রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভেবে অবাক লাগে, ঈশ্বর চল্লিশ লক্ষ বাঙালি তৈরি করতে গিয়ে, একজন পুরুষ তৈরি করে ফেলেছেন।’ সম্প্রতি এক গবেষক, ‘The essential Rokeya’ গ্রন্থে (‘Brill’ থেকে প্রকাশিত) রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতির খানিক বদল করে বলেছেন, ঈশ্বর চল্লিশ লক্ষ বাঙালি তৈরি করতে গিয়ে, দৈবাৎ এক নারীকে (রোকেয়া) গড়ে তুলেছেন!
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে রংপুরের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা গল্প “The Sultana’s Dream” ভীষণভাবে চর্চিত, অনুবাদিত এবং সারা বিশ্বে সমাদৃত। স্প্যানিশ চিত্রপরিচালক ইসাবেল ২০২৩ সালে এই ইউটোপিয়াকে কেন্দ্র করে অ্যানিমেটেড সিনেমা তৈরি করেন। বিবিধ অ্যাকাডেমিয়াতে এই টেক্সট গবেষণা বা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। সম্প্রতি ইউনেসকো থেকে এই বইকে ‘মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে; অর্থাৎ কতিপয় রচনা, যাদের আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ডকুমেন্টেড হেরিটেজ’ বলে ঘোষণা করা হয়। কেন এত হইচই এই বই নিয়ে?
আসলে বিশ্বসাহিত্যে এ এক বিস্ময় যে, বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে জন্মানো মুসলিম মহিলা, যিনি ছোটবেলা থেকেই থেকেছেন কঠোর পর্দার আড়ালে, স্কুলে যাননি কখনও, পারিবারিক অর্থ থাকলেও মেলেনি চলাফেরা বা ভাবনার স্বাধীনতা, কীভাবে এমন একটি সোশ্যাল সাট্যায়ার লিখে ফেলতে পারলেন? তাও আবার ১৯০৫ সালে দাঁড়িয়ে!
আরও পড়ুন: জেলজীবনের থেকেও কি পরিবারে বেশি বন্ধন সহ্য করতে হয় নারীদের? লিখছেন কোয়েল সাহা…
আজ তাঁর ১৪৫তম জন্মদিবস, মৃত্যুদিনও বটে। তাই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনার অবকাশ তৈরি হলে খুব স্পষ্টতই বলা প্রয়োজন যে, শুধু “Sultana’s Dream” কেন, বরং তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ, উপন্যাস বা ছোটগল্পে আমরা এমন কিছু ব়্যাডিক্যাল এলিমেন্ট দেখতে পাই, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ভারতে অনেকে লিখতে বা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। আজও যখন খুব সন্তর্পণে ঘর ও বাহির ভাগ হয়ে যায়, দশভূজা নাম দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয় অদৃশ্য, মজুরিবিহীন গৃহস্থালির শ্রমকে, তখন রোকেয়ার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। তাঁর কথাগুলো মনে হয় বারে বারে পড়ে যাই, মুখস্থ করে ফেলি, যেন রক্ত-মজ্জায় মিশে যায় বেগমের বুলি, তিনি লিখছেন:
‘এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কী? দাসী! আমরা দাসী কেন?… পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদেরকে যা করিতে হয়, তাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব… লেডি কেরানি হইতে লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেরিবেরিস্টার, লেডিজজ সবই হইবো… ৫০ বছর পরে লেডি viceroy হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে রাণী করিয়া ফেলিব! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই? না পা নাই? বুদ্ধি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব নাযে
(‘স্ত্রী-জাতির অবনতি’, ১৯০৭)
‘মতিচূর’ গ্রন্থে রোকেয়া এমন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, যা আজও, দেড়শো বছর পর বাঙালি মেয়েরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারে না। ‘পিপাসা’ নামক প্রবন্ধে মহরমের জলপিপাসার (অভুক্ত থাকা) সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন জ্ঞান-পিপাসাকে। মূর্খের মতো কিছু নিয়ম নকল করা নয়, বরং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানার পিপাসা; ভালবাসা, শান্তি বা প্রণয়ের তৃষ্ণার কথা বলেছেন। ‘স্ত্রী-জাতির অবনতি’ নিবন্ধে নারীর সমস্ত অলংকারকে ‘badges of slavery’ বলছেন, গোস্বামীরা তার বলদকে নাকে দড়ি পরায়, তেমনি স্বামী পরায় তার স্ত্রীকে নোলক। চুড়ি হয় হাতকড়ি আর পায়ের মল বেড়ি। রোকেয়া দেখাচ্ছেন যে, সোনারূপোর এই সমারোহ নারীকে করে স্থিরগতি-সম্পন্ন, সে চলাফেরা করে ধীরে, বাহিরমহলে পা রাখে না, পাছে খোয়া যায় সোনার দুল, তার মন আর শরীর হয় ঠিক যেন জড়পিণ্ড। কিছুক্ষণ আগেই উল্লিখিত, রোকেয়ার ভাষায়, ‘লেডি-কেরানি, লেডি-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি-জজ’ দুশো ভরি সোনা পরিধান করে হওয়া সম্ভব নয়, একথাই বলতে চেয়েছেন তিনি। আজকের ভোগবাদী সমাজে, যেখানে সোনারূপোর সঙ্গে নারী-প্রগতিকে যুক্ত করা হয় অহরহ, নামীদামি গয়না বিপণনী বিয়ের মরশুমে পণকে (dowry) একরকম ‘aesthetic ritual’ (নান্দনিক আচার)-এ পরিণত করে, তখন ফিরে যেতে ইচ্ছে করে রোকেয়ার লেখায়।
১৯৬৯ সালে Carol Hanisch লিখেছিলেন, ‘The personal is political’, যা নাকি বিখ্যাত সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজমের জন্ম দেয়। ঘর বা অন্দরমহল অরাজনৈতিক স্পেস নয়, সেখানে ঘটে চলা লিঙ্গবৈষম্য, অদৃশ্য শ্রম, সম্পত্তির অধিকারহীনতা, সবকিছুই আসলে ভীষণভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং রাজনৈতিক ক্যাম্পেনের (অভিযান) মাধ্যমেই এর সুরাহা সম্ভব। এই স্লোগান, চারটে শব্দে সীমাবদ্ধ হলেও, এর আদর্শগত প্রভাব অপরিসীম। ১৯৬৯ সালের এই উক্তির প্রায় ষাট বছর আগে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখছেন:
‘সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃংখলে কে পারে চালাতে?
রাজ্য শাসনের রীতিনীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।’
এই প্রাচীন প্রবাদের সঙ্গে মেয়েদের দুরবস্থা যুক্ত করার প্রয়াস রোকেয়াই করছেন। মুসলিম মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তি না পাওয়া, স্কুলে না যাওয়া, দাসী হয়ে থাকার কথা বলেছেন; ওপরের পংক্তিতে গৃহ ও রাজনীতির প্রসঙ্গ মিলিয়ে দেওয়ার পরই। ‘মতিচূর’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন:
‘ইংরেজ মহিলা মেরি করেলীর ‘The Murder of Delicia’ উপন্যাসখানি মতিচূর রচনার পূর্বে আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই, অথচ তাহার অংশ বিশেষের ভাবের সহিত মতিচূরের ভাবের ঐক্য দেখা যায়…. কেন এরূপ হয়? বঙ্গদেশ, পাঞ্জাব, ডেকান, মুম্বাই, ইংল্যান্ড সর্বত্র হইতে একই ভাবের উচ্ছ্বাস উত্থিত হয় কেন? ইহার কারণ সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা।’

এই স্পিরিচুয়াল ইউনিটি কিন্তু ধর্মীয় বাঁধন নয়, বরং লিঙ্গচেতনা, যাপন আর অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া। মেরি করেলী ছিলেন ব্রিটেনের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক। যাঁর লেখা ‘Murder of Delicia’ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ একটি মেয়ের জীবন-গাথা। নিজের ঠগ স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে, সামাজিক চাপে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে মেয়েটি। শারীরিক মৃত্যু নয়, তার সত্তা বা পরিচিতির মৃত্যু ঘটে, মন বিষিয়ে যায়। এই বইটি তৎকালীন ইংল্যান্ডে খুব সাড়া ফেলেছিল, ভিক্টোরিয়ান মহিলাদের সাজানো-গোছানো জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সামনে এনেছিল। রোকেয়া পরে এই গল্পের বাংলা অনুবাদ করেন, কিন্তু ‘মতিচূর’-এর প্রবন্ধ লেখার সময় তাঁর এই গল্প পড়া ছিল না। তবুও আকস্মিক এই মিলে যাওয়াকে রোকেয়া মনে করেছেন এক আত্মিক যোগাযোগের মতো। ‘গৃহ’ নামক প্রবন্ধে মেয়েদের বাড়ি বা নিজের স্পেস নিয়ে যাবতীয় দোটানার কথা তিনি লিখছেন, সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কাহিনি মিলে যায় ‘ডেলিসিয়া হত্যা’-র উপন্যাসের সঙ্গে। এই সাদৃশ্য plagiarism নয়, বরঞ্চ রোকেয়া ইঙ্গিত করছেন, যাকে আমরা এখন বলি, ‘ফেমিনিস্ট সিস্টারহুড’। পাঞ্জাবি, মাদ্রাজি বা বাংলার মহিলারা একে অপরের ভাষা বুঝতে না পেরেও পিতৃতন্ত্রের শিকার, তাই তাদের রচনায় মিল থাকবে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। হয়তো ফেমিনিজম বা প্যাট্রিয়ার্কি— এই শব্দগুলো ১৯০৭ সালে জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু এর সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ রোকেয়ার লেখায় পাওয়া যায়।
রোকেয়া পরে এই গল্পের বাংলা অনুবাদ করেন, কিন্তু ‘মতিচূর’-এর প্রবন্ধ লেখার সময় তাঁর এই গল্প পড়া ছিল না। তবুও আকস্মিক এই মিলে যাওয়াকে রোকেয়া মনে করেছেন এক আত্মিক যোগাযোগের মতো। ‘গৃহ’ নামক প্রবন্ধে মেয়েদের বাড়ি বা নিজের স্পেস নিয়ে যাবতীয় দোটানার কথা তিনি লিখছেন, সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কাহিনি মিলে যায় ‘ডেলিসিয়া হত্যা’-র উপন্যাসের সঙ্গে। এই সাদৃশ্য plagiarism নয়, বরঞ্চ রোকেয়া ইঙ্গিত করছেন, যাকে আমরা এখন বলি, ‘ফেমিনিস্ট সিস্টারহুড’।
শুধু পত্রিকায় লেখালেখি নয়, বিবিধ সামাজিক কাজকর্মেও রোকেয়া নিজের মতামতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর স্বামী ছিলেন উদারপন্থী, স্ত্রীয়ের পড়াশোনা বা লেখালেখিতে যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন। ১৯০৯ সালে তিনি মারা যাওয়ার পরে রোকেয়ার হাতে স্বামীর সম্পত্তির কিয়দংশ আসে। সেই অর্থে ভাগলপুরে তৈরি হয় মেয়েদের স্কুল। তাঁর স্বামীর পরিবারের লোকজনের আপত্তি ও তিরস্কারে খুব শিগগিরই সেই স্কুল বন্ধ হয়। একে বিধবা, তার ওপরে মেয়েদের পড়াশোনার ভার— অত্যন্ত দুঃসাহসিক এই কাজের খেসারত দিয়ে রোকেয়া চলে আসেন কলকাতায়। মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। কিন্তু এই স্কুলে কোনও বাঙালি ছাত্রী আসছে না, প্রায় সকলেই হিন্দি বা উর্দূভাষী এবং মাত্র তিনজনকে নিয়ে বাংলা মাধ্যম চালু করা দুষ্কর, এই চিন্তা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল রোকেয়াকে। এখানে তাঁর ছেলেবেলায় পড়াশোনা বা বাংলা সাহিত্যচর্চার কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। রোকেয়ার বাবা ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভুত, আশরাফ মুসলিম গোষ্ঠীর সদস্য। যাদের মধ্যে অনেকেই মনে করতেন, বাংলা ভাষা নিম্নমানের, আরবি-ফারসি শেখায় যে সম্মান রয়েছে, তা বাংলাচর্চায় নেই। নিম্নবর্গীয় আতরাফ (Atraf) মুসলিমদের সঙ্গে বাংলাকে সংযুক্ত করে একপ্রকার বিদ্বেষমূলক রাজনীতি চলত। রোকেয়ার পিতা তাঁর পুত্রদের ইংরেজি বা উর্দু শিক্ষায় কখনও কার্পণ্য করেননি, কিন্তু বাংলা ছিল ব্রাত্য। আর কন্যাদের ক্ষেত্রে সবরকম শিক্ষাই ছিল নিষিদ্ধ।

এখানে রোকেয়ার জীবনে দূতের মতো আসে তাঁর দিদি কারিমুন্নেসা। দিদি লুকিয়ে লুকিয়ে বোনকে বাংলা অক্ষর শেখায়। গোপনে চলতে থাকে দুই বোনের বাংলা ভাষাচর্চা। আরও পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া বড়দাদা তাকে ইংরেজি শেখায়। ইংরেজিতে ‘সুলতানাস ড্রিম’ বা আরও কয়েকটি নিবন্ধ লিখলেও, মূলত তিনি বাংলা ভাষায় তাঁর যাবতীয় রচনা রেখে গেছেন। সাখাওয়াত স্কুলে বাংলা মাধ্যম চালু করার জন্য প্রবল চেষ্টা করেছেন। পারিবারিক উন্নাসিকতা আর বাংলা ভাষাকে ঘিরে ঘৃণা পরিত্যাগ করে সহজ-সরলভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার অভ্যেস তৈরি করার ক্ষেত্রে আরবি-ফারসি নয়, বরং বাংলা ভাষাই উপযোগী— এই বিশ্বাস তাঁর ছিল। প্রায় একা হাতেই স্কুল সামলেছেন; তৎকালীন হিন্দু, ব্রাহ্ম বা অন্যান্য মেয়েদের স্কুলে ছুটে গেছেন প্রশাসনিক কাজ শেখার জন্য। একদিকে স্কুল চালানো, অন্যদিকে মেয়েদের পড়াশোনার পক্ষে লেখালেখি চলেছে সমান তালে। রামমোহন বা বিদ্যাসাগর যেমন নারীপ্রগতি বিষয়ক প্রস্তাবে বারবার শাস্ত্র উদ্ধৃত করেছে (বিধবাবিবাহ প্রচলন বা বহুবিবাহ ও সতী রদে শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, মেয়েদের অধিকারের কথা হিন্দু ট্র্যাডিশনাল টেক্সটেও রয়েছে), তেমন রোকেয়াও কোরান শরিফ বিশ্লেষণ করে নারীশিক্ষার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। এই বিপুল কর্মকাণ্ড খুব সহজ পথে এগোয়নি। ধর্মীয় ধ্বজাধারীদের সমালোচনা বা পারিবারিক ক্ষেত্রেও বাধা এসেছে প্রচুর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, এমন খামখেয়ালি চিন্তা পাশ্চাত্য বা খ্রিস্টানদের নকল করা ছাড়া আর কিছু নয়। কুৎসা রটেছে স্কুলে, সামাজিক কাজ বা ঘরের বাইরে বেরনো না কি কমবয়সি বিধবার নিজের রূপ দেখানোর সুকৌশল। শুধু চরিত্রহনন নয়, একটি চিঠিতে রোকেয়া লিখছেন যে, ‘আমার বড় অসহায় আর একা লাগে, অত্যন্ত কাছের আত্মীয়রাও প্রতিদিনের নূন্যতম খাবারটুকু আমার কাছে পৌঁছে দেয় না।’
এতদসত্ত্বেও জীবনের শেষ সময় অবধি রোকেয়া নিজের চিন্তাভাবনা, কাজ বা লেখালিখির প্রতি অযত্ন করেননি। তাঁর ‘মতিচূর’, ‘পদ্মরাগ’, ‘সুলতানাস ড্রিম’ বা অন্যান্য ছোটগল্পে যেভাবে মহিলাদের কথা উঠে এসেছে, শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, অনুবাদের মাধ্যমে অন্য মহাদেশের মেয়েদের জীবন বোঝার যে চেষ্টা, তাকেই আমরা আজ ‘ইন্টারসেকশানলিটি’, ‘ফেমিনিস্ট সিস্টারহুড’ বা ‘জেন্ডার সলিডারিটি’ নাম দিয়ে থাকি। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে কোনও বাঙালি মেয়ে এমন সংহতি দেখিয়েছেন, এটি যেমন বিস্ময়কর, তেমনই অনুপ্রেরণামূলক।


