কিস্সা, ছাপাখানা কা
পাহাড়ি পথের মতো জীবনেরও কোন বাঁকে যে অতর্কিতে সামনে চলে আসবে রাক্ষুসে ট্রাক, মুখোমুখি সংঘর্ষ না কি একচুলের জন্য বেঁচে যাওয়া, আগে থেকে কি জানা যায়! ২০১৫ সালে প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণে হিউস্টনে পা রেখেই আর-একবার টের পেলাম এই মহা সত্য। প্লেনে বেজায় মজা করতে-করতে গেছি। বিরাট দল গিয়েছিল কলকাতা থেকে। সেই দলে প্রাক্তন সাংসদ থেকে প্রাক্তন রাজ্যপাল, বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক থেকে দুদে ক্রিমিনাল লইয়ার, নামি গাইয়ে থেকে মুর্শিদাবাদের ঢাকি, টলিউডের তারকা, কে নেই! আর আছি আমি ও আমার দুই সহকর্মী। চলেছি নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স মানে যাকে ভালবেসে বঙ্গ সম্মেলন নামে ডাকেন প্রবাসী বাঙালিরা, সেখানে আমাদের কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে। বাকি দু’জন স্টল সামলাবেন আর আমার কাজ সম্মেলনের তিনদিন হিউস্টন থেকে ‘আজকাল’ সংবাদপত্র বার করা। সে এক জটিল পদ্ধতি। পরপর ছ’বছর এভাবে ‘আজকাল’ বেরিয়েছে আমেরিকার পূর্ব থেকে পশ্চিমে, বঙ্গ সম্মেলনের ভেন্যু বিভিন্ন শহর থেকে। খবর সংগ্রহ, ছবি তোলা, লেখার পর সবটা পাঠানো হত কলকাতায় ‘আজকাল’ দপ্তরে। সেখান থেকে লে আউট হয়ে আট পাতার কাগজের পিডিএফ ফেরত আসত মেলে। ছাপা হত স্থানীয় প্রেসে। পরদিন সকালে হাতে গরম ‘আজকাল’ বিলি হত বঙ্গ সম্মেলনের সাত-আট হাজার অতিথির মধ্যে। কলকাতার সঙ্গে মার্কিন মুলুকের এক-এক শহরের সাড়ে নয়, সাড়ে দশ, সাড়ে বারো ঘন্টা সময়েয় ব্যবধান। সেটা মাথায় রেখে কাজ করা মানে সূক্ষ্ম টাইম ম্যানেজমেন্ট। আর আমেরিকার চূড়ান্ত পেশাদারি ছাপাখানা যে সময়ের ব্যাপারে কী ভয়ঙ্কর কড়া, মিনিট গুনে চলে, সেটা বারবার টের পেয়েছি হাড়ে-হাড়ে। মেশিন বন্ধ মানে বন্ধই, নির্ধারিত সময়ে পিডিএফ না দিতে পারলে সেরাতের মত নো ছাপা। এই যুদ্ধে বাংলা পডকাস্ট-এর পিয়া আর দেবকে না পাশে পেলে জেতা সম্ভব হত না। এবং ছ’বছরে একবারও বিদেশের মাটিতে ‘আজকাল’ বেরোনোয় কোনও খামতি হয়নি, হাজার বিচিত্র সমস্যা পথ আটকে দাঁড়ানো সত্ত্বেও। ক্লিভল্যান্ড প্রবাসী এই দম্পতির পেশা অন্য হলেও নেশা মিডিয়া। বঙ্গ সম্মেলনের প্রচারের দায়িত্বে দীর্ঘকাল আছে ওরা।
দুবাই শহর কি দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বরেকর্ড-এর ওপরেই? পড়ুন: ডেটলাইন পর্ব ৩২
এমিরেটস-এর এয়ারবাসকে যে বিয়েবাড়ি বানিয়ে ফেলা যায়, সেটা করে দেখিয়েছিল কলকাত্তাইয়ারা। কেউ সিটে বসেই গলা ছেড়ে গান ধরেছে তো কেউ কলেজের করিডর ভেবে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। এয়ারহোস্টেসরা জেরবার হয়ে গেছিল এই ধেড়ে খোকাখুকিদের সামলাতে। দীর্ঘ বিমানযাত্রার একঘেয়েমি কাটাতে ওয়াই ফাই কানেক্ট করে কলকাতায় বন্ধুবান্ধবদের ফোন লাগিয়ে ইয়ার্কি মারাও হল। কে যেন বলেছিল, হাইড্রেটেড থাকার জন্য বারবার সরবত খেতে হবে। ব্যস, একশোবার করে জুস চেয়ে মেঘবালিকাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হল। শেষমেষ হৈ হৈ করতে করতেই নামা গেল হিউস্টনে। বিশাল বাস এসেছে আমাদের নিতে। ঝকঝকে রাস্তাঘাট পেরিয়ে পাঁচতারা হোটেলের লবি পর্যন্ত, একদম ফুরফুরে মেজাজ। এত লোকের চেক ইন করতে অনেক সময় লাগবে। তাই ভাবলাম, পরশু থেকে কাগজ বেরোবে, পিয়া আর দেবের সঙ্গে মিটিংটা সেরে নিই লবিতেই। হিউস্টনের এক গুজরাটি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে রেখেছে ওরা, ওঁর প্রেসেই ছাপা হবে ‘আজকাল’। ভিড়ের মধ্যে থেকে পিয়াকে খুঁজে বার করে বসলাম সোফায়। মুখ কালো করে বলল পিয়া, ‘ব্যাড নিউজ। লাস্ট মোমেন্টে, এই একটু আগে কান্তিভাই জানাল ছাপতে পারবে না। ওর প্রেসে কয়েকজন কর্মী ছুটি নিয়েছে।’ আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল। বলে কী! এই বিদেশ বিভুঁইয়ে ছাপাখানা কোথা থেকে পাব? আমার হতভম্ব মুখ দেখে পিয়া আশ্বাস দিল, ‘চিন্তা করিস না। ফ্রেশ হয়ে নে। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।’ আমি তো সোফা ছেড়ে নড়বইনা যতক্ষণ না অন্য প্রেস খুঁজে পাওয়া যাবে। যে কাজের জন্য এতদূর এলাম, সেটাই যদি না করতে পারি, মানসম্মান থাকে? এই সমস্যার কথা কাউকে বলেও লাভ নেই। সমাধান করতে পারবে না কেউ, শুধুশুধু টেনশন ছড়াবে। অতএব হোটেলের ঘরে যাওয়া মাথায় উঠল, লবিতে বসে বসেই একটার পর একটা ফোন করে চলল পিয়া। আর আমি একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। এখানে বলে রাখি, এটাই কিন্তু পিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি দেখা, আগের কয়েকমাস ফোনে কথা হয়েছে ক্লিভল্যান্ড থেকে কলকাতা।

হঠাৎ পিয়ার চোখমুখে আলো জ্বলে উঠল। সন্ধান মিলেছে এক ভিয়েতনামী প্রেসের। কাল সকালে আমি, পিয়া আর দেব যাব তাদের অফিসে। এখানে মুখের কথায় কিছু হয় না। কনট্র্যাক্ট সই করতে হবে। আপাতত ঘরে গিয়ে স্নান সেরে ছুটলাম মিট অ্যান্ড গ্রিট ডিনারে। আমন্ত্রিত সেলিব্রিটিরা সবাই প্রাক-ইভেন্ট এই নৈশভোজে থাকেন। এবং আমেরিকা বলেই বোধহয়, প্রবাসী তো বটেই, স্বদেশীদেরও খুব পাত্তা দেন। আর দেশ থেকে উজিয়ে যাওয়া সাংবাদিক পেলে তো কথাই নেই। নিজেকেই কেউকেটা মনে হচ্ছিল তারকাদের এত মনোযোগ পেয়ে। শো বিজনেসে থাকলে কালকের কাগজে ছবিটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কি স্বস্তি মেলে! আধো ঘুমে কাটল রাত। উদ্বেগ তো পুরোপুরি যাবে না যতক্ষণ না ফাইনাল হচ্ছে ছাপাখানা। সকালে ব্রেকফাস্টে নেমেই মন ভাল হয়ে গেল। হোটেলের সামনে একফালি এলেবেলে জমিতে চনমনে রোদে স্নান করছে দুধসাদা কাশবন, মন্দমধুর হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে কাশের গুচ্ছ। আহা, দূরদেশে এমন করে কে মন কেমনের দিস্তা পাঠায়! জুলাইয়ের গোড়ায় শরতের অকালবোধন। এবার প্রেস অভিযান। উবের ডেকে (নো ক্যাশ, ওনলি ক্রেডিট কার্ডের গেরোয় সেই প্রথম ভ্যাবাচাকা) গাছের ছায়াঢাকা ছিমছাম মাঝারি মাপের প্রেসে পৌঁছে মালকিনের উষ্ণ অভ্যর্থনা। বোধহয় এশীয় বলে একটু বেশি খাতির পেলাম জাতভাই হিসেবে। মাঝবয়সি মহিলা দেখলাম বেশ কনফিডেন্ট। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললেন, ‘আমি এর আগে ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজের ট্যাবলয়েড ছেপেছি।’ স্যাম্পল নিয়ে এলেন একটা উর্দু কাগজ। এবার আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘আমি জানি। ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজ ডানদিক থেকে পড়ে।’ আমি আঁতকে উঠে ‘না না’ বলার মধ্যেই দেব নেমেছে অবস্থা সামাল দিতে। ‘মাসীমা, বেঙ্গলি ইজ নট লাইক উর্দু। এনিওয়েজ, ইউ উইল গেট পিডিএফ। সো নো প্রবলেম।’ উনি কৌতূহলী হলেন, ‘হাউ ডিড ইউ কল মি?’ দেব ব্যাখ্যা করল, বাংলায় মাসীমা মানে আন্ট, খুবই সম্মানীয় সম্বোধন। তারপর থেকে তিনদিন আমরা ওঁকে মাসীমা বলেই ডাকতাম। সব ব্যবস্থা হওয়ার পর ভিয়েতনামী মাসীমা জানালেন, শনি, রবি ডেলিভারি সিস্টেম বন্ধ থাকার কারণে আমাদেরই কাগজ নিতে আসতে হবে। রাতে ছাপা হবে বটে, কিন্তু দিনের বেলা কেউ থাকবে না প্রেসে। আমি আবার কঁকিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেব দেখলাম নির্বিকার। ব্যাপারটা কী? বন্ধ প্রেস থেকে আমরা কাগজ নেব কীভাবে? দেখলাম, এদেশে অন্যরকম ব্যবস্থা আছে। গোডাউনের শাটার বন্ধ বটে, কিন্তু তার কোড চলে এল আমাদের ফোনে। শাটারের পাশে লাগানো কি প্যাডে সেই বোতাম টিপতেই শাটার উঠে গেল। ভেতরে পরপর ট্রলিতে সাজানো ছাপা কাগজ, বই, ম্যাগাজিন। প্রত্যেকটাতে সেই ক্লায়েন্টের নামের ট্যাগ লাগানো। যে যার নিজের মাল নিয়ে গাড়িতে চাপিয়ে চলে যাও। প্রথমদিন শুক্রবার শুধু প্রেস থেকে লোক এসে ‘আজকাল’ পৌঁছে দিয়েছিল ভেন্যুতে, বাকি দুদিন নিজেরাই কাগজ নিয়েছিলাম গোডাউন খুলে। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, গুদামের লাগোয়া ছাপাখানায় অত্যাধুনিক মেশিন বা আরও সব দামী যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম রয়েছে। কেউ বদমায়েশী করেও তো ক্ষতি করতে পারে! জিগ্যেস করতে অবাক হয়েছিলেন বঙ্গ সম্মেলনের কর্মকর্তা দেবাশিসদা। বললেন, ‘এদেশে এরকম কেউ করে না। অ্যালার্ম বাজতে পারে, আর সিসি ক্যামেরায় ধরা তো পড়বেই। খুব কঠিন শাস্তি।’ অথচ এই প্রেসের দরজার ঠিক বাইরে প্রথমদিন ভর সন্ধেবেলা আধো-অন্ধকারে পায়চারি করতে-করতে ফোনে কথা বলছিলাম দেখে এক কর্মী হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ডাকলেন, ‘ম্যাম, চড় মেরে ফোন নিয়ে পালিয়ে যাবে। ভেতরে আসুন।’ এটিএম-এ টাকা তুলতে গিয়েও এক কথা শুনেছি, ‘টাকা, কার্ড সব ব্যাগে ঢুকিয়ে ভাল করে চারদিক দেখে বেরোবে। ছিনতাই হতে পারে।’ কী বিচিত্র আইনশৃঙ্খলা!
হিউস্টনেই ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। দেবাশিসদা চালাচ্ছিলেন। বছর চল্লিশের বিশাল চেহারার এক কৃষ্ণাঙ্গ এগিয়ে এসে টোকা দিলেন কাচে। বুকে ঝোলানো প্ল্যাকার্ড, ‘প্লিজ হেল্প। স্টার্ভিং উইথ টু লিটল গার্লস।’ দেবাশিসদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি দিব্যি সুস্থ সবল। এদেশে তো কাজের অভাব নেই। ভিক্ষে করছেন কেন?’ দেবাশিসদা বললেন, ‘নিশ্চয়ই ওর কোনও ক্রাইম রেকর্ড আছে। এদেশে একবার যদি কেউ অপরাধ করে ধরা পড়ে, যে-কোনও কেউ তার সম্পর্কে সার্চ দিলেই সেই রেকর্ড ভেসে উঠবে স্ক্রিনে। আর এখানে যত ছোট কোম্পানিই হোক, খবর না নিয়ে কারোকে কাজে নেয় না।’ আবারও চিন্তায় পড়ে গেলাম, এত কড়া আইন, তবে ফাঁকা রাস্তায় বা এটিএম-এর বাইরে কেন এত সতর্ক সবাই ছিনতাইবাজদের নিয়ে?

এক অন্যরকম ট্যাক্সিচালকের কথা দিয়ে শেষ করব আজকের পর্ব। হিউস্টনে ভারতীয় শিখ, পাকিস্তানি, মেক্সিকান আর আফ্রিকান ট্যাক্সিড্রাইভার প্রচুর। প্রেস থেকে খবর এসেছে কিছু সমস্যা হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তড়িঘড়ি উবের ধরে ছুটলাম। কথায়-কথায় জানলাম, চালক পাকিস্তানের লোক। উনি অপেক্ষা করবেন প্রেসের বাইরে কারণ এলাকাটা নির্জন। আমরা ওঁর সঙ্গেই আবার কনভেনশন সেন্টারে ফিরব। প্রেসে পৌঁছে দেখা গেল সমস্যা জটিল। বারবার কলকাতার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে ঠিক করা গেল শেষ পর্যন্ত। এদিকে বিকেল গড়িয়ে গেছে। আমরা তো ভুলেই গেছি উবের দাঁড় করিয়ে রেখেছি। উনি কিন্তু একবারও প্রেসের ভেতরে আসেননি আমাদের খোঁজে। বেরিয়ে দেখলাম, বসে আছেন গাড়ির ভেতর। সরি বলতেই অল্প হাসলেন, ‘না-না ঠিক আছে। তবে নামাজটা মিস হয়ে গেল।’ সত্যি তো, রোজার মাস। বললাম, ‘ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছি। আপনি উপোস ভাঙন। আমরা অন্য উবের ডেকে নেব।’ কিছুতেই রাজি হলেন না। আমাদের নিয়ে ফেরার পথ ধরলেন। গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, ‘আরও একঘণ্টা না-হয় না খেয়েই থাকব। প্রতিবেশীর জন্য এটুকু করব না?’ চোখে জল চলে এল। ধেড়ে খোকারা কবে বুঝবে এই সহজ কথাটা?