শুধু কবিতার জন্য: পর্ব ৪৩

কয়েকটি কবিতা

সাক্ষী

সে কোন একটা বইমেলাতে হাতখরচা বাঁচিয়ে কেনা
রাহুল পুরকায়স্থ আর চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের বই
খুচরো বিনিময়ের সময় হাত লেগে হাত আদানপ্রদান
কে যেন বেশ বলেওছিল, ‘আমি তেমন ভাল পাঠক নই’।

ধুলোর হাওয়ায় চুলের গন্ধ মিলিয়ে যেত এক নিমেষেই
থাকত বলতে এক মুহূর্ত চশমা-আড়াল ফিরতিপথের চোখ
কোন ছোট পত্রিকার স্টলে আবার যেন দেখাও হলো
আমিও কেমন মনখারাপে মেলার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া লোক…

কলেজ যায় কি? না চাকরি? না দূরের কোনও গ্রহের মানুষ?
হঠাৎ এসে আলোর মধ্যে আগুন হয়ে পুড়তে থাকা মন
মৃত্যু নিছক বেড়ালছানা, তার কথা পড়াবেই মনে।
জীবন তখন ততক্ষণই, একটা ট্রামের ফিরতে যতক্ষণ।

আজ সে দেখার অনেক বছর একা একাই পালন করি।
নিজের নামে নিজেই চিঠি পাঠাই। লিখি, ‘আসবেন অবশ্যই’।
এসে দেখি, আর কেউ নেই। ধুলোমলিন সাক্ষী দু’জন।
রাহুল পুরকায়স্থ আর চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের বই।

বয়ান

একটা কোনও চিঠির বয়ান তোমার কাছে পাঠাতে চাই
যখন মিছিল পেরিয়ে যাচ্ছে কী গনগনে ধর্মতলার মোড় –
এবং নিতে চাইছে বুঝে দাবি দাওয়ার স্লোগানগুলো…
অথচ কেউ রিফু’র জন্য মন দিয়েছে, আলগা সুতোর ফোঁড়

সেলাই ক’রে দিচ্ছে অতীত, যা কিছু তার খুব পুরনো
ঢেউয়ের মতোই সুতোর দাগে নৌকা ভাসান যাচ্ছে স্মৃতির জল…
পালের গায়ে হাতের লেখা ঝাপটা লেগে ধুয়েই গেল
শহর তখন চাক্কা জ্যামে। অসন্তোষে জ্বলছে মফসসল।

কিন্তু তোমার ছাদের ঘরে মন সারানোর সেলাই মেশিন
সমাজ যখন বদলাতে চায়, সে চায় কেবল জুড়তে সারারাত
যা কিছু যার হারিয়ে গেছে, যে আর যা ফেরত পাবে না
সেই নকশায় উঠছে ফুটে অবিস্মরনীয় তোমার হাত।

একটা কোনও বিরল খেতাব তোমার কাছে পাঠাতে চাই
পুলিস যখন ভাঙছে মিছিল, জলকামানে তাও ভাঙেনি গান…
তোমার কাছেই সবটা আছে, আমার কাছে তোমার চিঠি
সইহীন সেই হাতের লেখা, ‘ফেরত নেবেন, আপনি যখন চান…’

রং

পাশ দিয়ে যাও যেমনি ভেসে, ইচ্ছে করে জিগেস করি
‘ও রং, তোমার বাড়ি কোথায়? সেই যেখানে অন্তরীণের চর?’
জানি তো উত্তর পাবো না। এমন ক’রে চলেও যাওয়া
ধীরগতিতে কেউ বোঝেনি, একাত্তরে মৃণাল সেনের পর।

প্রেম ছিল তার কুটির শিল্প, মাটির দাওয়া খড়ের চালা
ভুবন সোমের সুহাসিনী যেমন হাসির অবহেলায় চুর…
চোখ থেকে জল তুলতে গিয়ে বালতি গেল হারিয়ে সেই
অথচ তার কান্না হলো সারা গ্রামে সহজে মঞ্জুর।

এখন রাতের মাঠে মাঠে রাখালরা অবসরপ্রাপ্ত।
কে আর তোমায় ময়ূর পালক উপহারের দুঃসাহসে যায়।
তবু যখন মিথ্যে ডাকো, চাও না সাড়া, সেটা জেনেই
তখন আমার স্বপ্নে দেখা নিশান ফোটে গাছের কিনারায়।

পাশ দিয়ে যাও এমনি হেসে। ইচ্ছে করে জিগেস করি
‘ও ঘুম, তোমার পাড়া কোথায়? সেই যেখানে গুঞ্জরনের ঘর?’
জানি তো উত্তর পাবো না। এমন ভাবে নীরব থাকা
আড়াল থেকে কেউ দ্যাখেনি, একাত্তরে মৃণাল সেনের পর।

সমীক্ষা

যে গেছে, তার সুগন্ধকে একুশ দিনের চাকরি দেবে।
ফুটবে তাতে বিরহফুল। বলছে এমন, নতুন সমীক্ষায়।
শেষ যে-ট্রামে চড়েছিল, সে হবে বরখাস্ত সোজা।
আনবে এমন দারুণ চমক দুঃখগুলি, মলিন ব্যবসায়।

ঘুরবে আবার হাতে হাতে কাগজ দিয়ে তৈরি চাকা
সে জানাবে, বাতাস এখন কোনদিকে তার স্মৃতির অনুচর
জানলা থেকে আনবে খুলে অশান্তি এবং ইশতেহার
অবিশ্বাসী পথিকদেরও অল্প দামে পাইয়ে দেবে ঘর।

বিস্মরণের বারান্দাতে আনকোরা সব কাপড় মেলা
তাদের অভিবাদন জানায় দু’তিনতলা শুকনোদিনের মেঘ…
বাচ্চারা এই দোলনা থেকে উড়তে পেল চিলেকোঠায়
তাদের কাছে তোমার চেয়ে প্রিয় ছিল হাওয়ার গতিবেগ।

যে গেছে, তার আনন্দকে বন্দি করে রাখবে ঘরে।
ধরবে তাতে পুরনো রং। বলছে এমন, নতুন সমীক্ষায়।
শেষ যে-হাতে রেখেছে হাত, সে-হাত কেটে কলম হবে।
আনবে এমন দারুণ চমক দুঃখগুলি, মলিন ব্যবসায়।