বাঙালি নারী ও নীরদচন্দ্র

Nirad. C. Chaudhuri



১৯২৭ সাল। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তখন বেলেঘাটার কাছে শুঁড়ো-তে থাকেন। সেই সময়ে ফাঁড়িপথে কলকাতা আসার জন্য নারকেলডাঙার রেলপুল পর্যন্ত একটা পায়ে চলার রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা ধরে হ্যারিসন রোডের দিকে আসছেন নীরদচন্দ্র।

জায়গাটা ফাঁকা। কিন্তু মাঝে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের কতকগুলি একতলা বাড়ি আছে। পাড়াটার সামনে একটা মাঠের ধারে এসে নীরদ দেখলেন, একটা ছোটরকমের ভিড়। সেই ভিড়ে পুরুষ-স্ত্রীলোক, দুই-ই আছে। কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি বাড়ির সদরের কাছে একটি কিশোরী কাঁদো-কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি স্থূলকায় ভদ্রলোক হেঁটো ধুতি পরে খালি গায়ে চিৎকার করছেন। পাশে একদিকে কয়েকটি প্রৌঢ়া গৃহিণী। এক গৃহিণীর মুখে নীরদ শুনতে পেলেন, ‘ও মাগো, কী ঘেন্নার কথা! সোমত্ত মেয়ের বুকে হাত দেওয়া।’

ভদ্রলোকটির সামনে একটি যুবক অসহায়ভাবে জোড়হাতে দাঁড়িয়েছিল। সে গঞ্জনার উত্তরে অতি-কাতর কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। আমি নিজের বোন ভেবে বোঁটায় শুধু একটু কুরকুরুনি দিয়েছিলাম।’

অক্সফোর্ডের বাড়িতে নীরদচন্দ্র চৌধুরী

আরও পড়ুন: নাটকের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত বাঁধতেও দ্বিধা করেননি প্রমথনাথ বিশী!
লিখছেন অরুন্ধতী দাশ…

ভদ্রলোকটি একেবারে বোমার মতো ফেটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘শালা তুমি বোন ভেবে কুরকুরুনি দিয়েছিলে? কুরকুরুনি ঢুকিয়ে দেব তোমার পোঁদে!’

এই হল অতুলনীয়, অনবদ্য, অননুকরণীয় নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তবে ওপরের উদ্ধৃতিতে একেবারে বিশুদ্ধ নীরদকে পাওয়া যাবে না। আজকের পাঠক-পাঠিকার কথা ভেবে এইসময়ের সহনীয়-বোধনীয় বাংলায় নীরদের ক্রিয়াপদগুলি আনতে সেগুলির মধ্যে কিছু বিষক্রিয়া ঢুকিয়েছি। তবে সচেতনভাবে সচেষ্ট থেকেছি সারাক্ষণ নীরদচন্দ্রের অনন্য হিউমার, উইট এইসব জীবন্ত রাখতে।

নীরদচন্দ্র অবশ্য বাঙালি কী কাজে আদিরসাত্মক কাব্যকে নিয়োগ করতে হাত পাকিয়েছিল, সে-বিষয়টা ভুলে যাননি। একটু লেখাপড়া জানা বাঙালি প্রৌঢ়রা যুবতী স্ত্রী-র অনুগ্রহ পেতে রাত্রে বিছানায় তাদের আদিরসের কাব্য ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করে বোঝাতেন। নীরদের ভাষায়, ‘ভুঁড়ি ঊর্ধ্বগামী, ও অধোগামী নানাপ্রকার দুর্গন্ধ ইত্যাদির দ্বারা পত্নীকে প্রতিকূল করিয়া কামপ্রবৃত্তির সাহায্যে অনুকূল করিবার জন্য আদিরসাত্মক কবিতার সাহায্য লইতেন।’

এই উদ্ধৃতি নীরদের ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ গ্রন্থ থেকে। বাঙালি ও তার ‘মেয়েমানুষ’ -দের নিয়ে এমন বই পৃথিবীতে আর লেখা হবে কি? জানি না। বাঙালি যে মেয়েমানুষদের ‘রমণ’ করার পাত্রী বা বস্তু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি এবং আজও পারে না, এই সত্যটা ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ বইয়ে নীরদ কোনওরকম রাবীন্দ্রিক আড়াল না টেনে, চোখে এবং অন্যান্য জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি ও তার মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের সবচেয়ে হাস্যকর দিকটা হল, হিন্দু সাহিত্য ও জীবনের আদিরসও বাঙালি গ্রহণ করতে পারেনি। নীরদের ভাষায়, ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে যে আদিরস আছে তাহাকেও ভদ্রভাবে গ্রহণ করা সে যুগের বাঙালির পক্ষে সম্ভব রহিল না। প্রাচীন হিন্দুর তীব্র মদিরা তৃষ্ণায় কাতর হইয়াও আমরা ওষ্ঠের কাছে তুলিতে পারিলাম না।’ আদিরস সরাসরি পান করতে অক্ষম বাঙালির রোম্যান্টিক বা প্লেটোনিক শঠতার প্রয়োজন হল। এবং এই প্লেটোনিক শঠতা গড়াতে পারল সোমত্ত মেয়ের স্তনাগ্র স্পর্শের নিখাদ দেহজ উত্তেজনার ওপর নিজের ভগিনী-বোধের পবিত্র প্রলেপ পর্যন্ত।

নীরদচন্দ্র অবশ্য বাঙালি কী কাজে আদিরসাত্মক কাব্যকে নিয়োগ করতে হাত পাকিয়েছিল, সে-বিষয়টা ভুলে যাননি। একটু লেখাপড়া জানা বাঙালি প্রৌঢ়রা যুবতী স্ত্রী-র অনুগ্রহ পেতে রাত্রে বিছানায় তাদের আদিরসের কাব্য ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করে বোঝাতেন। নীরদের ভাষায়, ‘ভুঁড়ি ঊর্ধ্বগামী, ও অধোগামী নানাপ্রকার দুর্গন্ধ ইত্যাদির দ্বারা পত্নীকে প্রতিকূল করিয়া কামপ্রবৃত্তির সাহায্যে অনুকূল করিবার জন্য আদিরসাত্মক কবিতার সাহায্য লইতেন।’ এই কাজের একটি পেলব রাবীন্দ্রিক-সংস্করণ আমরা পাই ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে। সন্দীপ তার বন্ধু নিখিলেশের স্ত্রী বিমলাকে ফুঁসলাতে একটি দৃশ্যে কামোদ্দীপক বই ও ছবির সাহায্য নিচ্ছে। তবে সন্দীপ সরাসরি বিমলাকে পর্নোগ্রাফি পড়ে শোনাচ্ছে না। আদিরসাত্মক কাব্য পড়ছেও না তার সামনে। কিন্তু বিমলার বসার ঘরে কিছু আদিরসাত্মক বই ‘ভুল’ করে রেখে আসছে এবং পরে লুকিয়ে গিয়ে দেখছে, সেই বইগুলি সেখানেই পড়ে আছে না বিমলার হস্তগত হয়েছে!

তরুণ নীরদচন্দ্র চৌধুরী

নীরদচন্দ্র সেই বাঙালি, যিনি কামনাবর্জিত প্রেমে আদৌ বিশ্বাস করেন না। বাঙালি যত আধুনিক হয়েছে, তত ঘোমটার নিচে খ্যামটায় বিশ্বাস করেছে। রোম্যান্টিক বা প্লেটোনিক প্রেমের শঠতা বিদেশ থেকে ধার করে, তার নিজস্ব শরীরবাদের ঢাকনা হিসেবে এই ধারকরা প্রেমদর্শন বাঙালি নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছে। নীরদচন্দ্র বাঙালির এই রোম্যান্টিক বা প্লেটোনিক ন্যাকামির প্রতিবাদে লিখছেন তাঁর তেজি দেহবাদী প্রেমতত্ত্বর কথা। এই ভাষায়: ‘প্রেম কখনওই দেহ নিরপেক্ষ নয়। চুম্বন নিরপেক্ষ প্রেম নাই। সুতরাং দেহ নিরপেক্ষ প্রেমও নাই।… জীবনের উৎস যে কাম, তাহাকে পাপ বলিলে কোথায় দাঁড়াইব?’

নীরদচন্দ্রকে আজকের বাঙালি আর তেমন পড়ে না। তার প্রধান কারণ, আজকের বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ পেলব প্রেমে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন। স্ত্রীলোক বলতে আজকের বাঙালি যা-ই ভাবুক বা বুঝুক, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের ছায়া পড়বেই। রবীন্দ্রনাথের ছায়া বা আধো-আধো ভাব ছাড়া আরও স্পষ্টতায় রমণীকে একদিন বাঙালি ভাবতে পারত। যেমন, এই কবিতায়:

গিয়াছিনু সরোবরে স্নান করিবার তরে
দেখিয়াছি একজন অপরূপ কামিনী—

এইবার এই কামিনীকে পাওয়ার জন্য প্রি-রবীন্দ্রনাথ বাঙালিবাবু কী করবে? কোনও ধানাইপানাই নেই। বাবু বলছে: ‘যত চাহে দিব ধন দিব নানা আভরণ/ কোনওমতে মোর সঙ্গে বঞ্চে এক যামিনী’। অনেক বাঙালিবাবুও ওই একই জিনিস চাইবে। কিন্তু তার ভাবাবেশ, আবেগ, রোম্যান্টিক ভাঁওতা, প্লেটোনিক শঠতার শেষ থাকবে না। বাঙালির সর্বনাশ হল, সে রমণী দেখলেই প্রেমের আদিখ্যেতায় যায়। কিন্তু প্রেম-প্রেম করে মরে কী লাভ? প্রেম এমন এক ফেনা, যাকে বোঝা যায় না। তাই নীরদচন্দ্র ভোট দিচ্ছেন বিশুদ্ধ কামের পক্ষে। এবং বলছেন, বাঙালি খোকাবাবুরা, জেনে রাখুন, কাম তিনপ্রকার, মানে মূলত তিনপ্রকার। বাঙালি মেয়েরা কাম অনেক বেশি বোঝে। এবং কাম সম্পর্কে তাদের তেমন হাত কচলানিও নেই। তিনরকমের কাম হল, কাম-কোয়াত্রঁ, কামের চেরিব্র্যান্ডি ও কামের ক্রেম দ্য মাঁথ। তিনপ্রকার কামকেই তিন স্বাদের সুরার সঙ্গে তুলনা করেছেন নীরদচন্দ্র। এবং কামের রকমভেদের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন বাঙালি মেয়ের কামদর্শনের নির্দেশে! যদি কোনও রমণী দয়িতের কাছে বিয়ের আগে তার কন্যকা হারানোর উত্তেজনার কথা বলে কামোদ্দীপন উপভোগ করে, তাহলে সেটা হল, নীরদচন্দ্রর মতে, খুবই সফিস্টিকেটেড কাম— কাম-কোয়াত্রঁ, যে সুরার অনেকগুলি স্বাদ-স্তর আছে। এবার ধরা যাক, সংগমের এক স্তরে পৌঁছে মেয়েটি পুরুষকে বলে, আমার আলগা হয়ে যাওয়া চুল তুমি বেঁধে দাও, আমার স্তনতটে ছিঁড়ে যাওয়া মালা আবার গেঁথে দাও, এ হল কামের চেরিব্র্যান্ডি। আবার কামের ক্রেম দ্য মাঁথ হল, সংগমরত অবস্থায় উত্তেজক কথা। পুরুষ এবং রমণী, উভয়কেই সংগমরত অবস্থায় কামের ক্রেম দ্য মাঁথ হতে হবে! কিন্তু যে বাঙালি ‘যৌন যৌন’ করে সর্বক্ষণ চিৎকার করছে, সেই বাঙালি পুরুষ কতটুকু বোঝে কামশাস্ত্রর এই তিন আদি অধ্যায়?

নীরদচন্দ্র শেষ পর্যন্ত এই বক্তব্যে পৌঁছেছেন বলেই মনে হয় আমার: কামের ব্যাপারে বাঙালি পুরুষের থেকে অনেক এগিয়ে বাঙালি মেয়েরা। নীরদচন্দ্র লিখছেন, আমরা অল্পবয়সে দেখেছি, ভদ্রঘরের যুবতী খোল-করতাল-হারমোনিয়াম সহযোগে রতিসুখসারে গতমভিসারে গাইছেন আর প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরা হাউহাউ কেঁদে গড়াচ্ছেন। এটা সংস্কৃত জ্ঞানের অভাবের জন্য ঘটত, না কি চোরা লোচ্চামির জন্য ঘটত, তা বলতে পারি না। বাঙালির প্রেমদর্শনের ওপর নীরদচন্দ্রর এ-কথা আজও সত্য। বাঙালির প্রেমদর্শনে লোচ্চামি মিশেই আছে। তবে একটা আধ্যাত্মিক ঢাকনাও আছে বইকি সেই কামুক লোচ্চামির।