বিভাজন-পূর্ব কালের অখণ্ড পঞ্জাব এবং সিন্ধ প্রদেশের অন্তর দিয়ে বহু নদী বয়ে গেছে দক্ষিণে সাগরের দিকে। সিন্ধু ছাড়াও রয়েছে ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস, শতদ্রু। এইসব নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় একাদশ শতকের পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘ ছ’শো বছরে যে-সব সুফি ভাবধারার কবি ও সাধক কাজ করেছেন, তাঁদেরই মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের রচনার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলাই আসলে লক্ষ্য।
ভক্তিবাদের এক তরঙ্গ অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের অন্য নানা প্রান্তে যেমন প্রান্তজনের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল পাখনা, কতক তেমনই, ভারতের এই অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষের কাছে গিয়েছিল সুফিসন্তদের সুর। আজকের ভারতের ঘৃণালাঞ্ছিত রাজনীতির বয়ানে এসব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবু মনে রাখা যাক, তৌহিদে আস্থাশীল সাধকের হাতে রাধা-কৃষ্ণ, সোহ্নি-মেহের, হির-রান্ঝা বড় সমাদরে এসেছিলেন। ইতিহাস খুঁড়ে সর্বদা মসজিদ বা মন্দির নয়, ‘রাশি রাশি দুঃখের খনি ভেদ করে’ প্রায়শই শোনা যায় ‘শত জল ঝর্ণার ধ্বনি।’ তার কিছু রেশ এখনও ঘুরে বেড়ায় হিন্দি-অবধি গানের সুরে। বাংলা ভাষাতেও তার কিছু ভাগ যদি পাওয়া যায়— এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে এই কলাম— ‘সিন্ধুপারের সুফি’।
শাহ মাধো লাল হুসেইন-কে নিয়ে পড়ুন ‘সিন্ধুপারের সুফি’ পর্ব ৩। বাবা ফরিদকে নিয়ে পড়ুন ‘সিন্ধুপারের সুফি’ পর্ব ১ ও ২…
সুলতান বাহু
‘মন লাগো ইয়ার ফকিরি মেঁ’— বিখ্যাত এই গান অনেকেই শুনেছেন। আবিদা পারভিন-এর কণ্ঠে ঝরে পড়ে প্রায় অলৌকিক আকুতি— ফকিরিতে অভ্যস্ত হও মন, শিখে নাও তার ধরন-চলন। আমরা আগেও লিখেছি, বিশেষ করে সুফি ভাবনায়, ফকির আমাদের পরিচিত ভিখারি নন। যিনি সব যাচনা অতিক্রম করেছেন, চাওয়া যাঁর ফুরিয়েছে, তিনিই ফকির। অপরিসীম ঐশ্বর্যময় দারিদ্র্য তাঁর অর্জন। আজকের কিস্তিতে আমরা যে সুফি কবির কথা বলব, সেই সুলতান বাহু-র (১৬৩০-১৬৯১) রচনায় বারবার এসেছে, এমন ফকিরি পাওয়ার কথা। কাকে ফকির বলা হবে, সেটি ধরা আছে খানিক তাঁর এই লেখাটিতে—
চোখ দু’টি রক্তবর্ণ লাল,
মুখ যেন ফ্যাকাশে, পাণ্ডুর…
সকল হৃদয় খুঁড়ে
উঠে আসে দীর্ঘশ্বাসগুলি…
সুরভিত সেই মুখ গেল কতদূর?
কস্তুরী এবং প্রেম
কখনওই থাকে না গোপন,
অনিবার্য তারা উভয়েই।
মরমি সাধক শুধু তারাই তো বাহু,
বেঘর, যাদের কোনও ঠাঁই নেই পৃথিবীতে আর,
তারাই ফকির…
অখণ্ড পাঞ্জাবের ঝঙ জেলার মানুষ সতেরো শতকের কবি সুলতান বাহুর কিছু পরিচয় হোক। এমনিতেই তাঁর লেখার খুব প্রচার-প্রসার নেই পাঞ্জাবের বাইরে। বাংলাতেও বোধহয় তেমন পরিচিতি নেই তাঁর।

২
সুলতান বাহুর মৃত্যুর প্রায় ছ’শো বছর পরে তাঁরই এক উত্তরসূরি সুলতান হামিদ লিখেছিলেন, পারিবারিক ইতিহাস-সংবলিত বই ‘মানাকাব্-ই-সুল্তানি’। ঠিক জীবনী বলতে যা বোঝায়, এ-বই তেমন নয়। বরং বেশ কিছু শ্রুতকাহিনির ফসল। তবে সুলতান বাহুর জীবনের সামান্য যা কথা আজ আমরা জানি, তার বেশিরভাগই এসেছে এই বই থেকে। এই বই-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী নিজের নাম নিয়ে ভারি খুশি ছিলেন সুলতান বাহু। তাঁর আসল নাম ছিল সুলতান মুহম্মদ। মা, রাস্তি বেগম, তাঁর নাম রেখেছিলেন বাহু। মায়ের রাখা ওই নাম জানান দেয়, তিনি আল্লাহ-র থেকে একবিন্দু (নোক্তা) মাত্র দূরে আছেন। ‘বাহু’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘তাঁর (ঈশ্বরের) সঙ্গে’। আরবি ভাষায় ‘বাহু’ শব্দের বানান হচ্ছে বে-আলিফ্-হে-ওয়াও। আরবি বর্ণমালায় ব (বে) হরফের নীচে একটিমাত্র বিন্দু থাকে। সেখানে একটির বদলে দু’টি বিন্দু পড়লে তৈরি হয় নতুন বর্ণ ‘ইয়া’। বাংলায় যেমন ব-বর্ণের তলায় একটি বিন্দু দিলেই নতুন এক বর্ণের জন্ম হয়, কতকটা তেমন। ফলে, একটি বিন্দু বা নোক্তা বাড়ালেই ‘বাহু’ শব্দটি হয়ে যাবে ‘ইয়াহু’— যা কিনা স্বয়ং আল্লাহ্কেই বোঝায়। নিজের নামের সঙ্গে আল্লাহ্-র দূরত্ব মাত্র এক বিন্দুর— এই ধারণা সুলতান বাহুকে তৃপ্তি দিয়েছিল। নিজের মা-ই ছিলেন তাঁর প্রথম মুর্শিদ। তাঁর বাল্যকালের লেখাপড়া মায়ের কাছেই। বাবা মারা গিয়েছিলেন খুব অল্প বয়সে। বাবা বায়াজিদ ছিলেন শাহজাহানের সেনাবাহিনীর কর্মী। কাজের বিনিময়ে জায়গির পেয়েছিলেন সম্রাটের কাছ থেকে। সেখানেই, মুলতান আর ঝঙ অঞ্চলের মাঝখানে শোরকোট নামক এক জায়গায় জন্ম হয়েছিল সুলতান বাহু-র। পরিবার ও স্বজনদের বিশ্বাস ছিল, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলির উত্তরসূরি তাঁরা।
বাহু-র বাল্যকাল কীভাবে কেটেছে, তার খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কথা-কিংবদন্তি অনুযায়ী ছোট বয়সে কৃষিকাজের দিকে কিছুটা ঝুঁকলেও সে-কাজে মন লাগেনি তাঁর। দিন কাটত বনে-বাদাড়ে-কবরখানায় ঘুরে। শুধু শৈশব-কৈশোর নয়, রাভি আর চেনাব— এই দুই নদীর অববাহিকায় কেটেছে কবির প্রায় গোটা জীবৎকাল। রাভি নদীর তীরেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর প্রথম মুর্শিদের। ছোটবেলার সেই মুর্শিদ, হাবিবুল্লাহ্ খান অল্প দিনেই টের পান— তাঁর ছাত্র একেবারে অন্যরকম, অচিরেই গুরুর বিদ্যা ছাপিয়ে যাবেন শিষ্য। ফলে দ্রুত তিনি বাহুকে পাঠিয়ে দেন নতুন শিক্ষকের কাছে, দিল্লিতে। নতুন শিক্ষক সয়ীদ আব্দুর রহমান। সুলতান বাহু দীর্ঘ সময় তাঁর কাছে থেকেছেন, সুফি পরম্পরায় ক্রমে গভীর হয়েছে তাঁর ছায়া। এই সময় দিল্লির সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব। তাওয়ারিখ-ই-সুলতান বাহু আমাদের জানাচ্ছে, এই সময় আওরঙ্গজেব বাহুর প্রতি কিছু ‘কৃপা’ প্রদর্শনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বাহু ছিলেন নিরুত্তাপ। সম্রাটের থেকে দূরে এবং কিছু নিস্পৃহভাবেই তিনি কাটিয়েছেন সময়। অনেকে মনে করেন কাদিরি পন্থার অনুসারী দারা শিকোহ্-র প্রতি সম্রাটের আচরণ স্মরণ করেই বাহু আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণ্য বিষয়ে উদাসীন থাকতে চেয়েছেন।

দিল্লিতে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে সুলতান বাহু পুনরায় তাঁর স্বস্থানে ফিরে যান— শোরকোটেই কেটেছে তাঁর বাকি জীবন। সন-তারিখের হদিশ জানা নেই— কবে তিনি দিল্লি এসেছিলেন, কবেই বা ফেরত গেলেন দেশে। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে অন্য সুফি-সন্তদের মতো বাইরে বেরিয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তিনি ঠিক সংসার-ত্যাগী ছিলেন না। একাধিক বিবাহ হয়েছিল, সন্তানাদিও ছিল কয়েকজন। পূর্বসূরি মাধো লাল হুসেইন কিংবা বাবা ফরিদের মতো তাঁর জীবন তত বর্ণময় নয়— অজস্র উত্তরসূরিও নেই তাঁর। প্রথম জীবনে কিছু অলৌকিক কাণ্ড-কারখানা করেছিলেন বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেসবে আর তেমন আগ্রহ ছিল না। যেন কাউকে কিছুই দেখানোর নেই, কিছু প্রমাণ করার নেই, কেরামত নেই, ঝলমলে অবাধ্যতাও নেই, প্রেমে অতি-নিমজ্জিত, আচ্ছন্ন এক মানুষ ছিলেন বাহু। অজপা জপের প্রতিই তাঁর টান— গোটা শরীর যেন হয়ে উঠতে চায় ‘তসবিহ্’ বা জপমালা। গোটা শরীর হয়ে উঠতে চায় সখার দর্শন-পিয়াসী চোখ। বছর ষাট বয়সে পৌঁছে মৃত্যু আসে। বাড়ির কাছে, নদীর তীরেই তাঁর সমাধি। মৃত্যুর অনেক পরে, একবার চেনাব নদী যখন খেয়ে ফেলছিল মাটি, কুল যাচ্ছিল তলিয়ে, তখন তাঁর সেই সমাধি খুঁড়ে বের করা হয় দেহ— পরে নতুন করে আবার সমাধিক্ষেত্র গড়ে দেন ভক্তরা। সেখানেই এখন রয়েছে তাঁর মাজার। উর্স-এর দিনে কাওয়ালি হয়, সুলতান বাহুর পাঞ্জাবি কালাম লোকায়ত সুরে সুরে ভেসে বেড়ায় তাঁরই সমাধির ওপর।
৩
সুলতান বাহু ফারসি ভাষায় অনেকগুলি বই লিখেছেন। তাত্ত্বিক আলোচনার বই সেসব— গভীর প্রজ্ঞার ছাপ তাঁর রচনায় স্পষ্ট। বইয়ের মাঝে প্রায়ই আরবি উদ্ধৃতিও থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব না করলেও আরবি ও ফারসি ভালই জানা ছিল তাঁর। সুফি ভাবাদর্শ বা তাসাব্বুফ্ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য লক্ষ করে তাঁর সমকালেই তাঁকে বলা হত সুলতান-উল্ আরেফিন— মারফতি জ্ঞানের সম্রাট। কিন্তু সে-সকল গদ্য বই-এর দিকে আমাদের তত নজর নেই এখন। আমরা পড়ব তাঁর কবিতা— প্রচলিত পাঞ্জাবি ঢঙে লেখা নিরলংকার, নিরহংকার ক্ষুদ্র রচনাগুলি। পাঞ্জাবের ঝঙ্ অঞ্চলে প্রচলিত বুলিতেই লেখা হয়েছিল সেসব কবিতা। ক্ষুদ্র চার পঙ্ক্তির এই লেখাগুলিকে বলা হয় ‘আবায়াত্’। অনেকটা ফারসি ভাষার রুবাই-এর মতো দেখালেও রুবাই-এর ছন্দ এবং কাঠামোর সঙ্গে এদের বিস্তর ফারাক। রুবাই-এর চতুর্থ পঙ্ক্তির চমক, সামগ্রিক চাকচিক্য এসব কবিতায় নেই। একেবারে সাধারণ লোকের বোধগম্য, সরল উপমা এবং লোক-প্রচলিত শব্দাবলি ব্যবহার করা হয় এই সব রচনায়। এমনকী, অনেক ক্ষেত্রে ছন্দের গরমিলও চোখে পড়ে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ছন্দের ত্রুটি শুধরে দিতে হয়েছে প্রথম সম্পাদককে।
কোনও পাণ্ডুলিপি থেকে নয়, সুলতান বাহু-র পাঞ্জাবি কবিতা ছাপা হয়েছিল লোকমুখ থেকে সংগৃহীত ভাণ্ডার থেকে। মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পর, ১৮৯১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার এই লিথোগ্রাফ সংস্করণ— মোট ১১৬টি আবায়াত্ ছিল তাতে। অজস্র ভুল, ছন্দের গোলমাল, শব্দের ত্রুটি ছিল সেই অবহেলার সংস্করণে। আরও প্রায় সিকি শতক পরে, ১৯১৫ সালে নতুন কিছু লেখা জোগাড় করে মালিক ফজ্ল দিন ১৮৩টি কবিতা-সংবলিত একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। সেটিই প্রথম মান্য সংস্করণ। তবে সেও কোনও আধুনিক পদ্ধতি মেনে তৈরি হয়নি। বাহু-র নাম ব্যবহার করে অন্য লোকের কবিতাও তার মধ্যে ঢুকে থাকতে পারে। বিশ শতকের আটের দশকে প্রকাশিত হয় নাজির আহমেদ সম্পাদিত ‘কালাম-এ বাহু’। ১৯৯৬ সালে শরিফ সাবির-এর সম্পাদনায় লাহোর থেকে প্রকাশিত হয় মুকাম্মল ‘আবায়াত্-এ বাহু’। এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণাধর্মী সংস্করণ। অনুবাদকরা অনেকেই এটির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। এর আগে-পরে আরবি এবং গুরুমুখি লিপিতে তাঁর পাঞ্জাবি কবিতার বহু সংস্করণ হয়েছে। সেই তুলনায় তাঁর ফারসি কবিতাবলি কিংবা ফারসি গদ্যগ্রন্থগুলির জনপ্রিয়তা কম। সুলতান বাহু-র আবায়াত্-এর ইংরেজি তরজমা আছে বেশ কয়েকটি। ১৯৬৭ সালে মকবুল ইলাহি বেশ ঝাড়াই-বাছাই করে একটি তরজমা প্রকাশ করেন ‘দ্য আবায়াত্ অফ সুলতান বাহু’ নামে। এছাড়াও আরও যে তিন-চারটি ইংরেজি তরজমা আছে, তাদের মধ্যে দু’টি খুব উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে সয়ীদ হামাদানির বই ‘সেইজ বাহু’— ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত, আর অন্যটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত জামাল ইলিয়াসের তরজমা— ‘ডেথ বিফোর ডায়িং : দ্য সুফি পোয়েমস অফ সুলতান বাহু’। এই দু’টি বই-ই দ্বিভাষিক। শাহমুখি হরফে মূল পাঞ্জাবি কবিতাগুলিও একই মলাটে পাওয়া যায়। আমার বাংলা তরজমা না দেখে আগ্রহী পাঠক সেগুলি দেখলেই হয়তো বেশি ভাল লাগবে।

৪
‘আল্লাহ্ ব্যতিরেকে অন্য উপাস্য নেই এবং মুহম্মদ তাঁর প্রেরিত রসুল’ এই বাক্য সাধারণভাবে কলমা হিসেবে পরিচিত। ইসলাম ধর্মে এইটে কতকটা চৌকাঠের মতো— এই বাক্য উচ্চারণ এবং বিশ্বাস করেই পা রাখতে হয় ইসলামের চৌহদ্দিতে। এইটেই নিয়ম, এইটেই রেওয়াজ। কিন্তু বাহু নিজের কবিতায় প্রশ্ন করেন, কলমা কার জন্য? তাঁর মনে হয়, যার হৃদয়ে প্রেম আছে সে-ই কেবল কলমার অধিকারী। নিজের কবিতায় ইসলামের প্রাথমিক কর্তব্যের সঙ্গে এইভাবে প্রেমকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সুলতান বাহু। এই শর্ত সমস্ত ধর্মগুরু হয়তো মানবেন না, কিন্তু সুফি পন্থায় ঈশ্বরের উপাসনা কিংবা ইবাদত প্রেমের উন্মেষ ব্যতিরেকে প্রায় অসম্ভব। অনেক আগে দক্ষিণ ইরাকের বস্রা শহরের এক সুফিসাধক রাবেয়া প্রায় এমনই এক কথা বলেছিলেন। শয়তান বা ইব্লিশের জন্য তাঁর হৃদয়ে ঘৃণা রাখার জায়গাই নেই, কেননা আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসায় তাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে আছে— ঘৃণা রাখব কোথায়? ছিটেফোঁটা তর্ক তখনও উঠেছে, রাবেয়া বস্রি আদৌ কতটা নিষ্ঠাবান ধার্মিক, কতটা নিয়ম-নীতি মেনে তিনি চলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করেছে ধর্মবিজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞরা। সেই রাবেয়ার একটি পদে পাব এমন আশ্চর্য প্রেমের কথা, সে-ই নবম শতকে— বেহেশ্ত পাওয়ার লোভে, কিংবা দোজখের ভয়ে যদি আমি তোমার কাছে প্রণত হই আল্লাহ্, তাহলে আমাকে ধিক্কার। স্বর্গ-নরক তোয়াক্কা করি না, আমি এমনিই চাই তোমাকে। ভয়-দায়-দায়িত্ব-লোভ অতিক্রম করে প্রেম এসে জুড়ে বসে সমস্ত আসর। রাবেয়ার একটি ছোট্ট কবিতার তরজমা উদ্ধৃত করি এইখানে—
প্রেমই নিখুঁত নীরবতা,
সর্বোচ্চ মাতনও প্রেম, সবচেয়ে গভীর।
প্রেম শব্দটিও
পরিপূর্ণ, প্রায় তাঁরই মতো।
খুব কাছাকাছি সময়ে বস্রা শহরের এই কবির থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে অণ্ডাল নামক আর এক নারী, তামিল ভাষায় লিখছিলেন এমনই তীব্র প্রেমের কথা— কোনওদিন দেখা হল না তাঁদের। তেমনই, সুলতান বাহু-র (১৬৩০–১৬৯১) সঙ্গে দেখা হল না অল্প কিছু দূরের, অল্প কিছু আগের প্রেমাচ্ছন্ন কবি ও সাধক রাজস্থানের মীরা বাঈ-এর, অল্প কিছু আগের কবি ও প্রেমিক কাশ্মীরের মানুষ লাল দেদ্ বা লাল্লার।
বাহু-র পাঞ্জাবি আবায়াত্-এ প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তীব্র প্রেমের প্রসঙ্গ— ঈশ্বর আর মুর্শিদের প্রতি প্রেম। তাঁদের কখনও তিনি সখা হিসেবে দেখেন, কখনও প্রেমাস্পদ হিসেবে। নমাজ কিংবা রোজা কিংবা হজ— এইসবের চেয়ে সুফি ঘরানার অন্য অনেক কবির মতোই তিনি শ্রেয় মনে করেন অন্তরের প্রেম ও নিবেদনকে। তাঁর একটি কবিতায় পাই, নিকট-দূর বাজে কথা, তিনি সদাই রয়েছেন সঙ্গে। তাই কুফ্র কিংবা ইসলাম— যা-ই বলি না কেন, বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে তাঁর কাছে যাওয়ার দরকারই নেই। বাহু বলবেন, ঈশ্বরই আমার পরিচ্ছদ। তাঁরই পোশাক গায়ে দিয়ে আমি ঘরে ফিরি, তাঁর নাম অর্জন করাই আমার পেশা। ইসলাম কিংবা মূর্তি উপাসকদের মতো বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে ওঠার কথা বুঝি না, জীবন-মৃত্যু বলেও কিছু নেই। তিনি রয়েছেন আমার অতি নিকটে— এইমাত্র বুঝি; এত কাছে, এত কাছে, যে মনে হয় ঘাড়ের শিরার চেয়েও বুঝি নিকটবর্তী তাঁর থাকা। শুধু একবার নিজের ভেতরে তাকাও, দেখো, তিনি ভিতরেই আছেন, আমরাও তাঁরই অভ্যন্তরে— সমস্ত মিথ্যা, সব অসত্য এখন মুছে গেছে। দূর হয়ে গেছে দূরত্ব।
সুলতান বাহু-র কবিতার এই সর্বনাম, এই ‘তিনি’ প্রায় প্রেমিকের মতো— আপন সত্তারই অংশ যেন। আবার পরমুহূর্তেই অন্য কোনও কবিতায় মনে হবে, না, তিনি একেবারে একাকার হয়ে নেই। বরং আছেন কিছুটা দূরেই— যেখান থেকে অপরাধ এবং পাপ ক্ষমা করা যায়। ঈষৎ তির্যকভাবে একটি কবিতার শেষ প্রান্তে বাহু লেখেন, আমার কিছু পাপ যদি না-ই থাকে তাহলে হে প্রভু, তুমি ক্ষমা করবে কী? যেন মনে হবে, আল্লাহ বা ঈশ্বরের একটি বহু-চর্চিত গুণকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যই কিছু মানবিক পাপ প্রয়োজন। আমাদের মনে পড়বে, সুলতান বাহুর প্রায় সমসাময়িক কবি ও সাধক সরমদ (১৫৯০-১৬৬১) একটি ক্ষুদ্র কবিতায় লিখেছিলেন,
খোদার করুণা নিয়ে ভাবিত থাকি না আমি মোটে…
এমনকী, আমার যাবৎ অপকাজ—
আর তার সব পরিণাম—
তা নিয়েও আদতে আমার কোনও ভয়-ডর নেই;
সবই তিনি জানেন আসলে— সব কিছু…
আমার সমূহ পাপ, আর তাঁর অফুরন্ত ক্ষমা—
আমি কেন সেসব বিষয়ে বৃথা ভেবে ভেবে মরি?
বাহুর কোনও কোনও রচনায় এসেছে যোগসাধনার ভঙ্গি। এসেছে শ্বাস-নিয়ন্ত্রণের কথা। পতঞ্জল যোগসূত্রের সঙ্গে কি তাঁর পরিচয় ছিল? না কি অন্য সুফি সাধকদের কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন প্রাণায়ামের কথা? একটি পদে দেখব তিনি লিখছেন, কীভাবে ঈশ্বরের নাম জপ করতে করতে নিমগ্ন মানুষ একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়, ক্রমশ তার ওষ্ঠ-অধরেও আর কোনও কম্পন লক্ষ করা যায় না। অথচ তার সমস্ত শরীরই হয়ে ওঠে জিক্র বা জপের মন্দির। বহুবার তাঁর লেখায় এসেছে মৃত্যুর কথা— মরণ যেন এক পরম কাঙ্ক্ষিত স্থান— যেখানে শুরু হয় যথার্থ জীবন। আমাদের বাংলায় বাউল সাধক ‘জ্যান্তে মরা’ বলতে সম্ভবত এমনই বোঝেন। সুফি তত্ত্বের পণ্ডিত এসবের ব্যখ্যায় হয়তো জানাবেন, ক্লেদাক্ত এবং নিচুতলার ‘আমি’— যাকে ‘নফ্স’ বলা হয়, তাকে মেরে ফেলার কথাই এখানে হচ্ছে— তার শুদ্ধিকরণের শর্ত হিসেবেই জানানো হচ্ছে, বেঁচে থাকতে মরেছে যে-জন, সে-ই আসলে দুই দুনিয়া জয় করতে সক্ষম।
সুলতান বাহু-র কবিতার এই সর্বনাম, এই ‘তিনি’ প্রায় প্রেমিকের মতো— আপন সত্তারই অংশ যেন। আবার পরমুহূর্তেই অন্য কোনও কবিতায় মনে হবে, না, তিনি একেবারে একাকার হয়ে নেই। বরং আছেন কিছুটা দূরেই— যেখান থেকে অপরাধ এবং পাপ ক্ষমা করা যায়। ঈষৎ তির্যকভাবে একটি কবিতার শেষ প্রান্তে বাহু লেখেন, আমার কিছু পাপ যদি না-ই থাকে তাহলে হে প্রভু, তুমি ক্ষমা করবে কী? যেন মনে হবে, আল্লাহ বা ঈশ্বরের একটি বহু-চর্চিত গুণকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যই কিছু মানবিক পাপ প্রয়োজন।
৪
অন্যান্য সুফি কবিদের মতো সুলতান বাহু-র লেখাতেও প্রচলিত উপাসনা-পদ্ধতির সমালোচনা আছে। নমাজ-রোজা-হজ— কেবল এসব দিয়ে যে হবে না চরম প্রাপ্তি, যদি প্রেম না থাকে হৃদয়ে— সেই কথা বহুবার বাহু-র কবিতায় এসেছে। এসব কথা ছড়িয়ে রয়েছে পাঞ্জাবের প্রান্তরে-প্রান্তরে। প্রেমের প্রতি এই ভরসা সাধারণ মানুষ এখনও জারি রেখেছেন।
এমন একটি রচনার তরজমা এই রকম হতে পারে—
হিন্দু কিংবা মুসলিম ওরা নয় তো,
মসজিদ-মন্দিরে প্রার্থনা করে না—
বন্দনা মিশে থাকে প্রতি নিঃশ্বাসেই—
পায় ওরা ঠিক আল্লার নুর ফলত।
ওরা যথার্থ জ্ঞানী, আহা ওরা মত্ত,
কেননা ওরাই টের পায় তাঁর সুরভি।
দিতে পারি এই জীবন ওদের জন্য—
প্রেমলীলা খেলা যারা আজ বেছে নিয়েছে…
অনেক দিন আগে সুলতান বাহু-র এইরকম কয়েকটি লেখা তরজমা করেছিলাম ছয় মাত্রার দুলকি ছন্দে। এবং সেই ছন্দের টান অক্ষুণ্ণ রাখতেই সম্ভবত মূল ভাবটুকু বজায় রাখার দিকেই ছিল নজর। এমনকী, পঙ্ক্তির ক্রমও সর্বদা ঠিক থাকেনি, দু-চারটে শব্দ এসেছিল বাড়তি— খানিকটা ভাবসূত্র হিসেবে। বলা যায় সেই তরজমায় বেশ অনেকটা ব্যাখ্যা মিশে ছিল। আজকের তরজমায় সেই লোভ ছেড়েছি। পঙ্ক্তির ক্রমভঙ্গ করিনি, দুলকি ছন্দের আকর্ষণও উপেক্ষা করেছি। অতি সাদামাঠা মিশ্রবৃত্ত ছন্দের আধারে প্রায় শব্দ ধরে ধরে এগিয়েছি এইবার। উজ্জ্বলতা তাতে কিছু নিভেছে হয়তো, কিন্তু আমার বিশ্বাস, মূল রচনার আর একটু কাছে পৌঁছনো গেছে। একই রচনার দুই সময়ে করা দু’টি তরজমা পরপর দিচ্ছি এইখানে, পাঠক আশা করি বুঝবেন ভিন্ন সময় ও মেজাজে তরজমা কীভাবে আকাশ-পাতাল হয়…
ক)
প্রণম্য কোনও পণ্ডিত আমি নই হে,
বিচারক নই, আইনের বড়ো ওস্তাদ,
বেহেশ্ত চায় না আমার অন্তরাত্মা
নরকের কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই হৃদয়ে।
নিয়মমাফিক উপবাসও আমি করি না,
সাধু নই আমি, নমাজে নেই আসক্তি
শুধু তাঁর সাথে একাকারত্ম চেয়েছি
তিনি ছাড়া এই জগৎ মিথ্যা খেলনা…
খ)
তেমন পণ্ডিত নই আমি,
সাধু নই, লিপিকর, বিচারকও নই,
হৃদয়ে কখনও
নরকের বাসনা ছিল না;
স্বর্গের পরম লোভ— তাও নেই মনে…
এ জীবনে তিরিশ রোজার
কোনও ইতিহাস নেই,
পবিত্র নমাজী নই আমি,
ঈশ্বরকে যদি তুমি হৃদয়ে না পাও, বাহু, তবে
এ দুনিয়া নিছক এক খেলার জিনিস…
আমাদের আজকের লেখায় দ্বিতীয় ধরনের তরজমাই কেবল থাকবে। সুলতান বাহু-র কবিতা যথাসম্ভব অনুচ্চকিত হওয়াই ভাল। ধ্বনির জমক একটু যদি কম থাকে, তাহলেই চোখে পড়বে ছোট ছোট উপমার ঢেউ, কিংবা ডুব-সাঁতারগুলি। চোখে পড়বে বিরহ-বিছিয়ে রাখা কবির শরীর।
১
নিজেকে প্রেমিক ভাব যদি,
ভেতরে তোমার যদি প্রেমের বাসনা জেগে থাকে,
নিজের হৃদয়খানি করে তোলো পাহাড়ের মতো …
সহস্র শত্রুতা আর মিছে অপবাদ
মনে করো ফুটে আছে উদ্যানের মতো…
কত লোক মনসুরের মতো
গোপন কথাটি চির গোপনীয় রেখে
ঝুলে গেছে ফাঁসির দড়িতে—
নিজের প্রণত শির তবুও তুলো না তুমি, বাহু
হাজার মানুষ যদি বারবার বলে যায় কাফের তোমাকে…
২
প্রেমিকের অপার রহস্য থেকে আহা
ছুটি নেই প্রেমিকের।
ঘুম তার হয়েছে হারাম—
পরমের স্বরূপ যে পেয়েছে ঈষৎ,
নেই তার বিশ্রামের অবসর কোনও,
দিন রাত বিরহকাতর
অবিরাম হেঁটে চলা ভবিতব্য তার…
আহা কী সৌভাগ্য তার, বাহু,
শিখেছে যথার্থ যারা আলিফ অক্ষর…
৩
প্রেমের সুরায় সদা মত্ত হয়ে থাকে প্রেমিকেরা,
জীবিত থেকেও যারা জীবন বিলিয়ে দেয় প্রেমিকের কাছে—
দুই জগতেই তারা চির-আয়ুষ্মান…
হৃদয়ে যাদের জ্বলে প্রদীপের শিখা,
বাইরে মোমের আলো কেন তারা জ্বালাবে তবুও?
জ্ঞান আর তর্ক কোনওদিন
যাবে না সেখানে…
ধ্বংস করে দাও বাহু ওসব এই বার…
৪
গলানো মোমের মতো প্রেমিক-হৃদয়—
গড়িয়ে এগিয়ে যায় মাশুকের দিকে।
বাজপাখি শিকারের দিকে তার যেভাবে তাকায়,
তেমন লোভীর মতো চেয়ে থাকে সেও…
আহা সেই অসহায় বাজ—
ডানা তার বাঁধা পড়ে গেছে যেন আজ,
প্রেম নেই যার মনে হায়
দুই দুনিয়াই, বাহু, জেনো সে হারাবে…
৫
আমাকে সে নরম আর অসহায় দেখে
এল ধীর পায়ে, ঘর নিল লুঠ করে।
অশান্ত শিশুর মতো
আমাকে সে দেয় না ঘুমতে,
নিজেও জেগেই থাকে দেখি।
শীতের মরশুমে
তরমুজ খাবে বলে কাঁদে—
কোথায় এখন আমি পাব তরমুজ?
কিন্তু সব যুক্তি-তর্ক নিমেষে হারায়
যখন দু-হাতে প্রেম তালি দিয়ে ওঠে…
৬
জঙ্গলে থেকেছি আমি, জলাভূমিতেও,
কিন্তু কিছুতেই আমি পাইনি যা চাই,
মক্কা গেছি তীর্থ মনে করে,
কিন্তু তবু হৃদয়ের দ্রুত পদক্ষেপ
কমেনি কখনও।
যতক্ষণ-না ক্লান্ত হই,
তিরিশ দিনের রোজা, পাঁচ-ওয়াক্ত পড়েছি নামাজ—
আমার সকল চাওয়া
পাওয়া-য় উঠেছে ভরে, বাহু
পরমের ক্ষণিক চাহনি যেই পেয়েছি জীবনে…
৭
বাতিল করেছি এই দুনিয়াকে
যখন পেয়েছি খুঁজে আসল বিরাগ,
দুই হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরেছি যখন
মিলে গেছে দারিদ্র্যের যথার্থ সড়ক,
একটি চুমুকে
নিঃশেষ করেছি আমি অদ্বৈত সাগর,
পিপাসায় তবুও কাতর হয়ে আছি,
অশ্রু নয়,
চোখ থেকে এই পথে ঝরেছে শোণিতকণা, বাহু
যদিও সকলে ভাবে এসব তামাশা, ঠাট্টা, নিছক কৌতুক…
৮
দৃঢ় থাকো, থিতু হও আঘাতে আঘাতে,
তবেই তোমাকে বলা হবে
তরবারি।
চিরুণির মতো ভরে থাকো খাঁজে খাঁজে,
তবেই তো প্রিয়ার চুলের মাঝে
ঠাঁই পাবে তুমি।
মেহেদি গাছের মতো মাটির গভীরে
চারাও নিজেকে,
তবেই তো প্রিয়ার হাতের রঙ হয়ে উঠবে তুমি।
পেঁজা হয় যেভাবে কাপাস,
ওইভাবে তুমিও আহত হও নিজে,
শৌর্যের উষ্ণীষ তুমি হতে চাও যদি,
অন্তরে প্রেমিক হও বাহু,
তবেই তো খুঁজে পাবে তুমি
প্রেমের অমৃত।
৯
যে মুহূর্তে দেখিয়েছ তুমি
একের ঝলক,
তখনই তো নিজের ভেতর
সব চিহ্ন লুপ্ত হয়ে গেল…
তখন নৈকট্য নেই,
মিলন বলেও নেই কিছু,
নেই কোনও স্তর, লক্ষ্যবিন্দু,
দেহ নেই, আত্মা নেই কোনও
এমনকী, প্রেম— তারও অবশেষ ছিল না কোথাও,
ঠাঁই নেই, অস্তির বোধও বুঝি নেই…
সেই ক্ষণে, বাহু, আমি মুখোমুখি হই
অলৌকিক পরম একের;
তার সব গোপন রহস্য আমি টের পাই, বুঝি…
১০
আচ্ছা বেশ, যদি আমি গোপন করেই রাখি
প্রেমের প্রতিমা?
হৃদয় কখনও চলে যাবে না সুদূর,
কত কত দূর পাহাড়ের ওই পারে
আমার হাবিব থাকে, সখা বলি তাকে,
তবুও সে থাকে তো পাশেই, তাকে দেখি…
যদি কেউ পেয়ে যায় কণামাত্র প্রেম,
সুরা ব্যতিরেকে
সেও হয়ে ওঠে খুব দারুণ মাতাল…
তারাই তো মরমি ফকির, শোনো বাহু—
যাদের কবর
সর্বদা জীবিত রয়ে যায়…
১১
বুনো ঝোপ, অস্থির বালির স্তর সরে সরে যায়…
অইখানে জীবন নিজেকে খুঁজে পায়।
আজ হোক, নতুবা আগামী কাল ঠিক
ধ্বসে যাবে ভাঙাচোরা নদীর কিনার;
যেদিকে নদীর জল ফুলে উঠছে সেইদিকে লোক
ঘুময় না, থাকে না নিঝুম…
নদীকূলে, বালিয়াড়ি জুড়ে
বানানো যাবে না বাহু, কোনও জলাধার…
১২
মুর্শিদ আমার মনে বীজ বুনেছেন—
চাঁপা ফুল ফোটে সেই গাছে…
হ্যাঁ এবং না দিয়ে শরীরে—
শিরায় শিরায় তিনি দিয়েছেন জল,
ফুল ফুটে ওঠে, দেহে ছড়ায় সৌরভ,
দীর্ঘজীবী হোন তিনি, বাহু
আমার শরীরে যিনি ফুলগাছ দিয়েছেন পুঁতে…
১৩
হারিয়েছে নিজের হৃদয়,
তার সাথে নিজেকেও হারায় প্রেমিক,
হারিয়ে সে পুনরায় পায়নি কখনো আর ফিরে,
মিশে গেছে বন্ধুদের সাথে।
যখন প্রেমের সাথে দেখা হল তার—
বিস্মরণে গেল তর্ক, বুদ্ধি, জ্ঞান সব…
নিজের যৌবনে যারা হয়ে গেছে প্রেমের অধীন—
তাদের দিকেই, বাহু, হেঁটে যায় জীবন আমার…
১৪
কাঁদো তুমি,
রক্ত-অশ্রু ঝরে যাক সারা রাত্রি দিন…
চোখ ঠেরে
এমত নির্দেশ দেয় দুঃখ তোমাকে…
দেহের ভেতর
পরম একের অনুভূতি
নিয়ে এল তির,
শান্তি নেই, বিশ্রামের অবকাশ নেই তার পর…
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও নিজের শরীর,
এই সেই গোপন কথাটি—
প্রেমে অধিকার পেতে যা তোমার প্রয়োজন হয়…
সন্দেহ রেখো না বাহু, মনে,
নিবেদন কালে
ডাক আসবে যখনই তোমার
মরে যেতে দিও আমিটিকে—
১৫
জীবনের গোপন রহস্য
ডুবে থাকে প্রেমে।
মরণের আগে যদি মরে যেতে পারো,
মরণ তাহলে আর হবে না তোমার।
তাঁর নাম জেনেছি যখনই
মরণ আর প্রিয়-সম্মিলন
হয়ে গেছে একাকার সব…
কাছাকাছি নয়,
সত্য থেকে এসেছি সকলে
মিলিত হয়েছি ফের
সত্যের ভেতর…
সদাই জিক্র-এ থাকি,
জপি সর্বদাই তাঁর নাম—
বাহু বলে, ক্রমশ আমাকে
দিনরাত শ্রান্তিহীন গিলে ফেলে সেই উচ্চারণ—
১৬
সবচেয়ে উঁচু সিংহাসনে
নেই তিনি, মালিক আমার,
এমনকী, কাবাতেও নেই।
পুঁথির জ্ঞানেও তিনি নেই,
কোনও এক বেদির ওপরে কিংবা
জায়-নমাজেও তাঁকে পাবে না কখনও।
বহু পথ ঘুরেছি একাকী,
তবু তাঁকে গঙ্গাতটে
অথবা জলের মাঝে দেখিনি, দেখিনি…
নেই তিনি বারাণসীতেও।
কিন্তু যেই
মুর্শিদের সাথে আমি মিলেছি, ও বাহু…
এইসব খোঁজাখুঁজি থেকে
মুক্তি এল শেষে।
১৭
আমি চাই
আমার সারাটা দেহ যেন একটি চোখ হয়ে ওঠে।
হয়তো তাতেও আমি রয়ে যাব পিপাসার্ত খুব—
হয়তো তাতেও এই মুর্শিদের রূপ
থাকবে অধরাই…
আমার প্রতিটি রোম, কেশ
হয়ে উঠুক চোখ…
ক্রমান্বয়ে খুলুক নিভুক ক্ষণে ক্ষণে…
এমনকী, তখনও
এই তপ্ত বাসনা তো কমবে না ও বাহু…
এবার কোথায় যাই আমি?
দেখি যদি মুর্শিদের রূপ
সহস্র অযুতবার তীর্থযাত্রা হয় যে আমার…



