ভ্রমর সেনের সন্দেহ

Representative Image

যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ম্যাথমেটিক্সের অধ্যাপক ডক্টর সোমনাথ বসু যখন ডিপার্টমেন্টে ঢুকলেন, তখন সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিট। একটু জিরিয়ে নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বার করে ডায়াল করলেন অমিতাভ সেনকে— ‘কীরে কখন আসছিস? আমি এসে গেছি।’ অমিতাভ সেন আর সোমনাথ বসু একসঙ্গে ক্যালকাটা ইউনিভাসিটি থেকে ম্যাথমেটিক্সে এমএসসি পাশ করেছিলেন। অমিতাভ সেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। সোমনাথ বসু তারপর আমেরিকায় পিএইচডি করতে চলে যান। অমিতাভ সেন খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছিলেন। মামাদের পাঠানো টাকায় সংসার চলত। তাই এমএসসি পাশ করে বিদেশে যাওয়া ছিল দিবাস্বপ্নের মতন। একটা ফেলোশিপ পেয়ে ডিপার্টমেন্টের এক বিখ্যাত অধ্যাপক সুবীর সেনের কাছে পিএইচডি শুরু করেছিলেন অমিতাভ সেন। কিন্তু, মনে-মনে ভাবছিলেন, একটা সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে সংসারের সুবিধা হয়। কিছুদিন পর কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে আশুতোষ কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন অমিতাভ সেন। তারপর বাড়িতে জমে উঠল টিউশনি। সংসারের হাল ফিরল। মায়ের পছন্দ করা পাত্রী ভ্রমরের সঙ্গে যখন অমিতাভর বিয়ে হল, তখন অমিতাভর বয়স উনত্রিশ। বিয়ের দু’বছর পর কন্যাসন্তান নিহিরা এল ওদের জীবনে। পঁয়ত্রিশ বছর কর্মজীবন কাটিয়ে অমিতাভ বেশ কয়েকমাস হল অবসর নিয়েছেন। সোমনাথ বসুর রিটায়ারমেন্ট-ও সামনেই। সোমনাথ অনেকবার বলেছিলেন অমিতাভকে পিএইচডিটা করে নিতে। অমিতাভ কথা শোনেননি। যে-অধ্যাপকের কাছে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন, অমিতাভ চাকরি পাওয়ার এক সপ্তাহ পর একটি পথ দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। অমিতাভ পরে আর অন্য কোনও অধ্যাপকের কাছে পিএইচডি করেননি। সোমনাথের মনে হত, অমিতাভ কলেজ আর টিউশনিতে কেমন যেন আটকে পড়েছে। অমিতাভর উচিত পিএইচডি কমপ্লিট করে ইউনিভার্সিটিতে চলে আসা। কিন্তু অমিতাভ সেন অন্য ধাঁচের মানুষ। সোমনাথ বসুর অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। অনেকদিন পর অমিতাভর সঙ্গে দেখা হবে বলে সোমনাথের মনটা বেশ ফুরফুরে। অমিতাভ আপাত গম্ভীর কিন্তু রসিক মানুষ। একটু খ্যাপাটে। কিন্তু সেয়ানা বা ধান্দাবাজ নয়। এই ভুষিমালে ভরা সমাজে অমিতাভ সেনের মতন মানুষ পাওয়া কঠিন। হঠাৎ দরজায় কেউ ঠকঠক করল আলতো করে। ‘প্লিজ কাম ইন’— বলে উঠলেন সোমনাথ বসু। দরজা খুলে হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন অমিতাভ সেন। ‘আরে তুই আমার রুমে নক করে ঢুকছিস’— বলে উঠলেন সোমনাথ বসু। তারপর তপুকে ডেকে চা দিতে বললেন। শুরু হল ছত্রিশ বছর আগে এমএসসি পাশ করা দুই বন্ধুর গপ্পো।

আরও পড়ুন: সোমক রায়ের গল্প ‘এই শহরে, এই বর্ষায়’

— ভাই অমিতাভ আগে বল আছিস কেমন? এখন তো রিটায়ার করে ঝাড়া হাত পা। মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে।

— একদম ভাল নেই।

— কেন রে কী হল? শরীর খারাপ? না কি ভ্রমরের কিছু হয়েছে?

— ধুর, আমার কিছু হয়নি! ভ্রমর বহাল তবিয়তে গান, গাছ, একপাল বান্ধবীদের নিয়ে দিব্যি আছে ।

— তাহলে?

— রিটায়ার করে বিরক্ত লাগছে। কোনও কাজ নেই সারাদিন।

— আবার স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করে দে।

— না না। ওসব পাঁচ-ছয় বছর আগে ছেড়ে দিয়েছি। নতুনরা পড়াক। আমি তো টানলাম অনেকদিন। কিন্তু, আমি সময় না কাটার দুঃখের কাহিনি বলতে তোর কাছে আসিনি। একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।‘

— সে কী আমি জানি না! ফালতু গপ্পো করার বান্দা অমিতাভ সেন নয়। বল কী প্রয়োজন।

— আমি পিএইচডি করতে চাই।

— মানে! খেয়েদেয়ে কাজ নেই! পঁয়ত্রিশ বছর কলেজে পড়িয়ে রিটায়ার করে এখন পিএইচডি! হঠাৎ মাথায় পোকা নড়ে উঠল! আগে কতবার তোকে বলেছি, একবারও আমার কথাগুলো কানে তুলিসনি। তাছাড়া আমিও কয়েকমাস পর রিটায়ার করব।

— আমি কি এটা বলেছি যে, আমি তোর কাছে পিএইচডি করব? দেখ আমি যে-টপিকে কাজ করতে চাইছিলাম সেটা সুবীরবাবু ছাড়া অন্য কারও কাছে সম্ভব হত না। উনি হঠাৎ চলে গেলেন। আর পিএইচডি আমার কাছে জাস্ট একটা ডিগ্রি নয়, যেটা চাকরি পেতে কাজে লাগে। চাকরি আমি পেয়ে গেছিলাম তাই জাস্ট ডিগ্রি বাড়িয়ে ইউনিভার্সিটিতে চাকরির জন্য পিএইচডি করার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার। প্রমোশন পেতে গাদা-গাদা অবান্তর পেপার লিখে সিভিটাকে মুদিখানার ফর্দ বানানোর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু, এখন ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করছি পিএইচডি করার। তাই এসেছি তোর কাছে। বুড়ো বয়সে কি কেউ পড়াশুনা করে না! তোদের ইউনিভার্সিটিতেই বাদল সরকার সাতষট্টি বছর বয়সে তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ পাশ করেছিলেন। আমি পিএইচডি করতে চাইছি বলেই দোষ!

— তুই এত সুন্দর পড়াস কিন্তু অন্য কথা বোঝাতে গিয়ে চিরকাল গিঁট পাকিয়ে দিস। আমার কাছে পিএইচডি করবি না তো কার কাছে করবি? ঝেড়ে কাশ।

— আমি ম্যাথে পিএইচডি করলে তোর কাছেই করতাম। কিন্তু আমি অন্য কিছুতে পিএইচডি করতে চাইছি।

— কীসে ?

— শাড়িতে।

— তুই কি আমার সঙ্গে সাতসকালে মস্করা করতে এসেছিস? রিটায়ার করে টাইম কাটছে না বলে আমাকেই পেয়েছিস?

— হ্যাঁ টাইম কাটছে না। আমি ওই স্মার্টফোন নামক খেলনা নিয়ে মেতে থাকি না দিনরাত। সকালে উঠে কুড়িটা গুড মর্নিং আর রাতে শোবার আগে উনিশটা গুড নাইট বলার রুটিন মেনে চলি না। চায়ের দোকানে আড্ডা মারতেও আজকাল ইচ্ছে করে না। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পড়াশুনাই বেস্ট। পিএইচডি করলে একটা সঠিক রাস্তায় ওই পড়াশুনা করা যাবে। তাছাড়া তোদের মতন অনেকেই বারবার বলেছে, একটা পিএইচডি করে নাও। তখন গা করিনি। এখন ভেতর থেকে ইচ্ছে জাগছে। আমি শাড়ির উপর পিএইচডি করতে চাইছি।

— তুই কাউন্সেলিং করা। তোর মাথাটা গেছে। দাঁড়া আমি তোর বউকে ফোন করছি।

— হেল্প করবি না, ফাইন। বাট বাঁশ দিসনা।

— তুই কি সিরিয়াসলি শাড়ি নিয়ে পিএইচডি করতে চাইছিস? কেন? কোন ভূতে ধরেছে তোকে?

— সেই বিয়ে হবার পর থেকে বউ কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, আমি শাড়ি চিনি না, কিনতে পারি না । জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী সবেতেই শাড়ি কিনেছি । ভ্রমর শাড়িটা হাতে পেয়ে দেখাতো যে খুব খুশি, কিছুদিন পর বলতো, এই রঙটা কমন, এই ডিজাইনটা পুরনো, তোমাকে ঠকিয়ে দিয়েছে। একদিন ঝগড়া হল। আমি শাড়ি কেনা বন্ধ করলাম। তারপর আমাকে নিয়ে শাড়ি কিনতে যেত। সেখানেও আমার মতামত চাইত। মতামত দিতাম, কিন্তু আমার মতামত আজ অবধি গ্রহন করেনি! কিছুদিন আগে আমি আবার সাহস করে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে গেলাম। আট হাজার টাকা দাম! কিন্তু, কিছুই বদলায়নি দেখলাম। প্রথমে দেখাল যে, খুব খুশি। তারপর বলল, এই শাড়ি নাকি সে দু’হাজারে কিনে আনতে পারে! খুবই কমন কালার! খুবই কমন ডিজাইন! এখানেই শেষ নয়, নিজের বান্ধবীদের সঙ্গে এই নিয়ে মেলা বকবক করেছে । তারাও জানাচ্ছে যে, তাঁদের স্বামীরাও শাড়ি কিনতে গিয়ে গাধা বনে বাড়ি ফিরেছেন। তখন আমি ভাবলাম ভ্রমরের এভাবে কথা শোনানো এবার বন্ধ করতে হবে। আমার শাড়ির নলেজ নিয়ে এত যখন খোঁটা দেয় তখন আমিও শাড়িতে পিএইচডি করে নেব। তারপর দেখিয়ে দেব। আমি আসলে বিবাহিত মহিলাদের শাড়ি কেনার ব্যাপারে ব্রেন কীভাবে কাজ করে সেই নিয়ে একটা থিসিস লিখতে চাইছি।

— অমিতাভ তুই কি একটু বেশি সিরিয়াস হচ্ছিস না! শাড়ি কেনার ব্যাপারে সব বাঙালি পুরুষরাই তাঁদের স্ত্রীদের কাছে মুখঝামটা খায়। আমিও খাই। তাই বলে একদম শাড়িতে পিএইচডি করতে যাবি কেন?

— দেখ এটা জেন্ডার ইকুয়ালিটির জমানা। একটা মেয়ে যদি ছেলেদের পোশাক সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে পারে একটা ছেলে শাড়ি সম্পর্কে জ্ঞানী হবে না কেন! আজকাল তো ছেলেরাও শাড়ি পরছে! সেদিন কাগজে ছবি দেখলাম। আমি যখন ঠিক করে ফেলেছি করেই ছাড়ব। তুই শুধু বল, তোদের ইউনিভার্সিটিতে কার সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলা যায়।

— তুই যখন সিরিয়াস তখন আমাকেও সিরিয়াস হতে হচ্ছে। শাড়ি নিয়ে পিএইচডি করতে গেলে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যেতে হবে। এখানে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। তুই অন্য কোথাও কাজ করবি?

— পাঁচ-ছয় বছর! আমি এক-দেড় বছরে থিসিস নামিয়ে দেব।

— এখানে ওসব কেউ হতে দেবে না। তুই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি যেতে ইচ্ছুক?

— হ্যাঁ। আমার ইউনিভার্সিটির নাম নিয়ে ছুঁৎমার্গ নেই। আমার কাজ আর ডিগ্রি পাওয়া নিয়ে কথা।

— গ্রেট! তুই তাহলে নিউটাউনের গুরুকুল ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর মেধা সরকারের সঙ্গে কথা বল। আমি তোকে নাম্বার দিচ্ছি। আমি নিজেও ওকে ফোন করে বলে রাখছি।

— অনেক ধন্যবাদ সোমনাথ। প্লিজ এইসব কথা কাউকে বলিস না। ভ্রমরকে একদমই না। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে চাই।


প্রফেসর মেধা সরকার গুরুকুল ইউনিভার্সিটি-র পিএইচডি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর। বয়স সাতচল্লিশ। একসময়ে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। দু’বার বিয়ে করলেও এখন নিউটাউনের একটি কমপ্লেক্সে একাই থাকেন এক শিবা-ইনু কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। অমিতাভ সেনের সঙ্গে কথা বলে তিনি বেশ উচ্ছসিত। এই বয়সে কেউ পিএইচডি করবে তাও আবার নামকরা এক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। পূর্ব নির্ধারিত দিনে মেধা সরকারের অফিসে হাজির হলেন অমিতাভ সেন।

— আসুন স্যার। আমাকে প্রফেসর বসু আপনার কথা বলেছেন। আগে বলুন চা খাবেন না কফি?

— কিচ্ছু না। আমাকে একটু ডিটেলে এখানে পিএইচডির নিয়মগুলো বলবেন প্লিজ।

— আমাদের এখানে পিএইচডি প্রোগ্রাম পাঁচ বছরের। প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা কোর্স ফি। আপনি যে-বিষয়ে কাজ করতে চাইছেন, সেটা এখানে স্কুল অফ আর্টস এর অধীনে আসবে। সেটা মাথায় রেখে আপনাকে কোর্স ফি  বললাম। প্রফেসর বসু আমাকে বলেছেন যে, আপনি শাড়ি নিয়ে পিএইচডি করতে চাইছেন। আমি নিজেও স্কুল অফ আর্টসে আছি।

— পাঁচ বছর! ইম্পসিবল! আমি দু’বছরের মধ্যে কাজ নামিয়ে ফেলতে চাই।

— আচ্ছা। এটা একটু মুশকিল। এখানে এরকম আগে ঘটেনি। কিন্তু আপনারটা অবশ্য স্পেশাল কেস হিসেবে কন্সিডার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনাকে একটা লিখিত পরীক্ষা আর ইন্টার্ভিউ দিতে হবে। সেখানে আপনি এইটটি পারন্সেন্টের উপর স্কোর করলে, আপনাকে দু’বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার সুযোগ দেওয়া হবে আর আপনার টোটাল কোর্স ফি পাঁচ লক্ষ টাকার উপর ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে।

— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি কিন্তু আপনার কাছেই কাজ করতে চাই। কবে নাগাদ এই টেস্ট হবে?

— ঠিক আছে। আপনি আমাকে পিএইচডি গাইড হিসেবে পাবেন। আর টেস্টের টাইম যখন আপনি বলবেন। একমাস টাইম নিয়ে নিজেকে একটু তৈরি করে নিন। তারপর টেস্ট আর ইন্টারভিউ হবে। কিন্তু এখানে ঢোকার পর আপনাকে কোর্সওয়ার্ক করতে হবে ছ’মাসের। রেগুলার আসার দরকার নেই । কোর্সওয়ার্ক অনলাইন করতে পারেন।

— ঠিক আছে।

— আপনার টপিকটা আমার খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে। দোকানে শাড়ি কিনতে গিয়ে একজন বিবাহিত মহিলার ব্রেন কীভাবে কাজ করে।

— হ্যাঁ। এই থিসিস লিখতে গিয়ে আমাকে শাড়ির ব্যাপারে একজন এক্সপার্ট হয়ে উঠতে হবে। শাড়ির ব্যাপারে গুলে খেয়ে ফেলতে হবে।

— এই বয়সে আপনার এই উৎসাহ সত্যিই ঈর্ষণীয়! আপনি আমার চেয়ে বয়সে, অভিজ্ঞতায় অনেকটাই বড়। কিন্তু একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না স্যার। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আইজ্যাক নিউটন বলেছিলেন, জ্ঞানসমুদ্রের বেলাভূমি থেকে আমি কয়েকটামাত্র নুড়ি পাথর সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। আপনি দেড় বছরের মধ্যে শাড়ির ব্যাপারটা গুলে খেয়ে ফেলবেন ভাবলে কিন্তু ভুল করবেন। একটা ওভারঅল আইডিয়া তৈরি হবে। এইটুকুই। খুব বেশি এক্সপেকটেশন না রাখাই ভাল স্যার। শাড়ির দুনিয়াটা সমুদ্রের মতন। আপনি একা আর কতটা জল সেখান থেকে তুলতে পারবেন বলুন!

— ওহ! আমি এতদিন জানতাম অংকের দুনিয়াটা সমুদ্রের মতন। সেখানে আমি কিছু জিনিস শিখেছি মাত্র। শাড়ির দুনিয়াটাও যে এরকম ধারণা ছিল না।

—  স্যার, ধরে নিন একটা পাড়ায় একশো জন বিবাহিত মহিলা থাকেন। দেখবেন এই একশো জনের প্রায় প্রত্যেকের শাড়ির চয়েস আলাদা। এবার আপনার শহরে কতগুলো পাড়া আছে, সেখানে কতজন বিবাহিত মহিলা আছেন, একদম বিগ ডেটা! এ-জন্যই আমার মনে হয়েছিল আপনার টপিকটা খুব ইন্টারেস্টিং।

— ঠিক আছে। আপনি আমাকে টেস্টের স্যাম্পেল প্রশ্ন ইমেল করে দিন। আমি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। তারপর আপনাকে ইমেল করে জানাব কবে আমি টেস্ট আর ভাইভা দিতে ইচ্ছুক। আজ তাহলে আসি।

— আচ্ছা। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভাল লাগল। আপনার গাইড হতে পেরে খুব ভাল লাগছে। সাবধানে যাবেন।

মেধা সরকারের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর অমিতাভ সেন টেস্ট আর ভাইভার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। একমাস পর পরীক্ষা হল। অমিতাভ সেন পেলেন প্রায় নাইনটি পারসেন্ট মার্কস। অমিতাভ সেনের অ্যাডমিশন হয়ে গেল গুরুকুল ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ আর্টস-এর পিএইচডি প্রোগ্রামে।

অমিতাভ সেন পরিশ্রমের খামতি রাখেননি। বাড়িতে দিনরাত ল্যাপটপ খুলে পড়াশোনা । ভ্রমর বলেছিল, এবার পুজোয় কাশ্মীর ঘুরে আসি। ব্যাস ওই কটা দিন শুধু পড়াশোনা হয়নি। মাঝে-মাঝে ভ্রমর রেগে যেত। রিটায়ার করেও একটা মানুষ দিনরাত পড়াশোনা করছে। তাও, জাস্ট নিজের জন্য! অমিতাভ সেন অনেক কষ্টে এইসব পড়াশোনার নেপথ্যে আসল সত্য লুকিয়ে রেখেছেন। একটা বইয়েরও হার্ড কপি কেনেননি। সব ই-বুক। বই দেখলে যদি ভ্রমর সন্দেহ করে! ভ্রমর দিনরাত গাছ আর গান নিয়ে মেতে আছে। একপাল বান্ধবী মাঝে-মাঝে বাড়িতে এসে ভাঁট গপ্পের আসর জমায়। অমিতাভর অসহ্য লাগে এসব। কিন্তু, মানুষকে কিছু একটা নিয়ে তো থাকতে হবে। সে নিজে যেমন পিএইচডি নিয়ে মেতে আছে। মেয়ে-জামাই কিছুদিন এসে ঘুরে গেল। তখন আবার কিছুদিন পড়াশোনায় তন্দ্রাভাব এল। তারপর আবার নতুন উদ্যমে চালু। অমিতাভ সেন ঘেঁটে ফেলেছেন ভারতের নানা শাড়ি আর তার ইতিহাস। তাঁত, বালুচরি, টাঙ্গাইল, জামদানি, সম্বলপুরি, বোমকাই, কাঞ্জিভরম, বেনারসি, মুগা সিল্ক, পচামপল্লি, গাদোয়াল, তসর, কাসাভু, পৈঠানি, বাঁধনি, পাটোলা, চান্দেরি, ফুলকারি, কোটা দরিয়া, লেহেরিয়া, মঙ্গলগিরি, কোসা সিল্ক, ইলকাল, চিন্তামণি, কলমকারী, চিকনকারি, ভেংকাটগিরি, পাইথানি, লুগাদে, উপ্পাদা জামদানি, আরানি রেশম, মাইসোর রেশম, বলরামপূরম, মুর্শিদাবাদী সিল্ক, কাঁথা— প্রায় কিছুই বাদ রাখেননি অমিতাভ সেন। শিখে গেছেন কীভাবে শাড়ি চিনতে হয়। ভ্রমর বাড়িতে না থাকলে, আলমারি খুলে ভ্রমরের শাড়িগুলো দেখে-দেখে নিজের জ্ঞান ঝালিয়ে নিচ্ছেন অমিতাভ। তাঁর ভাষায় এটা হল ‘প্র্যাকটিকাল’। ভাল প্র্যাকটিকালের জন্য ভাল ল্যাব দরকার। অমিতাভ সেন এক্ষেত্রে বেশ লাকি বলা চলে। ভ্রমরের তিনটে আলমারি ভর্তি শাড়ি! একদম ‘স্টেট অফ দ্য আর্ট’ ল্যাব যাকে বলে। অমিতাভ সেন দেড় বছরের মধ্যে থিসিস লিখলেন বাংলায়, যার শিরোনাম— ‘বিবাহিত বাঙালি মহিলাদের শাড়ি কেনা— একটি কলকাতা ভিত্তিক স্টাডি’ । তারপর থিসিস ডিফেন্স হয়ে গেল যথাসময়ে। অমিতাভ সেন হয়ে গেলেন— ডক্টর অমিতাভ সেন! মেধা সরকারকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন পার্ক স্ট্রিটের ব্লু ফক্স হোটেলে। মেধা সরকার ওয়াইন দিয়ে সেলিব্রেট করলেন তাঁর সবচেয়ে বয়স্ক রিসার্চ স্কলারের পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার আনন্দ। অমিতাভ সেন অবশ্য মদ-সিগারেট কিছুই খান না। কিন্তু, এই ব্লু ফক্সের সেলিব্রেশনই কাল হল অমিতাভ সেনের জীবনে। তিনি জানতেন না সেদিন একজোড়া চোখ তাঁকে দেখে ফেলেছে ব্লু ফক্সের ভেতরে মেধা সরকারের সঙ্গে। মেধা সরকার অমিতাভ সেনের কাঁধ জড়িয়ে বেশ গদ্গদ হয়ে সেলফিও তুলেছেন। অন্য কেউ হলে হয়তো গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলতেন। গভীর নয় অগভীর চুম্বন! কিন্তু, চুমু খেলে অমিতাভ সেন হার্ট ফেল করবেন ভেবে পিছিয়ে এলেন।     


ভ্রমর সেন অনেকদিন থেকেই আঁচ করছিলেন তাঁর স্বামী একটু যেন পালটে গেছেন। রিটায়ার করার পর দিনরাত ল্যাপটপ নিয়ে পড়াশোনা করতেন। সে হতেই পারে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল শাড়ি নিয়ে যেচে-যেচে জ্ঞান দিচ্ছেন। আলমারির অমুক শাড়ির প্রসঙ্গ টেনে বিস্তর বর্ণনা দিচ্ছেন। অমুক শাড়ি কেন তাঁকে মানিয়েছে অথবা অমুক শাড়ি কেন মানায়নি সেই নিয়েও নানান টিপ্পনী কাটছেন। প্রথমদিকে ভ্রমর বিশেষ গা করেননি। বয়স হয়েছে, আবার অংকের লোক! মাথায় একটু-আধটু ছিট হতেই পারে। এত বছরের দাম্পত্য জীবনে যে-মানুষটা কোনওদিন শাড়ি নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি, যে-চিরকাল ভুলভাল শাড়ি কিনে এনে ভেবে এসেছে অসাধারন শাড়ি কিনেছে, সে আজকাল বিশেষজ্ঞের মতন শাড়ি নিয়ে কথা বলছে। লোকটা তো ফেসবুকেও নেই, যে বিভিন্ন শাড়ির গ্রুপের পোস্ট দেখে জ্ঞান ফলাবে। তাহলে এত তথ্য পাচ্ছে কোত্থেকে! আর কেনই-বা পাচ্ছে! ভ্রমর সবচেয়ে অবাক হলেন তাঁর জন্মদিনটায়। অমিতাভ অনেকদিন হল নিজে থেকে শাড়ি কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। ভ্রমর এতে খুশিই হয়েছিলেন। ভ্রমর অমিতাভর সঙ্গে গিয়ে নিজে পছন্দ করে কেনে। অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করলে মতামত দেয়। অনেকসময়ে সেইসব চয়েস যে খুব খারাপ হয় তা নয়। কিন্তু, একবার অমিতাভর চয়েসে টিক দিলে অমিতাভ বারবার নিজে পছন্দ করতে শুরু করে বিপদ ঘটাবে। তাই ভ্রমর অমিতাভকে ভাল চয়েসের সাফল্য থেকে বিরত রাখে। কিন্তু, ভ্রমরের ছাপান্নতম জমদিনে অমিতাভ একটা অসাধারন মুগা সিল্ক কিনে আনল! ভ্রমর নিজেও অবাক ! এত ভাল চয়েস অমিতাভর হল কী করে! কেউ কি কিনে দিয়েছে! অমিতাভ নিশ্চয়ই তাহলে বলত। কিন্তু, ভ্রমর নিজের উচ্ছাস সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে। বলেছে, ঠিকঠাক চয়েস, খারাপ নয়। অন্যান্য বারের মতন, দাম বেশি নিয়েছে, জঘন্য কালার, কেনার আগে আমাকে ফোন করোনি কেন এসব বলেনি। যদিও মনে একটা কুটকুট থেকে গেছিল। অমিতাভর এরকম পরিবর্তন হল কী করে! কিন্তু, ভ্রমরের বান্ধবী চৈতালির একটা ফোনে সেই কুটকুটের মাত্রা কয়েক কোটি গুণ বেড়ে গেল!

অমিতাভ আর মেধা যেদিন হোটেল ব্লু ফক্সে গেছিলেন সেদিন চৈতালিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর এক বান্ধবীর সঙ্গে। অমিতাভ খেয়াল করেননি। চৈতালির এমনিতেই অন্যের লাইফে উঁকি দেওয়ার খুব শখ। নিজের জীবনে বিশেষ কাজ নেই তাই গসিপ সংগ্রাহকের জীবিকা গ্রহণ করেছেন সানন্দে। হোটেল ব্লু ফক্সে ভ্রমরের হাজব্যান্ড অমিতাভ সেনকে এক সুন্দরী মহিলার সঙ্গে দেখে চৈতালি পুলকিত হয়ে উঠেছিলেন। সেলসের লোকেদের যেমন প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট টার্গেট রিচ করতে হয় চৈতালির মতন গসিপ সংগ্রাহককেও প্রতিদিন গসিপ খুঁজতে হয়। কোনওদিন জোটে, কোনওদিন জোটে না। হোটেল ব্লু ফক্সে অমিতাভ সেনকে এক সুন্দরী মহিলার সঙ্গে দেখতে পাওয়াটা চৈতালির কাছে সামনের সাতদিনের খোরাক! ঘটনাচক্রে চৈতালি সেই সুন্দরী মহিলাকে ফেসবুকের মাধ্যমে চেনে। মেধা সরকারের ফ্রেন্ডলিস্টে আছে চৈতালি। মেধা সরকারের দু’টি ডিভোর্স সম্পর্কেও সে অবগত । সেদিন ব্লু ফক্সে দেখা সবকিছু বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে সামান্য রঙ চড়িয়ে চৈতালি বলেছিল ভ্রমরকে। ভ্রমর প্রথমে ভেবেছিল অমিতাভর পুরনো ছাত্রী হয়তো। কিন্তু, মেধা সরকারের গপ্পো শুনে তাঁর মাথায় রাগের পাহাড় গজিয়ে উঠল। তাঁর আর বুঝতে বাকি রইল না কোনওকিছু। একত্রিশ বছরের দাম্পত্যে যে-স্বামী তাঁকে কোনওদিন ঠকায়নি, এই বুড়ো বয়সে এসে এক ডবল ডিভোর্সি মহিলার জন্য তাঁর ভীমরতি হয়েছে! মাথায় আগুন জ্বলছে ভ্রমরের। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল চৈতালি দেখেছে সবকিছু। এবার সে গোটা দুনিয়াকে জানাবে। নাম পালটে গোটা ঘটনাটা ফেসবুকে লিখবে। সেটা ভাইরাল হবে। ভ্রমর তাঁর মেয়ে নিহিরাকে ফোন করলেন। নিহিরা তখন অফিসের রুফটপ রেস্তরাঁয় লাঞ্চ করছিলেন ।

— হ্যাঁ, মা বলো।

— একটা জরুরি কথা আছে। তুই এখন কথা বলতে পারবি?

— হ্যাঁ হ্যাঁ। বলো না।

— তোর বাবা পরকীয়া করছে।

— কী! বাবা এক্সট্রা ম্যারিটাল করছে! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

— হ্যাঁ। মাথা খারাপই হয়েছে এখনও খুনখারাপি হয়নি। বুড়োভামের রস কত! ডবল ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে ইনটিমিনটি! মহিলা গলা জড়িয়ে সেলফি তুলেছে, ওয়াইন খেয়েছে। রাবিশ!

— তুমি কীভাবে জানলে? বাবার পেছনে লোক লাগিয়েছিলে?

— না। তোর বাপ ডুবে-ডুবে জল খায়। আমায় কয়েকদিন হল শাড়ি নিয়ে খুব জ্ঞান দিচ্ছিল। আমার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু গা করিনি। আমাকে একটু আগে চৈতালি ফোন করে বলল, যে দু’দিন আগে হোটেল ব্লু ফক্সে মেধা সরকারের সঙ্গে তোর বাবা লাঞ্চ করতে গেছিল। চৈতালি দেখে ফেলেছে। এবার গোটা পৃথিবী জেনে যাবে।

— তুমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করোনি? বাবা কোথায় এখন? আর মেধা সরকার কে?

— উনি এখন বাড়িতে নেই। কোন যমের দুয়ারে গেছেন উনিই জানেন। মেধা সরকার একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ফেসবুকে আছে, দেখে নে। ওই ছেচল্লিশ বছর মতন বয়স হবে। বাচ্চাকাচ্চা নেই, ফ্ল্যাটে একটা কুত্তা নিয়ে একা থাকে।

— শোনো মা, আগে থেকেই এত মাথা গরম কোরো না। তোমার ওই গসিপরাণী চৈতালির কথায় অত নেচো না। বাবার সঙ্গে ডিরেক্টলি কথা বলো। আমি ফেসবুকে মেধাকে সার্চ করে দেখি। তুমি লাইনে থাকো।

— আমি সন্দেহ করতাম না। কিন্তু শাড়ি নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে! আবার আমাকে একটা দারুণ মুগা সিল্কের শাড়ি গিফট করেছে। তোকে তো ভিডিও কলে সেদিন দেখালাম। এত ভাল চয়েস হয় কী করে রাতারাতি! এটা নিশ্চয়ই মেধা সরকার চয়েস করে কিনেছে। মেধাকেও একটা দিয়েছে নিশ্চয়। ওকে বেশি দামেরটা দিয়েছে আর আমাকে কম দামের।

— মা প্লিজ! একটু থামো। মেধা সরকারকে তো দারুণ দেখতে। ইনি কোনওদিনই বাবার মতন লোককে পছন্দ করবেন না।

— চুপ কর। দু’বার ডিভোর্স হয়ে বুঝে গেছে। এখন তোর বাবার মতন মাটির মানুষকে টার্গেট করেছে।

— বাবা ফিরলে তুমি প্লিজ বাবার সঙ্গে কথা বলো।

— ঠিক আছে। রাখছি।

নিহিরা ফোন রাখার দশ মিনিট পর বাড়ি ঢুকলেন অমিতাভ সেন। একটু ক্লান্ত। ভ্রমরকে খাবার বাড়তে বললেন। ভ্রমর কিচ্ছু বললেন না। উনি ঠিক করেছেন হাতেনাতে ধরবেন অমিতাভকে। খেতে বসে অমিতাভ কথা শুরু করলেন।

— আজ লটে মাছের তরকারিটা দারুণ হয়েছে।

— মালতির মা মাঝেমাঝে ভালই রাঁধে।

— তুমি আজ বিকেলে কি ফ্রি আছ, না কি তোমার ওই মধ্যমেধার বান্ধবীদের সঙ্গে ভাঁট গপ্পের প্ল্যান।

— হ্যাঁ সবার তো আর তোমার মতন পিওর মেধা জোটে না । না কোন প্ল্যান নেই।

— ভাবছি আজ বিকেলে তুমি আর আমি পার্ক স্ট্রিটে যাবো। কোথাও একটু খাব। আমাদের বিবাহবার্ষিকী সামনেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে গড়িয়াহাট এসে তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনব। তারপর ফিরে আসব। তুমি পার্পল কালারের বাঁধনি শাড়িটা পরবে? ওটায় তোমাকে দারুণ লাগে। তোমার পার্সোনালিটির সঙ্গে দারুণ মানায়। বাঁধনি শাড়ির ইতিহাসটাও খুব ইন্টারেস্টিং। ওই শাড়িটা তো তুমি গত বছর রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে কিনেছিলে। বাঁধনির জন্ম কিন্তু গুজরাটে, খাতরিদের হাতে। সে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিল্ক রুট দিয়ে পারসিদের সঙ্গে এদেশে এসেছিল এই শিল্প। মুঘল যুগে এই বাঁধনি শিল্প জনপ্রিয় হয়। ভাবতেও অবাক লাগে এত বছর আগের একটা আর্ট এখনও এত পপুলার।

— শাড়ি সম্পর্কে এত জ্ঞান তোমার আগে জানতাম না! কলেজে তো অংক করাতে। শাড়ি নিয়ে আমার বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করলে তুমি বলতে মধ্যমেধার চর্চা! এখন মধ্যমেধা কি মেধা হয়ে গেছে!

— না মানে কিছু না। তুমি-ই বলতে আমি শাড়ির কিছু বুঝিনা। এখন আমি তোমার চেয়ে বেশি বুঝি।

— হ্যাঁ। শাড়িতে এখন মেধার স্পর্শ পেয়েছ। স্বাভাবিক।

— কী বলতে চাইছ তুমি?

— ন্যাকা ষষ্ঠী আমার!

— খুলে বলো।

— ব্লু ফক্সে গিয়ে যে রাসলীলা করে এসেছ সেটা চৈতালি দেখেছে। আমার ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে বুড়ো বয়সে তুমি এই কাণ্ড ঘটাবে।

— চৈতালির যে খেয়েদেয়ে কাজ নেই সেটা আবার প্রমান করল। একদম ফালতু মহিলা।

— হ্যাঁ, তোমাকে দেখে ফেলেছে ইনটিমিনটি করতে। ফালতু তো হবেই। কীসের জন্য তুমি এসব করছ? শরীর? এই বুড়ো বয়সে এত রস!

— তুমি নিজেও জানো না কতটা ফালতু বকছ। চৈতালির সঙ্গে মেশার কুফল।

— মেধা সরকার কে?

— আমার গাউড।

— গাইড! বলো, ফ্রেন্ড ফিলোজফার গাইড! মুগা সিল্কটা ও চয়েস করেছে নিশ্চয়ই! আর নিজেও একটা নিয়েছে তোমার থেকে।

— বাংলা সিরিয়াল আর ওয়েবসিরিজ দেখে-দেখে তোমার এইসবই মাথায় আসে। মেধা সরকার আমার পিএইচডি গাইড। আর কিছু নয়। সেদিন ব্লু ফক্সে ওকে আমি পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার জন্য ট্রিট দিতে গেছিলাম। ইডিয়ট চৈতালি সেসব দেখে তোমাকে আলফাল গপ্পো দিয়েছে।‘
— শাক দিয়ে মাছ ঢাকা শুনেছিলাম কিন্তু পিএইচডি দিয়ে পরকীয়া ঢাকা প্রথম শুনলাম। মেধা সরকার ইংরেজি পড়ায়। তুমি অংকের লোক হয়ে তাঁর কাছে পিএইচডি করেছ! পরকীয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গাঁজাও খাচ্ছ না কি আজকাল?’

— তোমাকে আজ সব খুলে বলতাম। সেইজন্যই বিকেলে খেতে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু মাঝখান থেকে ইডিয়ট চৈতালি এসে সব ঘেঁটে দেবে কী করে জানব!

— কী বলতে তুমি?

— আমি গত দেড়-দুই বছর ধরে মেধা সরকারের কাছে পিএইচডি করেছি। কিছুদিন হল ডিগ্রি পেয়েছি। তবে ম্যাথে নয় শাড়ির উপর পিএইচডি। থিসিসের টাইটেল— ‘বিবাহিত বাঙালি মহিলাদের শাড়ি কেনা— একটি কলকাতা ভিত্তিক স্টাডি’। তুমি সারাজীবন আমাকে শাড়ি কেনা নিয়ে কথা শুনিয়েছ। রিটায়ার করার পর দেখলাম হাতে প্রচুর সময়। তাই ভাবলাম শাড়ির উপর একটা পিএইচডি করে ফেলি। সময়ও কাটবে। আর তোমাকে শাড়ি চয়েস করতে আমিও হেল্প করতে পারব। কারণ এখন আমি শাড়ির ব্যাপারে যথেষ্ট শিক্ষিত। কিন্তু, আমি এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে চৈতালি বলল, আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে!

— আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, তুমি শাড়ির উপর একটা থিসিস লিখে ফেলেছ দেড় বছরে!

— হ্যাঁ, আমাকে নয় তুমি চৈতালিকে বিশ্বাস করো।

— তোমার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার সময়ে আমাকে অনেকেই বলেছিল যে, অংকের লোকজন ক্ষ্যাপা হয়। সাবধান!

— হ্যাঁ বেশ করেছি ক্ষ্যাপামি করেছি। তোমার জন্য করেছি। তোমাকে ভালবাসি বলে করেছি। তুমি সারাজীবন আমাকে শাড়ি কেনা নিয়ে কথা শুনিয়ে যাবে আর আমিও শুনে যাব, এটা চলবে না। যাইহোক, তোমাকে মেধার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমাকে অনেক হেল্প করেছে।

— হ্যাঁ ঠিক আছে। বিকেলে কখন বেরবে?

— তুমি যখন বলবে ডার্লিং।

— ঢং! বুড়ো বয়সে আবার ডার্লিং! এগুলো কি মেধা শিখিয়েছে?

— শোনো, একদিন তুমি, আমি, চৈতালি আর মেধা একসঙ্গে লাঞ্চ করব। রাজি আছ?

— থাক। অনেক হয়েছে। দেখি আজ তুমি কীরকম শাড়ি কেনো। আমি কিচ্ছু বলব না।

সেদিন গড়িয়াহাটের এক নামকরা শাড়ির দোকান থেকে ডক্টর অমিতাভ সেন তাঁর স্ত্রী ভ্রমর সেনের জন্য একটা দামি শাড়ি কিনলেন। কেনার সময় দোকানদারদের শাড়ি নিয়ে নানান জ্ঞান দিলেন। দোকানদার শুনে খাবি খাচ্ছিল! ভ্রমর কিছু বলেননি। অমিতাভ সেন একশো শতাংশ শিওর যে উনি দারুণ শাড়ি কিনেছেন আর ভ্রমরের পছন্দ হয়েছে। রাতে ভ্রমর ফোন করলেন তাঁর মেয়ে নিহিরাকে।

— তোর বাবার কোনও পরকীয়া নেই। চৈতালি ফালতু বকেছে।

— তোমাকে আগেই বলেছিলাম।

— তোর বাবা মেধা সরকারের কাছে শাড়ির বিষয়ে পিএইচডি করেছে গত দেড়-দুই বছর ধরে আর ডিগ্রিও পেয়েছে। আমাকে এখন দিনরাত শাড়ি নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে।

— কী বলছ! সিরিয়াসলি! আমি জানি আমার বাবা জিনিয়াস। বিদেশে চলে গেলে কত নাম করত।

— হ্যাঁ জিনিয়াস-ই বটে। আমি শাড়ি কেনা নিয়ে এতদিন খোঁটা দিয়েছি বলে উনি শাড়ির উপর পিএইচডি করে নিলেন যাতে আমি কিছু বললে উনিও জবাব দিতে পারেন।

— বাহ। কাল বাবাকে ফোন করে ডিটেলে সব শুনব। একটু বাদে আমি ইউএস ক্লায়েন্টের কলে ঢুকব। আর কিছু বলবে?

— হ্যাঁ, আর একটা কথা। শাড়িতে পিএইচডি করেও তোর বাবার কোনও লাভ হয়নি!

— মানে?

— আজ গড়িয়াহাট রাজনন্দিনী থেকে আমার জন্য একটা জামদানি কিনেছে। আমি কিচ্ছু বলিনি। উনি ভাবছেন দারুণ চয়েস করেছেন। কিন্তু, শাড়িটা আমার একদম-ই পছন্দ হয়নি। বেশ খারাপ চয়েস!