ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢাকা ডায়েরি: পর্ব ৭


    খান রুহুল রুবেল (September 10, 2021)
     

    কমলা চা আর ইলিশ

    শ্যাওড়া স্টেশনে নেমে হতাশই হতে হল। না আছে শ্যাওড়া গাছ, না আছে তাতে বসা কোনও শাকচুন্নি। বনানী সংলগ্ন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পার হয়েই দুরন্ত বাতাসের পথ, আর কিছু এগোতেই শ্যাওড়া। আমি যাব ডি.ও.এইচ.এস.। ধনীদের সুনিয়ন্ত্রিত আবাসন ব্যবস্থা। বড়লোকদের এলাকায় সবকিছু সাজানো গোছানো থাকে। এখানকার রিকশাগুলোতেও হুল্লোড় নেই, সার বেঁধে দাঁড়ানো। আমি আর আমার এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছি এখানকার রেললাইনের পাশে। আদতে রেলবাজার। রেলরাস্তার চারপাশে নুড়ি-পাথর। রেলের চলাচলের মধ্যে একরকম সমুদ্রের দোলা আছে। আর এই রেললাইনই এমন করুণ শহরে নুড়িপাথর বিছিয়ে রাখে। রেললাইন আসলে বহতা সমুদ্র।

    আমাদের দুজনের গন্তব্য ছিল আরেক বন্ধুর অফিস কাম বাসস্থান। সেখানে পুব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ থেকে আরও জমায়েত হবার জন্য মলিন অফিসব্যাগ কাঁধে করে রওনা হয়েছে অনেকেই। আমরা একটু আগে পৌঁছেছি। ডি.ও.এইচ.এস.-এ বন্ধুর অফিসে ঢুকেই মনে হল চিনদেশে এসে পৌঁছেছি। বন্ধু আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন। তাঁর অংশীদার একজন চিনা। বাকি সহযোগীরা চিনা নয়তো মঙ্গোলিয়ান। ফলে সমস্ত অফিস চিনা কায়দায় সাজানো। আসবাব পর্যন্ত চিন হতে আমদানি করা। আমার সবচেয়ে পছন্দ হল সোফাটা। সেটা এত বড় আর নরম যে, সটান বিছানা বানাতে কোনও বেগ পেতে হয় না। বাঙালি বসতে পেলে শুতে চায়। তাহলে বসার জায়গাকে আমি বিছানা ভাবব না কেন? কে না জানে যে, আলস্যই আমার মূল পেশা! আলস্য বাদে বাকি সময়টুকু আসলে আমার বিশ্রাম, অর্থাৎ, আমি যখন চলেফিরে বেড়াই, সেটা মূলত আমার অবসর!

    টেবিলের নীচের অংশটা লাইব্রেরি, বইয়ের নয়, চায়ের। অন্তত পনেরো পদের চা সেখান থেকে বের হল। এ সবই নাকি চিন দেশ থেকে আগত। সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয় যেটা, সেটাকে আর যাই হোক, চা ভাবার কোনও উপায় নেই। আদতে ছোট ছোট শুকনো কমলা। কমলা শুকিয়ে চায়ের গুঁড়ো তাতে পুরে দেওয়া হয়েছে। আস্ত কমলাটা গরম পানিতে ফেলে দিন, চা প্রস্তুত।

    আমি সোফায় শায়িত, বাকিরা অন্য সব জায়গায় বসে। কিন্তু বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা গেল না। বন্ধু সোফার সামনে রাখা টেবিলে কোথায় যেন একটা সুইচ টিপতেই টেবিল জ্যান্ত হয়ে গেল! সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়— ‘একি ভানুমতী! এ কি ইন্দ্রজাল।’ জ্যান্ত টেবিলের একদিকে দেখা যাচ্ছে একখানা চায়ের পাত্র। টেবিলের এক কোনা আসলে এক রকমের স্ক্রিন, সেখানে স্মার্টফোনের মতো নানা নির্দেশনা দেওয়া যায়। নির্দেশ পেয়ে টেবিলের একটা অংশ রূপান্তরিত হয়ে হল ওয়াটার হিটার। সরু কলের মতো একটা নল এসে আবার একটু পর পর সেখানে জলসিঞ্চন করে যায়। টেবিলের নীচের অংশটা লাইব্রেরি, বইয়ের নয়, চায়ের। অন্তত পনেরো পদের চা সেখান থেকে বের হল। এ সবই নাকি চিন দেশ থেকে আগত। সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয় যেটা, সেটাকে আর যাই হোক, চা ভাবার কোনও উপায় নেই। আদতে ছোট ছোট শুকনো কমলা। কমলা শুকিয়ে চায়ের গুঁড়ো তাতে পুরে দেওয়া হয়েছে। আস্ত কমলাটা গরম পানিতে ফেলে দিন, চা প্রস্তুত। সামনে আবার কী এক সরীসৃপের মৃৎশিল্প। চা খাবার আগে চিনা নিয়মমাফিক তাকে চা সাধতে হবে। কমলা আকারে ছোট, চায়ের পাত্র তার চেয়েও ছোট। এ পাত্রে কমলা ডোবাব কীভাবে মাথায় এল না। গৃহকর্তা জানালেন, ঘাবড়াও মাত! ও কমলা এমনিতেই গলে যাবে। ‘কমলা চা’ খাওয়া হল। প্রাকৃতিক হোক কি কৃত্রিম, এ-কথা নিশ্চিত যে, এমন জঘন্য চা আমি ইহজীবনে খাইনি। কিন্তু চায়ের কর্তা নাছোড়, চিন দেশে চায়ের নিয়মই নাকি এই যে, একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে চা খেয়েই যেতে হবে। দলের একজন চোখ-মুখ উলটে দু’কাপ খেলেন, আমি আধা কাপ। বাকিটা হাতের ধাক্কা লেগে (আদতে ইচ্ছে করে) টেবিলের ওপর পড়ে গেল। পুনরায় ভোজবাজি! টেবিলে পড়েই চা হাওয়া! টেবিলের নীচে নাকি কী ব্যবস্থা করা আছে, যত তরলই ওর ওপর ফেলো, বেমালুম গায়েব করে দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, আমরা চা বানাচ্ছি ও টেবিলের ওপর একে একে ঢালছি। চিন দেশের চায়ের এমন অপমান চিনারা মেনে নিতেন কি না জানি না, গৃহকর্তা বন্ধু যে মানলেন না, সেটা তাঁর চেহারাতেও বোঝা গেল। তবে, তিনি হতাশ করলেন না। খানিক বাদে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে যে সিঙারা এল, তাঁর এক একটার আকৃতি মৌলভীবাজারের টিলাকে হার মানায়। সাথে অন্য ভাজাপোড়া ‘সুখাদ্য’। একটু পর পানীয় সহযোগে মঙ্গোলীয় সহযোগী হাজির। তাঁর নুডলস-বধ (আড়াই মিনিটে যে কিনা পেল্লায় এক থালা নুডলস সাবড়ে দেয় তাকে ভক্ষণ না বলে বধ বলাই শ্রেয়) এক দেখার মতো বস্তু। তিনি অন্তত তিন থালা নুডলস, ভর্জিত কুক্কুট সহযোগে আয়োজন করে বসেন। হাতে কাঠি। শুধু ‘সুউউপ!’ করে একটা আওয়াজ! কয়েক ‘সুউউপ’ আওয়াজে এক থালা শেষ। এই আওয়াজ নাকি খুবই জরুরি। আওয়াজ না করলে তাঁদের রীতিতে বুঝতে হবে, খাবার বিশেষ উপাদেয় হয়নি।

    টোল দিয়ে রাস্তার পাশের ফিলিং স্টেশন থেকে তেল নিতে গিয়ে আমরা ইলিশেগুঁড়িতে পড়ে গেলাম। ঢাকা-মাওয়া সড়কে বিপুলাকৃতির সব ট্রাক সার বেঁধে দাঁড়ানো। অর্থাৎ কিনা ট্রাফিক জ্যাম। তখনও অনেক ইলিশের পথ বাকি, কিন্তু আমাদের চারপাশে জলের শরীর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ বর্ষিত হতে থাকে। গাড়ির অনিয়মিত আলোয় তারা নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো ঝিকমিক করে উঠছে।

    রাত দশটার দিকে সকলের মাথায় চাগাড় দিল, অনেক হয়েছে। গৃহবন্দি আর নয়। নীচে দুটো গাড়ি মজুত রয়েছে। চলো মাওয়াঘাট*। ইলিশ খেয়ে আসা যাক। ফিরতে ভোর রাত হবে হোক, পথে বিস্তর জ্যাম ঠেলতে হবে হোক, কাল অফিস আছে থাকুক। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সকলেরই হাঙ্গামা। আমার না হয় চালচুলো নেই, বাকিদের আত্মীয়-পরিজন রয়েছে, তার চেয়ে বড় কথা পরমাত্মীয়া রয়েছেন, তাঁদের না সামলে, মিছে কথা না বলে এরূপ ভ্রমণ সম্ভব নয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব বলে দেড় ঘণ্টা পরে সকলে বের হলাম। এ আর নতুন কী, ন’টার ট্রেন কবেই বা ন’টায় ছেড়েছে!

    দেরি করে বের হওয়ার অনেক অসুবিধা থাকলেও ঢাকার রাস্তা ফাঁকা পাওয়ার সুবিধাটা পাওয়া যায়। মাত্র ত্রিশ মিনিটে পুরো শহর পার হয়ে আমরা মাওয়া রোডে পৌঁছলাম। পদ্মা সেতুর কাজ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু সেতুর কারণে যে দুর্দান্ত রাস্তা তৈরি হয়েছে, তার টোলঘর বসেছে পথে। টোল দিয়ে রাস্তার পাশের ফিলিং স্টেশন থেকে তেল নিতে গিয়ে আমরা ইলিশেগুঁড়িতে পড়ে গেলাম। ঢাকা-মাওয়া সড়কে বিপুলাকৃতির সব ট্রাক সার বেঁধে দাঁড়ানো। অর্থাৎ কিনা ট্রাফিক জ্যাম। তখনও অনেক ইলিশের পথ বাকি, কিন্তু আমাদের চারপাশে জলের শরীর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ বর্ষিত হতে থাকে। গাড়ির অনিয়মিত আলোয় তারা নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো ঝিকমিক করে উঠছে।

    ২.
    ‘কালো ইলিশ’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন বশীর আলহেলাল। কয়েক দিন আগে গত হলেন ‘শেষ পানপাত্র’, ‘আনারসের হাসি’, ‘যে পথে বুলবুলির যায়’-এর লেখক। সৃজনশীল লেখক হলেও, ক্লাসিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তাঁর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বই। কর্মজীবনে বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। বাংলা একাডেমির ইতিহাসও তাঁর রচনা। ৮৫ বছরের দীর্ঘ জীবনের শেষ দিকে মনে ও শরীরে সুস্থ ছিলেন না। বহুদিন ধরে তিনি যেন থেকেও ছিলেন না। যেন মরে গিয়ে মনে করালেন, তিনি জীবিত ছিলেন। বিদ্বৎসমাজের এককালের প্রভাবশালী এই ব্যক্তি শেষকালে খুব সাধারণ লোকের সঙ্গে মিশতেন। ভাষা আন্দোলন যে প্রজন্মকে তৈরি করেছিল, যাঁরা বোধি-রুচি-পরিশীলনের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন, তাঁদের মহীরুহদের মাঝে আর খুব বেশি কেউ জীবিত নেই।

    বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ লেখক হাসান আজিজুল হক অসুস্থ। লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, অবস্থা কিছুটা ইতিবাচক। সাহিত্যকে তাঁর আলাদা করে আর দেবার কিছু নেই। সেই সময়ও আর নেই। তবু, এ সকল মানুষ বেঁচে থাকা মানে একটি প্রজন্মের স্বচ্ছ হাওয়াকে চোখের সামনে দেখা। সেখান থেকে নিজের প্রাণরসকে সঞ্জীবিত করে নেওয়া। তাঁদের কিছু দেবার না থাকলেও অনেকেরই হয়তো নেবার রয়েছে।

    বশীর আলহেলালের প্রতি শ্রদ্ধা, হাসান আজিজুল হক সুস্থ হন, এই কামনা।

    *মাওয়া ঘাট বাংলাদেশের অন্যতম নদীবন্দর। ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ঢাকা আসার ক্ষেত্রে এ-ঘাট ফেরিজাহাজ ও স্টিমারের মাধ্যমে পদ্মার দুই প্রান্তের সংযোগ হিসেবে কাজ করে। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook