ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫৬


    বিমল মিত্র (April 1, 2022)
     

    পর্ব ৫৫

    পুজোর পরে আমার আর বোম্বে যাওয়া হয়নি, গুরুও হয়তো সময় করে উঠতে পারেনি। আমি অন্তত তাই ভেবেছিলাম কিন্তু পরে জেনেছিলাম তার পারিবারিক অশান্তি।

    ১৯৬৪-এর ১০ অক্টোবরের সকাল অন্য আর পাঁচটা দিনের মতোই এসেছিল। তখনও কেউ জানে না কি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। খবর পেলাম একটার নিউজ-এ। গুরু দত্ত আজ ভোর সাড়ে পাচটায় মারা গেছে। ডাক্তাররা সন্দেহ করছে এটা সুইসাইড কেস। অত্যধিক পরিমাণে স্লিপিং পিল খাওয়ার জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছে। খবরটা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। মাথার মধ্যে কেমন সব ফাঁকা-ফাঁকা ভাব। শেষ পর্যন্ত গুরু সেই সুইসাইইড-ই করে ফেললে। এর আগে তিনবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে সে, শেষবার তো ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর শুটিং প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, মাত্র কয়েকটা সীন বাকি আছে। সেই সময় হঠাৎ একদিন রাতে এত বেশি স্লিপিং পিল খেয়ে নিয়েছিল যে হাত-পা একেবারে বরফ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে-সঙ্গে নানবতী হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হয়েছিল। তিনদিন কোমাতে ছিল। আর আশ্চর্য, সুস্থ হয়ে যেদিন সে চোখ মেলেছিল প্রথমেই খোঁজ করেছিল গীতার। এত ভালোবাসা আবার এত ঝগড়া। কি বৈপরীত্য এদের দাম্পত্য জীবনে। আজ সত্যি-সত্যি চলে গেল। আমার একজন সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী চলে গেল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমাকে বড় আপন করে নিয়েছিল।

    আমার বারবার বোম্বে যাওয়ার মূল আকর্ষণ ছিল মানুষ গুরু দত্ত। গুরু আমাকে ‘সাহেব বিবি গোলামে’র চিত্রনাট্য লেখার জন্য ডাকতো এবং পরে আমাকে সিনেমা গল্প আলোচনার জন্যেও ডেকেছে, তবে সে কারণ আমার কাছে গৌণ, আমি যেতাম মানুষ গুরু দত্তকে দেখতে, তার সান্নিধ্য পেতে।

    একটা মানুষ যে জীবনে সবকিছু পাওয়া সত্ত্বেও এত নিঃস্ব-রিক্ত হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। রামু সারিয়া একবার বলেছিল ‘বিমলদা, গুরু দত্তকে শুধু ওপর থেকে দেখলে ওর চরিত্রটা আপনি বুঝতে পারবেন না, ওর সঙ্গে গভীরভাবে মিশলে তবেই বুহতে পারবেন কতখানি যন্ত্রণায় জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত, মন ওর।’ সত্যিই গুরু না দেখলে জীবনের এদিকটা আমার কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যেত।

    আমার কাছে গুরু দত্তের চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি জীবনে যতদিন বাঁচব গুরু দত্তকে একদিনের জন্যেও ভুলতে পারব না। আমরা দুজনে দুটো আলাদা আলাদা জগতের লোক হলেও এক জায়গায় আমাদে প্রচন্ড মিল। সে হল বই পড়া। আমার যেমন দেশ-বিদেশের নানা ধরণের বই পড়ার নেশা। গুরুরও দেখেছিলাম বই পড়ার নেশা। নানান জায়গা থেকে বই কিনিয়ে আনতো আর রাতের পর রাত জেগে সে-সব বই পড়ত। এমনকি যেদিন গুরু মারা যায় সেদিনও তার বিছানার পাশে একটা হিন্দি উপন্যাসের অর্ধসমাপ্ত পাতা খোলা ছিল।



    ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি গুরু পালি হিলের বাড়িটা ভেঙে ফেলে কাছেই পালিনাকায় একটা অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট ভাড়া করে ফ্যামিলি নিয়ে থাকতে আরম্ভ করে। আমি সে খবর পেয়েছিলাম। গীতার কথা ভেবেই হয়তো নতুন বাড়িতে উঠে এসেছিল। গীতা বলেছিল, ‘এই বাড়িটায় একটা ভূত আছে যে আমাদের জীবনটা অশান্তিতে ভরিয়ে রেখেছে।’ ভেবেছিলাম যাক্ ভালোই হল, নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করে এবার বোধহয় সব ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু সুখ তো গুরুর কপালে নেই। আবার ঝগড়া আরম্ভ হল। আর এবারে পরিণতি এমন হল যে গুরু সে বাড়ি ছেড়ে পেডার রোডে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে সম্পূর্ণ একলা থাকতে আরম্ভ করল। সঙ্গে শুধু চাকর রতন আর কুক ইব্রাহিম।

    আমার আব্রার আলভির সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিলাম— তা পেডার রোডের ফ্ল্যাটে গিয়ে কি গুরু শান্তি পেয়েছিল কিছু?

    –তাই কখনও হয় কি বিমলদা? আকলা থেকে কেউ কি আরামে থাকতে পারে? তখন ‘বাহারে ফির ভী আয়েঙ্গী’র শুটিং হত। স্টুডিও থেকে বাড়ি ফিরে সারারাত ড্রিঙ্ক করত আর তার সাথে স্মোকিং। আমরা সবাই জানতাম কি নিদারুণ মানসিক অবসাদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে, কিন্তু আমাদের কারুরই কিছু করারই ছিল না। তবে আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে সে আবার সুইসাইডের চেষ্টা করবে।

    আব্রার আলভি অবশ্য সবসময়েই চেষ্টা করেছে গুরুকে সঙ্গ দেবার। তাকে কাজে ব্যস্ত রাখার। ১৯৬৪-এর বেশির ভাগ সময়টাই সে ম্যাড্রাসে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিল। বোম্বে ফিরে এসেছিল সেপ্টেম্বরে। গুরু একলা পেডার রোডে রয়েছে শুনে সোজা গুরুর ফ্ল্যাটে গিয়ে দু-তিন সপ্তাহ ধরে গুরুর সঙ্গেই থাকতে আরম্ভ করেছিল। নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরেও রোজ সন্ধেবেলা গুরুর ফ্ল্যাটে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচলা করা তার রোজকার নিয়ম ছিল।

    মারা যাবার আগের দিন সন্ধেবেলা মানসিকভাবে প্রচন্ড বিচলিত ছিল গুরু। আব্রার যথারীতি ‘বাহারে ফির ভী আয়েঙ্গী’র স্ক্রিপ্ট লিখছিল, কিন্তু নজর ছিল গুরুর দিকে, গুরু ভয়ানক অন্যমনস্ক ছিল। সেদিন রাত একটা পর্যন্ত ছিল আব্রার গুরুর বাড়িতে। সেই সন্ধে থেকে রাত একটা পর্যন্ত যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ গুরুর হাতে বোতল ধরা ছিল। গুরুকে ড্রিঙ্ক করতে বারণ করা তো ভগবানেরও অসাধ্য কাজ। আব্রার বললে— ‘গুরু যখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে, তখন আমি বাড়ি ফিরে এসেছি। কিন্তু আমি যদি জানতুম গুরু কি ভীষণ কান্ড করতে যাচ্ছে সেদিন রাত্রে, তাহলে আমি কিছুতেই আসতাম না, কিছুতেই না।’

    গুরুর মনটা ছিল কচ্ছপের মতো। একবার ভেতরে ঢুকে গেলে কেউ আর তার শট চেষ্টাতেও নাগাল পেত না। তার মনের মধ্যে কি যে অশান্তি, কিসের যে যন্ত্রণা, সে না বললে কে বুঝবে। এজন্যই তাকে কেউ কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি।

    ‘সাহেব বিবি গোলাম’ যখন ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল, তখন গুরু আর গীতার সম্পর্ক চরমতম পর্যায়ে পৌঁছয়। আবার যে ওয়াহিদা রেহমানকে নিয়ে গুরুর নামে যে সমস্ত সমালোচনা পত্র-পত্রিকায় বেরোয়, সেই ওয়াহিদা রেহমানও ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর শুটিং শেষ হবার পর চিরকালের মতো গুরুকে ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনোদিন সে গুরুর জীবনে আসেনি। তবু কি অজ্ঞাত কারণে গুরুর জীবনে শান্তি আসেনি, রাতে ঘুম আসেনি।

    আমার কাছে গুরু দত্তের চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি জীবনে যতদিন বাঁচব গুরু দত্তকে একদিনের জন্যেও ভুলতে পারব না। আমরা দুজনে দুটো আলাদা আলাদা জগতের লোক হলেও এক জায়গায় আমাদে প্রচন্ড মিল। সে হল বই পড়া। আমার যেমন দেশ-বিদেশের নানা ধরণের বই পড়ার নেশা। গুরুরও দেখেছিলাম বই পড়ার নেশা। নানান জায়গা থেকে বই কিনিয়ে আনতো আর রাতের পর রাত জেগে সে-সব বই পড়ত। এমনকি যেদিন গুরু মারা যায় সেদিনও তার বিছানার পাশে একটা হিন্দি উপন্যাসের অর্ধসমাপ্ত পাতা খোলা ছিল। এই বই পড়ার নেশাই আমাদের দুজনকে এক অচ্ছেদ্য প্রীতির বন্ধনে বেঁধেছিল।

    সিনেমার ব্যাপারে গুরু ছিল পারফেক্শানিস্ট। এডিটিং-এর খুঁটিনাটি ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রমী। সহজাত প্রতিভা ছিল ওর। অভিনয় করার সময়ে হৃদয়ের সবটুকু মমতা ঢেলে দিত। আর এই সর্বস্ব দেওয়ার পরেও যখন আশানুরূপ সাফল্য আসত না ছবির ক্ষেত্রে, তখন বেদনায় দীর্ণ হত সে।

    অথচ আজ ভারতীয় সিনেমায় প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি গুরু দত্ত। গুরু কি কখনও ভাবতে পেরেছিল তার তৈরি সিনেমাগুলো শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বিদেশে, ইউরোপে “গুরু দত্ত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল” নামে শ্রদ্ধার সঙ্গে বারবার দেখানো হবে। আর দর্শকও তার অভিনয় প্রতিভার নিদর্শন দেখতে ভিড় করে আসবে। দেশে-বিদেশে চারদিকে আজ তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তার প্রতিভার স্বীকৃতি হয়েছে। যোগ্য সমাদর পেয়েছে।

    মনে হয় বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল গুরু। বড় অসময়ে। একটু ধৈর্য রাখতে পারল না। মাত্র উনচল্লিশ বছরে চলে যাওয়া— বেঁচে থাকলে আরও কত মহান কীর্তি করে যেতে পারত সে। খুব আফশোশ হয়। তারাভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবন-দেবতার উদ্দেশে বলি— ‘হে ঈশ্বর, গুরুকে একটু শান্তি দিও তুমি, ওর চোখে একটু ঘুম দিও, ও বহুদিন ‘বিনিদ্র’, বড় জ্বালায় জ্বলছে সে। কালের বুকের এত সফল কীর্তির স্বাক্ষর রেখেও জীবনযুদ্ধে সে হেরে গেছে, মরণে ওকে শান্তি দিও’—


    ওঁ দ্বৌ শান্তিরতুরিক্ষং শান্তিঃ
    পৃথিবী শান্তিরূপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তিঃ
    বন্সপতয়ঃ শান্তির্বিশ্বেদেবায়ঃ শান্তিব্রক্ষ্মঃ শান্তিঃ
    সর্বং শান্তি শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি
    ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook