শেষ নাহি যে…

Representative Image

‘We are all mortals until the first kiss and the second glass of wine’— Eduardo Galleano

নাটা কাঁদতে পারত না। নচিকেতার নীলাঞ্জনা গানটা বারবার শুনত কেবল। সায়কদের বাড়ি। প্রথম ভিসিডি প্লেয়ার। টিউশান শেষে হলদে চিকচিকে কাগজে মোড়া সিডি। এক জোড়া। ‘নচিকেতার জীবনমুখী গান’। চারপাশে গোল হয়ে বসে শুনলাম— ‘হিন্দী গানের কলি, সদ্য শেখা গালাগালি একঘেয়ে হয়ে যেত সময়ে সময়ে’। এই একঘেয়েমির মধ্যেই বুকের কাছ থেকে গলা অবধি দলা পাকিয়ে উঠত নাটার। কান্না নেই। কান্নার মতো কিছু। সবার মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করতাম আমরা। গেলাসে-গেলাসে। কাকিমার ধূপের ধোঁয়া উড়ে-উড়ে চলে যাচ্ছে দেওয়ালে সাঁটানো সচিনের পোস্টারের দিকে। সানগ্লাস পরা সচিন। হাতে এমআরএফ নিয়ে পোজ। পেপসির বিজ্ঞাপন। আমাদের সাইকেলগুলো ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে আছে। নাইন্টিয়ানার গায়ে হেলান দিয়ে যেভাবে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে আছে একটা নতুন দশক।

আরও পড়ুন: রক্তাক্ত সংঘর্ষ থেকে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা। ময়দানের মোহনবাগানি ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়!
লিখছেন স্বস্তিক চৌধুরী…

অরিন্দমকে মনে পড়ে খুব। এই সাইকেলের মিছিল থেকে একটা নিয়ে ও খুব জোরে প্যাডেলে চাপ দিল একবার। আমাদের সবার আগে। ক্লাসিকো দেখবে। আমরা ভেবেছিলাম, ক্লাসিকো কোনও দলের নাম। কিংবা প্লেয়ারের। ও খুব হাসল। ক্লাসিকো— স্প্যানিশ শব্দ। তার আগে একটা ‘এল’, এল-ক্ল্যাসিকো। ও বুঝিয়ে দিল— ‘ওরে মূর্খ, এল মানে ইংরিজিতে ‘দ্য’, আর ক্লাসিক থেকে ক্ল্যাসিকো— স্প্যানিশ জিভে। বার্সেলোনা-কাতালান ক্লাব। স্পেন-কাতালান রাজনীতি বুঝিনি কিচ্ছু। অরিন্দম তখনও শেখায়নি এত সব। শুধু বলেছিল— ‘একটা ছেলে আজ নামবে। রাতে। দেখিস।’ ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডের বার্সেলোনা। মনে পড়ছে, দু-হাতের আঙুল মুখে ভরে শিস দিচ্ছে রাইকার্ড, আর অদ্ভুত-আশ্চর্য একটা ছন্দে, দুলছে সবটা।

আমাদের চ্যাপেলের আপেল মুখে ছক্কা মারার প্রবল খিদে যে-সময়টায়, সৌরভের কামব্যাকের জন্য হিরো হোন্ডা ব্যাট নিয়ে বিকেল ধুলো-ধুলো করে দিচ্ছি যে সময়টায়, দ্রাবিড়কে মন্দার বোসের মতো দুষ্টু লোক সাজিয়ে যখন আগুন ঝরাচ্ছে খবরের কাগজ— তখন একটা মাঝরাত সব এলোমেলো করে দিল হঠাৎ। নচিকেতার গান শুনে থম মেরে যাওয়া নাটা প্রথম ঝরঝর করে কাঁদল বোধ হয়।

পাটিগণিতের অঙ্কে, মোক্ষম ভুল করে যেভাবে অবলীলায় খাতা জমা করে দিতাম আমরা— সেভাবেই অবলীলায় ছুটছে একটা ছেলে। রোনাল্ডিনহোর বার্সেলোনা, স্যাম্যুয়েল এটোর বার্সেলোনা— লাল-নীল কাতালান সাম্রাজ্যে মরশুমের প্রথম কালবৈশাখীর মতো এসে পড়েছে যেন। পেকেরম্যানের আর্জেন্টিনা, রিকেলমের আর্জেন্টিনা, ক্যাম্বিয়াসো-তেভেজের আর্জেন্টিনায় ওকে দেখেছি বছরখানেক আগে। একটা সাদা-নীল পাড়া ছিঁড়েফুঁড়ে দেওয়া হলদে জামার আদ্রিয়ানোর কোপা আমেরিকায় দেখেছি ওকে। নেহাতই বাচ্চা— আঠেরোর লিওনেল। সেই ছেলেটাই এ? এমন অবিশ্বাস্য স্প্রিন্ট? বাঁ-পায়ে বল রেখে ম্যাজিকের মতো মাঠের প্রান্ত থেকে ঢুকে আসছে ভেতরে। হারপুনের মতো বিঁধছে। নিস্তেলরুই-কে মনে পড়ে, গোল করে উচ্ছ্বাস করেছিল, তারপর অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। খেলা শেষে হাত মেলানোর সময়ে একটা ‘উফফ…’ বেরোল। অস্ফুটে। হ্যাটট্রিক।

প্রথমবার বিয়ারে চুমুক দিয়ে নাটা বলেছিল— ‘ভেতরটা জ্বলছে রে, খুব, যেন কেউ খুবলে যাওয়া নখের ওপর টিংচার আয়োডিন মারছে!’— আমাদের যে থমথমে হয়ে আসা কৈশোর, যেখানে লাল-ফিতে সাদা-মোজার অমোঘ আকর্ষণে আমরা অদৃশ্য ছুরি হাতে চেপে শুষে নিচ্ছি যন্ত্রণার সমস্ত আঘ্রাণ, জীবন যখন বারেবারে জীবনবিজ্ঞান বইয়ের পাতা খুলে মনে করিয়ে দিতে চাইছে, মানুষ আসলে, কোষ-কলার সমষ্টি, তাই মানুষ মরণশীল। ঠিক তখনই, একেবারে মোক্ষম সময়ে গ্যালিয়ানো সাহেবের সেই প্রথম চুমু আর ওয়াইনের দ্বিতীয় পেয়ালা হয়ে এলেন মেসি। আমরা দেখলাম, বুঝলাম এবং নিশ্চিত বিশ্বাস করলাম, আমাদের জহরমানিক বোঝাই করার সেই টিনের বাক্স আজ খুলে গেছে। এবার শুধু মুহূর্ত জমানোর পালা— আর তার সঙ্গে এ-ও বুঝেছিলাম, এই সব খুদকুঁড়ো মুহূর্তদের চকমকির টান ছেড়ে এ-জীবনে আর আমাদের মুক্তি নেই। ২০১০ সালে। বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র অস্থির হয়ে গেল হঠাৎ, আমাদের ইশকুলবাড়ির গেটের ভেতরে, রোজের কাগুজে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর ঢুকে এল হুড়মুড় করে। নাটার বাবা লালপার্টি করে, তবু পালাবদলের হাওয়ার মাঝে নাগাড়ে বলেছিল- ‘বাংলার মাটি তোরা চিনিস না, এখানে বদল অত সহজ না।’

আমাদের কাছে এসবের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি হয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার সবুজের বুকে বেজে ওঠা একটা গান— কে’নান-রিফিউজি। গাইলেন- ‘হোয়েন আই গেট অর্ডার, আই উইল বি স্ট্রঙ্গার, দে’অল কল মি ফ্রিডম জাস্ট লাইক অ্যা ওয়েভিন ফ্ল্যাগ…’, যে মুক্ত পতাকার নিচে ক্ষমতার লড়াই খুঁজছিল ঝান্ডা ধরার হাত, আমরা খুজছিলাম মেসিকে। আফ্রিকার ঐ বিশ্বকাপ। ভুভুজেলা। রঙিন। ঝলমলে। সাদাকালো জাবুলানি। মেসির পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ফুটবল ঈশ্বর— মারাদোনা। আমরা প্রদীপ স্পোর্টসে বেণুদার দোকান থেকে নীল-সাদা জার্সি কিনে গান বেঁধে ফেলেছি—‘মাঠের মাঝে আর্জেন্টিনা/মনের মাঝে মেসি/বুকের মাঝে মারাদোনা/তাতেই আমরা খুশি…’;

অথচ, মারাদোনার দু’-হাতে দুটো ঘড়ির তুকতাক কাজে এল না। অসহায় মারাদোনার মুখ। কাকা বলেছিল, আন্দ্রে ব্রেমের সামনে মারাদোনাকে নাকি নব্বই-এর ফাইনালে এমনই লাগছিল। আবার জার্মানি? মেসির ওপর সমস্ত দুনিয়ার বাজি। অথচ, হল না। মুলার-ক্লোজে-ল্যাম-সোয়াইনস্টাইগার ছিন্নভিন্ন করে দিল নীল-সাদা আকাশ। মেসির মুখটা দেখে আমাদের রাগ হয়েছিল খুব। এত নির্লিপ্ত কেন? ও মারাদোনা নয়। হতে পারে না। মেজ মামাদের স্কুলের গেটের বাইরে নাকি বুকুন পাগল, নব্বইয়ে মারাদোনার কান্নার একটা ছবি দেখলেই হাউ-হাউ করে কাঁদত। কোথায় কী? এই ছেলেটা রোবট। বার্সেলোনার গোলমেশিন। মারাদোনার মতো চরিত্র ও না। হতে পারে না। পরের দু’বছর ওয়েম্বলির ফাইনাল-ট্রেবল-রেকর্ড গোল, সবকিছু ছাপিয়েও যেন আমাদের অভিমান ভাঙাতে পারল না মেসি। কেন? আমাদের পাগলামি অত ঠুনকো না কি? শুধু ক্লাবের হয়ে হম্বিতম্বি? দেশের হয়ে যেন দায়সারা ভাব। মুখ খুলে জাতীয় সংগীত গাইতে পারে না। ব্রাজিলের ওই টিকা-টিপ্পনির বিরুদ্ধে আমাদের তো দরকার ছিল একটা ফ্রন্ট, একটা রোয়াব। মারাদোনার মতো বাজার যদিও ততদিনে নেক্সট মারাদোনা বানিয়ে দেদার মুনাফা লুটছে এই সাড়ে পাঁচফুটের ছেলেটার থেকে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপটা যেন অগ্নিপরীক্ষা। মারাদোনা বিশ্বজয় করেছিল সাতাশে। মেসির সেবার বয়স সাতাশ। চন্দননগরে কোন জ্যোতিষি মারাকানার ফাইনালের আগে বলে দিল— ‘এই মাহেন্দ্রযোগ! এবার জিতবেই…’

ঐ বসনিয়ার বিরুদ্ধে গোল করে জার্সি টেনে চিৎকার, ইরানের বিরুদ্ধে একতা পুসকাস জেতার মতো গোল, নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রি-কিক- আমরা জানতাম এবার হবে। হব্বেই। হল না। চীনা ফটোগ্রাফারের তোলা সেই কাল্ট ছবিটাই আমাদের বুকে উল্কি এঁকে বসে গেল। দগদগে ঘায়ের যন্ত্রণার মতো। মারিও গোটজে। ১১৩ মিনিট। আর হবে না। কোনওদিন হবে না। হিগুয়েন ঐ মিস করল? আর ও নিজেও তো, নয়্যারকে কাটিয়ে বাইরে মারল! প্যালাসিও? অমন একটা মিস? নাটাদের ভাড়াবাড়ির বারান্দায় জার্সিটা ফেলে রেখে পালিয়েছিল কেউ। আর পরবে না। কোনওদিন। ঐ যে, জহরমানিক জমানোর কৌটো— যা আমরা সঙ্গে নিয়ে উড়ে যেতে চাইছিলাম পক্ষীরাজে চেপে, তার ভেতরে যেন কেউ ভরে দিল তিন ভুবনের ভার। স্মৃতিকে যে রূপোর কাঠি ছোঁয়ালেই সে সুখস্মৃতি হয় না— তা বুঝিয়ে দিল ঐ মারাকানার ভোররাত। আমাদের উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো বিকেল, দু’-বেলা ফুটবল আর ক্রিকেটের বাড়বাড়ন্তে অতিষ্ঠ গলির মোড়ের ঝুলবারান্দায় বসে থাকা খিটখিটে রমেনদাদু, কিস্যু বোঝেনি। বোকার মতো বলত— এই জেনারেশনে একটা লোথার বা মারাদোনা আসবে না। চোখের কাছটা জ্বলত, মনে হত— তুমি জানতেই পারো না, কখন কে কোথা দিয়ে এসে যায়— মুগ্ধমদিত দু’নয়ানে! হায়!

মুখ খুলে জাতীয় সংগীত গাইতে পারে না। ব্রাজিলের ওই টিকা-টিপ্পনির বিরুদ্ধে আমাদের তো দরকার ছিল একটা ফ্রন্ট, একটা রোয়াব। মারাদোনার মতো বাজার যদিও ততদিনে নেক্সট মারাদোনা বানিয়ে দেদার মুনাফা লুটছে এই সাড়ে পাঁচফুটের ছেলেটার থেকে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপটা যেন অগ্নিপরীক্ষা।

এই চোখজ্বালা বেড়ে-বেড়ে ফসকে যায় আমাদের কোপা। একের পর এক। আমাদের হাতে ধরে মেসি-আচমন করানো অরিন্দম কলেজে উঠে কী ভীষণ বড় হয়ে যায়। যেন বলে- ‘ভালবাসলে, নিঃস্বার্থ হতে শেখ— শুধু চাই-চাই করিস না…’; আমরা আর কই পারলাম অত বড় হতে? আমরা পাগলের মতো চাইলাম, একটা ভাঙাচোরা টিম নিয়েও মিরাক্যাল হোক রাশিয়ায়, মার্কাস রোজোর শেষ মিনিটের গোলে নাইজিরিয়াকে মাটি ধরানো আর্জেন্টিনার ফানুস যে সেমিফাইনালেই ফুস হবে তা মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি তেমন। আমরা জানি— এই অবসর ভেঙে ফেরা লোকটা বোকা। পড়ে-পড়ে মার খেতে ফিরছে। বারবার। কাতার বিশ্বকাপ বলে কোনও ইউটোপিয়া আমাদের জন্য ও জমিয়ে রেখেছে এ-কথা কি আর জানতাম? বা কেউ বললেও বিশ্বাস করতাম? 

মন্যিয়েলের ঐ শটের পরই আসলে আমরা সেই কৈশোরে রাইকার্ডের সামনে খুলে ফেলা টিনের বাক্সটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মেসি যে আর আর্জেন্টিনায় খেলবে না, মেসি যে আর হয়তো ফুটবলটাই খেলবে না— একথা শুনে এত উতলা হচ্ছি না কেন? আমরাও কি অরিন্দমের মতো বড় হয়ে গেলাম? নাকি আমরা জানি, এডুয়ার্ডো গ্যালিয়ানো মিথ্যা বলেন না। বলতে পারেন না। আমাদের নশ্বর জীবনে ঐ একটা রাত, ঐ কিছু মুহূর্ত এসেছিল খুব অদ্ভুত সময়ে— আমাদের ফিকে হয়ে আসা নাইন্টিজের কাছে ঐ ছিল প্রথম চুম্বন। আর পুরনো ওয়াইনের দ্বিতীয় পেয়ালা। এরপর আমাদের মৃত্যু নেই। বুড়িয়ে যাওয়া আছে। ফুরিয়ে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে ওঠা আছে। কিন্তু মৃত্যু নেই নিশ্চিত। লিওনেল, বেঁচে থাকা মানে কেবল যন্ত্রণা— আপনি জানেন, তাও আপনি আমাদের মুক্তি না দিয়ে, স্মৃতির কাছে বেঁধে রেখে দিলেন; নাইন্টিজের পাতাঝরার মরশুমে আপনি আমাদের স্মৃতিবৃক্ষের গায়ে আঁকড়ে রেখে দিলেন কেমন— বন্ধুরা পুরনো পাড়া ছেড়ে চলে গেছে কত কত দূরে, দেখা নেই, কথা নেই— শুধু জমানো স্মৃতির সেই বাক্সে আমরা রাত বাড়লে, হাতড়ে নিই যৌথ স্মৃতি। এ-যন্ত্রণার কাছে পাকাপাকি বেঁধে ফেলতে পারলেন কেবল আপনিই। আপনার কৈশোর থেকে যৌবনের সায়াহ্ন অবধি সবটুকু আমরা, হারানো বন্ধুরা, বহু-বহু দূরে বসেও পাজল গেমের মতো সাজাতে থাকব আজীবন…