ইদানীং, কোনও বাঙালি শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক বা রাজনীতিবিদ মারা গেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় চালু হয়ে যায় কাল্পনিক আলোচনা— এবার ওঁরা পরলোকে আড্ডায় বসবেন, বসে এই বলবেন, ওই বলবেন, অমুক আর তমুক মিলে সিনেমা বানাবেন ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবণতা শিরোধার্য করে কল্পনা করা যাক, জরুরি অবস্থার ৫০ বছর উপলক্ষে পরলোকে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত, সি আর ইরানি, কুলদীপ নায়ার, রামনাথ গোয়েঙ্কা প্রমুখ এক আলোচনাসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং প্রত্যাশিতভাবেই বলছেন, ওই দিনগুলো ছিল ভারতীয় গণতন্ত্র তথা সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে দুর্দিন। এই কথাটা শুনে হাসি চাপতে পারবেন না যে সাংবাদিকরা, তাঁদের মধ্যে দু’জনের নাম গৌরী লঙ্কেশ আর মুকেশ চন্দ্রকর। আরও বেশ কিছু নাম বলা যায়, কিন্তু তাতে লেখাটা বহরে বাড়বে শুধু। যাঁর বোঝার, তিনি ওই দুটো নামেই যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন।
খোলসা করে বলা যাক। ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার সময়ে দেশে সংবাদমাধ্যম বলতে খবরের কাগজই ছিল। টিভি, রেডিওর খবর তো তখন সরকারের নিজের হাতে। তাই কাগজগুলোরই গলা টিপে ধরেছিল কেন্দ্রীয় সরকার; তাবড় সম্পাদক, প্রতিবেদকদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কাগজ ছাপাখানায় যাওয়ার আগে সরকারি অফিসারদের দেখাতে হত, কী ছাপা হচ্ছে না হচ্ছে। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে কোনও কাগজ সাদা পাতা ছাপিয়ে দিয়েছিল, কেউ পাতাভর্তি কাটা চিহ্ন। কিন্তু সাংবাদিকদের সঞ্জয় গান্ধীর বাহিনীর হাতে পড়ে ‘নসবন্দি’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়নি, প্রাণের ভয় তো ছিলই না।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়নি, কারণ সঙ্গিন অবস্থা চলছে। সম্পাদকদের কারারুদ্ধ করা জলভাত হয়ে গেছে। ‘নিউজক্লিক’-এর মতো ইংরিজি ভাষার সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হলে কিছুটা হইচই হয়, কিন্তু বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার কাগজ, পত্রিকা, ওয়েবসাইট, চ্যানেলের কত সাংবাদিকের নামে যে অন্যায় মামলা ঠোকা হচ্ছে রোজ, আর কতজনকে গরাদের পিছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে— তার হিসেব রাখা সত্যিই কঠিন হয়ে গেছে। মোদী-অমিত শাহের গুজরাটেই তো কিছুদিন আগে প্রাচীন ও জনপ্রিয় কাগজ গুজরাত সমাচার-এর মালিক বাহুবলী শাহকে গ্রেফতার করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। তাঁর দাদা শ্রেয়াংশ ওই কাগজের প্রধান সম্পাদক। এর কিছুদিন আগেই সরকারের কথায় কাগজটার এক্স হ্যান্ডেল নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর কোম্পানির একাধিক অফিসে এবং শাহ-র বাড়িতে আয়কর বিভাগ হানা দেয়, শেষে ওই গ্রেফতারি। বিশ বছরের পুরনো কোনও মামলার কারণে নাকি অত তৎপরতা।
আরও পড়ুন : লিঙ্গহিংসার ভয় কি অতিপ্রাকৃতকে ছাপিয়ে যায়?
লিখছেন দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত…
বাহুবলী অবশ্য চটজলদি জামিন পেয়ে যান, কিন্তু কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের বেলায় তা হয়নি। তিনি রাজ্য ছেড়ে সুদূর উত্তরপ্রদেশের হাথরসে যাচ্ছিলেন সেই দলিত মেয়েটার ধর্ষণ, খুন এবং তার পরিবারকে আটকে রেখে পুলিশেরই মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে। তাঁকে পথেই গ্রেফতার করে নেওয়া হয়, যে প্রতিবেদন লেখাই হয়নি, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে— এই অজুহাতে। সিদ্দিকের ছাড়া পেতে পাক্কা দুটো বছর লেগেছিল। তাও সিদ্দিককে ভাগ্যবানই বলতে হবে। তাঁকে অন্তত কর্নাটকের গৌরীর মতো গুলি খেয়ে মরতে হয়নি বা ছত্তিসগড়ের মুকেশের মতো সেপটিক ট্যাংকে মড়া হয়ে ভাসতে হয়নি। ইন্দিরার জরুরি অবস্থা চলেছিল ২৫ জুন, ১৯৭৫-২১ মার্চ, ১৯৭৭— অর্থাৎ, পুরো দু’বছরও নয়।
আজকের সঙ্গিন অবস্থার কিন্তু এক যুগ হতে চলল। তীব্রতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার বলেই মনে হয়। আরও বেশি সাংবাদিক মার খাবেন, পুলিসের হাতে বিবস্ত্র হবেন, হাজতবাস করবেন, খুন হবেন— এটাই অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় সাংবাদিকদের অনিবার্য পরিণতি। সাংবাদিক নামধারী অন্য এক প্রজাতির প্রাণীও আছে এই সঙ্গিন অবস্থায়, তাঁদের কথায় পরে আসা যাবে। কিন্তু সত্যিই যাঁরা সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন এখনও, তাঁদের হাল দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চালু হওয়া সেই কথাটা মনে পড়ে যায়, যেটা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আজকাল আবার বলা শুরু হয়েছে। সে আমলে রুশ কমিউনিস্টরা নাকি বলত—একমাত্র ভাল ফ্যাসিবাদী হল একজন মৃত ফ্যাসিবাদী। ইদানীং দেখছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থীরা ওটাকেই ঘুরিয়ে বলে, একমাত্র ভাল কমিউনিস্ট হল একজন মৃত কমিউনিস্ট। এই মুহূর্তে ভারতের যা অবস্থা, তাতে কৌতুক করে নয়, সত্যি সত্যিই বলতে হয়— একমাত্র ভাল সাংবাদিক হল একজন মৃত সাংবাদিক।
কেন এত রূঢ় কথা বলছি? কারণ কেউ যদি সত্যি সত্যি সাংবাদিকতা করতে চায় আজকের ভারতে, অর্থাৎ জর্জ অরওয়েলের কথামতো, যা কেউ না কেউ চায় অপ্রকাশিত থাকুক, সেটাকেই প্রকাশ করার চেষ্টা করে, তাহলে প্রথমে তার চাকরি যাবে। তারপরও সাংবাদিকতা করে যাওয়ার পাগলামি বজায় থাকলে হাজতবাস করতে হবে। তাতেও বাতিক দূর না হলে মরতে হবে। সবসময় যে এই ক্রমেই ব্যাপারগুলো ঘটবে সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না অবশ্য। আমাদের ছাত্রজীবনের কড়া মাস্টারমশাইরা অঙ্কে ‘স্টেপ জাম্প’ করলে নম্বর কেটে নিতেন, কিন্তু আজকের রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের আশ্রিত গুন্ডাবাহিনীর স্টেপ জাম্পে নম্বর কাটা যায় না।
কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, এসব মোটেই ইন্দিরার জরুরি অবস্থার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ এই কুকীর্তিগুলো কিছু ব্যক্তি করে, কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তি করে না। কথাটা আইনত ঠিক। কিন্তু ব্যাপার হল, রাষ্ট্র আর উন্মত্ত জনতার মধ্যে যখন তফাত থাকে না, তখনই তো রাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছয়। তখন জনতাই রাষ্ট্র যেগুলো করতে চায় কিন্তু আইনে হাত-পা বাঁধা বলে করতে পারে না, সেগুলো করতে শুরু করে। যার ভাতের ঠিক নেই, মাথার ঠিক নেই তাকেই যদি বুঝিয়ে ফেলা যায় যে, সে-ই রাষ্ট্র, তাহলেই তো কেল্লা ফতে।
অন্যদিকে যদি কেউ সাংবাদিক তকমাতেই খুশি হয়ে রোজগারে মন দিতে পারে, ক্ষমতাশালীদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে, তাহলে আকাশের চাঁদও হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে। কেউকেটা হয়ে উঠতে পারলে সে গ্রেপ্তার হলেও তার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত ছুটির মধ্যে শুনানি চালিয়ে হাই কোর্টের মামলা নিজের কাছে টেনে নিয়ে জামিন দিয়ে দেবে। বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, নাম হবে, এমনকী, তেমন নাম করতে পারলে আর অন্যের চাকরি করতে হবে না। নিজের টিভি চ্যানেল হবে। নিদেনপক্ষে ইউটিউব চ্যানেল তো হবেই। সেই চ্যানেলে সাংবাদিক রভিশ কুমারের মতো অত সাবস্ক্রাইবার, অত ভিউ না হলেও ক্ষতি নেই। পকেটে টাকার অভাব হবে না। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে এ-ব্যবস্থা দেশের শাসক দল করেছে। রভিশ যাদের গোদি মিডিয়া বলেন, সেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপর নিতান্ত একচোখা দর্শকদেরও বিশ্বাসভঙ্গ হচ্ছে এবং রভিশ, আকাশ ব্যানার্জি, ধ্রুব রাঠি বা লোক হাসানোর কাজ থেকে ক্রমশ সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়া কুণাল কামরার প্রভাব ভোটারদের ওপর বাড়ছে বুঝতে পেরেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।


পাশাপাশি ওঁদের, এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে আশ্রয় করে ছোট পরিসরে সঙ্গিন অবস্থার মধ্যেও সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে, সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকদের ব্যবহার করেই টাইট দেওয়াও চলছে। মাঝে-মধ্যেই দেখা যায় কোনও ছোট বিকল্প সংবাদমাধ্যমের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ব্লক হয়ে গেছে সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতে। কোনও সাংবাদিক তো বটেই, অনেক সময় কার্টুনিস্ট বা ঋজু বিদূষকদেরও একইভাবে চুপ করানোর চেষ্টা রোজ চলে। মহিলা সাংবাদিক হলে তো কথাই নেই। ধর্ষণের হুমকি, মুখে অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি— এসবের অভাব নেই।
কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, এসব মোটেই ইন্দিরার জরুরি অবস্থার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ এই কুকীর্তিগুলো কিছু ব্যক্তি করে, কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তি করে না। কথাটা আইনত ঠিক। কিন্তু ব্যাপার হল, রাষ্ট্র আর উন্মত্ত জনতার মধ্যে যখন তফাত থাকে না, তখনই তো রাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছয়। তখন জনতাই রাষ্ট্র যেগুলো করতে চায় কিন্তু আইনে হাত-পা বাঁধা বলে করতে পারে না, সেগুলো করতে শুরু করে। যার ভাতের ঠিক নেই, মাথার ঠিক নেই তাকেই যদি বুঝিয়ে ফেলা যায় যে, সে-ই রাষ্ট্র, তাহলেই তো কেল্লা ফতে। এই কাজটা ইন্দিরা বছর দুয়েকের জরুরি অবস্থায় করে উঠতে পারেননি, মোদী এক যুগের সঙ্গিন অবস্থায় করে ফেলেছেন। ফলে এখন রাষ্ট্রের অপছন্দের কথা বললে যে, কেউ যে কোনও জায়গায় আক্রান্ত হতে পারেন। সাংবাদিকরা তো পারেনই। এই বিপদটাও গৌরকিশোরবাবুদের ছিল না। সেই সময় বরং যে মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস করেন না, তিনিও ওই সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করতেন। এখন তো আত্মীয়স্বজনরাই অবাধ্য সাংবাদিকের বাবা-মা, স্বামী বা স্ত্রীকে বলে ‘বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। এবার থামতে বল।’
গোদি মিডিয়া ইন্দিরার আমলেও যে একেবারে ছিল না তা নয়। ছিল বলেই লালকৃষ্ণ আদবানি মন্তব্য করেছিলেন— শ্রীমতি গান্ধী চেয়েছিলেন সংবাদমাধ্যম মাথা নোয়াক, তারা হামাগুড়ি দিয়েছিল। কিন্তু তেমন সংবাদমাধ্যম সংখ্যায় কম ছিল। লড়াকুরা দলে ভারী ছিলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সকলেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্ন মনে আসা অনিবার্য, সেটা হল, এমনটা কী করে সম্ভব হয়েছিল? তখন কি কাগজের মালিকরা ব্যবসা করতে চাইতেন না এখনকার মতো? সকলে কি দানসত্র খুলেছিলেন? সম্পাদকরা কি সব ঠাকুরদেবতা ছিলেন?


এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়, খোল-করতাল নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তির গুণগান করা চলে। কিন্তু তাতে আজ যা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
গত ৫০ বছরে ভারতে সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা কত গুণ বেড়েছে, তা হিসেব করাও মুশকিল। তার ওপর তখন কেবল খবরের কাগজগুলোকে জব্দ করলেই কাজ হাসিল হত। এখন আছে গাদাগুচ্ছের টিভি চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া, সর্বোপরি সোশ্যাল মিডিয়া। ক’টা অফিসে, ক’জনের বাড়িতে সরকারি অফিসার পাঠাবে সরকার? ব্যাপারটা অসম্ভব বলেই সাংবিধানিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা অর্থহীন, সত্যি কথা বলতে তার দরকারও নেই। যখন যেখানকার লোকের কাছে খবর পৌঁছনো বন্ধ করা দরকার, সেখানকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলেই হল। সেখানকার লোকগুলো সরকারের কতটা অপছন্দ, তার ওপর নির্ভর করে ঠিক হয় কতদিন খবরের আনাগোনা বন্ধ করে রাখা হবে। কানপুর হলে কয়েক ঘণ্টা, কাশ্মীর হলে কয়েক মাস। বিশেষ কোনও সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিককে স্তব্ধ করে দেওয়া তো আরও সহজ। আগেই বললাম।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হয়ে গেছে, কারণ বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সবই গোদি মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। কী করে হল? কোথায় গেলেন রামনাথ গোয়েঙ্কা বা বরুণ সেনগুপ্তর উত্তরসূরিরা?
প্রথমত, জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদমাধ্যম কম থাকায় সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার প্রতিযোগিতাও ছিল কম। তখনও ভারতে মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু হয়নি, ফলে কর্পোরেট বিজ্ঞাপন বলেও কোনও বস্তু ছিল না। এখন প্রথমটার জোরে সংবাদমাধ্যমকে পকেটে পুরে ফেলতে পারে সরকার, দ্বিতীয়টার জোরে কোন খবর প্রকাশ্যে আসবে, আর কোনটা আসবে না— তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কর্পোরেট। কোনও সংবাদমাধ্যম দুটোর চাপই অগ্রাহ্য করলে পছন্দের কর্পোরেটকে দিয়ে তাকে একেবারে কিনে নিতে পারে সরকার। আগে ইডি-সিবিআই দিয়ে উত্যক্ত করে, মামলায় ফাঁসিয়ে মালিকদের প্রণয় রায়-রাধিকা রায়ের মতো করে তাড়িয়ে দিলেই হল। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে রামনাথ বা সেই সময়ের অন্য মালিকরা কি অতখানি লড়াকু থাকতেন? বলা কঠিন।
দ্বিতীয়ত, জরুরি অবস্থার সময়ে দেশের স্বাধীনতার তিন দশকও পূর্ণ হয়নি। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশে থাকা প্রেসের লড়াকু মানসিকতার কিছুটা তখনও বাকি ছিল।
তৃতীয়ত, সাংবাদিকতায় তখন সম্মান যতটা ছিল, দক্ষিণা তার ধারে-কাছে পৌঁছত না। ফলে সেকালের শিক্ষকদের মতোই সাংবাদিকদেরও এই পেশায় আসার মূল প্রণোদনা ছিল সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছে। গরমের ছুটিতে বিদেশে বেড়াতে যাব, দামি গাড়ি চড়ব, নামে-বেনামে আমার কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি থাকবে—এইসব স্বপ্ন বরুণবাবুরা দেখতেন না। কারণ এই পেশায় থেকে ওসব হওয়া সম্ভব ছিল না। এখন সম্ভব। অপ্রিয় সত্য হল, জরুরি অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে নায়ক বনে যাওয়া ভারতীয় সাংবাদিকরা পরের ৩০-৪০ বছরে এমন সব উত্তরসূরিদের তৈরি করে গেছেন, যাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশছোঁয়া। তাতে ধুয়ো দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে কবজা করতে আজকের সরকারকে খুব বেগ পেতে হয়নি। সেই উত্তরসূরিরা আবার তাঁদের মতো সাংবাদিকই তৈরি করায় মন দিয়েছেন। ফলে আজ নরক গুলজার।
সুতরাং, অদূর ভবিষ্যতে নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দল অপসারিত হলেও সাংবাদিকতার সঙ্গিন অবস্থা কাটবে বলে মনে হয় না। কারণ আগে তরুণ সাংবাদিকরা শিখত— বড় সাংবাদিক সে-ই, যাকে মন্ত্রীরা ভয় পায়। জরুরি অবস্থা এই ধারণাকে আরও মজবুত করেছিল। এখন শেখে, যাদের সঙ্গে মন্ত্রীরা সেলফি তোলে, তারাই বড় সাংবাদিক।
পুনশ্চ: এমন নয় যে শুধু নরেন্দ্র মোদী আর তাঁর দলই গোদি মিডিয়া তৈরি করেছে বা কেবল তারাই সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করে। এমনও নয় যে, অন্য দলগুলোর শাসনে থাকা এলাকায় সাংবাদিক খুন হয় না। তবে সেসব নিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় লেখাই নিরাপদ।