ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ২৮


    বিমল মিত্র (September 3, 2021)
     

    পর্ব ২৭

    বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই মানুষের মহত্ত্ব বা মনুষত্ত্ব্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। পশুত্ত্ব বা হীনম্মন্যতাও ঢাকা থাকে না বিপদের সময়। নইলে বাইরে থেকে তো আমরা সবাই সমান। আমরা, অর্থাৎ আড্ডার ‘আমি’রা কেউই কোনো বিষয়ে কম যাই না। আড্ডার মধ্যে ভারি-ভারি কথার আড়ম্বরে আমরা বিদগ্ধ পন্ডিত সাজতে পারি অতি সহজেই। লেখক, সমালোচক, পাঠক, পন্ডিত, সব কিছু সুষ্ঠুভাবেই আমরা হয়ে উঠি আড্ডার আবহাওয়ায়।
    কিন্তু সেই রকম কার্যক্ষেত্রে চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে কে পারে?

    লেখক, পরিচালক, গায়ক, সবাইকেই জীবনে একদিন না একদিন সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। যদি তা না হয় তো প্রমাণ হল না ক্ষমতার মাত্রা সম্বন্ধে। পরীক্ষা না হলে বলতে পারব না তুমি ধোপে টিকবে, কি টিকবে না।

    নিজের কথা বলতে পারি এ সম্বন্ধে। সাপ্তাহিক পত্রিকায় উপন্যাস লেখবার দীর্ঘ কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতায় এ-রকম অনেকবার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। হাতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়। তারই মধ্যে আমার গল্পের চূড়ান্ত কেন্দ্রবিন্দুটি ঠিক নিশানা করতে হবে। তখন সাহস দেবার কেউ নেই। একলাই আমাকে জাল বুনে গল্প জটিল করতে হবে আর একলাই জাল কাটতে হবে। সে এক মহা পরীক্ষা। এই সব পরীক্ষাতেই বহু লেখক-সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে তার অনেক নজির আছে। কিন্তু সিনেমার ব্যাপারে গুরু দত্তকে সেদিন সেই মর্মান্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখলাম। ওদিকে ছবি আবার বাজারে চলতে শুরু করেছে, ডিস্ট্রিবিউটারদের তরফ থেকে হতাশা-ব্যঞ্জক মতামত, আর এক দিকে গুরু দত্তর সেই পরীক্ষা। অমোঘ ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’।

    গুরু যখন আমাদের রেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন আসলে সে হয়তো ঘুমোয়নি। ঘরের ভেতরেই ছটফট করেছে। তার মাথায় অনেক ভাবনা। একদিন লক্ষ-লক্ষ টাকা লোকসান যাওয়ার প্রশ্ন, আর একদিকে আর্ট। কোনটা সে বাঁচাবে? টাকা না আর্ট? প্রত্যেক মহৎ শিল্পীর জীবনেই কোনও-না-কোনও সময়ে এই সমস্যা একদিন মুখব্যাদান করে দাঁড়ায়। তখনই সিদ্ধান্ত নেবার পালা। সেই সময়ে যে শিল্পী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাকেই লোকে বলে প্রকৃত শিল্পী। সেদিন গুরুকে দেখে আমার সেই সব কথাই মনে পড়ছিল।

    গুরু যখন আমাদের রেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন আসলে সে হয়তো ঘুমোয়নি। ঘরের ভেতরেই ছটফট করেছে। তার মাথায় অনেক ভাবনা। একদিন লক্ষ-লক্ষ টাকা লোকসান যাওয়ার প্রশ্ন, আর একদিকে আর্ট। কোনটা সে বাঁচাবে? টাকা না আর্ট? প্রত্যেক মহৎ শিল্পীর জীবনেই কোনও-না-কোনও সময়ে এই সমস্যা একদিন মুখব্যাদান করে দাঁড়ায়। তখনই সিদ্ধান্ত নেবার পালা। সেই সময়ে যে শিল্পী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাকেই লোকে বলে প্রকৃত শিল্পী



    সেদিন রাত্রে আমরা কিন্তু সবাই বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে বিছানায় শুতে গেলাম। পরের দিন পত্রিকায় ছবির সমালোচনা থাকবে। আমরা অপেক্ষা করে আছি। ভোর থাকতেই ঘুম থেকে উঠেছি। গুরুর ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি গুরু এক গাদা খবরের কাগজ নিয়ে ডুবে আছে। ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, সব ভাষার কাগজ। গুরু একখানা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিলে। কাগজখানা ‘The Times of India’. সিনেমার পাতায় বড়-বড় হরফে লেখা— ‘এ ক্লাসিক ইন্ সেলুলয়েড্।’ বোম্বাইয়ের ছবির জগতের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত অত প্রশংসা বোধহয় কোনও ছবি সম্বন্ধেই ছাপা হয়নি। সত্যিই অবাক কান্ড।

    একে-একে সব ভাষার খবরের কাগজ পড়া হতে লাগল। অর্থাৎ বোম্বাইতে যত ভাষার খবরের কাগজ পাওয়া যায়। সব কাগজ আনা হল। তার সঙ্গে সাপ্তাহিক পত্রিকাও আছে, যেমন ‘ব্লিৎজ’। গুরু নিজে অনেক ভাষাই পড়তে পারত। কেবম গুজরাটি ভাষাটা তার আয়ত্ত ছিল না। কিন্তু গুরুর চাপরাশি রতন নিজে গুজরাটি। ড্রাইভার রাম সিংও গুজরাটি। তারা পড়ে-পড়ে মানে বুঝিয়ে দিতে লাগল।

    ততক্ষণে একে একে স্টুডিওর সবাই এসে হাজির। বাইরের কিছু বন্ধু-বান্ধবও এসেছে। তারাও সবাই শুনতে লাগল। প্রশংসা অনেক ছবির কপালেই জুটেছে, এবং ভবিষ্যতেও জুটবে। নিন্দে জুটেছে এবং জুটবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্যিক হিসেবে নিন্দে শুনতে-শুনতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে ও আর আমার গায়ে লাগে না। আমি নিন্দে-প্রশংসার ব্যাপারে প্রায় নির্লিপ্ত। কিন্তু সেদিন যে-সব প্রশংসা-বাক্য ছাপা হয়েছিল তা শুধু গুরুকেই নয়, আমাকেও যেন খানিকক্ষণের জন্য বিচলিত করল। এত প্রশংসাও তো আবার ভালো নয়। ‘ভারতজ্যোতি’-তো লিখে দিলে এই বইও যেমন এপিক, এ ছবিও তেমনি এক এপিক।

    আমি মনে-মনে হাসতে লাগলাম। গুরুর এ কদিনের অশান্তি যেন কিছুক্ষণের জন্য দূর হল। তার দিকে চেয়ে দেখলাম তার মুখে মৃদু হাসি।

    বললাম— দায় চুকল—

    গুরু বললে— কিন্তু আমি তো আপনাকে বলেছিলাম যে ছবির নিন্দে হলেও আপনাকে আমি কখনও তার জন্য দায়ী করব না—

    বললাম— তাহলেও, আমার ভাবতে ভালো লাগে না যে আমার গল্প ছবি করে বা ছাপিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক—

    আমি ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্যিক হিসেবে নিন্দে শুনতে-শুনতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে ও আর আমার গায়ে লাগে না। আমি নিন্দে-প্রশংসার ব্যাপারে প্রায় নির্লিপ্ত। কিন্তু সেদিন যে-সব প্রশংসা-বাক্য ছাপা হয়েছিল তা শুধু গুরুকেই নয়, আমাকেও যেন খানিকক্ষণের জন্য বিচলিত করল। এত প্রশংসাও তো আবার ভালো নয়। ‘ভারতজ্যোতি’-তো লিখে দিলে এই বইও যেমন এপিক, এ ছবিও তেমনি এক এপিক



    আমি ব্যাপারটা সব বুঝিয়ে বললাম গুরুকে। বললাম— এই বই যে প্রকাশক ছাপেন, তার নিজস্ব বাড়ি হয়েছে এই বই ছাপবার পর। যে প্রডিউসার এই বই এর সিনেমা করেছেন, তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। এই ছবি করার পর তাঁর সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে যায়। আমি বহুকাল দাসত্ব করেছি সরকারি দফতরে। এই বই লেখবার পর আমি স্বাধীন জীবিকা করেছি। এ-সমস্তই আমার এই ‘সাহেব-বিবি-গোলামে’র কল্যাণে। আজ যে আমি এখানে বসে আছি, সেও এই বই-এরই জন্যে। বাংলা বই-এর জগতে কোনও উপন্যাস এত বিক্রিও হয়নি, প্রশংসাও পায়নি, এত নিন্দেও পায়নি। বই-এর ব্যবসার জগতে এ বই এক রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই বই-এর স্বেচ্ছাকৃত অনুবাদ সব ভাষাতেই প্রায় বেরিয়ে গিয়েছে। অথচ বাংলা দেশের সুধী সমাজ আর কোনও বই-এর ওপর এত খড়্গহস্ত হয়নি। তাই তাদের ক্ষমতায় যেটা কুলিয়েছে সেইটুকু তারা প্রাণপণে চেষ্টা করেছে। এই বই পাছে কোনও সরকারি-তক্মা পেয়ে যায়, তাই তারা এর বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়েছে, এ-বই-এর বিরুদ্ধে স্বনামে-বেনামে নানারকম লেখা লিখিয়ে ছাপিয়েছে।

    যা হোক, খবরের কাগজে সেই সব লেখার উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে এখানে এ-রচনা দীর্ঘতর করার প্রয়োজন নেই। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে। যে গুরুকে সেদিন যেমন সুখী দেখেছিলাম আর কোনো দিন তেমন দেখিনি। গুরুর বোধ হয় সেই-ই প্রথম রাত, যে-রাতে সে প্রাণ ভরে ঘুমিয়েছিল।

    পর দিন রিপোর্ট আসতে লাগল চারদিক থেকে। গুরু দত্তকে অভিনন্দন আর অভিনন্দন। গুরু সেদিন রাত্রে আবার কে. আসিফের আসরে গেল। আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যেখানে যাবার প্রয়োজন তখন আমার ফুরিয়ে গিয়েছে।

    তখনও বাকি ছিল কলকাতায় দেখানো। বোম্বাই-এর সাতদিন পরে কলকাতার শো আরম্ভ। আমার চলে যাবার তাড়া। কলকাতায় গিয়েই সেবার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়েছি। শুধু মাথার মধ্যে তখন আমার দায়িত্বের বোঝার ভার।

    সূর্য লাডিয়া কলকাতায় ছবির ডিস্ট্রিবিউটার। সে ছবি নিয়ে গেলে তবে কলকাতায় রিলিজ হবে। সে তাই নিয়েই ব্যস্ত।

    কিন্তু মুশকিল হল আমার। ফেরবার বুকিং আর পাই না। হাওয়াই জাহাজে জায়গার অভাব, সাতদিনের মধ্যে ‘ন স্থানং তিল ধারয়েৎ’। সূর্য লাডিয়ার কাছে শুনলাম তার ফেরার সিট রিজার্ভ হয়েই আছে, কিন্তু আসলে আরো দু-দিন দেরি হবে যেতে।

    বললাম— আপনার টিকিটটা দিন, আমি আপনার নামে কলকাতায় ফিরে যাই, আপনি আমার টিকিট নিয়ে আমার নামে ফিরে যাবেন—

    অর্থাৎ আমি হব সুর্য লাডিয়া আর সুর্য লাডিয়া হবে বিমল মিত্র। এতে অসুবিধে কিছু নেই। এইটুকু মাত্র অসুবিধে যে আমাকে প্লেনের ভিতর নিরামিষখানা খেতে হবে, আর তাকে খেতে হবে আমিষ। কারণ আমাদের দুজনের টিকিটে সেই নির্দেশই দেওয়া আছে। তা হোক, আমার তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কাটলেটের বদলে না হয় কচুরিই খাবো। ও দুটোই তো আমার শরীরে বিষ।

    এবারে গুরুর মনটা খুব প্রফুল্ল দেখলাম। কিন্তু এবারে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম। স্টুডিওর ধারে-কাছে কোথাও ওয়াহিদা রেহমানকে দেখতে পেলাম না। অথচ আগে নানা কাজে এখানে আসত। ছবির শুটিং না থাকলে গল্প করে যেত গুরুর সঙ্গে। বাইরে অন্য কোনও প্রোডিউসারের ছবিতে শুটিং থাকলেও টেলিফোনে যোগাযোগ করত। আমি বেশ লক্ষ্য করেছি, মেয়েটি গুরুকে গুরুর মতন শ্রদ্ধা করত। জীবনে সে যে কতভাবে গুরুর কাছে ঋণী, তা সে আচরনে-ব্যবহারে কথাবার্তাতেও প্রকাশ করত।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook