আমাদের স্বদেশিয়ানার সঙ্গে, বাংলা-কলমের ছবির যোগ যেমন গভীর, তেমনি দূর-প্রাচ্যের ছবির রসদ, অবলীলায় এখানে এসে মিশেছে। শিল্পের দিক থেকে, পশ্চিমকে বর্জন আর ভারতীয় তথা দেশীয় শিল্প-আদর্শকে গ্রহণ, এইটেই বাংলা-কলমের ছবির প্রধান লক্ষ্য ছিল।
বিদেশি শাসকের রাজত্বকালে, ভারতীয় বিষয়, শিল্পভাবনা ও আঙ্গিকে স্বদেশি ভাবের প্রকাশ— এই শিল্প আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সময়ের নিরিখে, এর ঠিক আগে, আমাদের দেশের পৌরাণিক বিষয় অবলম্বনে চিত্রিত— রবি বর্মার ছবিকে আমরা ভারতীয় চিত্রকলার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম।
একটু তলিয়ে বিচার করলে বোঝা যাবে, রবি বর্মার ছবির বিষয়টুকু কেবল ভারতীয়, কিন্তু তাঁর ছবির আঙ্গিকের কৌশল— পশ্চিম থেকে উঠে এসেছে। ছবিতে দেখা গেছে, পশ্চিমের সেই রিয়েলিস্টিক গড়ন, বাস্তবানুগ আলোছায়ার খেলা, তেলরঙের প্রথাগত ব্যবহার ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে রবি বর্মার ছবি, পাশ্চাত্য ছবিরই একপ্রকার রকমফের, একে ভারতীয় শিল্পের তকমা দেওয়া চলে না। এহেন মুহূর্তে, আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


বিষয়ভাবনা ছাড়াও, ছবির নির্মাণ শৈলীতে তিনি আনলেন এক অভিনব কৌশল, ছবির আঙ্গিক হয়ে উঠল স্বতন্ত্র— যা পশ্চিমের ছবির টেকনিক থেকে, একেবারে আলাদা। অবন ঠাকুরের ছবিতে, বাস্তবের চোখে দেখা, সেই আলোছায়ার বিন্যাস বদলে গেল। ফিগারের আদলে এল আলংকারিক ভঙ্গিমা, পরিপ্রেক্ষিত বা পার্সপেকটিভের বোধ হয়ে উঠল, স্বতন্ত্র দৃশ্য আধারে।
অবশেষে, এইটেই নতুনরূপে বাংলা তথা ভারতীয় শিল্পকলার বনেদ হিসেবে দেখা দিল— যা বহুকাল আগে ফুটে উঠেছিল, অজন্তার চিত্রমালায়, রাজস্থানী বা মোগল অনুচিত্রে। পাশাপাশি, এই ‘নতুন ছবি’র অন্দরে এসে লাগল, চিনে-জাপানি ছবির ঢেউ। শিল্পকলায় দেখা দিল এক নতুন জোয়ার। বিলেতের একাডেমিক শৈলী থেকে নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারার দূরত্ব হয়ে উঠল বহুযোজন। ভেবে দেখলে, অবন ঠাকুরের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল থেকে, এই নবতর শিল্প আন্দোলনের উত্থান।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, ভাবনা ও আদর্শের দিকে তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিলেন একাধিক ব্যক্তিত্ব। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, ইবি হ্যাভেল, কাকুজো ওকাকুরা, ভগিনী নিবেদিতা, আনন্দ কুমারস্বামী প্রমুখের নাম সবার আগে উচ্চারিত হবে। যাঁদের প্রত্যক্ষ উৎসাহ এবং দিকনির্দেশ ছাড়া, বাংলা-কলমের উদ্বোধন এবং তার প্রসার কোনওমতে সম্ভব ছিল না।


ইতিহাসের নিরিখে, সময়টা ১৯০৫, কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ, হ্যাভেল সাহেবের প্রবল উদ্যোগে আর্ট কলেজে ভাইস-প্রিন্সিপালের পদে যোগ দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। এই কাজ্ অবন ঠাকুরের সম্মতি আদায় করা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক কাণ্ড করে হ্যাভেল তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন। সেই পর্বে, অবন ঠাকুর পরিচালিত বিভাগটির নাম ছিল ‘অ্যাডভান্সড ডিজাইন ক্লাস’। অবনীন্দ্রনাথ ছাড়া এই বিভাগের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন শিল্পী ঈশ্বরীপ্রসাদ বর্মা।
এঁদের ছত্রছায়ায় একেবারে প্রথম দলে, যে-সব ছাত্রেরা শিল্পের পাঠ নিচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে, বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়— সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, অসিতকুমার হালদার, দুর্গেশচন্দ্র সিংহ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, কে ভেংকটাপ্পা, শৈলেন্দ্রনাথ দে, হাকিম মহম্মদ খান প্রমুখের নাম।
পরে এসেছেন, সারদাচরণ উকিলের মতো ছাত্রেরা। কালক্রমে অবনীন্দ্রনাথের পরিচালনায়, এই ছাত্রদের হাতে গড়ে উঠেছে, বাংলা-কলমের চিত্রধারা। উক্ত ছাত্রদলের অধিকাংশই পরবর্তীকালে, বেঙ্গল স্কুলের ঘরানা অবলম্বন করে, চিত্রচর্চা করেছেন এবং চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন।


যদিও দু’একজন শিল্পী, বেঙ্গল স্কুলের প্রত্যক্ষ আদর্শ থেকে পরে খানিকটা সরে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে, নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায় অন্যতম, যাঁদের চিত্রধারা একেবারে নিজস্ব পথে প্রবাহিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, উপরে উল্লেখিত শিল্পীদের মধ্যে, মাত্র কয়েকজনের কথা আমরা স্মরণে রেখেছি, বাকিরা হারিয়ে গেছেন, স্মৃতির অতলে। ইতিহাস বুঝি এমনই, যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোর নীচে উদ্ভাসিত— তাঁরাই আমাদের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন, বাকিদের নাম মুছে গিয়েছে।
এ যেন প্রকাণ্ড অট্টালিকা নির্মাণের মতো, যেখানে প্রত্যেকটি ইটপাথরের টুকরো, সমান শক্তি দিয়ে সেই হর্ম্যকে ধরে রেখেছে, অথচ আমাদের চোখের সামনে থাকা কিছু টুকরোই আলোকিত হতে চায়। কথাটা এই কারণে ওঠে, বেঙ্গল স্কুলের শিল্পী বলতে, অসিত হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, সারদা উকিলের মধ্যেই আমাদের ভাবনা সীমিত। সুরেন গাঙ্গুলি, সমরেন্দ্র গুপ্ত বুঝি অনেকটাই ঝাপসা হয়ে উঠেছে, আর বাকিদের কথা সহজে মনে পড়ে না। সেই মনে না-পড়া শিল্পীদের দিকে এক ঝলক নজর দেওয়া যেতে পারে। সনতারিখের হিসেবে, অবনীন্দ্রনাথের প্রথম ছাত্র সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, নন্দলাল এসেছেন তারপরে। অত্যন্ত কৃতি ছাত্রটির কাজ সবার মনে বিপুল আশার সঞ্চার করলেও, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু— শিল্পী হিসেবে পরিপূর্ণ জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যায়। এমনকী তখনও, তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয়নি। প্রবল অর্থাভাবে চিত্রচর্চায় ব্যাঘাত ঘটেছে, অবনীন্দ্রনাথ ইন্ডিয়ান মিউজিয়মে তাঁর চাকরির ব্যবস্থা করলেও চিত্রচর্চায় বাধা পড়বে— এই আশঙ্কায় তিনি সেই চাকরি গ্রহণ করেননি।
মাত্র কয়েকজনের কথা আমরা স্মরণে রেখেছি, বাকিরা হারিয়ে গেছেন, স্মৃতির অতলে। ইতিহাস বুঝি এমনই, যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোর নীচে উদ্ভাসিত— তাঁরাই আমাদের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন, বাকিদের নাম গিয়েছে মুছে।
তীব্র দারিদ্র্যকে দাঁতে-দাঁত চেপে সহ্য করেছেন সুরেন্দ্রনাথ, তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ ক্ষয়রোগ। তবে সেই স্বল্পসময়ে তাঁর কাজ যেমন একাধারে উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে, তেমনই তা জন্ম দিয়েছে বহু বিতর্কের। সুরেন্দ্রনাথের ছবির বিষয়, মূলত বাংলার ইতিহাস এবং পুরাণ কেন্দ্র করে রচিত, তার মধ্যে ‘দি যক্ষস ওয়াইফ’, ‘লক্ষণ সেনের পলায়ন’ ইত্যাদি বিশেষ ভাবে আলোচিত ছবি। দ্বিতীয় ছবি নিয়ে বিতর্কের জের অনেকদূর গড়িয়েছিল। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এই ছবি অবলম্বনে প্রবন্ধ লিখেছেন, ছবিটিকে তিনি ‘লক্ষণ সেনের পলায়ন-কলঙ্ক চিরস্মরণীয়’ করে রাখবার জন্যে তিরস্কার করতে ছাড়েননি।

আবার ছবির চিত্রগুণ প্রসঙ্গে, আলোচনা করেছেন ভগিনী নিবেদিতা, আনন্দ কুমারস্বামী ছাড়াও স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ। শিল্পী অঙ্কিত ‘মহাভারত লিখন’ ছবিটি তদানীন্তন বিচারপতি স্যার জন উডরফ সংগ্রহ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের ছবি ছাপা হয়েছে, লন্ডনের ‘দি স্টুডিয়ো’ পত্রিকা, ‘প্রবাসী’, ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘ভারতী’ ইত্যাদি বিভিন্ন সাময়িক পত্রে। অথচ এই অসমাপ্ত আলোকশিখার মতো চিত্রীকে আমরা তেমন করে মনে রেখেছি কি?
পাশাপাশি মনে পড়ে, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্তের নাম। নিবেদিতা ও অবনীন্দ্রনাথের উৎসাহে গুণী ছাত্র সমরেন্দ্রনাথ লেডি হেরিংহ্যামের নেতৃত্বে অজন্তার গুহাচিত্র অনুলিপি কাজের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। সেই দলে, অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন নন্দলাল, অসিত হালদার এবং কে ভেঙ্কটাপ্পা।
অজন্তার চিত্রমালা শিল্পীদের মনে ও কাজে যে নবতর ভাবনার বীজ রোপণ করেছিল, তা বলাবাহুল্য। অজন্তার চিত্র-অভিজ্ঞতা অবলম্বনে সমরেন্দ্রনাথ পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র একাধিক বক্তৃতা দিয়েছেন। অল্প বয়সে লাহোরের— ‘মেয়ো স্কুল অফ আর্টস’-এ উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন এবং বিদেশ থেকে ফিরে এসে, তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেই শিল্প-বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। সাংগঠনিক দক্ষতা ছাড়াও, শিল্পকলায় তিনি বিশেষ নজির তৈরি করেছেন। উল্লেখ্য, কেবলমাত্র বেঙ্গল স্কুলের ঘরানার মধ্যে নিজেকে তিনি আটকে রাখেননি।


বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর ছবিকে অন্যতর মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু শিল্পের ইতিহাসে, তিনিও কি উপেক্ষিত নন? তবে কি সে তাঁর সুদীর্ঘ প্রবাসজীবনের কারণে? একইভাবে আসে, শৈলেন্দ্রনাথ দে বা ভেঙ্কটাপ্পার কথা। উভয়েই কৃতি শিল্পী, শৈলেন্দ্রনাথের ছবি মুদ্রিত হয়েছে ‘রূপম’ পত্রিকা, চ্যাটারজিস এ্যালবাম, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ইস্ট-ওয়েস্ট’ শীর্ষক পত্রিকায়, ছবি সংগৃহীত হয়েছে, একাধিক মিউজিয়মে। ওয়াশ-ছবির কৌশলে গুরু অবনীন্দ্রনাথের ছবির ধারাকে তিনি নিপুন দক্ষতায় আয়ত্ত করেছিলেন। ভেঙ্কটাপ্পাও শিল্পাচার্যের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতশিল্পে মূর্তি’র প্রাথমিক খসড়ায় তাঁরই চিত্রায়িত করার কথা ছিল। ছবি আঁকা ছাড়াও, তিনি ভাস্কর্য সংগীতে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তবে পরিতাপের বিষয়, তাঁকেও আমরা সেভাবে মনে রাখিনি। বেঙ্গল স্কুলের শিল্পী-তালিকার প্রসঙ্গ উঠলে, অসিতকুমার হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ কর বা সারদা উকিলের পর আমাদের স্মৃতি কেমন দুর্বল হয়ে আসে।
এ যেন সেই ফরাসী দেশের ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতোই, গুটিকয় শিল্পী আমাদের মনে উঁকি দিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে মানে, মোনে, রেনোয়া, সিসলে, দেগা, পিসারোর মত কয়েকজনকে আমরা মনে রেখেছি। এখানে সেজান, ভ্যানগগ, গোঁগাকে আমরা, বিশেষ করে মনে রেখেছি, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের প্রধান মুখ হিসেবে। এঁদের হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা, বিশ্বশিল্পের আধুনিক যাত্রাপথ।
অনুরূপভাবে আধুনিক ভারতীয় শিল্পের অগ্রপথিক হিসেবে বাংলা-কলম থেকে সরে আসা চিত্রীদের মধ্যে নন্দলাল ও যামিনী রায়ের নাম এসে পড়ে সকলের আগে। তবু পিছন ফিরে তাকিয়ে, আজ মনে হয় বাংলা-কলমের শিল্পীদের মধ্যে পাদপ্রদীপের আড়ালে সেই ছায়াঘেরা এলাকা কি ক্রমশ ঘন থেকে আরো ঘন অন্ধকার হয়ে উঠছে?