সাতের দশকের মাঝামাঝি একদিন, একটা ১৯-২০ বছরের ছেলে বিখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকারকে সারা কলকাতায় হন্যে হয়ে খুঁজছে— এমন একটা বিদঘুটে মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে হলে, এর নেপথ্য-কাহিনিটা জানতে হবে।
আমি তখন সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করেছি। আমার যে-সব স্বপ্ন ছিল, আমার বাবার দৌলতে কোনওটাই পূরণ হচ্ছে না এবং হবেও না, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। বাবা পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট যেতে দিলেন না, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় পড়তে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। সেই স্বপ্ন ভাঙার সময় খবর পেলাম, বাদল সরকার নামে একজন আছেন, তাঁর একটা থিয়েটার গ্রুপ আছে, তিনি অভিনয় শেখান। খুঁজেপেতে একদিন পৌঁছে গেলাম তাঁর কাছে। সরাসরি বললাম, ‘অভিনয় শিখতে চাই।’ বাদলবাবু বললেন, ‘আমি তো নিয়মিত শেখাই না, যখন ওয়ার্কশপ হবে, তখন তুমি এসো।’ আমার ভেতরটা তখন অভিনয় শেখার জন্য ছটফট করছে। বললাম, ‘আমি সবার সঙ্গে শিখব না। একা একা আপনার কাছে শিখব।’ উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, ‘তুমি এই টাকাটা নিয়ে এসো, তারপর দেখছি।’ তখনকার দিনে সেটা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ছিল। আমি তো ভালই জানি, বাবা টাকা দেবেন না। অগত্যা মা’র কাছে ঘ্যানঘ্যান করে কিছু টাকা জোগাড় করলাম। গেলাম বাদলবাবুর কাছে। বললাম, হাজার-দেড়েক জোগাড় করতে পেরেছি, এবার আপনি আমায় শেখান। কী বুঝলেন বাদলদা জানি না, বললেন, ‘শেখাব, কিন্তু তার আগে তোমায় একটা কাজ করতে হবে। এখন সকালবেলা তো, আমি একটা কাজে যাচ্ছি, যদি তুমি সন্ধের মধ্যে কলকাতা শহরে আমায় খুঁজে বের করতে পারো, তাহলে আমি তোমায় শেখাব। নচেৎ, তোমার বাবার অফিসে গিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে আসব।’ শুনে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। একে তো এরকম অদ্ভুত একটা শর্ত, তায় আবার না পারলে বাবার অফিসে পৌঁছে যাবেন! বাদলবাবু আমায় নিয়ে বেরলেন, তারপর একটা জায়গায় ছেড়ে দিলেন। আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, দিনটা চালিয়ে নিও।
আরও পড়ুন: ‘রক্তকরবী’-র উত্তরাধিকার কীভাবে বহন করেছিলেন বাদল সরকার?
লিখছেন সুদেব সিংহ…
আমার অভিযান শুরু হল। আমি শুনেছিলাম, বাদল সরকার সেন্ট জেমস স্কুলে নাটকের ওয়ার্কশপ করেন। তাহলে প্রথম গন্তব্য সেন্ট জেমস। সেখানে যেতে হলে শিয়ালদা দিয়ে যেতে হবে, এটুকু জানতাম। তখনও আমি অত ভাল কলকাতা চিনি না। এসপ্ল্যানেড চিনি, কলেজ স্ট্রিট, আর এদিক-ওদিক একটু। সেন্ট জেমস পৌঁছে শুনলাম, উনি তো নিয়মিত এখানে শেখান না, কিন্তু কার্জন পার্কে নাটক করেন। আমি তো অবাক! উনি রাস্তায় নাটক করেন! গেলাম কার্জন পার্ক। সেখানে জিজ্ঞেস করতেই এক ট্রাম-কন্ডাক্টর বেজায় বকুনি দিয়ে বলল, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে, রাস্তায় কেউ নাটক করে? যত পাকা ছেলে সব!’ আমি গুটিগুটি তখন ডেকার্স লেন গেলাম কিছু খাওয়াদাওয়া করতে। সেখানে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে এক অফিসযাত্রী বললেন, বাদল সরকার থিওসফিকাল সোসাইটিতে যান। ছুটলাম থিওসফিকাল সোসাইটি। সেখানে একজন আমায় পাকড়াও করে থিওসফি-র মর্ম বোঝাতে শুরু করলেন। একজনের আত্মা অন্যজনের আত্মার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেকে চিনতে শিখতে হবে। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে, তুমি কাকে খুঁজছ। আমি তো মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আর আমার আত্মাটা ছটফট করছে। শেষে জানা গেল, সেদিন বৃহস্পতিবার, থিওসফিকাল সোসাইটির কাজ বন্ধ থাকে, সেদিন বাদল সরকার ওখানে আসেন না।

কলেজ স্ট্রিট চত্বরে আমার একটা আড্ডা ছিল মেডিকেল কলেজ হস্টেল-এ। আড্ডা মারতে আর রক অ্যান্ড রোল শুনতে যেতাম। বব ডিলান থেকে শুরু করে জ্যাজ, ব্লুজ আমার ওখান থেকেই শোনার শুরু। সেখানে গিয়ে যে-ই বললাম, অভিনয় শেখান যে বাদল সরকার, তাঁকে খুঁজছি, বন্ধুরা ছ্যা-ছ্যা করে উঠল। বলল, কিস্যুই জানিস না। বাদল সরকার নাটক লেখে। কলেজ স্ট্রিটে যে কোনও পাবলিশার্সকে জিজ্ঞেস কর, বলে দেবে। আমার ফের অবাক হওয়ার পালা! নাটক লেখেও লোকটা! বাপ রে! কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকানে বললাম, ‘আমায় বাদল সরকারের নাটকের বই দেবেন।’ দোকানি জিজ্ঞেস করল, ‘কোন বই?’ আমতা আমতা করে বললাম, ‘দেখান না কী আছে।’ আমি তো তখন বাদলবাবুর একটা নাটকেরও নাম শুনিনি। দোকানি রেগে গিয়ে বলল, ‘এটা কি শাড়ির দোকান? কী আছে দেখান? যান তো মশাই এখান থেকে। কিছু জানে না শোনে না, চলে এসেছে বাদল সরকারের বই কিনতে!’ আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাদল সরকার কি এখানে আসেন?’ দোকানি আরও রেগে গিয়ে বললেন, ‘লেখকদের বই পাওয়া যায় বলে কি লেখকদেরও বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়?’ প্রায় মিনতির সুরে বললাম, ‘তাহলে কোথায় পেতে পারি বলুন তো?’ চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি কী করে জানব? যান গিয়ে কফি হাউস-টাউসে দেখুন।’
সন্ধে হয়ে গেছে তখন। আমি কফি হাউসের নিচে গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকলাম। ততক্ষণে বাদল সরকারকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি। সন্ধে সাতটা নাগাদ শ্রান্ত পায়ে কফি হাউসে ঢুকে দেখি, কোণের একটা টেবিলে বাদলদা বসে আছেন। আমি তো দৌড়ে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছি— ‘আমি জানি না, আপনি আমায় শেখাবেন কি না বলুন।’ বাদলবাবু তাড়াতাড়ি আমায় ধরে তুলে বললেন, ‘আগে চোখ মোছো। কী করছ! ওঠো ওঠো! তবে আমি তো ওরকমভাবে শেখাই না, কিন্তু তুমি আমার কাছে এসো।’
সেই আমার সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। ওঁকে ‘বাদলদা’ বলে ডাকার শুরু। আমি বাদলদার প্রোডাকশনে থেকেছি, দেখেছি, কখনও প্রোডাকশন করেছি, কিন্তু আমি কোনও দিন বাদলদার পরিচালনায় নাটক করিনি।
আমায় বাদলদা দুটো জিনিস শিখিয়েছেন। কলকাতাকে চিনতে, আর নিজেকে চিনতে। আমি বাদলদার সঙ্গে কলকাতার পথে পথে হেঁটে কলকাতাকে চিনতে শিখেছি। আমার জীবন শেখার একটা মূল উপাদান হল, বাদলদার সঙ্গে কলকাতা শহরে হেঁটে বেড়ানো। এবং হাঁটতে হাঁটতে, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছেন। বাদলদা বলতেন, অভিনেতা হতে গেলে আগে নিজেকে চিনতে হবে। নিজেকে না চিনলে, কোনও চরিত্রই সৎভাবে তোমার কাছে ধরা দেবে না, আর তুমি তাকে সৎভাবে উপস্থাপনাও করতে পারবে না। হয়তো একদিন হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কী দেখছ? আমি বললাম, ট্রাম। তখন বললেন, ট্রামের গতি ধীর, কিন্তু নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কলকাতা শহরটাও ঠিক তেমন। বিশ্বের বড় শহরগুলোর মতো নয়। নিউ ইয়র্কে বড় বড় বিল্ডিং, লোকজন যেন সবসময় ছুটছে। কলকাতা ধীরে চলে, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিনতে শেখো, আত্মস্থ করতে শেখো, তাহলে জীবনকে চিনতে পারবে।
বাদলদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কত সময় ‘ট্রাস্ট এক্সারসাইজ’ করেছি। কোনওদিন হয়তো বললেন, একটা উঁচু জায়গা থেকে ঝাঁপ দিতে। আমি বললাম, পড়ে যাব তো বাদলদা! বলতেন, দাও না। ঝাঁপ দেওয়ার পর পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বাদলদা ধরে নিতেন। কখনও বলতেন, দৌড়ে ঘাড়ের ওপর উঠে পড়ো তো! সে কী বাদলদা! আপনার ঘাড়ে উঠব আমি? তখন বলতেন, নির্লজ্জ হও। অভিনেতার লজ্জা থাকলে চলে না। সে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারে না।
আরও কত কিছু যে শিখিয়েছেন, তা ঠিক গুনেগেঁথে বলা যাবে না। আসলে আমি যখন বাদলদার কাছে গিয়েছিলাম, তখন ছিলাম একটা মাটির তাল। সেই মাটির তাল থেকে বাদলদা আমায় গড়ে তুলেছেন। মৃণালদা হয়তো সেই গড়নের ওপর রং-টং চড়িয়ে আমায় আরও পালিশ করে দিয়েছেন, কিন্তু মুখ্য কারিগর হলেন বাদলদা।
আমায় বাদলদা দুটো জিনিস শিখিয়েছেন। কলকাতাকে চিনতে, আর নিজেকে চিনতে। আমি বাদলদার সঙ্গে কলকাতার পথে পথে হেঁটে কলকাতাকে চিনতে শিখেছি। আমার জীবন শেখার একটা মূল উপাদান হল, বাদলদার সঙ্গে কলকাতা শহরে হেঁটে বেড়ানো। এবং হাঁটতে হাঁটতে, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছেন। বাদলদা বলতেন, অভিনেতা হতে গেলে আগে নিজেকে চিনতে হবে।
আমাদের নিজেদের একটা থিয়েটারের গ্রুপ করেছিলাম তখন— ওপেন থিয়েটার। সেই গ্রুপের নাটক বাদলদা দেখতে এসেছেন। কিন্তু নাটকের বিরুদ্ধে নানারকম আপত্তি ওঠায় আমাদের নাটক করা বন্ধ করতে হয়। আর তারপর তো আমি সিনেমায় ঢুকে গেলাম। এই সিনেমা করাটা বাদলদার একদম পছন্দ হয়নি। খুব অভিমান করেছিলেন। কয়েকজনকে বলেওছিলেন, ‘অঞ্জন তো ভাল অভিনয় করত, কেন যে সিনেমা করতে গেল!’ তার উত্তরে আমার সাফাই গাইতে একজন বলেছিলেন, ‘বাদলদা, নাটক করে তো রোজগার করা যাবে না। সিনেমা করে তো তবু কিছু রোজগার হয়।’ এই কথা শুনে বাদলদা বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আশ্চর্য, টাকা রোজগার করতে হলে সিনেমা করতে হবে কেন? একজন অভিনেতা রোজগারের জন্য চাকরি করবে, পড়াবে, কিন্তু সিনেমা কেন করবে?’
সেই অভিমান আমার আর ভাঙানো হয়নি। উচিত ছিল হয়তো। আমারও বোধহয় অভিমান হয়েছিল, বাদলদা কেন আমার দিকটা বুঝলেন না। এছাড়া বাদলদার কিছু দর্শনের সঙ্গে আমার মতামত মিলছিল না। কিন্তু বাদলদাকে গিয়ে তো আমি আর সে-কথাটা সরাসরি বলতে পারি না! ফলে ধীরে ধীরে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে এক-দু’বার যোগাযোগ হয়েছিল, কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য। এখন মনে হয়, আমার উচিত ছিল ওঁর কাছে যাওয়া। খুব আফশোস হয়। কেন গেলাম না, বিশেষ করে জীবনের শেষ দিকটায়, যখন উনি প্রায় একাই ছিলেন।

এ লেখা আমার আর বাদলদার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে, বাদল সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে নয়, তবু একটা কথা স্পষ্টই বলি, আমি মনে করি বাদলদা ভারতের সেরা নাট্যকার। সমস্ত বড় বড় নাটক-লিখিয়েদের কথা মনে রেখেই বলছি। বাদলদার প্রায় সব নাটকের ভেতরের স্তরে একটা যৌনতার প্রকাশ ছিল, কিন্তু সেটা এতটুকু প্রকট নয়, সেটা আমায় খুব আকৃষ্ট করত। আমার মনে হয়, এটাই বাদলদাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। এইভাবে যে যৌনতার ব্যবহার করা যায়, বাদলদার নাটক না পড়লে বুঝতে পারতাম না। আর নাটক লেখার ক্ষেত্রে ওঁর কারিগরি দক্ষতা ছিল অসাধারণ। বাদলদা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, ওঁর সঙ্গে যে জীবনের গোড়ার দিকটাতেই আমার আলাপ হয়েছিল, আর ওঁর সান্নিধ্যে কিছুদিন আসতে পেরেছিলাম, এজন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়।