‘বলতে পারো প্রেম নয় বেশ কাঙালপনাই হল,
আমার কাঙালপনায় তোমার নাম রোশনাই হল।’
শ্রীজাত
সমালোচক তার কাগজে ব্যান্ডের গানের দোষত্রুটি ধরেছে বলে, লিড-সিঙ্গার ছেলেটি অফিসে এসে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে দিল। সমালোচক নাকি জানে না, কত কষ্ট করে গান লিখতে হয়, সেটায় সুরারোপ করতে হয়। এসব ‘স্ট্রাগল’ না বুঝেই খারাপ-খারাপ কথা লিখল সে? কেন? সমালোচকের অতএব উত্তমমধ্যম প্রাপ্যই!
ছেলেটির নাম কৃষ কাপুর। চরিত্রের মনের কোণে প্রতিষ্ঠানের প্রতি জমে থাকা রাগ বোঝাতে, পরিচালক ছায়াছবির প্রথমেই এমন একটি দৃশ্য নির্মাণ করেছেন। তবে ছেলেটি প্রতিভাবান। ঘাড় অবধি অবিন্যস্ত চুলের, সারাক্ষণ কালো জিনসের জ্যাকেট পরে থাকা ছেলেটি যে-কোনও কথার ওপরই মুহূর্তে গান ভেজে ফেলতে পারে। কৃষ সকলের সঙ্গে দুর্বিনীত হয়ে কথা বলে। জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। মদ্যপান-ধূমপান করে মারাত্মক। তথাকথিত ‘টক্সিক’ পুরুষের চরিত্র আঁকতে বলিউড এখন এমন একটি মানচিত্র তৈরি করেছে, যেন এগুলোর কোনওকিছুই না করা একটি ছেলে ‘টক্সিক’ হতে পারে না! আর এর ঠিক উলটোদিকে এমন একটি মেয়ের চরিত্র নির্মিত হচ্ছে, যে সরল, নিখুঁত সুন্দরী, প্রতিভাময়ী। এক্ষেত্রে মেয়েটি বাণী বাত্রা। কৃষ আর বাণীর মধ্যে শুধু যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় তা না, কিছু ক্ষেত্রে তাদের ‘ট্রমা বন্ডিং’ হয় এবং কৃষ তার মনোযোগের অভাব কাটিয়ে উঠতে পারে, বাণী তাতে ফিরে পায় এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। এবার হিন্দি ছবি বলে কথা! সেখানে ‘মশলা’ থাকবে না তা কি হয়?
আরও পড়ুন: ‘খওফ’ দেখতে-দেখতে প্রতি মুহূর্তে মালুম হয়, বাস্তব অতিপ্রাকৃতের চেয়েও ভয়াবহ! লিখছেন দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত…
আরবী ভাষায় ‘সাইয়ারা’ শব্দের অর্থ চলমান নক্ষত্র। সম্প্রতি এই নামাঙ্কিত একটি সিনেমা ভারতে ঝড় তুলেছে। ফিল্ম পরিচালনায় মোহিত সুরির মুন্সিয়ানা আছে। মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম ছবি বানিয়েছিলেন। একই বছরে (২০০৫) তাঁর দু’টি ছবি ‘জ্যাহের’ আর ‘কলযুগ’ মুক্তি পেয়েছিল। তারপর এই কুড়ি বছরে প্রায় প্রতি বছর-ই তাঁর একেকটি ছবি বেরিয়েছে। এতগুলো বছরে একটিও ফ্লপ ছবি তাঁর ঝুলিতে নেই। সুতরাং, আমজনতার নাড়ি তিনি চিনবেন তা বলাই বাহুল্য।
যুগের চাহিদা মিটিয়ে তাঁর ছায়াছবিরা কেবল প্রেমের কথা বলে। সেই প্রেমের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে নায়ক-নায়িকাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এবং চরিত্র চিত্রণ বলিউড-মার্কা হলেও কিঞ্চিৎ গভীরতা যে থাকে না এমন বলা যায় না। তবে ‘সাইয়ারা’-তে এসে মোহিতের সিনেমা নিয়ে এমন দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তা এর আগে কখনও হয়নি। দর্শক গণহিস্টিরিয়াতে ভুগছে। বিভিন্ন সিনেমাহলে তরুণ-তরুণী কাঁদছে, মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এতে পঁয়ত্রিশ কোটির ছবি প্রথম সপ্তাহেই একশো কোটি ছুঁয়ে তো ফেলেইছে, এখনও অবধি দু’শো আশি কোটির ব্যবসা করে নিয়েছে। সিনেমা নিয়ে এমন উন্মাদনা বহু বছর পর দেখা গেল।
একসময়ে অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা নিয়ে এসব চলত। মিঠুনের সিনেমা ঘিরেও। বাংলায় উত্তম কুমারের সময়ে কী হত জানা নেই, তবে রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ (২০০৮) আর ‘প্রেম আমার’ (২০০৯) ছবি দু’টি ঘিরে একসময়ে বিরাট উত্তেজনা তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এ-যেন একটা ‘ফ্যানডম’ গড়ে ওঠার মতো ব্যাপার। একটা সিনেমাকে অচিরেই ‘কাল্ট’ হিসেবে নির্মাণ করার খেলা। অনেকে বলছেন এটা পাবলিক রিলেশন স্টান্ট। ‘সাইয়ারা’ ছবির প্রযোজক ‘যশ রাজ ফিল্মস’ এটা ঠান্ডা মাথায় তৈরি করেছে। খুব বড় কোনও লঞ্চপার্টি করেনি, অভিনেতাদের ইন্টারভিউ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, সমালোচক কী লিখল তা ভেবে সময় নষ্ট করেনি, কেবল মানুষের মুখের প্রচারে এই গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে ফেলেছে। সমাজ মাধ্যমের তীব্র ক্ষমতার যুগে, একটা ‘কান্নাকাটি’র ভিডিও ভাইরাল করে দিতে পারলেই যারা পরে সিনেমাটা দেখতে যাবে, তারাও একই আবেগের মধ্যে দিয়ে যাবে। মানুষের যুক্তিবুদ্ধি কাজ করবে না। শুধু ভাইরাল হবার তাড়নায় প্রত্যেকে কান্নাকাটি, মাটিতে গড়াগড়ির ভিডিও পোস্ট করতে থাকবে আর সকলের মধ্যে বিরাট আগ্রহ তৈরি হবে ছবিটা দেখার। কিন্তু পুরোটাই কি ব্যাবসায়িক চাল? এই সর্বব্যাপী আবেগের কি কোনও ভিত্তি, সত্যিই নেই? কোনও শিল্প নেই? সিনেমা পরিচালনায় এমন কিছু নেই যাতে দর্শকদের মধ্যে এমন আবেগ ঘনিয়ে ওঠা সম্ভব?

সম্ভব। প্রথমত, অভিনেতা নির্বাচন। মোহিত সুরি যে প্রধান দু’টি চরিত্র নির্মাণ করেছেন কৃষ কাপুর আর বাণী বাত্রা— তারা নবাগত শিল্পী। তরুণদের চরিত্রে তরুণদের নেওয়ার জন্য পরিচালকের প্রশস্তি প্রাপ্য। তিনি বয়স্ক অভিনেতাদের তরুণ সাজাননি। তারপর পুরো ছবিটার মধ্যে চরিত্রের পোশাক-আশাকে কোনও তথাকথিত গ্ল্যামারের ছোঁয়া নেই। ছেলেমেয়ে দু’টি যেন আমার-আপনার বাড়ির লোক। পরিচালক আর চিত্রনাট্যকার বুঝি এখনকার তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষার খোঁজ রেখেছেন। কৃষের ব্যান্ডে গান গাওয়া, সেই সংঘ ভেঙে যাওয়া আর তারপর আবার জোড়া লাগার ঘটনা যেন ভারতের প্রতি ঘরের তরুণদের কাহিনি। বাণীর কবিতা লেখাও তাই। বান্ধবীকে বুলেট বাইকের পেছনে বসিয়ে সেটা চালিয়ে সারা শহর ঘোরা তো তারুণ্যের চিহ্ন এখন; পরিচালক সেটাও অপূর্ব ধরেছেন। প্লট জিনিসটা ভীষণ রকম পাকা এ-ছবিতে। সব চরিত্রেরই একটা অভ্যন্তরীণ গল্প আছে। আর সব থেকে বড় কথা ‘টক্সিক রিলেশনশিপ’ আর ‘ট্রমা বন্ডিং’-এর এই কাহিনিতে, কৃষ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পণ্য হয়ে শুধুই প্রেমিকার ওপর অত্যাচার চালিয়ে গেছে, তা নয়। বাণী যখন বিরল রোগ ‘আর্লি অনসেট ডিমেনশিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে সব কিছু ভুলতে বসেছে তখন এই কৃষ নিজেকে বদলে প্রেমাষ্পদের সকল রকম যত্নে থেকেছে। এখানেই একটা গভীর আবেগের জায়গা তৈরি হয়েছে।
হিন্দি বাণিজ্যিক ছবি আকিরা কুরোসোওয়া, সত্যজিৎ রায়, মার্টিন স্করসেসে কিংবা কিমকি-দুক আর কোয়েন্তিন তারান্তিনোর শৈল্পিক চেতনা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা একটা বোকামি। বাণিজ্যিক ছবির একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মাধ্যম আছে আর মানুষের শৈল্পিক চেতনা আর সৌন্দর্যবোধ সমৃদ্ধ করার কোনও দায় তার নেই। হিন্দি ছবির থেকে আমরা শিখেছি, সাপ মানুষের রূপ ধরে প্রতিশোধ নিতে পারে, যমজ ভাইবোনের একজনকে মারলে অন্যজনের গায়ে কালশিটে পড়ে যায়, এখানে ঘুষি মারলে ঘিপ-ঘিপ আওয়াজ হয় আর গান গাইলে সঙ্গে বাজনা বেজে উঠতে অসুবিধা হয় না।
হিন্দি ছবি জনগণের আবেগ নিয়ে কাজ করে, বাস্তবিক-ই হতে হবে, এমন কোনও দিব্যি তাকে কেউ দেয়নি। সুতরাং ডিমেনশিয়া রোগী এত সেজে কী করে থাকে কিংবা কয়েক মাসেই ভারতের এক গায়ক সারা পৃথিবীতে কীভাবে এত নাম করে নিল অথবা সমুদ্রের পাশে এত ব্যয়বহুল কটেজে ওরা থাকে কী করে, এসব ভাবনা চিন্তা অবান্তর। বরং, আজও সিনেমা দেখে যে মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, উত্তেজনা-উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে এগুলো বেশ ভাল। এগুলো আশার দিক। বয়স্ক অভিনেতাদের প্রোজেকশন, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার আগ্রাসন আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর বাড়বাড়ন্তয় ইদানিং টকমিষ্টি প্রেমের গল্প, তারুণ্যের কাহিনি বলিউড থেকে প্রায় চলে যেতে বসেছিল। মোহিত সুরি পরিচালিত, আহান পাণ্ডে (কৃষ কাপুর) এবং অনিত পাড্ডা (বাণী বাত্রা) অভিনীত ‘সাইয়ারা’ (২০২৫) সে-পথ খানিক বন্ধ করল। মানুষ আবার রোম্যান্স নিয়ে ভাববে। যুদ্ধের পৃথিবীতে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে? বেঁচে থাক ছেলেমানুষি। তবে হিন্দি ছবি না হয় একটা পথ পেল, কিন্তু বাংলা ছবিতে এমন কান্নাকাটির, বাঁধনছাড়া আবেগের গল্পগুলো কবে ফিরবে?