মেডিসিনারি : পর্ব ১৩

Representative Image

নারীশরীর, স্ত্রী-রোগ

তখন আমি ‘মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা’র ইন্টার্ন। সদ্য ওয়ার্ডের কানা-ঘুপচিগুলোর সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। প্রায় প্রতিটা রোগী, আমায় আমার কাজ থেকে, টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছে সমাজের বৈষম্য।

আমি অনেকদিন যাবৎ বিশ্বাস করি, ডাক্তারি পেশায় থাকলে— মানবসভ্যতার কলঙ্কগুলো প্রতিনিয়ত সূচের মতো এসে— বিঁধতে থাকে চোখে, কিন্তু সে ছিল এক ভিন্ন রকম নগ্নতার পরিদর্শন! গাইনি পোস্টিং!

স্ত্রী-রোগ বিভাগকে ভাগ করা যায় দুটো ভাগে। এক, গর্ভাবস্থা এবং প্রসব সম্পর্কিত চিকিৎসা এবং দুই, ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ অর্গ্যানগুলোর বিশিষ্ট রোগের চিকিৎসা। ওয়ার্ড, আউটডোর বাদেও আমাদের ডিউটি পড়ত লেবার রুমে— যেখানে প্রসব হত। সে এক অন্যরকম জগৎ!

রূপান্তরকামীদের চিকিৎসা করলেও, তাঁদের পাশে কতটা দাঁড়াতে পেরেছি? অভিজিৎ চন্দর কলমে পড়ুন মেডিসিনারি পর্ব:১২

দেখতাম, ১৭, ১৮, ১৯, ২১… এই হচ্ছে বয়স হবু মায়েদের। ২৪-২৫-২৬ হলেই আমরা বুঝে যেতাম দ্বিতীয় সন্তান বা তৃতীয়। শরীরে হিমোগ্লোবিন নেই, বোতলের পর বোতল রক্ত দিতে হচ্ছে। একটি মহিলাকে দেখেছিলাম, আক্ষরিক অর্থেই সাদা হয়ে আছেন। ফরসা নয়, সাদা। মৃতের চোখ, ওর থেকে বেশি রক্তিম থাকে। এবং, এর প্রায় সবটাই হয় পুত্র চেয়ে, নইলে আনপ্ল্যান্ড প্রেগন্যান্সি।

পূর্বে দু’বার সিজার হওয়া মা তৃতীয় গর্ভ নিয়ে আসেন। ‘আগের দুটো মেয়ে’। সে-রকমই একজনের জরায়ু ফেটে যায়, পেটের ভেতরে, দৌড়ে ওটি-তে নিয়ে গিয়েও প্রাণ বাঁচানো যায় না! বারবার কল করতে থাকি, কিন্তু বাড়ির লোকের ফোন ‘ব্যস্ত’ শোনায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম।’ ‘রক্ত আনতে হবে, ব্লাড ব্যাংক যাও…’ সেই রক্তের ব্যাগ আর এসে পৌঁছয় না। ডাক্তার নিজে ছোটে, কিন্তু রক্ত পাওয়া শরীরটা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ভাগ্যের এমন চরম পরিহাস, যে এই সন্তানও মেয়েই হয়। প্রাণ থাকা অবধি তার ঠাঁই হয় আইসিউতে, তার দুই দিদি রয়ে যায়, মাতৃহীন।

নির্লিপ্ত হতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু চিত্র বদলাত না। কুর্নিশ জানাতে হয় সেই মানুষদের, যাঁরা দিনের পর দিন, এর মাঝে বাস করে, চিকিৎসা করেন। মেয়েদের শরীর, মেয়েদের ব্যথা, মেয়েদের চিকিৎসার এককণাও মেয়েদের হাতে নেই। পুতুলনাচ হয় জানেন? সেইভাবে সুতো দিয়ে ঝোলে মানুষগুলো, তাদের বাঁধা হাত, বাঁধা শরীর, নাচে অঙ্গুলিহেলনে। বাড়ির ঠিকানা জানে না অনেকেই। জন্মতারিখ জানে না। শেষ মাসিক জিজ্ঞেস করলে, স্বামীকে ডাকে।

‘কেন পড়াশোনা করতে দেননি?’ জিজ্ঞেস করলে মা বলে, ‘আসলে পাড়াটা খারাপ তাই বিয়ে দিয়ে দিলাম…’
‘বিয়ে করলেই বাচ্চা নিতে হবে?’ তার আর জবাব আসে না।

আমি শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার গলায় জোর আছে বলে বোধ করি। তবু প্রশ্ন আসে মনে, হামাগুড়ি দিয়ে, আমারাও কি চাইলেই পার্টনারকে বারণ করতে পারি ইচ্ছেমতো?

লাইগেশন চায় কেউ-কেউ। অর্থাৎ, প্রজনন বন্ধ হওয়ার অপারেশন। সরকার টাকাও দেয় করালে। মজার বিষয়, পুরুষের বীর্য শুক্রাণুবিহীন করার অপারেশন করালে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু পুরুষের লিঙ্গ, শুক্রাশয় ছোঁয়ার জিনিস নয়। ওগুলো দামি!

যদিও সেই ‘বিনা ছুরির অপারেশনে’ কমপ্লিকেশন কম, ভর্তি হতে হয়না ইত্যাদি-ইত্যাদি।

দুটো বাচ্চা বাড়িতে নষ্ট, নিজেরাই জানায়। দুটোই মেয়ে। এবং মা বারংবার বলেন, ‘আমাকে সিজার করে, বাচ্চা বন্ধের অপারেশেন করে দিন।’ ভয়ংকর এবং দীর্ঘায়িত একটি লেবার চলার পর মায়ের কোল আলো করে আসে পুত্রসন্তান— মায়ের মুক্তি হয়, জন্মের আগেই, সে দুই দিদির থেকে অনেক বেশি দামি হয়ে যায়।

মজার বিষয়, পুরুষের বীর্য শুক্রাণুবিহীন করার অপারেশন করালে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু পুরুষের লিঙ্গ, শুক্রাশয় ছোঁয়ার জিনিস নয়ওগুলো দামি!

এ-রকমই দেখেছিলাম একজনকে। সেই দুই মেয়ে, এবং তখন তৃতীয় প্রেগন্যান্সি চলছে। বাচ্চা দুটোর বয়স জানেন না মা।

‘আন্দাজে বলো?’
‘এই হবে একটা চার, একটা দুই’

আমি কেঁপে উঠি। ‘মানুষ মনে করো না ওদের নাকি? এতটা ফেলনা ওরা?’
মা ক্যাবলা হাসেন। কোনও প্রতিবাদ নেই।

গর্ভ আছে। যোনি আছে। বাচ্চা বেরবে। যটা লাগে!

উনিশ বছরের মেয়ে, মাস দু’একও হয়নি বিয়ের। ‘বাচ্চা চাই, হচ্ছে না’ বলে এসেছে, আমাদের কাছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সাবফার্টিলিটির সংজ্ঞা অনুযায়ী, অন্তত এক বছরের সহবাস প্রয়োজন, ডায়াগনোসিস করার জন্য। আমাদের অতদূর যেতে হয় না। মেয়ে নিজেই বলে, স্বামী কেবল সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে। ‘মেলামেশা করতে হবে’, বলা হয় তাকে, ‘নইলে কী করে হবে বাচ্চা?’ কে তোমাকে বলেছে বাচ্চা হচ্ছে না? অচিরেই বোঝা যায় কে বলেছে, কে পাঠিয়েছে।

আমার ক্লান্তি বাড়তে থাকে। হাত ব্যথা হয়ে থাকে, একটি মেয়েকে টেনে ধরে রাখার জন্য। উনিশ বছর বয়স। পেটে বাচ্চা নষ্ট হয়েছে। লেবার রুমে ঢুকে, সে বেজায় ভয় পেয়ে যায় এবং দরজা দিয়ে ছুটে পালাতে যায়। তাকে আটকাতে যাই, কিন্তু তার গায়ের জোরের কাছে পরাজিত হই। কোনওভাবে সে ভেতরে আসলে বকি, খুব বকি। কিন্তু কেন? ভয় পাবে না কেন সে? একটিও বাড়ির লোক নেই আশেপাশে, মাটিতে রক্ত পড়ে আছে হয়তো, ব্যথায় কাতরাচ্ছে।

অনেকগুলো অপরিচিত মানুষ। কার বুক কেঁপে উঠবে না? প্রসব-যন্ত্রণায় ছটফট করা মায়েরা জল দিতে বলতেন। খাইয়ে দিতাম। ‘পেইনলেস লেবার’ করা সম্ভব। অনেক বেসরকারি জায়গায় হয়। কিন্তু সরকারের টাকা বা সদিচ্ছা কোনওটাই নেই। জন্ম দিতে গেলে তো কষ্ট পেতেই হবে! কে কবে ব্যথা ছাড়া জন্ম দিয়েছে? এমনটাই বলতে দেখতাম সবাইকে! এবং ক্রমশ আমিও তাই শিখে গিয়েছিলাম বলতে।

মেয়েদের রোগ।
মেয়েদের শরীর।
মেয়েদের চিকিৎসা।
বাঁধা হাত, বাঁধা শরীরগুলো নাচে অঙ্গুলিহেলনে।
রাষ্ট্রের, পিতৃতন্ত্রের।