আমার লেখা ‘গণেশ পাইনের ছবি’ বইটি বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে। এর আগে তাঁর ছবি নিয়ে একটিমাত্র প্রবন্ধ লিখেছিলাম ১৯৮৮ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। ওই প্রবন্ধ লেখার জন্য শিল্পীর সঙ্গে কোনও কথা বলিনি। তখনও পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ছিল না। একদিন অ্যাকাডেমিতে দেখা। বললেন, লেখাটি পড়েছেন। ভাল লেগেছে। তবে, একটা ‘পয়েন্ট’ আমি ‘মিস’ করেছি। সেটা হল ‘মিথ’-এর বিষয়টি। তখনই আমি বলেছিলাম, তাঁকে নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই লিখতে চাই, যদি তিনি সহযোগিতা করেন। তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় আমার প্রস্তুতি।
মেডিক্যাল কলেজের উলটোদিকে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ থেকে বেরিয়েছে ছোট গলিটি। কবিরাজ রো। দু’পাশে আয়না তৈরির কারখানা। বাঁ-দিকে দোকানগুলোর পিছনে টানা বাড়ি, প্রায় একশো বছরের পুরনো। ও-পথে খানিকটা গেলে ডান হাতে একটি চৌচালা ছাদের রাধা-কৃষ্ণের মন্দির। এর উলটোদিকের বাড়িটিতেই গণেশ পাইন (১৯৩৭-২০১৩) তখন থাকতেন। তিনতলার উপরে একটা ছোট ঘর ছিল তাঁর স্টুডিয়ো। বেল বাজালে একটু পরে উপরের জানলাটা খুলে যেত। স্মিত হাসিতে অপেক্ষার অনুরোধ জানাতেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার চটির আওয়াজ পাওয়া যেত। দরজা খুলতেন। পাশেই বসার ঘর। আমরা গিয়ে বসতাম। শুরু হত কথাবার্তা। এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর্বটি চলেছিল প্রায় তিন বছর, ১৯৯০ পর্যন্ত। গণেশ পাইন কথা বলতেন স্নিগ্ধ কণ্ঠে, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে। মনে হত যেন কোনও লেখা থেকে পড়ছেন। এই সাক্ষাৎকার ছিল আমার বইয়ের তথ্যের উৎস। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে পরে একটা বইও হয়েছে। ওই কবিরাজ রো-র বাড়িতে ছিল একটা অন্ধকার পরিসর। আর সামনে ওই গৌর-নিতাইয়ের মন্দির আর মূর্তি। ওই ‘মিথ’। এই দুটো বিষয় ছিল তাঁর ছবির এক রহস্যময় উৎস।
১৯৮৮ সালে, গণেশ পাইনের খ্যাতি তত প্রসারিত হয়নি। তখন কেন আমার তাঁকে নিয়ে লেখার কথা মনে হল? আমার প্রথম বই ছিল ‘এই সময়ের ছবি’। তাতে আমার একটা সন্ধান ছিল, কী হতে পারে আমাদের চিত্রকলায় আধুনিকতার আত্মপরিচয় (আইডেন্টিটি)? আমার মনে হয়েছিল, গণেশ পাইনের ছবি এদিক থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি তাই তাঁর ছবির গহনে প্রবেশ করতে চাইছিলাম।

বাংলা তথা ভারতের চিত্রকলায় আধুনিকতার আত্মপরিচয় সন্ধানের প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ থেকে। তিনিই প্রথম আমাদের চিত্রকলাকে নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আর একটা জিনিস ছিল অবনীন্দ্রনাথের। ছবিতে তিনি চাইতেন ভাবের ব্যঞ্জনা। বাস্তবের গভীরের রহস্যকে উন্মীলিত করতে চাইতেন। চারের দশকের শিল্পীরা তাঁদের সময়ের কঠোর বাস্তবতার প্রতিক্রিয়ায় অবনীন্দ্রনাথ বা নব্য-ভারতীয় ঘরানা থেকে একটু দূরে সরে এসেছিলেন। ছয়ের দশকে অবনীন্দ্রনাথকে নতুন মাত্রায় আবিষ্কার করেছিলেন যেসব শিল্পী, গণেশ পাইন তাঁদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের সময় আর গণেশ পাইনের সময় তো এক নয়! উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে জীবন ও বাস্তবতা অনেক জটিল হয়েছে। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালের ১১ জুন। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের স্মৃতি তাঁর খুব সামান্যই ছিল। কিন্তু ১৯৪৬ বা তার পরবর্তী সময়ে যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে কলকাতায় বা অন্যান্য অঞ্চলে, এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তিনি। ওঁর মুখ থেকেই শোনা, সেই সময়ে একদিন তিনি মেডিক্যাল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে, ট্রাকবোঝাই মৃতদেহ নামানো হচ্ছে, চোখে পড়ে যায় অপূর্ব সুন্দরী মধ্যবয়সি এক মহিলার নগ্ন মৃতদেহ ভূমিতে শোয়ানো। বুকের ওপর অস্ত্রের আঘাতে রক্তের দাগ তখনও জ্বলজ্বল করছে। গণেশ পাইন পরে বলেছিলেন, এ-নৃশংস বাস্তবতা ছবিতে আঁকা যায় না। দাঙ্গার সময়ে একবার তাঁদের কবিরাজ রো-র বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়েছিল।


চল্লিশ-পঞ্চাশের এই কঠিন বাস্তবতা তিনি শরীর দিয়ে জানতেন। তাই অবনীন্দ্রনাথের অন্তর্লোক আর তাঁর অন্তর্লোক এক হতে পারে না। তা ছিল অনেক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ। এ ছাড়া তাঁর চেতনায় প্রায় সব সময়ে সংলগ্ন থাকত এক আত্মসৃষ্ট নির্জনতার বোধ। তিনি অনেক সময়ে বলেছেন, এই আত্মগত অস্তিত্বের বাইরে তাঁর ভূমিকা অনেকটা অভিনেতার মতো। মগ্নতার এই একাকিত্ব ছিল তাঁর আশৈশব সঙ্গী। তাঁর ঠাকুরমার মুখে শোনা রূপকথার জগৎ তাঁর একাকিত্বকে পুরাণকল্পের আলো-আঁধারিতে সমন্বিত করেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার চারপাশে যে রূপকথার জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল ছেলেবেলায় এ (তাঁর ছবির জগতে আসা) বোধ হয় তারই প্রভাব। (বাড়ির) সামনে ওই যে মন্দির ওতে গৌরাঙ্গ আর নিত্যানন্দ মূর্তি আছে, গাঢ় হলুদ গায়ের রং, আকর্ণ বিস্তৃত চোখ, ঊর্ধ্ববাহু, সব মিলে এক ভাবের উপস্থাপনা। মনে পড়ে, … আর ওই ও-পাশের বাড়িটা ওটাও এক পাইনদের, ও বাড়ির ঠাকুরদালানে টাঙানো ছিল একটি ওলিওগ্রাফি— অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন। অদ্ভুত কাল্পনিক এক রচনা।… আমি যখনই ও বাড়ি গেছি তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি ও ছবির সামনে।… ওই সব ছবি আর মূর্তি, সেই সঙ্গে ছিল ঠাকুরমার গল্প।…’ (‘দেশ’, ১৫ মার্চ ১৯৮৬)। এই ছিল তাঁর কল্পনার পুরাণকল্প, একাকিত্ব আর নির্জনতার উৎস।
এই ভিত্তির উপর পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছে তাঁর ছবি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাইরের জগতের এবং নিজের জীবনের কঠোর বাস্তবতা। ১৯৫৯ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্ট বিভাগে পাশ করে বেরিয়েছেন। ১৯৬০-’৬১ ওখানেই উড-ক্রাফটে বিশেষ প্রশিক্ষণ। এর পর বাস্তব জীবন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর উপর। অনেক চেষ্টা করেও কোথাও একটা চাকরি পেলেন না। ১৯৬১-তে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে মন্দার মল্লিকের স্টুডিয়োতে অ্যানিমেশন ফিল্মের ছবি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৭ পর্যন্ত ওই কাজে যুক্ত ছিলেন। অ্যানিমেশনের ছবির অনেকটা প্রভাব আছে তাঁর নিজের ছবিতে। ১৯৬৩-তে কলকাতায় ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলে যোগ দিলেন। ১৯৮৯ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। সোসাইটি-র প্রদর্শনীর মধ্যমেই ছবিতে তাঁর অনন্যতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথম জীবনে এবং আর্ট কলেজেও গোড়ার দিকে তাঁর ছবিতে অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায় এবং নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। ক্রমে অন্ধকারের এক তৃতীয় মাত্রা যুক্ত হতে থাকে। আর্ট কলেজে রেম্ব্রান্টের উপর একটি তথ্যচিত্র দেখেছিলেন। রেম্ব্রান্টের আলো-আঁধারির গহন পরিমণ্ডল তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ঝাঁসির রানিকে নিয়ে করা ১৯৫৭-র জলরং ‘ডেথ অফ আ ড্রিম’ এবং ১৯৬১-র ‘রক্তকরবী’; এই দু’টি ছবি তাঁর অবনীন্দ্রনাথ ও রেম্ব্রান্ট সমীকরণের আদর্শ দৃষ্টান্ত। আর্ট কলেজ থেকে বেরোনোর পরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক সংকটের যে-বিধ্বস্ত বাস্তব, তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। সেই সময়ে, ১৯৬২-’৬৩ সালে, আত্মমগ্নতার মধ্যে নিজের সঙ্গে কথোপকথনের মতো ইঙ্ক অ্যান্ড ওয়াশ ও গুয়াশ মাধ্যমে এঁকে গেছেন প্রায় শ’চারেক ছবি। তাঁর নিজস্ব অভিব্যক্তি ও প্রকাশভঙ্গির প্রথম আবির্ভাব এই ছবিগুলোর মধ্য দিয়েই। মৃত্যু এখানে আসছে প্রকৃষ্ট প্রতিমা হয়ে।
১৯৬২-র ‘দি ডেথ অফ অ্যান এনসেন্ট ম্যান’ এই ঘনীভূত মৃত্যুরই রূপকল্প। আবার ১৯৬৩-র ‘দি ল্যাম্প’ ছবিটির মধ্যে নিঃসীম অন্ধকারের প্রেক্ষিতে শুভ্র আলোর উৎস দেখা যায়। মৃত্যুর প্রান্ত থেকে আলোর অভীপ্সা জেগে ওঠে। এটাই পরবর্তী কালে হয়ে উঠেছে তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় তত্ত্ববিশ্ব। ১৯৬৩ সালে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্বকণ্ঠে শুনেছিলেন ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ কবিতার এই লাইনগুলি: ‘তীরে কী প্রচণ্ড কলরব/জলে ভেসে যায় কার শব/কোথা ছিল বাড়ি?/রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়— আমি স্বেচ্ছাচারী।’ এই কবিতা থেকে তাঁর মনে মৃত্যু ও জলযানের এক সমন্বিত প্রতিমাকল্প তৈরি হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে তাঁর অনেক ছবিতেই এসেছে।


ছয়ের দশক থেকেই আত্ম-আবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় গণেশ পাইন তাঁর শিল্পকে অন্বিত করতে চেয়েছেন কোনও এক শাশ্বত কেন্দ্রের সঙ্গে। বলেছেন, ‘সমকালীন যে বাস্তব সেটাকে কখনও ধরতে পারিনা আমরা। সেটা এত পিচ্ছিল যে মুহূর্তে মুহূর্তে তার রং বদলায়।’ বাস্তবতার এই সীমাবদ্ধ গণ্ডি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা করতে-করতে ১৯৬৮-তে তিনি পৌঁছে যান তাঁর নিজস্ব মাধ্যম টেম্পেরায়। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবির অনেকগুলোই গণেশ পাইন এঁকেছেন সাতের দশকে। ১৯৭১-এর ‘হারবার’, ১৯৭২-এর ‘ফিশারম্যান’ ও ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’— এই তিনটি ছবিতে তাঁর আত্মগত দর্শন সবচেয়ে সার্থকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে বলে আমার মনে হয়। তিনটিই টেম্পেরায় আঁকা।
‘হারবার’ ছবিটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে গ্রিক পুরাণকল্পে দেবী সারসি (Circe) আখ্যানের সারাৎসার। এই দেবীর ক্ষমতা ছিল মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করার। ‘হারবার’ ছবিটিতে আমরা দেখি একটি মনুষ্য আকৃতির জলযান ভেসে আসছে একটি পাহাড়প্রতিম বন্দরের দিকে। তার দীর্ঘ হা-করা মুখটিও মানুষের মতো। সেই মুখগহ্বরের ভিতরে রয়েছে নিবিড় অন্ধিকার। জলযানটি কি ওই অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে? তার সামনে মৃত্যুর গহ্বর। অথচ সেই মৃত্যুকে পরিবৃত করেই সেই পাহাড়টির শরীরে ফুটে আছে ফুল, জীবন বা উজ্জীবনের স্মারক।
‘ফিশারম্যান’ ছবিটিতেও রাত্রি, নদী বা সমুদ্র আর তাতে ভাসমান জলযান। সেই জলযানে ধ্যানমগ্ন বসে আছে এক ধীবর। জলের ভিতর জাল ফেলে সে বসে আছে। আর আছে অন্ধকার বনচ্ছায়ে বৃক্ষের পত্ররাজির ফাঁক দিয়ে পূর্ণ চাঁদের ম্লান আলোর চকিত মায়া। সেই ধ্যানী পুরুষের পাশে জলযানের উপরে জ্বলছে অতন্দ্র এক দীপশিখা। এই পুরুষ কি ধীবর না কোনও যোগী? এখানে যেটুকু পুরাণকল্প, তা পরোক্ষ। বৌদ্ধ দর্শনে একটি বাণী আছে— ‘অত্তদীপা বিহরথ’ অর্থাৎ ‘তুমি তমার প্রদীপ হও’। দুঃখের তিমিরে আত্মদীপই উত্তরণের পথ। ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ছবিটিতে বাংলার গ্রামের এক কুটিরের সামনে বসে আছে মা ও শিশু। পিছনে গাছের উপর বসে আছে পাখি। অন্য প্রান্তে বৃক্ষছায়ায় জলাশয়ে ফুটে আছে দুটি শালুক ফুল। এই ছবিটির নির্মাণে আমরা পাই বাংলার চিত্রের নিবিড় এক লৌকিক আত্মপরিচয়।

এরকম আঙ্গিক ও তত্ত্ববিশ্বের উন্মোচনেই গণেশ পাইন ষাটের দশকের চিত্রকলার আধুনিকতার এক স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছেন। এর আর একটি নিদর্শন ১৯৭৫-এর ‘বসন্ত’। একটি বৃক্ষ রূপান্তরিত হয়েছে মানবী প্রতিমায়। গাছের দু’টি ফল যেন রহস্যময়ী সেই মানবীর দু’টি স্তন। অন্ধকার জলস্রোত অতিক্রম করে তার দিকে এগিয়ে আসছে নৌকার আদলে একটি পশুকরোটি। একটু দূরে প্রান্তিক পরিসরে অনির্বাণ জ্বলছে একটি দীপশিখা। বাস্তবকে কল্পমায়ায় রূপান্তরিত করে নেন শিল্পী। সুররিয়ালিজমের এক দেশীয় ধরন তৈরি হয়। জীবনের সঙ্গে চলছে মৃত্যুর সংলাপ। এরই মধ্যে প্রজ্জ্বলিত দীপশিখায় থাকছে মৃত্যুর, বিলয়ের তমিস্রাকে নিরাকৃত করার প্রতিশ্রুতি। এখানে এসে তিনি তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব জগৎ।
অবনীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার থেকে এক সময়ে তিনি শুরু করেছিলেন। এখানে তার প্রত্যক্ষ কোনও ছাপ রইল না। রবীন্দ্রনাথের ছবির অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা কল্পমায়ার মধ্যে ছড়িয়ে গেল। রেম্ব্রান্টের আলো-আঁধারির রহস্যময় জগৎ ও উৎসহীন আলো মৃত্যুচেতনায় সমাহৃত হয়ে গেল। পাউল ক্লে-র নিষ্পাপ সারল্য সুররিয়ালিস্ট আবহে দ্রবীভূত হল। এ-সমস্ত সমন্বিত হয়ে গড়ে উঠল তাঁর নিজস্ব এক গভীর ভুবন।
এই আস্তিকতায় শেষপর্যন্ত তিনি স্থিত থাকতে পারেননি। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সামাজিক পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে যখন তিনি মহাভারত-চিত্রমালা আঁকছেন, তখন সেই ছবির প্রায় সমস্তটাই মৃত্যুকীর্ণ হয়ে গেছে। ২০০৯-এর ‘দি ডেমন অফ ওয়ার’ ছবিতে একটি ভয়ংকর মুখ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। সেই মুখের দু’পাশে আছড়ে পড়ছে নিক্ষিপ্ত তির। ‘দি চ্যারিয়টিয়ার’ ছবিতে শ্রীকৃষ্ণ তমসাবৃত। কোথাও কোনও আশার আলো নেই। এই নিরাশা নিয়েই কি তিনি চলে গেলেন ২০১৩-র ১২ মার্চ?