ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ৬


    শুভময় মিত্র (September 10, 2021)
     

    সুপারমার্কেট

    তুমি তো গেছ আগে। ব্যাপারগুলো জানো। পাসপোর্টও আছে, এক্সপায়ারিটা দেখে নিও। আর ওখানে তো ইংরিজি। আমি জানি তুমি কিস্যু করছ না। কোনওদিন চাকরি করলে না, তা ভি.আর.এস. নিলে কী করে? এক কাজ করো, চলে যাও।’ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে উনি যে এরকম একটা কিছু বলবেন, ভাবতেই পারিনি। কোথায় যাব, কেন যাব এসব জিজ্ঞেস করলাম না, বলবেন নিশ্চয়ই। উনি দারুণ লোক, আমার বন্ধুর বাবা, প্রচুর পয়সা। কিন্তু ভোঁদাই বড়লোক নন। এখনও গ্লাইডার বানান। ঝকঝকে চেহারা। কখনও জেঠু, কখনও কাকাবাবু বলি। আমাকে একদিন নিজের হাত দেখিয়ে বললেন, ‘লেদারটা দ্যাখো, এই কোয়ালিটি পাবে না বাজারে।’ আমার খুবই ইচ্ছে করে ওঁর কাছে যেতে। কিন্তু ভয় করে। বাপ-ছেলের সম্পর্ক খুব সুবিধের নয়। ওঁর বাড়ি গেলে আমার বন্ধুর সঙ্গে একটু গেঁজিয়ে কেটে পড়ি। আমার সম্পর্কে ওঁর কিছুই জানার কথা নয়। ‘হিথরো থেকে লিভারপুল ঘণ্টা ছয়েক, তারপর ওয়েস্ট কার্বি আর বেশি না। চারশো সাঁইত্রিশ নম্বর ডাবল ডেকার বাস, সবুজ রঙের। অ্যারাইভা কোম্পানির। চাবি খুলে সোজা ঢুকে পড়বে, সব আছে, অসুবিধে হবে না। ভিসা, টিকিট করে দিচ্ছি। এমিরেটসই ভাল। ক্যাশ দিয়ে দেব। ফোনটা ইন্টারন্যাশনাল রোমিং করে দিচ্ছি। ওখানে বেনেট আছে, বেনেটের ছেলে বনেট, নাতি সেনেট। বলা থাকবে, ইচ্ছেমতো যা দরকার নিয়ে নেবে। লিভারপুলে অবশ্যই যাবে। বিটল্‌সদের জায়গা, পুণ্যস্থান। আরও অনেক কারবার আছে ও তল্লাটে, বলে দেব।’ পাড়ার মোড় থেকে পাঁউরুটি কিনে আনার মতো সহজেই বলে দিলেন এসব। আমিও বলে দিলাম, ঠিক আছে। নিজের ছেলের বদলে আমাকে বিলেতে পাঠিয়ে ওঁর কী সুবিধে হবে জিজ্ঞেস না করে, ওখানে গিয়ে কী কী করব তার মতলব ভাঁজতে লাগলাম। এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করার পয়সা দেবেন নিশ্চয়ই, খেতে আর কীই-বা খরচ! থাকা ফ্রি। আজকের ইংল্যান্ড অনেক সময় আমাদের লেক মার্কেটের চেয়েও সস্তা, এটা জানতাম। আমার জবরদস্ত ডাক্তার বন্ধুরাও আছে আশেপাশে। এককালে বহু কষ্ট করে শেষপর্যন্ত জাঁকিয়ে বসেছে। ছবির মতো বাড়ি, গাড়ি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সায়েবরাও মুখ ঘুরিয়ে দেখে। গতবার ওরাই জবরদস্তি করে আমাকে ধরে এনেছিল, পুজোর সময়। একদিকে যেমন খারাপ, অন্যদিকে আমার কপাল সাংঘাতিক ভাল। নিজেই নিজেকে হিংসে করি মাঝে মাঝে। ওদের আগে থেকে বলব না, গিয়ে চমকে দেব, ‘কী রে, আছিস নাকি? তা’লে থাক। আসছি।’ ‘কে আছিস, সায়েবকে নকুড়ের সন্দেশ দে’ বলে চলে গেলেন উনি। আমার কোনও উত্তেজনা হচ্ছিল না। 

    দুবাইতে কাস্টমসের লোকগুলো আগের মতোই অভদ্র আছে, মাথা দিলাম না। একবার কাঁচের ওপারে চলে গেলে আর ঝামেলা নেই। চ্যানেল পেরোলেই সায়েবদের দেশ, ভদ্দরলোকের জায়গা। বারবার নিজের পকেটে হাত দিচ্ছিলাম। যে কাগজগুলোর একটাও হারালে আমি মরুভূমিতে শুকিয়ে মরব, সেগুলো নিয়ে অযথা টেনশান করছিলাম। আপত্তি করা সত্ত্বেও একটা ক্রেডিট কার্ড গুঁজে দেওয়া হয়েছে, সেটাও আঙুলে ঠেকল। অ্যাসাইনমেন্ট কী? ওঁর বাড়িটা ভাল করে চেক করে, সবকিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করে সাজিয়ে, বিছানার চাদর টান টান করে, টুকটাক কিছু জিনিস আছে, সেগুলো প্যাক করে নিয়ে আসতে হবে। ফেরার টিকিট কাটা আছে, চাইলে পিছোতেও পারি। উনি আসবেন পরে। সেইজন্যে আমার মতো বিশ্বাসভাজন কাউকে উনি পাঠিয়েছেন এত খরচ করে। খরচের ব্যাপারটাই খচখচ করছে। যদিও ওঁর কাছে এটা কোনও টাকাই নয়। আমারও ক্রেডেনশিয়াল কম নয়। গ্লানিময় কর্মহীনতা না থাকলে আমাকে বলতে পারতেনই না। দুবাই-হিথরো প্লেনের চাল বদলে গেল। মেমসায়েব এয়ার-হোস্টেস এসে আমাকে বলল, ‘আপনাকে বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে দিয়েছি।’ জীবনে এত মার খেয়ে ফেলেছি, জানি আরও খাব, আর হেলমেট লাগবে না, খেতে খেতে মাথায় কড়া পড়ে গেছে। দুঃখ-আনন্দ কিছুই হয় না, সবই ভাল লাগে। নতুন সিটে ম্যাসাজ করার যন্ত্র লাগানো আছে, চালু করে দিলাম। পা ছড়ানোর জায়গা এত বেশি যে, পা ফুরিয়ে যাচ্ছিল। ড্রিঙ্কস নিলামই না, ওনলি নাট্‌স। লোভের পঁয়ত্রিশ হাজার ফিট ওপর দিয়ে যাচ্ছি। যা স্পিড, সাধারণ পেঁচোমি আমাকে তাড়া করেও কিস্যু করতে পারবে না। ইন-ফ্লাইট ম্যাগাজিনে নতুন আলফা রোমিওর দাম দেখতে লাগলাম। হিথরো-তে ইমিগ্রেশন কী যে ভাল ব্যবহার করে বিলেতে টেনে নিল, কী আর বলব! শেষ টেনশন, কোনও টেনশন নেই, মোবাইল এখন ফাটিয়ে রোমিং। লিভারপুলের বাসে চেপে জর্জ হ্যারিসনের ‘হিয়ার কামস দ্য মুন’ শোনার ইচ্ছে হল। একটু শুনে বন্ধ করে কোক-স্টুডিওতে কৌশিকী। বাড়ি পৌঁছে একবার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, চাবিটা এনেছি তো?

    আজকের ইংল্যান্ড অনেক সময় আমাদের লেক মার্কেটের চেয়েও সস্তা, এটা জানতাম। আমার জবরদস্ত ডাক্তার বন্ধুরাও আছে আশেপাশে। এককালে বহু কষ্ট করে শেষপর্যন্ত জাঁকিয়ে বসেছে। ছবির মতো বাড়ি, গাড়ি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সায়েবরাও মুখ ঘুরিয়ে দেখে। গতবার ওরাই জবরদস্তি করে আমাকে ধরে এনেছিল, পুজোর সময়। একদিকে যেমন খারাপ, অন্যদিকে আমার কপাল সাংঘাতিক ভাল।

    সব ঘরে ঘুরে-ঘারে বুঝলাম, ঘণ্টাখানেক ভ্যাকুয়াম ক্লিন ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ছবির মতো সাজানো সব। এই যেন এক্ষুনি কাকাবাবু ঢুকে বলবেন, ‘এম ওয়ানে জ্যাম পাওনি তো?’ ওঁকে জানানোই হয়নি যে, পৌঁছে গেছি। জানলা খুলে দিলাম, ঠান্ডা আছে। মনে হল একটু দূরে জল, রাতের জাহাজ যাচ্ছে নাকি? সঙ্গের হাবিজাবি খাবার দিয়ে চালিয়ে দিলাম। সোফাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই নেই। সকালে পর্দা সরাতেই ঝকাস এয়ার কন্ডিশন্ড রোদ। মেরিন লেক। তারপর ডি নদী। তারপর আইরিশ সি। ফোনে গুগল ম্যাপ আমাকে আকাশে তুলেছে। আরও দূরে আইল অফ মান। তারপরেই আয়ারল্যান্ড। বিক্রম-বিদিশার ডাবলিন। দেখেশুনে সিগালের মতো পাখা নামিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলাম। খিদে পেয়েছিল। সকালের ব্রেকফাস্টটা ভাবিনি, ফ্রিজে কিছুই থাকার কথা নয়। কলকাতায় আড়মোড়া ভেঙে, ‘অ্যায়, চা দিচ্ছে না ক্যানো’ বলা অভ্যেস। রাস্তায় নামলাম, অল্প লোকজন। কেউ জগিং করছে, কেউ এমনি হেঁটে যাচ্ছে। দশটার শেয়ালদা নয়। এরা বোধহয় আমারই মতো, কাজ নেই। তাই প্রফেশনাল হ্যাজার্ডও নেই। কারুর সঙ্গে চোখাচোখি হলে একটু হেসে দেখা হওয়াটা অ্যাকনলেজ করে। একজন তো হাতও তুলল। পেছনে ঘুরে দেখলাম, অন্য কাউকে নিশ্চয়ই। কিছু একটা ভয় হচ্ছিল, কী যেন একটা লুকোচ্ছিলাম। আমি আসলে কে, কেউ যেন বুঝে না ফেলে। সুপারমার্কেট এসে গেল, মরিসনস। এখানেই কফি-স্যান্ডউইচ মেরে দেব, রান্নার বাজারও করে নেব। আর গাঁইয়াদের মতো বারবার পাউন্ড থেকে রুপিয়া গুণ করব না। সামনে বিশাল কার পার্ক, আগেরবার লেস্টারের অ্যাজডায় পৌঁছে ভেবেছিলাম গাড়ি বিক্কিরি হচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই আরাম, গরম। সাইকেল, সুটকেস, গার্ডেন গাছ চোখে পড়ল। সামনে সবথেকে সস্তায় ভাল-ভাল দুধ ডিম বেকন আলু গ্যালাপ্যাগোসের কাঁঠাল সাজানো আছে। প্যাক করা। এটা এই দিনের, এই মুহূর্তের দাম। রাতে আরও কমতে পারে। ডিল খেয়াল রাখতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিক্রি। পচা মাল গছানোর দেশ নয়। টিপে দেখলাম, দিব্যি টাইট লাল টমেটো। যা পড়ে থাকে তা বার্ধক্যের অনেক আগে, প্রাণ থাকলেও, প্রৌঢ়ত্বের শেষ প্যারাগ্রাফ পেরোনোর আগেই ডিলিট হয়ে যায়। হয়ে কোথায় যায়?

    ম্যাপ দেখে বেনেটদের বাড়িতে ঢোকার আগে রাস্তায় একটা ভিন্টেজ গাড়ি দেখতে পেলাম, তলা থেকে তিন জোড়া পা বেরিয়ে আছে তিন দিকে। সারাচ্ছে বোধহয়। এটাই বেনেটদের বাড়ি কি না সেটা জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি হচ্ছিল, মুখ দেখতে না পেলে কি কথা বলা যায়? তলা থেকেই ডাক এল, ‘কাম ইন।’ চারপাশে কেউ নেই। আবার, ‘কাম অন।’ হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম। বুঝলাম ঠিক জায়গাতেই এসেছি। বনেট বলল, ‘দিস বিচ গট সাফিশিয়েন্টলি স্ক্রুড। বাট শি উইল ড্যান্স সুন।’ আরও এক-আধটা কথা এগোনোর পর, নিজেরাই বলল, বুঝলাম পুরনো গাড়িকে রিস্টোর করে এরা। গাড়ির তলা থেকে আধা-আধা দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। মালিকের সঙ্গে বেড়াতে বেরোনো কুকুর একটু খোঁজ নিল এদিকে। খুব শিগগির এরা কেউ এখান থেকে বেরোবে বলে মনে হল না। টাকা লাগলে আমি পেয়ে যাব সেটাও বলে দিল। কফি খেতে ডাকল না। আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেসও করল না। এদেশের এটা একটা ভাল ব্যাপার। ফের রাস্তায় উঠে দাঁড়ানোর সময় শুনলাম, এই গাড়িটার নাম সানবিম ট্যালবট। চেনা ঠেকল। এই মুহূর্তে গাড়িটা কতটা জীবিত আমার বোঝার অভিজ্ঞতা নেই। গোবদা চেহারা, চকচকে গা। সুনন্দর দিদি মারা যাওয়ার পর শ্মশানে দেখেছিলাম, মুখ-চোখ দিব্বি সতেজ, ঘুমোচ্ছে যেন। ভ্যাগ্যিস গাড়ির প্রাণ হয় না! তাই হয়তো বাঁচানো যায়। ভুল ভাবলাম, প্রাণ আর মনের মাঝখানে কী একটা ব্যাপার আছে। অসসিলেটর জাতীয়। ওটা আছে বোঝা যায় না, কিন্তু আছে। এই যে চারপাশে একটাও লোক নেই, সাদা-সাদা পরিপাটি ঢালু ছাদের বাগান বাগান বাড়ি— মডেল তো নয়, লোক আছে। কাঁচের মধ্যে দিয়ে আমাকে দেখতে-দেখতে কেউ হয়তো বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে। বা স্যালাড বানাচ্ছে। ইমেল চেক করছে। অথবা মন খারাপ করে অনেকদিন কোনও কথা বলেনি, আজও বলছে না। সূর্য কিছুটা মাথার ওপর চড়েছে, গরম তো নেইই। গাড়ির তলার ছায়া আর আমারটা জুড়ে ছিল এতক্ষণ, এবারে বিচ্ছিন্ন করে এগোলাম গুটিগুটি। কোথাও যাবার নেই, বাড়িতেও কাজ খুঁজে পাইনি কিছু, তাই বলে ওদের স্পেসে বেশিক্ষণ থাকাটা শোভন নয়। এই ব্যাপারটা আমি বুঝি, আমাদের দেশে এটা হয় না। দেখা করতে রাজি না হলে লোকে ফোনে বকে-বকে ই.এন.টি. জ্যাম করে দেয়। কেউ নেই আর একবার দেখে নিয়ে একটা মানি প্লান্টের মতো লতা ছিড়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেললাম সঙ্গের ব্যাগে।

    ঘরদোর তো একদম স্পিক অ্যান্ড স্প্যান। বুকশেল্‌ফ, ওয়াইন ক্যাবিনেট সুসংহত। তলায় ওয়াইন সেলার, পরপর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব শায়িত। একটা স্বদেশি ওল্ড মঙ্ক দেখে প্রাণ নেচে উঠল। খাব না মোটেই। কোনওটাই ছোঁব না। যে-কাজে এসেছি সেটা প্রথমে হোক। এদিকে পর্দার কুচি পরিপাটি। এদেশে ঝুল জমে না। ফুলে বি বসে, গায়ে মাছি বসে না। তাহলে কি ওয়ার্ডরোব, আলমারি খুলব? কাচাকাচি করব? জেনারেল পারপাস লিকুইড সোপ আর স্ক্র্যাবারটা কোথায় ব্যবহার করব মাথাতেই আসছে না। ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না। হাঁটতে-হাঁটতে ওয়েস্ট কারবি রেলস্টেশনে পৌঁছে গেলাম। এখানেও কেউ নেই। প্ল্যাটফর্ম টিকিট না কিনে এমনি ঢুকলে পুলিশ ধরবে কি না কে জানে! ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে একা-একা। লোকাল। হলুদ রং। একটু যেন ময়লাপানা। কামরায় ঢুকলাম, ফেলে দেওয়া খবরের কাগজ পেয়ে তুলে নিলাম। ‘সান’। ইংল্যান্ডের কুখ্যাত ট্যাবলয়েড। সামনে প্রায় অসভ্য ছবি। এটাও এদেশের একটা ভাল দিক, ছুঁৎমার্গ নেই। কিছু খালি বিয়ার-ক্যান গড়াগড়ি খাচ্ছে। ট্রেন থেকে নেমে লাইন ধরে হাঁটলাম সিগন্যাল অবধি। সবুজ হয়ে আছে। আরে বাবা একটাও যাত্রী নেই, কাকে যেতে বলছে? কেন যাবে? এই তো শুনছি দেশের হাল খারাপ। ব্রেক্সিটে বিচ্ছিরি অবস্থা ইকোনমির। মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস। বুঝি না কিছু, এসব সত্যি না মিথ্যে। আমাদের দেশেও ঝুড়ি-ঝুড়ি গরিব লোক। খেতে পায় না বললে ভুল হবে। অনাহারের ভয়ে মরেই গেছে, আজকাল নিজেকেও মেরে ফেলছে। আবার স্লামের সামনে রেললাইনের ধরে বসে লোকজন ফোনে কীসব দেখে আর হ্যা হ্যা করে হাসে। বেজায় উঁচু বড় গাড়ি চড়ে অনেকেই যায় সিটে ডুবে-ডুবে। আবার আমার মতো লোকও আছে। এদেশে যা দেখছি, যদিও এ দেখার কোনও সারবত্তা নেই, সবার এক বাড়ি, গাড়ি, চেহারা। সবাই সায়েব। অনেকেই মেম। অনেককে দেখে সন্দেহ হয়, এরা বোধহয় এক ধরনের কালো। কত মিলিয়ন শেডস অফ গ্রে, ব্রাউন, হলুদ, সবুজ, ওরাং ওটাং ভরা ব্রিটিশ দুনিয়া। তবে বদলেছে নিশ্চয়ই। রমরমার সময়, যখন সব দেশে এরা উপনিবেশ গড়ছে, নিজেরাই নিজেদের সবকিছুকে গ্রেট নাম দিয়ে দিত। যেটুকু শুনেছি, যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত জার্মানি এখন ঝিনচ্যাক। ইউ কে কি এখন রিগ্রেট করে?

    আমাদের দেশেও ঝুড়ি-ঝুড়ি গরিব লোক। খেতে পায় না বললে ভুল হবে। অনাহারের ভয়ে মরেই গেছে, আজকাল নিজেকেও মেরে ফেলছে। আবার স্লামের সামনে রেললাইনের ধরে বসে লোকজন ফোনে কীসব দেখে আর হ্যা হ্যা করে হাসে। বেজায় উঁচু বড় গাড়ি চড়ে অনেকেই যায় সিটে ডুবে-ডুবে। আবার আমার মতো লোকও আছে।

    বন্ধুদের ফোন করলাম না। থাক। যদি বলে, ‘উইল ক্যাচ আপ সুন’, তারপর আর ফোন না করে? অথবা যদি বাড়িতে না ডেকে পাবে নিয়ে গিয়ে স্কচ খাওয়ায়? যদি দামি উপহার দেয়? যদি বলে, ‘তুই এখানেই থেকে যা, ও দেশ তোর না।’ ভেবেই ভয় করতে লাগল। জোড়া রেল-ট্র্যাকের মধ্যে সিগন্যাল পেরিয়ে বহুদূর অবধি চলে যাওয়া ইঞ্জিন থেকে পড়া পোড়া তেলের দাগ দেখে একটু শান্ত হলাম। যাক, এ দেশ পুরোপুরি স্টেইনলেস নয় তাহলে। আবার রাস্তায় ফিরলাম। অনেক দোকানের ওপর লেখা আছে ‘বুক মেকার্স’। প্রথমবার ভেবেছিলাম, শিক্ষিত পশ্চিম, বইয়ের কদর আছে। পরে জেনেছিলাম ঘণ্টা! ওগুলো জুয়ার ঠেক। বুকি। সারাক্ষণ দোকানের কাঁচে নিজের মুখ দেখতে আর ভাল লাগছিল না। মরিয়া হয়ে বাড়ি চলে গেলাম। রান্না করা দরকার। যে কাজে আমাকে পাঠানো হয়েছে, তা খুঁজে বের করতেই হবে। এতক্ষণ পরে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হল। এখানে অনেক দাম, তাই নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। তন্নতন্ন করে ব্যাগ খুঁজতে লাগলাম। না পেয়ে মনের জোর বাড়ল। সারাটা ফ্ল্যাট খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। খুঁত খুঁজতে লাগলাম। সব সালটে দেব দু’দিনের মধ্যে। তারপর লিভারপুলের মডেলজোন-এ গিয়ে খেলনা ট্রেন দেখব। নেট দেখে-দেখে দাম মুখস্ত, কেনার চাপ নেই। পেনি লেনেও একবার ঢুঁ মারব। একটু পরেই ঘুম পেতে লাগল, জেট ল্যাগ হতে পারে। রান্না করা যায়নি। এখানকার ইন্ডাকশন অন্য রকম, পুরো রান্নার টেবিলটা গরম ক্যানভাস হয়ে ওঠে, তারপর অংশত সংবেদনশীল পাত্র চাপাতে হয়। চালুই করতে পারিনি। বন্ডেল রোডের অটো চালিয়ে কি আর বেন্টলি-র ইঞ্জিনে স্টার্ট দেওয়া যায়? বাংলা ইলেকট্রিক কেটলি পাওয়া গেছে, চা-কফি চলছে। অমুক মেকার তমুক মেকারে আমি ঢুকি না। ওঁর বেডরুমে আমি ঘুমোইনি, সোফা ঠিক আছে। একটু ঘুম নামা, একটু আধো জাগার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছিলাম রোদ্দুর ঘুরে যাচ্ছে। একটা কাঁচের ফুলদানিতে সেই মানি প্লান্টটা জলে ডুবিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। একা থাকতে ভয় করতে পারে, সেই ভয়ে। জানলা দিয়ে এসে, কাঁচের আবরণ পেরিয়ে, লতার শরীর ছুঁয়ে, কিছুটা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ বিকেলের রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে। ওদিকে, সাদা লেসবোনা টেবিলক্লথের ওপর লাউডগার মতো একটা সবুজ ছায়া আস্তে-আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে লতার শরীর ছেড়ে। 

    ইউরোপে আফ্রিকার মতো অন্ধকার নামে না বোধ হয়। থমকানো আধা-অন্ধকার রাস্তায় এক-আধটা গাড়ি, কোনও কোনও বাড়ির ছবির মতো জানলার পেছনে মৃদু আলো। শুধু পাবের সামনে সাইনবোর্ডের আলোর তলায় হুল্লোড় করছে কিছু ছোকরা-ছুকরি। আর সুপারমার্কেট। বন্ধ হয় না কখনও। অপেক্ষা করছে মস্ত স্পেসশিপের মতো। সব আলো জ্বেলে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। বাঁ-দিকের গেট দিয়ে ট্রাক ঢোকে, মাল আনলোড হয়। ডান দিকে ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা, তবে দরজাটা ছোট। এসব আমার জানা আছে। ওদিকেই এগোচ্ছি। কিছু একটা ঘটনা ঘটছে সেখানে। একটা মাঝারি ট্রাক গরগর করছিল, বেরিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করে। একটা আলোর আয়তক্ষেত্র আবার কালো হয়ে গেল। অনেক মানুষের গলার শব্দ। কাছে পৌঁছতেই একটা হুড়মুড় শব্দ, সঙ্গে হুটোপুটি। সেই ছোট দরজা ফের খুলেছে। কীসব যেন বেরোচ্ছে সেখান দিয়ে। ভিড়টা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেখানে। একজন তার মধ্যে থেকে একটা ভারী বস্তা টেনে বের করে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে চলে গেল। ফের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, ধাক্কাধাক্কি। আবার খুলল, আবার আলো, আরও কীসব উগরে দিয়ে একদম শাট ডাউন। প্রায় অন্ধকারে ভিড়টা শান্ত হয়ে এল। যে যা পেয়েছে, তার ভাগ-বাটোয়ারা চলছে। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা মেয়ে দৌড়ে এল, ‘হেই, সি হোয়াট আই গট’ বলেই জামা তুলে ফেলল। দেখি প্রচুর জমাট বাঁধা মাংস, প্যাকেটে ভরা, স্কার্ফ জাতীয় কিছু দিয়ে বাঁধা। ‘বাট ইউ গট নাথিং’ বলে কীসব আমার হাতে ভরে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অল্প সময়ে ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা। একটা-দুটো বুড়ো-বুড়ি, নড়বড়ে লোক আরও বেশি অন্ধকার জায়গাগুলোয় তখনও কীসব খুঁজে যাচ্ছিল। আমিও চলতে লাগলাম। রাস্তায় পর পর অনেকগুলো ফাটা ডিম পড়ে আছে। শেষপর্যন্ত আলোর তলায় পৌঁছে দেখি আমার হাতে বেশ কয়েকটা টোপা-টোপা আলুবোখরা। ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালা হয়নি। অন্ধকারে কয়েকদিনের চেনা ঘরটা মনে হচ্ছিল বার্গম্যানের ‘থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি’র শেষ দৃশ্যের সেট। মনে হয় সেটাও সত্যি নয়।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook