আজ মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা সময় ছিল, যখন বাংলা মূলধারার ছবির প্রতি মানুষের বড্ড বিশ্বাস ছিল। ছবি বিশ্বাস সেই যুগের স্থপতিদের অন্যতম, এক সম্রাট।
প্রথম লাইনটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দ্বিতীয়টা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে কি না, সেটা পরে দেখা যাবে’খন।
মাত্র দু’একদিন আগে, এক বাংলা সিনেমা সংক্রান্ত সেমিনারে বসে, কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হল, এই যে আমরা এখনকার বাংলা ছবির সমস্যা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করি, পডকাস্ট বা প্রবন্ধে ভাবি, ভাবি কেনই বা লোকে হলে সপরিবার যায় না, কেন তাদের এহেন অসদাচারণ? ভাল ভাল শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যে হিসহিসে জ্বালাটা, সেটা অরিন্দম বলেছিল নায়কের প্রথম দৃশ্যেই। ‘শালা পাবলিক, হুইমজিক্যাল, শালাদের স্টিম রোলার দিয়ে ফ্ল্যাট করে দিতে পারলে…’।
আরও পড়ুন : সুরের লড়াইয়ে জিতে উৎপলা সেনের থেকে সিগারেট উপহার পেয়েছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়!
লিখছেন সোমনাথ শর্মা…

উক্তিতেও প্রায় এই ক্ষোভই আরও সরলভাবে লুকিয়ে ছিল। এই প্রশ্নের একটা উত্তর কি এটা হতে পারে যে, ছবি বিশ্বাস যে-যুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিনিধি, সে-যুগে সিনেমা বোঝা-র ‘বোঝা’, বা, বাতিক সাধারণ লোক পর্যন্ত পৌঁছয়নি? সাধারণ দর্শক ‘বই’ বিশ্বাস করে দেখত? ভুলে যেত, না কি জানত বা ভাবতই না যে, এটা মায়া, বানানো, আসলে ক-এর সঙ্গে খ-এর ঝগড়া নেই, গ-এর সঙ্গে প্রেমও নয়। ওই বাড়িটার শুধু তিনটেই দেয়াল, তাও প্লাইউডের, জানলার বাইরেও সূর্য নয়, স্বপনের চিতাও নয়, প্রকাণ্ড আলো, রিফ্লেক্টর আর ফ্ল্যাটের ছটা।
তারা কাঁদত, হাসত, হলের বাইরে, বা বাড়িতে গিয়ে দিনসাতেক আলোচনা করত, কার কোন মুহূর্তে কী করা উচিত ছিল, কী করলে কী হতে পারত, অনেকসময় পর্দায় ছবি চলাকালীন সুচিত্রা সেনকে চেঁচিয়ে বা ফিসফিসিয়ে পরামর্শ দিত, উত্তমকে সব বলে দিতে, বুকে পাথর চাপা দিয়ে কষ্ট পাওয়ার দরকার কী?
আজকের ভাষায় একে বলে রিলেট করতে পারা। সেই বিশ্বাসের যুগেই ছবিবাবুর প্রতাপ।
সে-যুগের সিনেমায় ছবি বিশ্বাস, অন্তত তাঁর জীবনের একটু প্রৌঢ় সময়ে ছিলেন আভিজাত্যের অমোঘ প্রতীক— এ-কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তিনি অভিজাত পরিবারেরই সন্তান, কিন্তু সেটা তো তখন অজস্র! বাঙালির আর্থিক সমৃদ্ধির যুগের শেষ আলোটুকু তখনও বেশ জোরালো। বহু পরিবার, বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য কলকাতায়, তখনও প্রাসাদোপম সব অট্টালিকায় বসবাস করেন। প্রবীণরা আক্ষরিক অর্থেই পরিবারের প্রধান, পছন্দের বার্নিশ করা ছড়িটি নিয়ে সন্ধের ঝোঁকে গঙ্গার ধারে কি দিঘির পাড়ে হাঁটতে যান, ফিরে এসে রাতে দুধের সঙ্গে সামান্য অহিফেনও থাকে। একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে, কিন্তু তখনও অবধি ভাঙাটা ব্যতিক্রম, তা-ই গল্পের উপাদান। এখন যেমন উল্টোটা।
কাজেই অভিজাত মানুষজন সিনেমাজগতে আসতেন। বরং বাপ-পিতেমোর ব্যবসা চালানোয় তাঁরা অনাগ্রহী, অপারগও। তাঁদের আভিজাত্য অতীতে সঞ্চিত অর্থে নির্ভরশীল, অতীতেই অর্জিত। কিন্তু তাঁরা বিশেষ কেউ-ই পর্দায় সেই আভিজাত্যকে বিশ্বাস্য করে তুলতে পারেননি, যতটা পেরেছেন ছবি বিশ্বাস। অবশ্য এ-ব্যাপারে তিনি একক নন, জহর গাঙ্গুলি, পাহাড়ী সান্যাল কিংবা নীতিশ মুখোপাধ্যায় বা অহীন্দ্র চৌধুরী, কখনও-সখনও বীরেশ্বর সেনও আভিজাত্য এনেছেন সুন্দর, কিন্তু কেউ-ই ছবি বিশ্বাসের মতো নয়, যিনি বাঙালি আভিজাত্য, (‘জলসাঘর’, বা, ‘দেবী’) ও ইঙ্গবঙ্গ আভিজাত্য (‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’)— দুটোতেই অসামান্য।


কিন্তু ছবি বিশ্বাস মানে আভিজাত্য, এটাই কি একমাত্র সত্যি? আর এই আভিজাত্যের অভিনয় যিনি করেন, বাস্তবেও কি তাঁর মধ্যে তার প্রকাশ ছিল, না কি সবটাই নিছক অভিনয়?
এইখানে পাঠককে একটুখানি আশ্রয় নিতে হবে ছবি দেখার স্মৃতির, কিংবা সম্ভব হলে ইন্টারনেটের। কারণ পরের কথাগুলো নানা ছবির দর্শন-স্মৃতিনির্ভর।
ছবিবাবুর চলচ্চিত্র-জীবনের প্রথম দিকে একটা বড় সময় তিনি নায়ক ছিলেন, কেননা, তাঁর প্রৌঢ়তাই আমাদের স্মৃতিতে উজ্জল হলেও, বাস্তবে তাঁরও, সবার মতোই, একটা যৌবনকাল ছিল, আর সেটাই অভিনয়ে আসার বয়স। নায়ক হিসেবে ছবি মোটের ওপর জনপ্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু তাই বলে প্রমথেশ বড়ুয়া, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কে এল সায়গল, রবীন মজুমদার বা নীতিশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সফল নায়ক নন। তাঁর ডাক পড়ত মূলত বিখ্যাত ক্লাসিকের মঞ্চায়ন, বা চিত্রায়নেই, বিশেষ করে যেসব নায়ক চরিত্র তারকা নয়, অভিনয়ক্ষমতা-সম্পন্ন নায়ক দাবি করে। মঞ্চের কথাটা এইখানে উঠে পড়ল, কেননা, অল্প বয়সে সিনেমায় তিনি যতটা জনপ্রিয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তারকা-মহিমা তাঁর রঙ্গমঞ্চে, বোর্ড থিয়েটারে, এবং তখনও পর্যন্ত সিনেমার চেয়ে সেটা বেশি জনপ্রিয়, সিনেমা উঠতি তামাশা, যাতে কিছু কিছু শিল্পসম্মত কাজও হয়, আর মঞ্চ চিরকালীন সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে সুদীর্ঘকাল ধরে স্বীকৃত।

এই মঞ্চের রাজা ছিলেন ছবি বিশ্বাস, তাঁর যৌবনকালে। ওই কণ্ঠ, ডিকশন, দাপট, স্মৃতিশক্তি, কৃৎকৌশলের ওপর দখল, শারীরিক অভিনয় তাঁর সেই যুগের নাট্যমঞ্চের মতো সাংঘাতিক প্রতিযোগিতার চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে দিনে দিনে সঞ্চয় করা। তখনও মঞ্চের এই তুখড় অভিনেতার সামান্য নাটকীয়তা-সম্পন্ন যে স্টাইল, তাকে সিনেমায় সঠিকভাবে ব্যবহারের মতো পরিচালক আসেননি। যখন এলেন, তখন তিনি সৌন্দর্যমণ্ডিত বলিষ্ঠ এক প্রৌঢ়। একটা বিষয় কৌতূহলোদ্দীপক যে, যেসব সিনেমায় তুলনায় অল্প বয়সের ছবি বিশ্বাসকে আমরা পাই, সেখানে তিনি কিন্তু তাঁর পাশে ফ্রেমে থাকা অন্য অনেকের চেয়ে অনেক নিচু তারে তাঁর অভিনয়কে বেঁধেছেন, যেটা তৎকালীন মঞ্চনায়কের পক্ষে খুবই ব্যতিক্রমী। বরং চারপাশের উচ্চগ্রামের পাশে তাঁর কম-করে-করা অভিনয়ের কারণেই যেন সিনেমায় তাঁকে তখন তুলনায় ফ্যাকাশে, রক্তহীন, একটু অনিশ্চিত লেগেছে। সে-যুগের শিল্পীদের সার্থক সাক্ষাৎকার কেন যে কেউ নেননি, নিলেও তা গ্রন্থায়িত হয়নি— তা ভেবেই পাওয়া যায় না।
আমার দেখতে বসলে মনে হয়, যে-যুগে সিনেমার উদ্দেশ্য ভাল থিয়েটার হয়ে ওঠা, সে-রকমই চিত্রনাট্য, মঞ্চসফল আখ্যানই বাছাও হয়, বাকি সবাইও ওই মঞ্চের অভিনয়টাই ক্যামেরার সামনে আর-একবার করেন— সে-যুগে যিনি ক্যামেরার সামনে মঞ্চের তুলনায় স্বাভাবিক থাকতে চান, তিনি পরিচালকের উদ্দেশ্যের খানিক বিরুদ্ধেই চলে যান, এবং মনে হয়, মানাচ্ছে কম, যদিও সিনেমা-অভিনয় বরং তাঁর স্টাইলটাই। এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা এই ছবিগুলির! এর পাশাপাশি যখন রাখি বহুশ্রুত তাঁর বিপুল পাঠাভ্যাসের কথা, মনে হয়, আগেকার যুগের মঞ্চশিল্পীদের কিছুটা কম-পড়াশোনার যুগকে পিছনে ফেলে যখন ক্রমেই ইংরেজি-শিক্ষিত মার্জিত রুচির অভিনেতারা উঠে আসছেন মঞ্চে, তখন ছবিতে অভিনয়ের আগে ভিন্ন অভিনয়রীতি সম্পর্কে কিছুটা পড়াশোনা করে নেওয়া, তাঁর পক্ষে কি খুব স্বাভাবিক নয়?
অথচ, সেটাই আবার তাঁকে অন্যদের তুলনায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে পর্দায়, যেহেতু ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্য সিনেমা অভিনয় চাইছেই না। এসব বিষয়ে আজ আর মহাকালকে প্রশ্ন করে কোনও উত্তর পাওয়ার আশা নেই, কেউ তাঁকে তাঁর মেথড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেনি তখন। পরের দিকে হয়তো আর সাহসও করেনি।
অথচ, পরবর্তীতে যখন পরিণত বয়সে রুপোলি পর্দার রাজা তিনি, তাঁর জন্যই চরিত্র ভাবা হচ্ছে, টালিগঞ্জে তাঁর ওপর কারও কথা চলে না, তখন কিন্তু তাঁর অভিনয়ের মধ্যে যে থিয়েটার থেকে অর্জিত কৌশল, সেটার জন্যই সফল হচ্ছেন তিনি, নিচু পর্দার অভিনয়ের জন্য নয়। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ কিংবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় তাঁর চরিত্র কিন্তু আন্ডার-অ্যাকটিং চায় না, চায় মঞ্চ-অর্জিত দাপট। এ-ও এক অদ্ভুত কন্ট্রাডিকশন।

এই দাপট, এই রাজকীয়তা তাঁর চরিত্রেও ছিল। তরুণ মজুমদারের ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ এমন বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য, চাক্ষুষ সাক্ষ্য হাজির করেছে আমাদের সামনে। বইটি আশা করি অধিকাংশেরই পড়া, না-পড়া হলে অবশ্যপাঠ্য, তাদের পাঠসুখ নষ্ট না করেও একটু চুম্বকাকারে দু’-একটা ঘটনা বলা দরকার।
‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির এক অভিনেতা, তরুণবাবু ভদ্রতাবশত তাঁর নাম না বললেও, একটু অনুসন্ধিৎসুরা আন্দাজ ঠিকই করতে পারবেন, অন্তত আমি পারি, তারকাসুলভ রেলায় একবার এক ড্রেসারের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ঘোর অপমান করেন। বাচ্চা ছেলেটি ভীতু, আনমনা, কাজ হারানোর ভয় ও অপমানে জর্জর। ছবি বিশ্বাসের নজর এড়ায়নি তার মুখভারটুকু। জিজ্ঞেস করায়, সে ভেঙে পড়ে ঘটনাটি জানায়। ছবি বিশ্বাস সটান সেই অভিনেতার মেক-আপ রুমে রক্তচক্ষুতে হাজির হয়ে যান (সেই অভিনেতাও সেকালে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত) এবং সোজা এই আচরণের কৈফিয়ত দাবি করেন। তিনি বলেন যে, তাঁর সন্দেহ যে, তাঁকে অন্যের ব্যবহৃত কস্টিউম দেওয়া হয়েছে, তাই তিনি জামা ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন বাগানে। ছেলেটি তার অপরাধ স্বীকার করছে না। ‘গরিব হলেই সে মিথ্যেবাদী, একথা কোথায় শিখলে? যাও যে হাতে ছুড়ে ফেলেছ, সেই হাতেই নিজে গিয়ে তুলে নিয়ে এসে পরে নাও জামা’, সর্বসমক্ষে রায় ঘোষণা করে দেন ছবিবাবু। পরিচালক স্বয়ং যে সাহস পাননি, সেই শাসনের ভার নিজেই হাতে তুলে নিতেন তিনি।
ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর গেটে পিকেটিং-রত ছাঁটাই কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ আসছে জেনে তিনি শুটিং ফেলে গিয়ে সেখানে চেয়ার নিয়ে তাঁদের প্রহরায় বসেন। পুলিশ অফিসার এসে পৌঁছলে, এদের গ্রেপ্তার করার আগে যে তাঁকে করতে হবে, একথা জানিয়ে দেন তিনি। পুলিশ সেই সাহস করেনি। ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ছবির জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রকে দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে দিয়ে সম্পূর্ণ কাজ কিছুতেই আদায় না হওয়ায় তরুণ মজুমদারকে সাহস দিয়ে নিজেই চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার সাহস ও একখানি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর জোগাড় করে দেন তিনি, প্রজাবৎসল এক সুশাসকের মতো তাঁর আচরণ। অর্থাৎ, যে আভিজাত্য, সবার ওপরে দাঁড়ানো এক পর্বতসম তাঁর সিনেমা-পার্সোনা, সেটা তাঁর চারিত্রধর্ম। বাইরের জিনিস নন।
এমন নয় যে, তিনি অন্যতর চরিত্র করেননি বা সফল হননি তাতে। ‘দাদাঠাকুর’ তো প্রকৃষ্ট উদাহরণ, এছাড়াও শেষ পর্যন্ত, বা ‘সদানন্দের মেলা’-য় তাঁর চরিত্র সাধারণের। বিখ্যাত দৃশ্য তাঁর ‘সবার উপরে’ ছবির কোর্টরুম সিন, সেই ‘ফিরিয়ে দাও আমার চোদ্দটা বছর।’ সেখানে তিনি নাটকীয়, কিন্তু অভিজাত নন। সে-অর্থে সাধারণই তো তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’। কিন্তু, শেষ বিচারে, ‘দাদাঠাকুর’ আর ‘সবার উপরে’ ছাড়া, আর বাকি কোনও ছবিতেই তাঁকে অপরিহার্য মনে হয়নি। অন্য অনেকেই ওই চরিত্রগুলি করতে পারতেন, সে-অর্থে সাধারণ মানুষের চরিত্রে তিনি পারঙ্গম, কিন্তু অমোঘ নন।
হয়তো এই কারণেই অভিজাত চরিত্রে দিব্য অভিনয় করলেও ছবি বিশ্বাস আর দ্বিতীয় কেউ হয়নি। সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’-য় এক অন্য রসের রহিসি চরিত্রে ছিলেন এক অত্যন্ত সু-অভিনেতা। অ্যাসিস্ট্যান্ট অমিয় সান্যাল, যিনি যৌথভাবে বন্ধুদল হিসেবে এই ছবির প্রযোজকমণ্ডলীর একজন, তিনি তাঁর অধুনালুপ্ত একটি স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, এই ছবির যে-দৃশ্যে ব্যোমকেশ ও অজিত রমেন মল্লিকের বাড়িতে যান, সেই দৃশ্যের শুটিংয়ের মাঝেই উত্তমকুমারের প্রথম হার্ট অ্যাটাকটি হয়। প্রোডাকশনের ডিরেক্টরের জন্য বরাদ্দ গাড়িতেই উত্তমকুমারকে তুলে, ডাক্তারবাবু শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, যিনি তাঁর ডাক্তারি দৃষ্টিতে প্রথমেই ধরতে পারাতে উত্তম সেবারের মতো রক্ষা পান, যখন হাসপাতালে ছুটছেন, সত্যজিৎ-সহ বাকি কেউ কেউ পিছনে ট্যাক্সিতে— সেই গাড়ির পথ আটকে এক অভিনেতা শুটিং বন্ধ হলেও তাঁর সেদিনের প্রাপ্য পারিশ্রমিক চেয়ে নেন, এমনকী, যেহেতু লাঞ্চ ব্রেকের আগেই প্যাক আপ, তাই খাইখরচ পর্যন্ত। বিরক্ত সত্যজিৎ পেমেন্ট করে দিতে বলেন। এবং কন্টিন্যুইটির কারণে সেই ছবির বাকি অংশে কাজ করালেও, পরবর্তীতে আর কখনও তাঁকে যে নেবেন না, একথাও ইউনিটকে জানিয়ে দেন। নেনওনি। এই ছিঁচকেপনা ছবি বিশ্বাসের চরিত্রে কোনওদিন ছিল না বলেই তাঁর আভিজাত্য পর্দায় হয়তো বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
এমন নয় যে, তিনি অন্যতর চরিত্র করেননি বা সফল হননি তাতে। ‘দাদাঠাকুর’ তো প্রকৃষ্ট উদাহরণ, এছাড়াও শেষ পর্যন্ত, বা ‘সদানন্দের মেলা’-য় তাঁর চরিত্র সাধারণের। বিখ্যাত দৃশ্য তাঁর ‘সবার উপরে’ ছবির কোর্টরুম সিন, সেই ‘ফিরিয়ে দাও আমার চোদ্দটা বছর।’ সেখানে তিনি নাটকীয়, কিন্তু অভিজাত নন। সে-অর্থে সাধারণই তো তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’। কিন্তু, শেষ বিচারে, ‘দাদাঠাকুর’ আর ‘সবার উপরে’ ছাড়া, আর বাকি কোনও ছবিতেই তাঁকে অপরিহার্য মনে হয়নি। অন্য অনেকেই ওই চরিত্রগুলি করতে পারতেন, সে-অর্থে সাধারণ মানুষের চরিত্রে তিনি পারঙ্গম, কিন্তু অমোঘ নন।

মহারাজোপম অভিমান ও ঔদার্যও তাঁর চরিত্রগত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে একটি দৃশ্যে বারবার আটকে যাওয়ায় তিনি শিখিয়ে দেন তাঁর শেখা কিছু ব্যবহারিক কৌশল। আবার অন্য একটি ছবিতে ক্লান্ত, স্টুডিওর গরমে কোট-প্যান্টুল পরিহিত তিনি সংলাপ বারবার ভুলে যাওয়ায় নিজের ওপরেই যখন বিরক্ত, সৌমিত্র তাঁকে মনে রাখার একটি টেকনিক মনে করিয়ে দেন। শট উতরে গেলেও তাঁর বিষন্নতা কাটছে না দেখে, সৌমিত্র তাঁর কাছে গিয়ে কথা শুরু করেন। বলেন ঘটনাটি ভুলে যেতে, কারণ একদিন সবারই এরকম হতে পারে, এখনও তো আপনি রাজাই। ঈষৎ বক্রসুরে ছবিবাবুর জবাব, ‘যুবরাজ তো তৈরি হয়ে গেছেনই দেখছি। আমার আর তো ছুটি নিতে অসুবিধে নেই!’
ছুটির দিন এসেও গিয়েছিল তাঁর, সেও মহারাজোচিত স্টাইলেই। ছোট জাগুলিয়ায় নিজের গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে ঈষৎ মদ্যাক্রান্ত ছবি বিশ্বাস ড্রাইভারের হাজার আপত্তি তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে জোর করে স্টিয়ারিংয়ে বসেন। যশোর রোডে উল্টোদিক থেকে আসা একটি গাড়ি বাংলা ছায়াছবির এই মাথার মণিটিকে ‘হর্ন’ করে নিয়ে চলে যায়। অনেকটা ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যের মতোই, তাই না? সত্যজিৎ এভাবেই ‘নায়ক’-এ দেখেন উত্তমকুমারের ভবিষ্যতের ক্রাইসিসকে, ‘জলসাঘর’-এ ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুকে। কেমন যেন ভুতুড়ে এই ভবিষ্যদৃষ্টি!
একটি অন্যরকম কথা দিয়ে শেষ করি। ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সে-যুগের অন্য দুর্ধর্ষদের একটা অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল। এদের অন্যতম, পাহাড়ী সান্যাল। তাঁর ক্ষেত্রে মধুটাই বেশি, একটু বন্ধুত্বময় খোঁচা মারার স্বভাবটি ছাড়া। অম্লটির ভাগ বেশি জুটত নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের। কোনও এক মঞ্চের মেক-আপ রুমের আড্ডায় ছবি বিশ্বাস মেজাজের মাথায় নৃপতিকে বলেন, ‘এই নাটকে সবাই ছবি বিশ্বাসকেই দেখতে আসে, নৃপতিকে নয়, তোর আবার মেক আপ কী!’ নৃপতিও বলে দেন, তিনি অচিরেই দেখিয়ে দেবেন, নাটকে কোনও চরিত্রই ছোট নয়। নাটকটিতে ছবি বিশ্বাসের চরিত্র অভাবগ্রস্ত এক আপাদমস্তক সৎ মানুষের, নিতান্ত দুর্বিপাকে তাঁকে পাওনাদারকে এড়াতে অন্যায় রাস্তা নিতে হচ্ছে। সৎ মানুষটির এই আচরণই তাঁর প্রতি দর্শকের সহানুভূতি আরও বাড়িয়ে দেবে এটাই দৃশ্যের চাহিদা। সেখানে পাওনাদার-রূপী নৃপতিকে আসতে দেখে লুকিয়ে পড়েছেন ছবি, নাটকের লুকনো, কাজেই দর্শক তাঁর প্রতিটি অভিব্যক্তিই দেখতে পারছে। খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে নৃপতি ক্ষান্ত দেবেন— এরকমই কথা। নৃপতি প্রথমে তাই করলেন, তারপর ‘মশাই, গেলেন কোথায়, লুকিয়ে পড়লেন নাকি’ বলে নৃপতি প্রথমে স্বাভাবিক, পরে ক্রমে অস্বাভাবিক, এবং ক্রমশ অসম্ভব সব স্থানে খুঁজতে শুরু করলেন। কুলুঙ্গিতে, খাটের চাদর তুলে, কোণে রাখা মাদুরের প্যাঁচ খুলে, টেবিলের ড্রয়ার টেনে, এমনকী জুতোর ভেতরে উঁকি দিয়ে যখন তিন মিনিটের দৃশ্যকে ১৫ মিনিটে নিয়ে গিয়ে বেরলেন তখন করুণ রসের নাটক হাসির নাটকে পরিণত হয়েছে, দর্শক হাসি ও হাততালিতে ফেটে পড়ছে।
এরপর ছবি বিশ্বাস যেই না তাঁর প্রচ্ছন্ন অবস্থান থেকে বেরিয়ে ফুটলাইটে এসে দাঁড়ালেন, হলে কান্না তো দূরস্থান, অট্টহাস্য ও সিটির ছড়াছড়ি। এরপর নাটক চালানো সম্ভব হয়নি, সে রাতের মতো পর্দা ফেলে দর্শকদের টিকিটের দাম ফেরত দিতে হল। পরেও বেশ কিছুদিন ওই নাটক জমানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। ওই দৃশ্যটি এলেই দর্শক হাসতে শুরু করত। কঠিন মূল্য দিয়ে ছবি বিশ্বাস বুঝলেন, মঞ্চে কোনও সহ-অভিনেতাই ছোট নন।
এই গল্পে ছবি বিশ্বাসের মহত্ব এইখানে যে, এটি নৃপতি কোনওদিন মুখে আনেননি , আড্ডায় পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের এই পরাজয়ের গল্প সহাস্যে বলতেন ছবি বিশ্বাস স্বয়ং।
একে রুচির আভিজাত্য ছাড়া আর কী বলব বলুন?