ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আক্রান্ত: পর্ব ১


    অপরাজিতা দাশগুপ্ত (June 4, 2021)
     

    ‘… আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করব ৷এখন তাপমাত্রা উনত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের সংস্থার তরফ থেকে আমি ক্যাপ্টেন রাঠোর এবং বিমানের অন্যান্য ক্রু আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, এই ফ্লাইট উপভোগ্য হয়েছে—’ শুনতে শুনতে একটু আনমনা ভাবে অভিমন্যু সিটবেল্টটা বেঁধে নিল। নিজের কাছে স্বীকার না করলেও ওর সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী টানটান হয়ে রয়েছে। একটু স্পর্শ পেলেই ঝনঝন করে বেজে উঠবে। বাইরে সমস্ত শহর সকালের নরম রোদে ভাসছে। সরু সুতোর মতো নদী, হুগলি ব্রিজ, প্রতি মুহূর্তে উচ্চতা হারাচ্ছে প্লেন আর শহরটা যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খুব চেনা অথচ কোথাও যেন অচেনার দূরত্ব তৈরি হয়েছে শহরের সঙ্গে। অনেকগুলো অনুভূতি এখন মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে রয়েছে, অভিমন্যু যাদের আলাদা করতে পারছে না। ঝপ করে আরও নিচে নেমে এল প্লেনটা। বিশাল রানওয়ে প্রায় চোখের সমান্তরালে। চাকা মাটি ছুঁল। ধাতব এক গতিময়তা ছড়িয়ে যাচ্ছে অভিমন্যুর ভিতরে। বিমানের গতি কমে আসছে এবার। ‘ফাসেন ইওর সিটবেল্টস্‌’-এর আলো নিভে গেছে। কেবিনে রাখা ব্যাগটা কাঁধে আড়াআড়ি ঝুলিয়ে পায়ে পায়ে প্লেনের এগজিটের দিকে এগিয়ে গেল অভিমন্যু।

    ‘চিকু, চিকু, আর কত ঘুমোবি? উঠে পড়ে চোখেমুখে জল দিয়ে আয়।’ দিদি ডাকছে। দিদিটা এইরকমই। সবসময় একটা বড়-বড় ভাব। বড্ড বেশি বিজ্ঞ। অথচ মোটে আমার থেকে আড়াই বছরের বড়। দিদি বেশি সর্দারি করার চেষ্টা করলেই আমি ওকে ঠান্ডা করে দিই। এই যেমন এখন করছি। ঘুম ভেঙে গেছে, তবু চোখ মেলে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছি ড্যাবড্যাব করে। যেন শুনতেই পাচ্ছি না। দিদি ধুপধাপ করে ঘরে এসে পর্দাগুলো সরিয়ে দিচ্ছে— ‘জেগে জেগে শুয়ে আছিস কেন? বিকেল হয়ে গেল, তাও মিটকি মেরে শুয়ে থাকা, সব সময় তেএঁটেপনা, দাঁড়া বাবা এলে আজ তোর ইয়ার্কি মারা বার করছি—’ দিদি বকবক করে যাচ্ছে নিজের মনে। মিটকি মেরে শুয়ে থাকা, তেএঁটেপনা— এসব কথাগুলো ওর নিজের না, সব মামণির কাছ থেকে ধার করা। মামণি আমাদের নিজের মা নয়, আমার মা মরে যাবার দু’বছরের মাথায় বাবা মামণিকে বিয়ে করেছে। মা আর মামণি একজন আরেকজনের থেকে এক্কেবারে আলাদা। মা ছিল কালো, বেশ মোটাসোটা, গিন্নিবান্নি চেহারা। মাকে আমার অত মনে নেই, শুধু মায়ের কোলের একটা নরম ঠান্ডা অনুভব মনের কোথায় যেন রয়ে গেছে। মা বেশি হাসত না, কিন্তু হাসলে মার গালে যেন একটা টোল পড়ত। সেই টোলটা মনে রয়ে গেছে। মামণি একদম অন্যরকম। ফর্সা, টানা টানা চোখ, ভাসা ভাসা দৃষ্টি— ঠিক আমাদের দেওয়ালে টাঙানো যামিনী রায়ের ছবির মতো। মামণি খুব হাসে। উচ্ছ্ল ভাবে হাত-পা নেড়ে কথা বলে। হাসলে মামণির টোল পড়ে না। কিন্তু মুক্তোর মতো গজদাঁত ঝিলিক দেয়। আমার মা মরে গেছে যখন আমার পাঁচ বছর বয়স। মামণি আমাদের বাড়ি এসেছে যখন আমার সবে সাত। দিদির তখন প্রায় দশ। মামণি নাকি বাবার ছাত্রী ছিল। কলেজের ছাত্রীকে বউ করে বাবা নিয়ে এসেছে ভাবলেই আমার হাসি পায়। আমি হি হি করে হাসতে থাকি। শুয়ে শুয়ে। দুলে দুলে।

    ‘এই, কী হয়েছে? হাসছিস কেন?’ দিদির গলার স্বরে চটকা ভাঙে আমার। আমি হাসি থামিয়ে ফেলি। ইশ! আমি কেন হাসছি না হাসছি জানতে দেব কেন দিদিকে? সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে দিদিকে প্রশ্ন করি— ‘আচ্ছা দিদি, মা যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনের কথা মনে আছে তোর?’ প্রশ্নটা নতুন নয়, এই প্রশ্নটা দিদিকে আমি আগে বহুবার করেছি। যেমন আশা করেছিলাম তেমনই হল। দিদির মুখে ঝাঁপিয়ে এল একরাশ বিষণ্ণতা। একটু উদাস উদাস ভাব গলায় মেখে ও বলল— ‘হাজার বার একই প্রশ্ন করিস কেন? যখন উত্তরটাও তোর জানা।’ ঠিকই বলেছে দিদি। বহুবার শুনেছি উত্তরটা। ‘মা মরে যাওয়ার ঘটনাটা আমার অত ভাল মনে নেই। বরং কাজের দিনটা মনে আছে। মার ছবি যেটা আমাদের দু’বোনের শোবার ঘরের মাথার দিকের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে, সেটা মালা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অনেক লোকজন আসছিল। দিদি বলেছে, মামণিও নাকি এসেছিল সেদিন। তখন মামণি সবে এমএ পরীক্ষা দিয়েছে। দিদি নাকি মামণিকে জুঁইমাসি বলে ডাকত। মামণির ডাকনাম জুঁই। এখন অবশ্য আমরা দুজনেই জুঁইমাসিকে মামণি বলি। মামণিকেই বেশিদিন দেখছি আমি। আট-নয় বছর হয়ে গেল বোধহয়।

    দিদির গলার স্বরে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল— ‘চিকু, যা একবার পাড়ায় ঘুরে আয়। মনটা ভাল লাগবে তোর।’
    ‘আমার মন খারাপ কি না আমি বুঝব। আমি কি কিছু বলেছি তোকে?’
    ‘বলবার দরকার হয় না। পরীক্ষা হয়ে যাবার পর থেকে তো সারাদিন খালি গোঁজ হয়ে শুয়েই থাকিস। স্কুলের বন্ধু ছেড়ে দে, পাড়ার বন্ধুগুলোর অবধি খবর রাখিস না।’

    ঠিকই বলেছে দিদি। আমার বন্ধু নেই কোনও। স্কুলের বন্ধুরা আসলে শুধুই ক্লাসমেট। পাড়াতেও বেরোই না অনেকদিন। দিদির অনেক বন্ধু আছে। মিষ্টু, শাওন, জ্যোতি, কাবেরী, অর্ণব, দোলন এরা সব প্রায়ই আসে আমাদের বাড়িতে। দিদি খুব আউটগোয়িং। আমি ঘরকুনো। এখন যেমন মাধ্যমিকের পরে ঘরেই থাকি আমি। পাড়া বেড়াতে আমার ইচ্ছে করে না। কারুর বাড়িতে যেতেও ভাল লাগে না। অবশ্য বেড়াতে যাবই বা কার বাড়ি? বাবার দিকে আত্মীয়দের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগই নেই আমাদের। মামণির বাড়ির সঙ্গে বরং অনেক বেশি যাতায়াত। ভাবতে ভাবতে আবার নিজের ভাবনার জালে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু না, এখন দিদিকে আগে ‘ভুল’ প্রমাণ করা দরকার। আমি একলাফে উঠে পড়ি। দিদির সঙ্গে একটাও কথা না বলে রেডি হই। চটি ফটফট করে বেরিয়ে যাই পাড়া বেড়াতে।

    মিঠির একটা নিজস্ব জগৎ আছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে। যাদবপুরে কম্পারেটিভ লিটারেচারে ভর্তি হবার পর সেটা আরও বেড়েছে। কোথায় যেন মিঠির সঙ্গে নিজের একটা মিল খুঁজে পান সুচেতনা। হওয়ার কথা নয়, তবুও। মিঠি আর চিকুর বড় হওয়ার মধ্যে কি তাঁর কোনও প্রভাব কাজ করে কোথাও?

    বিকেল পড়ে এসেছে। পরীক্ষার খাতার বাণ্ডিলটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন সুচেতনা। ‘চললে সুচেতনাদি ?’ পিছন থেকে রমার গলা।
    ‘হ্যাঁ রে, যাই এবার। তুই কি বাপের বাড়ি যাবি নাকি আজ? তাহলে আমার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারিস। আজ গাড়ি এনেছি।’
    ‘না গো, আজ যাওয়া হবে না। বাড়িতে বলা নেই। শাশুড়ি কিছু বলেন না, কিন্তু মুখ দেখলে বোঝা যায় অসন্তুষ্ট। আমি দায়মালী কারাগারে বন্দি হয়েছি’— রমা হেসে বললেও ওর চোখে বিষণ্ণতা চিকচিক করছে সুচেতনা টের পেলেন। বেচারা রমা। দু’বছর হল ওর বিয়ে হয়েছে, কাগজ দেখে সম্বন্ধ করে। শ্বশুরবাড়ি অবস্থাপন্ন। সল্টলেকে প্রাসাদের মতো বাড়ি। কিন্তু প্রভাবশালী শ্বশুরবাড়ির ভয়ে রমা সবসময়ই একটু কুঁকড়ে থাকে। গড়িয়ার দিকে ওর মা-বাবা থাকেন। সেখানেও ইচ্ছেমতো যাতায়াতের স্বাধীনতা নেই বেচারার। তুলনায় সুচেতনা অনেক ভাগ্যবান। তাঁর সব ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতা। দশ বছর পেরিয়ে গেছে বিয়ের। শ্বশুরবাড়ি বলতে যা বোঝায়, তা তাঁর কোনও কালেই ছিল না। শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন বহু আগে। তাঁর স্বামী প্রভাত তাঁর কোনও স্বাধীনতায় কখনও হস্তক্ষেপ করেননি, কোনও ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেননি। রাখেননি কি? একটু অন্যমনস্ক ভাবে সুচেতনা কলেজ কম্পাউন্ড এসে গাড়িতে উঠে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলেন।

    সুচেতনার কলেজ মধ্য কলকাতায়। গাড়িটা প্রভাত বছর কয়েক হল কিনে দিয়েছেন মূলত সুচেতনারই ব্যবহারের জন্য। মারুতি আজকাল মধ্যবিত্তের ব্যবহারের জিনিস হয়ে গেছে। সুচেতনার শৈশবে ধনীরা ছাড়া কেউ গাড়ি ব্যবহার করত না। সুচেতনার বাবা বিপদে-আপদে ছাড়া পারতপক্ষে ট্যাক্সি চড়তেন না। বোনের যখন রক্ত-আমাশা হল, তখন ট্যাক্সি চড়ে অনেকটা পথ যেতে হয়েছিল বোনকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য। সুদর্শনার সেই সঙ্কটের সময়ও সুচেতনার বেশ ভাল লেগেছিল ট্যাক্সি চড়া হচ্ছে ভেবে। কেমন একটা আউটিং আউটিং ব্যাপার। পরে নিজের এই গোপন আনন্দের কথা মনে করে অনেকবার অপরাধী মনে হয়েছে নিজেকে। কতই বা বয়স তখন! দশ কি এগারো হবে। বোনের সবে বোধহয় আট। সাড়ে তিন বছরের তফাত তাঁদের। ভাবও ছিল খুব, এই সেদিন পর্যন্ত। অল্প বয়সের তফাতে কি এমনই ভাব থাকে? মিঠি আর চিকুর মধ্যে অবশ্য খুব একটা ভাব দেখেন না সুচেতনা। মিঠির একটা নিজস্ব জগৎ আছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে। যাদবপুরে কম্পারেটিভ লিটারেচারে ভর্তি হবার পর সেটা আরও বেড়েছে। কোথায় যেন মিঠির সঙ্গে নিজের একটা মিল খুঁজে পান সুচেতনা। হওয়ার কথা নয়, তবুও। মিঠি আর চিকুর বড় হওয়ার মধ্যে কি তাঁর কোনও প্রভাব কাজ করে কোথাও?

    মিঠিকে তাও বুঝতে পারেন, কিন্তু ইদানীং চিকুকে বুঝতে বেশ অসুবিধা হয় তাঁর। যত বড় হচ্ছে, কেমন যেন অবাধ্য আর জেদি হয়ে যাচ্ছে ও। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বড্ড হেলাফেলা করে দিন কাটাচ্ছে চিকু। প্রভাতকে বলতে হবে ওকে একটু সময় দেবার জন্য।

    গুরুসদয় রোড দিয়ে গিয়ে ডান দিক নিলেন সুচেতনা। ফ্লাইওভারগুলো হবার পর গাড়ি চালানো বেশ সহজ হয়ে গেছে কলকাতায়। সুচেতনা বেশ উপভোগ করেন ড্রাইভিং। যাদবপুর থানায় আজ ট্রাফিক লাইটে আটকাতে হল না। সোজা কিছুদূর গিয়ে ডান হাতের রাস্তায় বাঁক নিলেন সুচেতনা। এটা বেশ নিরিবিলি একটা পাড়া। কিছু দূরেই যে অত হইহট্টগোল, বাজার এলাকা, তা এখান থেকে মালুমই হয় না। বেশ টলটলে জলের একটা পুকুর। তার পাশ দিয়ে পাড়া। বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বসতবাড়ি। অনেক বাড়ি একটু পুরনো হয়ে গেছে। পঞ্চাশের দশকের ছিন্নমূল মানুষগুলো এইখানে একটুকরো করে জমি পেয়ে বাড়ি করেছিল। সেইসব মানুষজন এখন আর বিশেষ নেই। তাদের সন্ততিরা রয়ে গেছে পূর্বজদের বাঁধা নীড়ের আশ্রয়ে ৷ পাড়ার দু’তিনটে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটও উঠেছে ইতিমধ্যে। সুচেতনারাও এরকমই একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। হঠাৎ যোগাযোগ হয়ে গেছিল। প্রায় দৈবাৎই ফ্ল্যাটটা কেনা গেছিল তাই। সুচেতনার মামাতো ভাই প্রদীপের কোনও এক বন্ধুর বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবার কথা প্রদীপের মুখে শুনেছিলেন সুচেতনা-প্রভাত। কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে মিলে কো-অপারেটিভ করেছিল। ফ্ল্যাট যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন নানা গণ্ডগোলের জেরে এক বন্ধু সরে দাঁড়াল। তখনই প্রদীপ বলেছিল কথাটা।

    ‘তুই ইন্টারেস্টেড থাকিস তো বল ফুলদি। বাইরের কোনও আননোন লোককে ঢোকানো মানেই ঝুটঝামেলা। জন্মের মধ্যে কম্ম করে একবারই তো মাথা গোঁজার একটা জায়গা করব। তোরা যদি পাশে থাকিস, তবে আমারও একটা ভরসা থাকে। মা-বাবাও তো বুড়ো হচ্ছে।’

    প্রভাত ও সুচেতনা আলোচনা করে মন ঠিক করে নিয়েছিলেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মন একটু খচখচ করেনি তা নয়। কিন্তু সব দ্বিধা দূর হয়ে গেছিল ফ্ল্যাটটা দেখার পর। দক্ষিণ কলকাতার ভিতর এমন চমৎকার দক্ষিণ-পুব খোলা বাড়ি যে পাওয়া সম্ভব, তা কল্পনাই করতে পারেননি সুচেতনা। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রদীপকে প্রচুর ধন্যবাদ জানাতে কার্পণ্য করেননি। কো-অপারেটিভ করে দিব্যি সস্তাতেও করেছে প্রদীপ। তিনটি বেডরুমের প্রায় বারোশো স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাটের জন্য দিতে হয়েছিল দশ লাখের কাছাকাছি। তাও পাঁচ বছর আগে বলে। এখন হলে এই জায়গায় ফ্ল্যাটের অনেক বেশি দাম হত। হঠাৎ যেন মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এর ধুম শুরু হয়েছে। আশপাশের সব এলাকায়, জলা জমি ভরাট করে অথবা পুরনো বাড়ি ভেঙে গজিয়ে উঠছে ফ্ল্যাটবাড়ি।

    প্রভাত ও সুচেতনা আলোচনা করে মন ঠিক করে নিয়েছিলেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মন একটু খচখচ করেনি তা নয়। কিন্তু সব দ্বিধা দূর হয়ে গেছিল ফ্ল্যাটটা দেখার পর। দক্ষিণ কলকাতার ভিতর এমন চমৎকার দক্ষিণ-পুব খোলা বাড়ি যে পাওয়া সম্ভব, তা কল্পনাই করতে পারেননি সুচেতনা।

    ‘ফুলদি, ফাউ একটা গ্যারেজ পাচ্ছিস। কলকাতা শহরে এখন লোকে গ্যারেজের জন্যও পঞ্চাশ হাজার-এক লাখ করে নিচ্ছে।’ ঠিকই বলেছিল প্রদীপ। বাড়ির জন্য লোন করতে হয়েছে কিছু। প্রভাত চাকরির প্রায় শেষ প্রান্তে। ব্যাঙ্কগুলো ইয়াং-প্রোফেশনালদের লোন দিতে আগ্রহী হয় বেশি। সুতরাং লোনটা সুচেতনার নামেই নেওয়া। এখনও অনেক বছর চাকরি আছে তাঁর। প্রতি মাসে মোটা টাকা কেটে যায় ঋণ মেটাতে। প্রথম দিকে মনটা খুঁতখুঁত করত। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। পনেরো বছরের লোনের সবে পাঁচ বছর হয়েছে। আরও দশ বছর। মাঝে মাঝেই মনে মনে হিসেব করেন সুচেতনা। দশ বছর মানে প্রভাতের বয়স হবে পঁয়ষট্টি। প্রভাতের ইউনিভার্সিটির চাকরি। এক্সটেনশন নিলে পঁয়ষট্টি অবধি কাজ করতে পারবেন প্রভাত। পারবেন কিনা কে জানে? প্রভাতের শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছে না একেবারে। জ্বরজ্বারি লেগে আছে। উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপারটাও পারিবারিক। সম্প্রতি বুকে ব্যথা হওয়াতে ইসিজি করিয়ে হার্টেরও গোলমাল ধরা পড়েছে একটা। স্পেশালিস্ট দেখানোর সময় হচ্ছে না প্রভাতের। বইপাগল লোক। দিনরাত বইয়ে মুখ গুঁজে মশগুল হয়ে থাকেন। সুচেতনার ইচ্ছে বাড়ির ঋণ শোধ হলে বছরে দশেক পর প্রভাতের সঙ্গে একবার ইউরোপ ঘুরতে যাবেন। মিঠি আর চিকুর হয়তো ততদিনে বিয়ে হবে যাবে। তখন স্বামী-স্ত্রী ঝাড়া হাত-পা হয়ে বেড়াতে বেরোবেন। গার্হস্থ্য ত্যাগের পর আগেকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যেমন তীর্থদর্শনে যেত, তাঁদের বাণপ্রস্থের তীর্থ হবে ইউরোপ। ভাবতে ভাবতে ঈষৎ হাসি খেলা করে গেল সুচেতনার মুখে। দশ বছর পরে তাঁর বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ। পঞ্চাশ কি খুব বেশি বয়স? চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও সুচেতনার শরীরের বাঁধুনি এতটুকুও টসকায়নি। যে কোনও যুবতী মেয়ের ঈর্ষা উদ্রেক করার মতো সুঠাম ফিগার তাঁর। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে ছাত্রদের চোখে মুগ্ধতা তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। মিঠির ইউনিভার্সিটির নতুন বন্ধুরাও বাড়ি এলেই অবাক চোখে দেখে তাঁকে। 

    ‘আপনি মিঠির মা না জানলে বিশ্বাস করতাম না আন্টি। দিদি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।’ তৃণা বলে মেয়েটি বলেই ফেলেছিল সেবার। সুচেতনা কিছু বলেননি, হাসি হাসি মুখে তাকিয়েছিলেন। মিঠির প্রতিক্রিয়া ঠিক বোঝা যায়নি। ও অন্য এক বন্ধুকে কী যেন বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

    পার্কিং স্পেসে গাড়িটা ঢুকিয়ে খাতার বাণ্ডিলটা হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। কেয়ারটেকার হয়ে নতুন একটি ছেলে যোগ দিয়েছে কয়েকদিন হল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে খুব সম্ভ্রমভরা চোখে চেয়ে আছে দেবু। মহিলা হিসেবে গাড়ি চালানো বোধহয় বিশেষ সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। কিছু না বললে খারাপ দেখায়, তাই সুচেতনা বললেন, ‘দেবু, তোমার দাদা ফিরেছেন?’ দাদা অর্থাৎ প্রভাত। দেবু কৃতার্থ হয়ে যাবার ভঙ্গিতে এক গাল হেসে বলল— ‘হ্যাঁ, বৌদি, প্রফেসারবাবু তো অনেকক্ষণ এসে গেছেন।’ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ সুচেতনার মনে হল, ফ্ল্যাটে লিফট না থাকাটাই একমাত্র খারাপ জিনিস। প্রভাত না হয় এখনও মারাত্মক অসুস্থ নন। কিন্তু কখনও যদি ওঁর বাইপাস সার্জারি করতে হয়, তবে দোতলায় ওঠাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রভাত তাঁর চেয়ে বয়েসে অনেকটাই বড়। প্রায় ষোলো বছরের। বয়সের তফাত দাম্পত্যের মধ্যে কোনও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে কি না তা এতদিন বাদে সুচেতনার নিজের কাছেও আর স্পষ্ট নয়। তবে ইদানীং প্রভাতের শরীরের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় তাঁর। প্রভাতের জন্য, প্রভাতের সংসারের জন্য অদ্ভুত এক মায়ায় ভরে থাকে ভিতরটা। এমন কেন হয় জানেন না সুচেতনা। মায়াই কি তবে ভালবাসার আসল নাম? প্রভাতের জীবনের সঙ্গে ঘাটে ঘাটে বসে যাওয়া সুচেতনার জীবন, সেই যৌথ জীবনযাপনের খাঁজে খাঁজে মিশে থাকা অদৃশ্য সুতোর টানের কথা ভাবতে ভাবতে উপরে উঠতে লাগলেন সুচেতনা।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook