কেরি সাহেবের মুন্সিয়ানা

William Carey

সময়টা আঠারো শতকের শেষদিক। ইংল্যান্ডের নর্থহ্যাম্পমটনশায়ারে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম হ্যাকলেটনে বছর কুড়ির এক যুবক সদ্য ঘর বেঁধেছেন স্ত্রী ডরোথির সঙ্গে। যুবক পেশায় মূলত জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন; সঙ্গে চলে শখের বাগান পরিচর্যা। এবং যেটা খুব বেশি করে করেন, তা হল নিজস্ব লেখাপড়া। তার মধ্যে একটি বিষয় যদি হয় খ্রিস্টধর্ম, অন্যদিকে পাশাপাশি চলে ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু-সহ একাধিক ভাষার চর্চা। ইতিমধ্যে জন্ম হয় তাঁর প্রথম সন্তানেরও। তবে উক্ত যুবকের হ্যাকলেটনের সেই নিরবিচ্ছিন্ন জীবন অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন স্বদেশে কাটিয়ে, বত্রিশ বছর বয়সে দেশত্যাগী সেই যুবকই বঙ্গদেশে এসে আমাদের সাধের মাতৃভাষার হাল ধরবেন উনিশ শতকের গোড়ায়; বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস বইয়ে হয়ে উঠবেন একটি নিশ্চিত অধ্যায়। 

উইলিয়াম কেরির বহুস্তরীয় কর্মমুখর জীবন যদিও শুধুমাত্র ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকার মতো নয়, তবু বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে বাংলা ভাষার আপনজন হিসেবেই; কখনও কৃতজ্ঞতায়, কখনও আবার ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে। কেরি তাঁর ৭৩ বছরের দীর্ঘ জীবনে পেশা বদল করেছেন একাধিকবার, যার শুরুটা বাস্তবিকই হয়েছিল জুতো সেলাই দিয়ে আর শেষ করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুবাদক হিসেবে।

আরও পড়ুন: ‘চলিত’ বাংলা আর ‘মৌখিক’ বাংলা আসলে এক নয়, ‘চলন্তিকা’র মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন রাজশেখর বসু! লিখছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়…

কেরির পিতা এডমন্ড কেরি ছিলেন পলার্সপিউরি গ্রামের একজন তাঁতি। এডমন্ড তাঁর পাঁচটি সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান উইলিয়ামকে মাত্র পনেরো বছর বয়সে হ্যাকলেটনের এক জুতো নির্মাতার কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে ঢুকিয়ে দেন। সেই সময় থেকে প্রায় আঠাশ বছর বয়সে লিসেস্টারে চলে আসার আগে পর্যন্ত উইলিয়াম সংসার নির্বাহের জন্যই জুতো তৈরির কাজটি চালিয়ে যান। কিন্তু কেরির এই পেশা তাঁকে তাঁর আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি, গ্রাস করতে পারেনি তাঁর প্রতিভাকেও। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের আদর্শ তাঁকে প্রবাসের পথে ঠেলেছে, আর বহুভাষা-সাহিত্য বিষয়ে দক্ষতা তাঁর প্রতিভাকে করেছে বিশিষ্ট। 

শ্রীরামপুর কলেজে এখানেই বসবাস করতেন উইলিয়াম কেরি

ধর্মের বীজ কেরির মনে গাঁথা হয়েছিল একদম শৈশব থেকেই। পলার্সপিউরিতে থাকাকালীনই খ্রিস্টানশাস্ত্রের অধ্যয়ন শুরু হয়। পরবর্তীতে হ্যাকলেটনে কেরির জুতো সেলাই কর্মের দ্বিতীয় মনিব ওল্ডের সংস্পর্শে এসে তাঁর ধর্মচর্চা আরও বাড়ে। আর এই ধর্মচর্চার প্রয়োজনেই গ্রিক-ল্যাটিন শেখার পাশাপাশি তিনি শিখতে শুরু করেন হিব্রুও। অর্থাৎ ধর্মীয় চেতনাই এখানে তাঁর প্রতিভাকে উসকে দিয়েছে আরও জোরালো হওয়ার দিকে। বাইশ বছর বয়সে কেরি ব্যাপ্টিস্ট মতে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকেই হয়ে ওঠেন খ্রিস্টধর্মের অত্যন্ত উৎসাহী ও সক্রিয় প্রচারক। ক্রমশ তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে একজন খ্রিস্টান পাদরি হিসেবে। জানতে ইচ্ছে করে, সমকালীন ভারতবর্ষীয় সমাজে কেরির জন্ম হলে পাদুকা নির্মাতা থেকে ঈশ্বরের দ্যূত হওয়ার এই যাত্রা কি আদৌ এত অনুকূল হত?

শ্রীরামপুর কলেজে কেরির ব্যবহৃত ডেস্ক

সে যাই হোক, ব্রিটিশ-খ্রিস্টান কেরিকে তাঁর জীবিকার জন্য ঈশ্বরের পথে তেমন কোনও সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। বরং তখন তিনি সমুদ্রপাড়ে অ-খ্রিস্টান ‘হিদেন’দের উদ্ধারের জন্য ব্যাকুল। তারই ফলস্বরূপ ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর রাইল্যান্ড, সাটক্লিফ, স্যামুয়েল পিয়ার্স প্রমুখ সহযোগী পাদরিদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেন, ‘The Particular Baptist Society for propagating the Gospel amongst the Heathen’। কিন্তু তথাকথিত ‘হিদেন’দের মধ্যে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড থেকে এই প্রথম নয়। এর আগে বাংলায় ধর্মপ্রচার করতে আসা চিকিৎসক জন টমাসের বৃত্তান্ত অনেকেরই জানা। ভাষাশিক্ষা, বাইবেল অনুবাদ এবং ধর্মান্তরণে ব্যর্থ হয়ে টমাস ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন ঠিক এই সময়তেই, অর্থাৎ ১৭৯২ সালের শেষদিকে। সদ্যগঠিত উক্ত ব্যাপটিস্ট মিশনকে ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতবর্ষের নাম প্রস্তাব করেন টমাসই। নচেৎ কেরির পরিকল্পনায় ভারতবর্ষের কথা ছিল না। অতঃপর আর কী! পিতা এডমন্ডের বারণ, পত্নী ডরোথির আপত্তি সত্ত্বেও টমাসকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ‘ক্রন প্রিন্সেস মারিয়া’ নামক দিনেমার জাহাজে করে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন কেরি স্বদেশ ত্যাগ করেন; প্রথম ও শেষবারের মতো। 

কেরি অনূদিত বাইবেল

এদেশে এসে কেরির বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা অনেকেই কমবেশি পরিচিত। নীলকুঠিতে চাকুরি, শ্রীরামপুর মিশন ও প্রেস প্রতিষ্ঠা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপনা (বাংলা, সংস্কৃত ও মারাঠি বিভাগে), এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ পাওয়া, বাংলা-সহ একাধিক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ, ব্যাকরণ রচনা, অভিধানের সংকলন ও সম্পাদনা প্রভৃতি বিবিধ কর্ম-ভূমিকায় অবতীর্ণ কেরির নিছক পাদরি পরিচয় ক্রমেই নস্যাৎ হয়ে যেতে থাকে। সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে এদেশে এলেও তাঁর ভাষাবিদ ও অনুবাদক সত্তা ধর্মীয় কার্যকলাপকে অচিরেই ছাপিয়ে যায়। যে-‘বিধর্মী’দের উদ্ধারের জন্য তাঁর স্বদেশ ত্যাগ, সেই ‘হিদেন’দের সঙ্গে দীর্ঘ সহবাসের ফলে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে কেরির মুগ্ধতা ও মমত্ব আমাদের চমকিত করে— ‘হিন্দুদের মধ্যে দীর্ঘকাল বাস করিয়া আমি এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, বঙ্গীয় ভাষা আমার মাতৃভাষার মতই আয়ত্ত হইয়াছে।… আমি এখন নিঃসংশয়েই বলিতে পারি যে, এদেশের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, সংস্কার এবং হৃদয়াবেগের সহিত আমরা এমনই পরিচিত হইয়াছে যে, সময়ে সময়ে নিজেকেই এদেশীয় বলিয়া সন্দেহ হয়।’(সজনীকান্ত দাস, ‘বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস’, মিত্রালয়, শ্রাবণ ১৩৬৬, পৃ. ১১৮)এই বক্তব্যটি তিনি রেখেছিলেন ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাবলিক ডিসপিউটেশন অনুষ্ঠানে, তাও সম্পূর্ণ সংস্কৃতে। সামনে বসেছিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি।

এক সময়ে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চোখ এড়াতে দিনেমার জাহাজে করে লন্ডন থেকে কলকাতায় আসা, ব্যাপটিস্ট মিশনটিও খোলা ডেনমার্কের উপনিবেশ শ্রীরামপুরে, ক্রমে সেই কোম্পানির কর্তাদেরই প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন কেরি। সেটিও কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অসাম্প্রদায়িক আচরণের জন্যই। বস্তুত তৎকালীন বাংলার কোম্পানি সরকার কখনওই চাইত না এদেশীয়দের ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে, তাই এদেশে মিশনারিদের আনাগোনা ও কার্যকলাপকে তারা দেখত সন্দেহের চোখে। কিন্তু উইলিয়াম কেরি ও তাঁর শ্রীরামপুর মিশন কখনওই সেভাবে কোম্পানির বিরাগভাজন হয়নি। বরং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কেরির যোগদান (১৮০১), এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হিসেবে তাঁর নির্বাচন (১৮০৬) এবং সর্বোপরি ১৮২৪ সালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে সরকারের বাংলা অনুবাদক রূপে নিয়োগ— এই সব ঘটনা তাঁর শাসক-ঘনিষ্ঠতাকেই প্রমাণ করে।

লিথোগ্রাফে এশিয়াটিক সোসাইটি

এই কোম্পানি-ঘনিষ্ঠতার আরও বেশ কিছু ইতিবাচক উদাহরণ রয়েছে। যেমন, সমকালীন সমাজ-সংস্কারে কেরির পরোক্ষ অবদান। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো কু-প্রথা চোখের সামনে দেখে ধর্মপ্রাণ কেরির মানবিক হৃদয় যারপরনাই ব্যথিত হয়। তিনি চিঠি লিখে গভর্নর জেনারেলের নজর এদিকে টানেন। ওয়েলেসলি তখন কেরিকেই দায়িত্ব দেন এই প্রথা আদৌ শাস্ত্রসম্মত কি না খতিয়ে দেখার জন্য। এর ফলে কার্যত উইলিয়াম কেরির সহায়তাতে ও ওয়েলেসলির উদ্যোগে ১৮০৪ সালে গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের কু-প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকী ১৮২৯ সালে যখন সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়, তখনও বেন্টিঙ্ক সেই আইনের খসড়াটি শ্রীরামপুরে কেরিকেই পাঠান অনুবাদের জন্য। সেদিন রবিবার থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ কেরি গির্জার প্রার্থনাসভায় না গিয়ে সারাদিন ধরে বাংলায় অনুবাদ করেন সতীদাহ-বিরোধী আইনের ইংরেজি খসড়া। এভাবেই উইলিয়াম কেরির কর্তব্যনিষ্ঠা ও জ্ঞানপিপাসু মন বার বার ছাড়িয়ে গেছে তার ধর্ম সাপেক্ষতাকে।

যে-সম্ভাবনা কেরি বাংলা ভাষায় দেখেছিলেন, তা কখনওই অতিকথন নয়

ছোটবেলা থেকেই বাগান করার শখ ছিল কেরির। হ্যাকলেটনের নতুন সংসারে যেমন জুতো সেলাই করা ছেলেটা বাগানের পরিচর্যা করত; তেমন বহুভাষাবিদ, কলেজের অধ্যাপক প্রৌঢ় কেরিও শ্রীরামপুরে সাজিয়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধের বাগান। তবে শুধু শখের বাগানচর্চা নয়, চাষের পদ্ধতি, ঋতু অনুযায়ী চারা-বীজশস্য ইত্যাদি সব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন কেরি। আর এটি কেরির বিচিত্র কর্মমুখর জীবনে নতুন আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে কেরির উদ্যোগে ও লেডি হেস্টিংসের উৎসাহে তৈরি হয় কলকাতার এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি।

তবে এত কর্মকাণ্ড থাকা সত্ত্বেও বাঙালির মনে কেরি চিরন্তন হয়ে থাকবেন বাংলা ভাষার সাথে তাঁর আত্মীয়তার জন্যই। কেরিও এই ভাষাকে কম সম্মান দেননি। তার বেশ কিছু দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে, তাঁর রচিত বাংলা ব্যকরণ বইতে। A GRAMMAR OF THE BENGALEE LANGUAGE গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘This language is peculiarly copious and harmonious and were it properly cultivated, would be deserving a place among those which are accounted the most elegant and expressive.’ 

যে-সম্ভাবনা তিনি বাংলা ভাষায় দেখেছিলেন, তা কখনওই অতিকথন নয়। আজ, ৯ জুন উইলিয়াম কেরির প্রয়াণের ১৯১ বছর পূর্ণ হল। কিন্তু যে- প্রশ্নটা থেকেই যায়, কেরি-বিদায়ের প্রায় দু’দশক পরেও তাঁর প্রস্তাবিত প্রয়োজনীয় ‘কাল্টিভেশন’ বাঙালি আদৌ করে উঠতে পেরেছে কি?