সেই আগুন ও বইমেলা

Memories of Kolkata Book Fair, 1997 by Rahul Majumder. It reminisces the day fire broke out in Book Fair.

১৯৯৭, ৩ ফেব্রুয়ারি, দুপুরবেলা। সরস্বতী পুজোর দিন। সেই বছর মেলা কর্তৃপক্ষর নতুন উদ্যোগ ‘স্ট্যান্ড প্যাভিলিয়ন’-এ প্রথম নিজস্ব প্রকাশনী ‘কিংবদন্তী’-র ঠাঁই জুটেছিল। বিশাল এক ওল্টানো বাটির মতো তাঁবুর মধ্যে সারি সারি খোপ— ওপরে প্রকাশনীর নাম লেখা। আমার থেকেও বাকি সন্দেশী-দের উৎসাহ বেশি! বেশ চলছিল। যেহেতু খদ্দেরের আনাগোনা প্রায় শূন্য, তাই মাঝেমধ্যেই ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছিলাম। সেই সময় ‘কুম্ভ’ রক্ষার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছিলেন বয়সে ৩০ বছরের বড় বন্ধু অসিতদা, অসিত চৌধুরী। আমি মাঠে, অসিতদা স্টলে।

হঠাৎই একটা শোরগোল— ‘আগুন— আগুন’। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি,চটের দেওয়ালের আড়ালে লেলিহান শিখা। ওখানে তো একটা রেস্তোরাঁ ! নির্ঘাত তাদেরই উনুন থেকে আগুন লেগেছে। তখনও আমার মতো অনেকেই ভাবছিলেন দমকল আছে, আগুন আয়ত্তে এসে যাবে।

একটু পরেই কানে এল, দমকল ঢুকতেই পারছে না। এবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ছে আগুনও। আরম্ভ হয়ে গেছে ছোটাছুটি। স্টলের লোকেরা খদ্দেরদের বের করে দিয়ে স্টলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করতে ব্যস্ত। তখনও কারও চিন্তার জগতে আসন্ন লঙ্কাকাণ্ডের কোনও চিহ্নই নেই। গঙ্গার দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস আগুনকে আরও প্রবল করে তুলল। আগুন ছড়াচ্ছিল মূলত পুব দিকে। অতএব, খানিকটা স্বস্তি নিয়েই ছবি তুলে যাচ্ছিলাম।

আরও পড়ুন : সরস্বতী পুজোর সঙ্গে লেখাপড়া বন্ধ থাকার নিদান জড়িয়ে গেল কী করে? লিখছেন বিজলীরাজ পাত্র…

হঠাৎই বাতাস তার গতি বদল করল। স্ট্যান্ড প্যাভিলিয়নের প্রায় মুখোমুখি ছিল, সে-বছরের থিম প্যাভিলিয়ন ‘ফ্রান্স’। একটা আগুন-লাগা পলিথিন ব্যাগ উড়তে উড়তে এসে পড়ল ফ্রান্স প্যাভিলিয়নের ওপর— দপ্ করে জ্বলে উঠল ফ্রান্স। মুহূর্তের মধ্যেই গোটা প্যাভিলিয়ন আগুনের গোলায় বদলে গেল। এবার আমার টনক নড়ল। ছুটলাম আমাদের প্যাভিলিয়নের দিকে। কিন্তু আমার থেকে আগুন অনেক দ্রুতগামী— আমার চোখের সামনে আগুন গিলে নিল স্ট্যান্ড প্যাভিলিয়নকেও। এদিকের গেট জ্বলছে। ছুটলাম উল্টোদিকের গেটের দিকে। সেখানেও তখন আগুন এসে পড়েছে। ‘ছোটদের কচিপাতা’-র সমর (পাল) ওর প্রকাশনী থেকে গতকালই প্রকাশিত, তৎকালীন দমকল মন্ত্রী প্রতিম চট্টোপাধ্যায়ের বই ‘আগুন নিয়ে ছড়া’ জলভরা চোখে যতগুলো সম্ভব বাঁচাতে প্রায় ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

আমার মনে তখন আতঙ্ক— অসিতদা অক্ষত বেরতে পেরেছেন তো! কী যে অসহায় লাগছিল! ভেতরে ঢোকার কোনও উপায়ই নেই— সেটা তখন রাবণের চিতা। ছুটলাম ‘সন্দেশ’-এর স্টলের দিকে। সর্বত্র একই ছবি! পাঠক-দর্শকরা মাঠ থেকে বেরনোর জন্য আর স্টল মালিকরা যথাসম্ভব বাইরে ছুড়ে ফেলে বই বাঁচানোর চেষ্টায় পাগলপারা। একেবারে অরাজকতার চূড়ান্ত। দমকল যেখানেই ফাঁকা জায়গা পাচ্ছে, সেখান থেকেই আগুনে জল ঢালছে ; কিন্তু প্রলয়ংকর আগুনের কাছে সে চেষ্টা দশ গোল খাচ্ছে।

গোটা মেলা জুড়েই অগ্নিদেবতার তাণ্ডব নৃত্য তুঙ্গে। আমার কাছে একটা পরম স্বস্তির খবর পৌঁছল। অসিতদা আমার ছোট্ট ক্যাশবাক্সটা নিয়ে পাশের প্লাইউডের দেওয়াল ভেঙে অক্ষতই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। ‘সন্দেশ’-এরও বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি আগুন; হাতে হাতে অনেক কিছুই বাঁচানো গেছে। কর্তৃপক্ষের কেউ করুণ কণ্ঠে সকলকেই নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে অনুরোধ জানিয়ে চলেছেন।

প্রকাশক-দোকানদাররা বই বাঁচাতে বাইরে ছুড়ে ফেলছেন, সেখানে এসে এসে ক্রেতারা দামি বই তুলে নিয়ে বলছেন, দশ টাকায় দিয়ে দিন না, নষ্টই তো হবে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ বই তুলেই নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

আমার স্টল এখন সমস্ত আশার বাইরে। তাই খানিকটা ‘নিশ্চিন্ত মন’-এই আরও দু-চারটে ছবি তুললাম, বাইরে দূরে ময়দানের দিকে পা চালাতে চালাতে।

এই সময়টাতেই আমাদের বাঙালির ‘সংস্কৃতিমনস্কতা’-র বিশ্রী রূপের মুখোমুখি হতে হল। প্রকাশক-দোকানদাররা বই বাঁচাতে বাইরে ছুড়ে ফেলছেন, সেখানে এসে এসে ক্রেতারা দামি বই তুলে নিয়ে বলছেন, দশ টাকায় দিয়ে দিন না, নষ্টই তো হবে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ বই তুলেই নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

লজ্জায়, ঘেন্নায় চোখে জল এসে গেল। মেলার উত্তর-পশ্চিম দিকের গেট তৈরি হয়েছিল আইফেল টাওয়ারের আদলে— সেটা তখন জ্বলছে। মনে হল, আমাদের সংস্কৃতিমনস্কতার রূপ জ্বলছে।

পরদিন সকালে স্টলের ধ্বংসস্তূপ থেকে পোড়া বইয়ের খানিকটা তুলে এনেছিলাম; সেটুকু এখনও যথাসম্ভব যত্নে রেখেছি।