চোখ-কান খোলা: পর্ব ১২

Cabin

কেবিন থেকে ক্যাফে

তাদের এখন সাধারণ আর-পাঁচটা খাবারের দোকানের মধ্যে গণ্য করা হয় না। পুরোপুরি দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এমনও নয়; আবার খুব যে কাছের করে রাখা হয়েছে, তা-ও নয়। তারা ঐতিহ্যবাহী। তারা নস্টালজিয়া। মেইনস্ট্রিম নয়, তারা প্যারালাল। অবজ্ঞার ফাঁকে-ফাঁকে যে-আদিখ্যেতা মাঝে মাঝে ছিটকে বেরিয়ে আসে আচমকা, তেমন করেই লোকে এখন তাদের দেখে। ফলে, উত্তর কলকাতা কিংবা দক্ষিণ কলকাতায় এখনও যে-সমস্ত কেবিন টিমটিম করে ব্যবসা চালাচ্ছে, তারাও যে-কোনও দিন উঠে গেল বলে! পুরনো কাঠের চেয়ার-টেবিল, বোন চায়নার থালা-বাটি— এসব হয়তো আর আকর্ষণ করে না আমাদের। চাই আলো-ঝলমলে সুন্দর সাজানো ক্যাফে। খোলামেলা। ওয়াইফাই। হালকা মিউজিক। এক কথায় যেখানে গেলে পয়সা দ্রুত কমে এবং স্ট্যাটাস দ্রুত বাড়ে।

চপ-কাটলেট-কবিরাজির পথ ছেড়ে নতুন প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই পিৎজা-পাস্তার রাস্তা ধরেছে। সেইদিক থেকে কেবিন-সংস্কৃতি পিছিয়ে পড়েছে তো বটেই, উপরন্তু কয়েক দশক আগেও যেখানে পর্দাপ্রথার আড়ালে খুলে যেত ভালবাসার উৎসমুখ, লাজুক প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠত কিঞ্চিৎ সপ্রতিভ— সেই প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে। ‘প্রাইভেসি’ এখন আর তত দুর্লভ নয়। বদ্ধ কেবিনে বসে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার দিনও অতীত। ঘরোয়া পরিবেশের পরোয়া না করে, আমরা এগিয়ে গেছি অনেকটা। সব সময়ে কি নিজেরাও বুঝতে পেরেছি ঠিক কী চাইছি! হয়তো ভাবলাম যাব অ্যালেন, চলে গেলাম ক্যাফে বাই দ্য লেন— কোথায় যে আসলে যেতে চেয়েছি, বুঝিনি। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বিকল্পের হাতছানিতে মন স্থির করা কঠিন হয়ে পড়েছে বার বার। আর এভাবেই হয়তো অবচেতনে দূরে সরে গেছে দিলখুশা, ভোলানাথ কিংবা ধীরেন কেবিন।

আরও পড়ুন: কলকাতায় ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছে বিরিয়ানির দোকান! পেছনে লুকিয়ে কী রহস্য? লিখছেন সৌমিত দেব…

আড্ডা ছাড়া কলকাতা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু সেই আড্ডা জমবে কোথায়— এক কাপ চায়ের সঙ্গে কেবিনে, নাকি কফি হাতে আধুনিক ক্যাফেতে? এই দ্বন্দ্ব আসলে শহরের সংস্কৃতি বদলের গল্পও। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে যে ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট, সেখানে আজও সকাল-সন্ধেয় কোনও একটি বা দু’টি দলকে দেখা যাবে আড্ডায় মশগুল। ক্রীড়া থেকে বিনোদন, রাজনীতি থেকে সমাজ— চায়ের পর চায়ে সেখানে ভেসে উঠছে তীক্ষ্ণ, তির্যক টিপ্পনীমালা। নামেই ‘রেস্টুরেন্ট’, পাওয়া যায় মেরেকেটে টোস্ট-অমলেট-চা। যে-ছেলেটি বা মেয়েটি বার্গার বা স্যান্ডউইচ চায়, সে কি আসবে এই রং-চটা ‘ঐতিহ্য’ সামলাতে? অন্যদিকে আরও এক প্রবণতা শুরু হয়েছে ইদানীংকালে। ওয়ার্ক ফ্রম ক্যাফে। একটা ল্যাপটপ কিংবা খাতা-বই নিয়ে নিভৃতে কফিশপে বসে কাজ করো। খরচ বেশি হয়, হোক। সেখানে শান্তি আছে যে! চেঁচামেচির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অনন্ত ভাবনা-বিস্তার।

শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে যে ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট, সেখানে আজও সকাল-সন্ধেয় কোনও একটি বা দু’টি দলকে দেখা যাবে আড্ডায় মশগুল। ক্রীড়া থেকে বিনোদন, রাজনীতি থেকে সমাজ— চায়ের পর চায়ে সেখানে ভেসে উঠছে তীক্ষ্ণ, তির্যক টিপ্পনীমালা। যে-ছেলেটি বা মেয়েটি বার্গার বা স্যান্ডউইচ চায়, সে কি আসবে এই রং-চটা ‘ঐতিহ্য’ সামলাতে?

কলেজ স্ট্রিটে ফেভারিট কেবিন উঠে যাওয়ার পর সমাজের এক অংশ হায়-হায় করে উঠেছিল। তাদের দুঃখ ছিল, ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছে। কিন্তু এ-কথা কি একবারও ভেবে দেখবার নয় যে, সত্যিই যদি ওই কেবিন থেকে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা লাভ হত, কেবিন-মালিক কি তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতেন? নজরুল কিংবা সৌমিত্র চ্যাটার্জি ফেভারিট কেবিনে নিয়মিত আড্ডা দিতেন কিংবা টাকা হাতে এলেই শিবরাম চক্রবর্তী ঢুকে পড়তেন দিলখুশা কেবিনে— বঙ্গ-সংস্কৃতির আইকনদের এইসব গল্প শুনতে ভালই লাগে! কিন্তু গল্পের গোলকধাঁধায় যা ভুলে যাই, তা হল সময়ের ব্যবধান।

‘ঠেক’ শব্দটা নতুন প্রজন্মের অনেকাংশের কাছে বেমানান। তারা চায়ের দোকান চায় না, চায় ক্যাফে। পানশালা চায় না, চায় পাব। ডেটিং থেকে সেটিং— সব ওখানেই হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে রেটিং। ইন্টারনেট সার্চ করে সেখানে লোক আরও যাচ্ছে পিলপিল করে। দক্ষিণ কলকাতার অলিগলিতে আজও তাই ক্যাফে হয়েই চলেছে; এমনকী বাদ যাচ্ছে না উত্তরের গলিও। হাতিবাগান-শ্যামবাজার-বাগবাজারে গজিয়ে উঠছে ছোট-বড় কফিশপ। ‘মোকা’ যতই ‘মোচা’ উচ্চারিত হোক, ভুলে গেলে চলবে না, হুজুগে বাঙালি এখন অল্প সময়ে ‘খেতে’ যায়; বাকিটা কাটিয়ে দেয় ‘এক্সপ্লোর’ করে…