এমনকি হায়দ্রাবাদের প্রাক্তন ফুটবলার-কাম-স্কুলের মাস্টারমশাই-কাম কলেজের পিটি স্যার-কাম একজন ফুটবল ভাবুক দার্শনিক রহিমসাহেবের জীবন, বা জীবনের একটা পর্ব ঘিরে ভারতীয় ফুটবলের মোটামুটি ১০ বছরের (১৯৫২ থেকে ১৯৬২) একটা ঐতিহাসিক গ্রাফ তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। মানে হেলসিঙ্কি-র ১০ গোলের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে সোনালি আলোকের এই ঝরনাধারা। তার মানে দুনিয়াভর স্পোর্টস ফিল্মের ফর্মুলায় সেই চিরকেলে ব্যর্থতার অপমানে খান-খান হওয়া থেকে, ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠে তৃপ্ত, দৃপ্ত, হাত-মুঠো। কিন্তু এই ফর্মুলার ছাঁচে ব্যক্তি রহিমসাহেব আর ভারতীয় ফুটবলের ফুটন্ত ইতিহাসকে ঢালতে গিয়ে ময়দান-এর গড়নেই গলদ হয়েছে। আর ফোকাসটাও গেছে ঘেঁটে। ছবিতে ভারতীয় ফুটবলের ঐতিহাসিক ফ্রেমে রহিমসাহেবের ব্যক্তিগত জীবনের ছবি বাঁধানো থাকবে, নাকি সৈয়দ আবদুল রহিমের জীবন-সাইকেলে চলতে-চলতেই ওই সময়ের দেশি ফুটবলের মানচিত্রে নজর বুলিয়ে নেওয়া হবে, এই টানা-পড়েনটা চিত্রনাট্যে থেকেই গেছে। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের একটা মেধাবী সমাধান হতে পারত পর্দায় সদ্যস্বাধীন দেশের নেশন-নির্মাণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলের যোগসূত্রটা খুঁজে বার করা। সেই ময়দানি ‘ভারত এক খোঁজ’-এর মলাট হতে পারতেন রহিমসাহেব। পণ্ডিত নেহরুর বহুত্ববাদী নেশন-ভাবনার সঙ্গে এই হায়দ্রাবাদি ধর্মভীরু, কিন্তু উদার, সেকুলার সংখ্যালঘু ভদ্রলোকটির মিলজুল অনেক। সেগুলোর সুলুকসন্ধান চলতে পারত। কিন্তু মোদীজির এই ভারতে বনি কাপুরের রিসার্চ-টিম আর চিত্রনাট্যকারেরা খামোকা অত ঝকমারিতে যাবেন কেন? তাতে বাণিজ্যিক ঝুঁকিও অনেক। তাই তাঁদের হাতে শেষ অবধি ‘ভারতমাতা কি জয়’-গোছের গনগনে জাতীয়তাবাদের পেনসিলটুকু ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকে না। ফলে ওই জাতিবিদ্বেষী জুতোর ফিতে বাঁধাবাঁধি আর স্বভাব-গম্ভীর রহিমসাহেবের জবানিতে ওই চটুল ডায়লগবাজি!  

    গোটা ছবিতে রহিমসাহেব সারাক্ষণ একটা বিছিন্ন দ্বীপের মতো একলা জেগে রইলেন। একা-একাই ভাবলেন, একা-একাই সইলেন! কখনওই টিমের সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগটা খুঁজে পাওয়া গেল না। আমরা বুঝতেই পারলাম না কোন সে ম্যাজিক, যার সম্মোহনে এশিয়াডে সোনা জয়ের প্রায় ৬০ বছর পরেও রহিমসাহেবের স্মৃতিচারণ করতে বসে পিকে-বলরাম-রা আবেগে আপ্লুত হয়ে যান।

    ‘ময়দান’-এর নির্মাতারা খুব হিসেব কষেই ইন্টারভ্যাল অবধি, বা বলতে গেলে ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে ফ্রান্সের সঙ্গে ১-১ ড্রয়ের ম্যাচ পর্যন্ত, ফুটবলের সঙ্গে দেশপ্রেমের গাঁটছড়া বাঁধার গ্রাউন্ড-ওয়ার্কটা চালিয়ে গেছেন। ফুটবল যেহেতু ভারতের জনপ্রিয়তম খেলা নয়, এমনকি এত বড় দেশের গোটা কয়েকটা পকেট ছাড়া সেভাবে জনতার প্রাণের খেলাও নয়, এখন বলিউডের নিয়মিত দর্শকের যেহেতু ফুটবল-খেলা টিম ইন্ডিয়ার হয়ে গলা ফাটানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাই মেলবোর্ন, রোমে দেশপ্রেমের ছোট-ছোট ডোজে অভ্যেস করিয়ে নেওয়া দরকার ছিল। কারণ ছবির দ্বিতীয়-অর্ধের পুরোটা জুড়েই তো সেই সোনার আখরে লেখা ফুটবল-পুরাণ। ১৯৬২-র জাকার্তা এশিয়ান গেমস, তার প্রস্তুতিপর্ব, অনেক আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়িয়ে, বাধাবিপত্তির হিমালয়-ভারত মহাসাগর পেরিয়ে জাকার্তা-যাত্রা ও গোটা ইন্দোনেশিয়া জুড়ে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ, স্টেডিয়াম-ভর্তি উন্মত্ত জনতার উত্তাল হিংস্র স্লোগানকে উপেক্ষা করে তেরঙ্গা ঝান্ডার পতপত সাফল্য— সব মিলিয়ে জাতীয়তাবাদী মেলোড্রামার চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স। এতদিন পর্দায় ভারতীয় ক্রিকেট-হকি-বক্সিং-কুস্তি, এমনকি ব্যাডমিন্টন-অ্যাথলেটিক্স-এর জন্য গলা-ফাটানো পাবলিকের চোখের সামনে প্রথমবার ফুটবলের রঙিন রূপকথার দুনিয়া খুলে যাচ্ছে। তার একটা জবরদস্ত সেলিব্রেশন হবে না? সেজন্যই তো আগে থেকেই দেশপ্রেমের যেখানে যেটুকু খুদকুঁড়ো-বারুদগুঁড়ো জড়ো করে, ফাইনালে মোক্ষম বিস্ফোরণের আয়োজন।  

    কিন্তু ‘ময়দান’ কি শেষ পর্যন্ত সেই দেশপ্রেমের বিস্ফোরণ বা উদ্‌যাপন, কোনওটাই ঘটাতে পারল ঠিকঠাক করে? সমস্যাটা তো সেই ফোকাসের। পাশাপাশি, নির্মাতাদের আরও একটা গোপন ‘অ্যাজেন্ডা’ আরও বেশি করে গোল পাকিয়েছে। ‘ময়দান’-এ শুরু থেকেই কোথাও রহিমসাহেব, নেশন ভারত, জাতীয় সংহতির আবেগ বনাম ভদ্রলোক বাঙালির ছেঁদো-পাতি-সংকীর্ণ মানসিকতা এবং চক্রান্ত, তথা ছিঁচকে ম্যানিপুলেশন-প্রবণ, খণ্ড- জাতীয়তাবাদকে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবিতে তথ্যের যতটা গণ্ডগোল, তার পিছনেও এই রাজনীতিই দায়ী। সেজন্যেই ছবির দুই প্রধান খলনায়ক বেচু দত্তরায় মার্কা একজন বাঙালি ফুটবলকর্তা, এবং একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি কাগজের সবজান্তা বাঙালি সাংবাদিক। ক্রীড়া-সাংবাদিক হলেও কলকাতায় রাজভবনের পার্টি থেকে দিল্লির নর্থ ব্লক— তিনি সর্বত্র অবাধ বিরাজমান। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় থেকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই, সবাই তাঁকে খাতির করেন। আবার এশিয়ান গেমস কভার করতে গিয়ে তিনি স্টেডিয়ামে রঙিন পানীয়ের গ্লাসে চুকুস-চুকুস চুমুকও মারেন। এমন সর্বশক্তিমান ক্রীড়া-সাংবাদিক সেই আমল হোক বা এই আমলেও, কোথায় মেলে কে জানে! তা যাই হোক, এই ভিলেন বঙ্গ-ব্রিগেড, ফেডারেশনের মিটিংয়ে বা কাগজের রিপোর্টিংয়ে বার বার রহিমসাহেবকে বাংলাবিদ্বেষী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তিনি কলকাতার ছেলেদের উপেক্ষা করে হায়দ্রাবাদি ফুটবলার দিয়ে জাতীয় দল ভর্তি করতে চান, এমন অভিযোগ তোলা হয়। উলটোদিকে চিত্রনাট্যে রহিমসাহেবকে দিয়ে ভিকটিম-কার্ড খেলানো হয়েছে। বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-পীড়িত-উপেক্ষিত সাচ্চা দেশপ্রেমিক নায়ক রহিম, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও ধান্দাবাজ প্রাদেশিক বাঙালি ফুটবল কর্তাদের চোখে চোখ রেখে বলতে পারেন— ‘আমি ভেবেছিলাম এখানে হিন্দুস্তানের কথা হবে, কিন্তু আপনারা তো বাংলা বনাম হায়দ্রাবাদের ঝগড়াতেই আটকে রইলেন।’

    ‘ময়দান’-এর রহিমসাহেব প্রেমিক-স্বামী, স্নেহময় পিতা, মাতৃভক্ত সন্তান— এক কথায় আপাদমস্তক ঘরোয়া, পারিবারিক মানুষটা যখন ফুসফুসের ক্যানসার নিয়েও আক্ষরিক অর্থেই মুখে (বা রুমালে-বেসিনে) রক্ত তুলে ভারতীয় ফুটবলকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিলেন, ফুটবলের জন্য বলতে গেলে প্রায় শহিদ হলেন, সপসপে সেন্টিমেন্ট আর আবেগে ভেজা তাঁর জীবন-আখ্যান দেখতে দেখতে দর্শকের চোখের কোণে বাণ ডাকতেই পারে। এমনকি সিনেমা-ঘরের এই প্রতিবেদকের পিছনের রো-এর একজন উত্তেজিত, উদ্দীপিত দর্শকের মতো মনে হতেই পারে, ‘দেখেছ, ভারত সব পারে!’ কিন্তু তাঁর ‘কামব্যাক’-কে আলোকিত-মহিমান্বিত করার জন্য রহিমসাহেবকে এতটাই কোণঠাসা, আক্রান্ত দেখানো হয়েছে, তাতে কোচ-ফুটবল প্রশাসক হিসেবে তাঁর অনেক কীর্তিই ঢাকা পড়ে গেছে। যেমন রহিমের কোচিংয়ে হায়দ্রাবাদ পুলিশ দলের টানা পাঁচ বছর (১৯৬০-’৬৫) রোভার্স কাপ জয়ের অক্ষয় রেকর্ড, ১৮১ মিনিটের এই ফুটবল মহাকাব্যে উপেক্ষিত। যেমন রহিমসাহেবকে ফেডারেশনের কনফারেন্স ঘরের বাইরে ফেকলুর মতো টুলে-বেঞ্চে বসিয়ে রাখতে হবে বলে, হায়দ্রাবাদ-অন্ধ্রপ্রদেশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে তাঁর পরিচয় বা ভূমিকাটাও আড়ালে রাখা হয়েছে।

    এখন এগুলো কতটা গবেষণার ফাঁকফোকর, আর কতটা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস-সংস্কৃতির প্রতি বলিউড-সহ আমাদের স্বদেশি-কর্পোরেট পুঁজির উপেক্ষা আর উদাসীনতা, সেটা বলা মুশকিল। যেমন চুনী গোস্বামী প্রদীপ ব্যানার্জিকে ‘পিকে-দা’ বলে ডাকছেন, এটা অবশ্যই রিসার্চ-টিমের মহা-মূর্খামি! কিন্তু ১৯৬২-র এশিয়াড দলের অধিনায়ক চুনীকে যখন একজন সুখী, শৌখিন (ফুটবল মাঠের ভাষায় ‘ফ্যান্সি’), অনেকটাই অকার্যকারী বল-প্লেয়ার হিসেবে দেখানো হয়, তখন সেখানে একটা বিশেষ মতলবের গন্ধ পাওয়া যায়। সিনেমায় আমরা যে চুনী গোস্বামীকে দেখি তিনি পরিশ্রম-বিমুখ, মোটেই টিমম্যান নন। ব্যক্তিগত স্কিলের দিকেই তাঁর ঝোঁক! হাততালির  লোভে বেশিক্ষণ পায়ে বল রাখেন, গোলকিপারকেও কাটিয়ে, গোললাইনে বল রেখে ব্যাকহিলে গোল করেন— এমনকি আন্তর্জাতিক ম্যাচেও! এটা তো ভুল গবেষণা নয়, বরং ইচ্ছে করেই কলকাতার ফুটবল-চর্চা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরির চেষ্টা। এই তথ্য-বিকৃতির ফাঁদে পড়েই এশিয়াডের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে দুর্ধর্ষ খেলা মিডফিল্ডার প্রশান্ত সিন্‌হাকে সিনেমার মাঠেই নামানো হয় না। গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচ ছাড়া গোটা টুর্নামেন্টে দুরন্ত গোলকিপিং করা প্রদ্যোৎ বর্মণের কৃতিত্বকেও তাঁর উচ্চতার মতোই খাটো করে দেখানো হয়।

    আসলে নাটক জমানোর জন্য ছবিতে প্রাদেশিক বাংলা বনাম রহিমসাহেবের ভারত-চেতনার ঠোকাঠুকি বানাতে গিয়ে, দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কোচের ইউএসপি-গুলোই বাদ পড়ল। গোটা ছবিতে রহিমসাহেব সারাক্ষণ একটা বিছিন্ন দ্বীপের মতো একলা জেগে রইলেন। একা-একাই ভাবলেন, একা-একাই সইলেন! কখনওই টিমের সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগটা খুঁজে পাওয়া গেল না। আমরা বুঝতেই পারলাম না কোন সে ম্যাজিক, যার সম্মোহনে এশিয়াডে সোনা জয়ের প্রায় ৬০ বছর পরেও রহিমসাহেবের স্মৃতিচারণ করতে বসে পিকে-বলরাম-রা আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। ‘ময়দান’ ছবির রিসার্চ টিম আমাদের এই তথ্যটা জানাতেই পারল না যে, ১৯৬২-র জাতীয় ফুটবল দলের থিম সং ছিল— লখনউ প্রবাসী বাঙালি কবি-গীতিকার-সুরকার-সঙ্গীতবিশারদ বাবু অতুলপ্রসাদ সেন-এর ‘বল বল বল সবে’! এশিয়াড ভিলেজে, টিম বাসে, ড্রেসিংরুমে বাঙালি-অবাঙালি সমস্ত খেলোয়াড় যে যার নিজস্ব উচ্চারণে গলা ছেড়ে গাইতেন— ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’! মাঝে মাঝে তাতে গলা মেলাতেন স্বয়ং রহিম সাহেবও! ক্ষুদ্র, খণ্ডিত প্রাদেশিকতার রাজনীতি করতে গিয়ে সিনেমার ময়দানে খুন হয়ে গেল টিম ইন্ডিয়ার সংহতির আসল স্পিরিট!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook