ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ১৯


    বিমল মিত্র (July 2, 2021)
     

    পর্ব ১৮

    কলকাতায় যখন ছবি তুলতে এসেছিল আমি তখন গুরুর সঙ্গে বেশিক্ষণ কাটাতে পারিনি। আমি তখন ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত। সমস্ত ইউনিট সঙ্গে এসেছে। খাওয়া-থাকা-শোওয়া সব কিছুরই বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে সকলের। কলকাতা থেকে চব্বিশ মাইল দূরে একটা পুরনো বাড়ির ভেতরের ছবি তোলা হবে। প্রায় একমাস থাকতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আছে জেনারেটার। গ্রামের মধ্যে ছবি তোলার সুবিধে যেমন আছে, অসুবিধেও তেমনি। তাদের ধোপা-নাপিত থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু বন্দোবস্ত।

    ঠিক সেই সময়ে একদিন বোম্বাইতে গীতার কাছ থেকে এক চিঠি এল। গুরু বললে— দেখুন, আমি তখন দিন-রাত পরিশ্রম করছি, দিনের বেলা শুটিং করি আর রাত্তিরে সেই সুদূর গ্রাম থেকে টালিগঞ্জের স্টুডিওতে এসে প্রোজেকশান দেখি, রাশ প্রিন্ট দেখি—

    — তারপর? গীতা কি লিখেছিল চিঠিতে?

    গুরু বললে— গীতা লিখেছিল আমাকে, আপনি এখুনি চলে আসুন, এখানে একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে।

    সত্যিই সে এক সর্বনাশই বটে। সেদিন গুরু দত্ত দিন-রাত পরিশ্রম করছে। দিন-রাত পরিশ্রম মানে, ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই, আউটডোর শুটিং মানেই তাই। সারা রাত টালিগঞ্জ স্টুডিওতে রাশপ্রিন্ট দেখা আর সমস্ত দুপুর বোশেখ মাসের ঠা-ঠা রোদ্দুরে ছবি তোলা। টাকার হিসেব রাখার প্রশ্ন আছে, আর্টিস্টদের সুখ-অসুখের প্রশ্ন আছে। আছে গল্পের দিকে নজর রাখা। তার ওপরে আছে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা। লাখ-লাখ টাকার প্রশ্ন। সৃষ্টির সেই সংগ্রামের মধ্যে হঠাৎ সর্বনাশের খবরে মন কি-রকম বিচলিত হয়, তা আমি কল্পনা করতে পারি। তা ছাড়া এ তো বাঙলা ভাষার ছবি নয়। হিন্দি জগতের দিকে চোখ রেখে, ফাইন্যান্সিয়ারের দিকে চোখ রেখে ছবি তোলা।

    সর্বনাশটা এল অপ্রত্যাশিত ভাবে। গুরুর পালি হিলের বাড়িতে তখন গীতা রয়েছে। আর রয়েছে আরো দুজন। দুজন ঠিক নয়, বলতে গেলে তিনজন। একজোড়া স্বামী-স্ত্রী। তারা এসেছে লন্ডন থেকে। একজনের নাম সতীশ ভাটনগর। ছেলেটি বি-বি-সি তে চাকরি করত, গুরু লন্ডন থেকে তাদের নিয়ে এসে নিজের স্টুডিওতে চাকরি দিয়েছে। আর আছে একজন নেপালী ছেলে। তাকে গুরু এনেছিল দার্জিলিং থেকে। তিনজনেই গুরুর বাড়িতে থাকে অতিথি হিসেবে আর কাজ করে স্টুডিওতে। হঠাৎ একদিন রাত্রে ভাটনগরের বিলিতি স্ত্রী নেপালী ভদ্রলোকের সঙ্গে উধাও হয়ে গেল! বারো বছরের একটি ছেলে ছিল ভাটনগরের। সেই ছেলেকে রেখেই পালিয়ে গেল বউটা।

    আমি বললাম— তারপর?

    তারপর সতীশ ভাটনগরের সেই যন্ত্রণা আর নেপালী ভদ্রলোকের স্ত্রী খবর শুনে দার্জিলিং থেকে পুত্র-কন্যা নিয়ে বোম্বাইতে এসে হাজির। সেই নেপালী মহিলা টেলিফোন করে শাসায়। বলে— আপনাদের জন্যেই আমার পর স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে— সে এক জটিল অবস্থা!

     — তারপর?

    গুরু বললে— আমার তখন সঙ্গীন অবস্থা। আমি না পারি কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে, না পারি ভালো করে মন দিয়ে ছবি তুলতে। শেষকালে তাড়াতাড়ি করে ছবি শেষ করে একদিনের জন্যে গেলাম সুন্দরবনে শিকার করতে। আমার আবার শিকার করবার বাতিক আছে। বন্দুকের লাইসেন্স আছে আমার। এতদূরে এসে আর সুন্দরবনটা দেখে যাব না?

    — তারপর?

    গুর বলতে লাগল— সেখানে শিকার করতে গিয়েও একটা সর্বনাশ হতে হতে বেঁচে গেলাম। খুব তাড়াতাড়ি ছিল আমার। দু’তিনটে লোক সঙ্গে নিয়েছি। তারা জঙ্গলী-লোক, তারা আমার গাইড। তাদের মধ্যে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলে বন্দুক কেমন করে ছোঁড়ে। আমি তাকে বন্দুক ছোঁড়া দেখাচ্ছি, হঠাৎ একটা গুলি দুম করে বেরিয়ে গেল নল দিয়ে…

    — সর্বনাশ তারপর?

    একজোড়া স্বামী-স্ত্রী। তারা এসেছে লন্ডন থেকে। একজনের নাম সতীশ ভাটনগর। ছেলেটি বি-বি-সি তে চাকরি করত, গুরু লন্ডন থেকে তাদের নিয়ে এসে নিজের স্টুডিওতে চাকরি দিয়েছে। আর আছে একজন নেপালী ছেলে। তাকে গুরু এনেছিল দার্জিলিং থেকে। তিনজনেই গুরুর বাড়িতে থাকে অতিথি হিসেবে আর কাজ করে স্টুডিওতে। হঠাৎ একদিন রাত্রে ভাটনগরের বিলিতি স্ত্রী নেপালী ভদ্রলোকের সঙ্গে উধাও হয়ে গেল! বারো বছরের একটি ছেলে ছিল ভাটনগরের। সেই ছেলেকে রেখেই পালিয়ে গেল বউটা।

    — আমি কি জানতাম যে ওটা লোডেড? কিন্তু খুব ভাগ্য ভালো যে লোকটার গায়ে গুলি লাগেনি। তার মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল—

    গুরু আবার সিগারেট ধরাল।

    বললে— সেই বাবা মারা যাবার পর থেকেই শুরু হয়েছিল সর্বনাশ। তার পরে সুন্দরবন, তারপরে এই সতীশ ভাটনগরের স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া।

    বললাম— কিন্তু আপনি কেন সকলকে নিয়ে আপনার বাড়িতে রাখলেন? নেপালী ছেলেটাকেই বা কেন আনলেন, আর সতীশ ভাটনগরকেই বা কেন সস্ত্রীক নিয়ে এলেন?

    — না, কিন্তু আমি তো ওদের ভালোর জন্যেই চেষ্টা করেছিলাম। ওরা দুজনেই যে আমার স্টুডিওয় কাজ করতে চেয়েছিল।

    — কিন্তু নিজের বাড়িতে কেন রাখতে গেলেন? আপনারই তো দোষ। আপনিই তো এর জন্যে দায়ী! আপনি এখনও লোক চিনতে পারেন না? গুরু চুপ করে রইল। আমি বেশি কিছু বললাম না। বেশি বললে গুরু মনে কষ্ট পায়। আমি জানতাম গুরু বেশ সেন্টিমেন্টাল। শুধু বললাম, তারপর?

    — তারপর তাই নিয়ে গীতার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হতে লাগল। গীতা আমাকে বললে আমারই নাকি সব দোষ। আমার আবার রাগ হলে জ্ঞান থাকে না বিমলবাবু, আমাকে আপনি রাগতে দেখেননি কখনও, দেখেছে অ্যাসিস্টেন্টরা। তারা জানে আমার কি রাগ!

    বললাম— কিন্তু আত্মহত্যা করতে গেলেন কেন?

    গুরু চুপ করে রইল। আমি বললাম— আপনার একবার মনেও পড়ল না, ‘সাহেব বিবি গোলামে’র কথা? একবারও ভাবলেন না যে আপনার এত টাকা দামের ছবির কি হবে? আপনার ছেলেদের কথা ভাবলেন না? আপনার মার কথা ভাবলেন না? ভাইয়ের কথাও একবার মনে পড়ল না? গুরু কিছু উত্তর দিলে না। চুপ করে আমার কথাগুলো শুনতে লাগল।

    আমি আবার বলতে লাগলাম— আর তা ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা-কাটাকাটি কোথায় না হয়? কার না হয়? টলস্টয়ের জীবনটা ভাবুন তো! আব্রাহাম লিংকনের জীবনটা ভাবুন তো। সক্রেটিসের জীবনটা ভাবুন তো!

    বলে একে একে সকলের দাম্পত্য জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী শুনিয়ে দিলাম। গুরু শুনতে লাগল অবাক হয়ে। তারপরে শেষ মার দিলাম আমার নিজের কথা বলে। বললাম— আপনি শুনলে অবাক হবেন আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়, তুমুল ঝগড়া হয়—

    গুরু চমকে উঠল, একটু যেন আশার আলো দেখতে পেল।

    বললে— আপনাদেরও মধ্যেও ঝগড়া হয়?

    বললাম— হ্যাঁ হয়, পৃথিবীর প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়—

    গুরু ভাবতে লাগল খানিকক্ষণ। তারপর বললে— আমার ধারণা ছিল আমি ওয়ার্কিং-গার্ল বিয়ে করেছি বলেই এই রকম—

    বললাম— না, দুজন মানুষ সারা জীবন একমন-একপ্রাণ হওয়া কি সোজা কথা নাকি? ঝগড়া হবে না! ঝগড়া তো প্রেমের স্বাস্থ্যের লক্ষণ! ঝগড়া না হলে বুঝতে হবে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোথাও ভেজাল আছে, খাদ আছে, গলদ আছে—

    গুরু যেন খানিকটা শাস্তি পেল আমার কথা শুনে। খানিকটা সান্ত্বনা। তারপর বললে— ঝগড়া হলে আপনারা কি করেন?

    বললাম— দুজনেই স্লিপিং পিল খাই, পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার সেই ভাব—

    গুরু একটু ভেবে বললে— আপনি আর ওই পিল খাবেন না। ওটা খুব খারাপ জিনিস। ওর একটা নেশা আছে, একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না।

    বললাম— কিন্তু তখন যে আর না খেয়ে থাকা যায় না!

    — না, তবু খাবেন না। আমিও আগে খেতাম। আর খাই না। রাশিয়াতে দেখেছি, পৃথিবীসুদ্ধ সবাই আজকাল স্লিপিং-পিল খাচ্ছে। ওটা খাবেন না।

    বললাম— তারপর আপনি কি করলেন সেদিন?

    গুরু বললে— একটা টিউবে আটত্রিশটা ট্যাবলেট থাকে। সব কটা পিল জলে গুলে খেয়ে ফেললুম—

    কথাটা শুনে, আমি ভয়ে আঁতকে উঠলুম। আমার মনে হল গুরু যেন আমার সামনে বসেই আটত্রিশটা পিল গিলে ফেললে। আমি ভালো করে চেয়ে দেখতে লাগলাম গুরুকে। আশ্চর্য এতদিন ধরে দেখছি ওকে অথচ আজও চিনতে পারলাম না। কী অদ্ভুত মানুষের মন। মনের কী বিচিত্র গতি!

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook