গঙ্গার ধারে বিস্তীর্ণ মাঠ। ছেলেটি তার বন্ধুদের সঙ্গে সেই মাঠে রোজ আড্ডা দেয়। খোলা গলায় গান গায়। গঙ্গার বুকে সূর্য ঢলে পড়ে। ছেলেটা গলা সাধে। সন্ধের আকাশ-বাতাস ভরে ওঠে সুরে। রেডিওয় সে গান শোনে, শোনে গ্রামোফোন। দিকপাল গীতিকার সুরকারদের সৃষ্টি, গায়কদের গায়ন ভঙ্গী ছাপ ফেলে যায় তার কন্ঠে। ক্রমে সুরের জালে জড়িয়ে পড়ে ছেলেটা। আর সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ তার মা অপূর্ব কন্ঠের অধিকারী। অন্য দিকে দাদারা, একমাত্র দিদি— সকলেই তো অসামান্য গান করেন! কাজেই অল্পদিনের মধ্যেই সে স্থানীয় সমস্ত অনুষ্ঠানে অপরিহার্য হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমে পরিচিতি ঘটে সংগীত মহলে। কিন্তু তখনও তার নিজস্ব ভাব তৈরি হয়নি। গানের জগতে হয়নি তার আত্মপরিচয়। পারিবারিক গানের পরিবেশ সংগীতের পথে যাত্রা তার সুগম করেছিল, কিন্তু তাই বলে সংগীতের জগতে নিজের পরিচয় তৈরি করতে কম লড়াই করতে হয়নি তাকে। ভাবলে অবাক হতে হয় যে— ক্রমে এই মানুষটিই হয়ে উঠবেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের পরম আশ্রয়। প্রত্যেক তরুণ শিল্পী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি শ্রদ্ধেয় শ্রী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
ঘটনাচক্রে বার কয়েক দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। প্রথম থেকেই নাম ধরে ডেকে, তুই সম্বোধনে আপন করে নিয়েছিলেন। তখন শরীর অশক্ত হয়ে পড়ছে। গল্ফ গ্রীনের বহুতল থেকে নামতে কষ্ট হয়। টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারের জন্য ফোন করতেই বললেন তুই ডেকেছিস? তাহলে যাব। হাল্কা কল্কা করা সিল্কের পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা, সৌখিন পান-জর্দার সুবাস আর সহজাত আভিজাত্যে জটিলদা যেন সুরের জগতের রাজপুত্রটি। ওঁর মুখেই শোনা, বাংলা গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বন্ধুদের অনুরোধে নানা অনুষ্ঠানে সে-সব গেয়েওছেন। কিন্তু এ বোধ ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে— স্বকীয়তা তৈরি করতে না পারলে, পায়ের নীচের মাটি শক্ত করা মুশকিল। একে তো মফস্সলের ছেলে কলকাতায় সাম্রাজ্য তৈরি করতে চাইছে, সুতরাং বোঝাই যায় এ-পথ কিছু কম দুর্গম ছিল না।
সুধীন দাশগুপ্ত এবং সলিল চৌধুরী, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবনের দু’টি ‘কী নোট’। সুধীন দাশগুপ্তর সুর-সৃষ্টির সমগ্র প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন জটিলেশ্বর। গুরুর প্রভাব তাঁর গানে যে বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে গণনাট্য সংঘের প্রভাব এবং সলিল চৌধুরীর সান্নিধ্য তাঁকে গান রচনায় নির্দিষ্ট অভিমুখ দিয়েছিল। তাই বোধহয় ছ’য়ের দশকের প্রথম দিক থেকেই আমরা একের পর এক মৌলিক গান পেতে আরম্ভ করি। এ গানে ‘চাঁদ ফুল জোছনার’ কথা নয়, প্রকাশিত হয়েছিল জীবেনর জটিল সমস্যাগুলির কথা। অনেক বছর পর যখন ‘জীবনমুখী গান’ শুনতে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি, তখন মনে পড়েছে অনেক-অনেক দিন আগে ঠিক এমনি করে নিজের কথায়-সুরে জীবনের গান শুনিয়েছিলেন যিনি তাঁর নাম জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ওরফে জটিলদা।
খুব স্বাভাবিক কারণেই বোঝা যায়, ‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে’ নিছক প্রেমের গান নয়। আবার ‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস’ গানে প্রেমের বেদনা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। অন্য দিকে গণনাট্য সংঘের কোরাস অংশগুলি গাইতে- গাইতে অন্যধারার গান তৈরির হাতেখড়ি হয়ে যায় মানুষটার। ভাটিয়ার রাগটা খুব প্রিয়। বারবার মাথায় ঘোরে সে সুর। এভাবেই রাগ ভাটিয়ারকে অবলম্বন করে জন্ম হয় সেই কালজয়ী গান, ‘এ কোন সকাল’ যেখানে পাখির কুজন এবং হাহাকার একাকার হয়ে যায়৷ পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর শিষ্য জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর গানে সফল ভাবে সুর ও কথার সমানুপাত বজায় রেখেছেন। যা কিনা সফল আধুনিক বাংলা গানের এক অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য।
বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে রীতিমতো নাড়া বেঁধে গান শিখেছেন। রেকর্ড করেছেন তাঁর গান। মৌলিক হোক বা সিনেমার প্রয়োজনে তৈরি, তাঁর রচিত গানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বাঙালি সচেতন। কিন্তু আজীবনের সৃষ্টি সহস্রাধিক গানের সঞ্চয় থেকে কটা গান আমরা শিখতে পারলাম! খাতার ভেতরে গুমরে মরা গান গুলি কেবল ইশারায় ডাকে। আজ যদি তিনি বাঙালি শ্রোতার কাছে প্রশ্ন করেন তাঁর জন্য আমরা কী করলাম? কী উত্তর দেব আমরা?




