বিভাজন-পূর্ব কালের অখণ্ড পঞ্জাব এবং সিন্ধ প্রদেশের অন্তর দিয়ে বহু নদী বয়ে গেছে দক্ষিণে সাগরের দিকে। সিন্ধু ছাড়াও রয়েছে ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস, শতদ্রু। এইসব নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় একাদশ শতকের পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘ ছ’শো বছরে যে-সব সুফি ভাবধারার কবি ও সাধক কাজ করেছেন, তাঁদেরই মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের রচনার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলাই আসলে লক্ষ্য।
ভক্তিবাদের এক তরঙ্গ অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের অন্য নানা প্রান্তে যেমন প্রান্তজনের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল পাখনা, কতক তেমনই, ভারতের এই অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষের কাছে গিয়েছিল সুফিসন্তদের সুর। আজকের ভারতের ঘৃণালাঞ্ছিত রাজনীতির বয়ানে এসব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবু মনে রাখা যাক, তৌহিদে আস্থাশীল সাধকের হাতে রাধা-কৃষ্ণ, সোহ্নি-মেহের, হির-রান্ঝা বড় সমাদরে এসেছিলেন। ইতিহাস খুঁড়ে সর্বদা মসজিদ বা মন্দির নয়, ‘রাশি রাশি দুঃখের খনি ভেদ করে’ প্রায়শই শোনা যায় ‘শত জল ঝর্ণার ধ্বনি।’ তার কিছু রেশ এখনও ঘুরে বেড়ায় হিন্দি-অবধি গানের সুরে। বাংলা ভাষাতেও তার কিছু ভাগ যদি পাওয়া যায়— এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে এই কলাম— ‘সিন্ধুপারের সুফি’।
‘সিন্ধুপারের সুফি’ পর্ব ১-এ পড়ুন ‘বাবা ফরিদউদ্দিন মাসুদ শকর্গঞ্জ’ সংক্রান্ত লেখার প্রথম কিস্তি…
বাবা ফরিদউদ্দিন মাসুদ শকর্গঞ্জ : কিস্তি ২
তরজমা
১
দরবেশের পথ খুব কঠিন ফরিদ, চলি পৃথিবীর পথে,
মাথার উপর এই ভার আমি কোথায় নামিয়ে রাখি বলো…
২
এ জগৎ অতল, গভীর, যেন লুকনো আগুন;
তাঁর দেওয়া উদাসীনতাই আজ দিয়েছে বাঁচিয়ে,
নইলে সে আগুনে আমিও পুড়ে যেতাম কবেই…
৩
ও ফরিদ, পথের ঘাসের মতো হও।
কেউ তুলে নেবে ছিঁড়ে, কেউ বা মাড়িয়ে চলে যাবে—
তবে তো খোদার কাছে পৌঁছে যাবে তুমি…
৪
ফরিদ, লোভের মধ্যে কোনও প্রেম নেই,
লোভ প্রেমঘাতী;
বর্ষা এলে
ফুটোফাটা খড়ের চালের ঘরে কতক্ষণ থাকা যায় বলো?
৫
কেবলই কি খোঁজো তুমি এ বিশ্বের নিয়ন্তা প্রভুকে?
তাকাও পায়ের নীচে,
তৃণের মতন হও, দেখো
সে কেমন দলিত ও নত,
ছিন্ন হল দেখো কত বার…

৬
দুর্নাম কোরো না তুমি ধুলোর, মাটির…
ধুলোর মতন আর কী আছে ফরিদ,
যতদিন বেঁচে আছি, পা দিয়ে মাড়িয়ে যাই ধুলো,
মরণের পরে, দেখো, সেই ধুলো ঢেকে দেবে দেহ আমাদের…
৭
কেন তুমি ঘন জঙ্গলের দিকে যাও,
পায়ে কাঁটা মাড়িয়ে মাড়িয়ে?
ভিতরে আছেন তিনি তোমার নিজের,
নির্জন অরণ্যে তবে কেন তুমি খুঁজে মরবে তাঁকে?
৮
রাত কী ভীষণ দীর্ঘ হয়ে ওঠে যেই
ছাড়াছাড়ি হয় তাঁর সাথে…
দেহের দু-পাশ যেন পুড়ে যায় দহনে-দহনে;
তিনি ব্যতিরেকে যারা খোঁজে অন্য কিছু,
নিদারুণ অভিশপ্ত জীবন তাদের…
৯
পথ কাদা মাখা, আর প্রেমিকের ঘর বহু দূর,
কী গহন তাঁর প্রতি প্রণয় তবুও,
যদি ছুটে যাই তাঁর কাছে, (ঘামে) ভিজে ওঠে দেহের পোষাক,
আর যদি না যাই, ঘরেই থাকি বসে,
ছিঁড়ে যাবে প্রণয়ের যোগ…
১০
ভিজে যাক গায়ের কম্বল,
আল্লার হুকুমে বৃষ্টি ঝরুক তুমুল,
তবুও আমায় যেতে হবে তাঁর কাছে,
কখনও না ছেঁড়ে যেন প্রেমের বাঁধন…
১১
ম্যায়ঁ ভুলাবা পাগ দা মত্ মেইলি হো যায়ে
গেহ্লা রুহ্ না জানি সর্ ভি মিট্টি খায়ে
কী যে বোকা আমি…
সামান্য ধুলোর স্পর্শে ময়লা হবে পাগ্ড়ি,ভয় ছিল,
অথচ অচিরে আসবে সেদিন যখন
মাথার খুলিও ঠিক ভরে যাবে ধুলোয় ধুলোয়…
বোঝাই যাচ্ছে, পাগড়ি— এখানে ঐশ্বর্য, অহংকার, সম্মান। তাকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলার মধ্যে যে চমকপ্রদ মূর্খতা আছে ফরিদের গানে তা বেশ ফুটেছে।
১২
উদ্বেগ আর চিন্তা দিয়ে রচিত বিছানা,
বুনেছি বেদনা দিয়ে তাকে।
বিরহের লেপ গায়ে রাখি,
এ রকমই জীবন আমার তুমি দেখো হে সাহেব, দেখে যাও…
১৩
লোভ থেকে যদি আসে তবে
প্রেম নয় কাম বোলো তাকে।
প্রবল বর্ষণে কোনও ভাঙা-চাল ঘরের ভিতর
কতক্ষণ অপেক্ষায় দাঁড়াবে মানুষ?
১৪
দু’টি দীপ প্রজ্বলিত ঘরে,
মরণের ফেরেশ্তারা তবু দেখি চুপিচুপি এসে গেছে ঠিক,
সব নিল, ফাঁকা করে দিল কলসিখানি,
যাবার সময়ে দুটি প্রদীপও নিবিয়ে দিল ফুঁয়ে…
১৫
কাঁধে নিয়ে চলে জায়-নমাজ,
গায়ে মোটা সুতোর পোষাক,
কিন্তু বুকে গোপনে রেখেছে ছুরি যারা,
ঝকমক করছে জিভ সুচারু কথার মিথ্যে মেখে,
বাইরে তারা কী উজ্জ্বল,
ঘন রাত অথচ অন্তরে।
১৬
এ শরীর অনুতাপে ভিজে নম্র হয়েছে ফরিদ,
যদি কেটে ফেল, দেখবে
কণামাত্র রক্ত চুঁয়ে পড়ে কি পড়ে না…
খোদায় রঙিন হয়ে গেছে যারা তাদের শরীরে
থাকে না শোণিতকণা অবশিষ্ট আর।
১৭
জগৎ এক সরোবর যেন,
তার-ই কিনার ঘেঁষে সারি সারি নেমেছে মরাল,
জলে তারা ডোবায়নি ঠোঁট,
সদাই অপেক্ষমান, স্তব্ধ ডানা রয়েছে ছড়ানো,
এখুনি আবার তারা উড়ে চলে যাবে…
১৮
ও ফরিদ, এই আয়ুপাখি—
এ তো এক ক্ষণিক অতিথি;
এ পৃথিবী মনোরম উদ্যানের মতো,
ভোর থেকে বেজেই চলেছে শোনো বিদায়-মাদল,
ওঠো তুমি, তৈরি হও, যাত্রা শুরু হল বলে এই…
১৯
মধ্যরাতে হে ফরিদ, দারুণ অগুরু গন্ধে ভরে ওঠে ঘর,
পেল না সৌরভ যারা ঘুমে অচেতন;
নিদ্রা-বিজড়িত চোখ রয়েছে যাদের
মিলনের তৃপ্তি তারা পাবে কি কখনও?
২০
একা আমি রয়েছি অসুখী— এই ভেবেছি ফরিদ।
কিন্তু চেয়ে দেখো এই সারা পৃথিবীই
বেদনায় কাতর, মলিন।
উঁচু স্থানে দেখেছি দাঁড়িয়ে,
একই অগ্নি ছড়িয়েছে সব ঘরে ঘরে…
বাবা ফরিদের শ্লোকে একদিকে যেমন চরম বৈরাগ্য, জীবনের সব আকর্ষণ তুচ্ছ করে সংযমের কথা আছে, বারবার আছে মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা, তেমনই এসবের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করেছে পরম সত্তার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য অস্থিরতা। আছে প্রবল, প্রায় উন্মত্তের মতো নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার বাসনা— নিবেদন ছাড়া সব কিছুই যেন তাঁর তুচ্ছ মনে হয়, পণ্ড মনে হয়।
২১
কীভাবে যে কেটে গেল এই দীর্ঘ জীবন, ফরিদ…
দিনগুলি দুঃখে পরিপূর্ণ আর রাতগুলি শুয়ে ছিল কাঁটার উপর,
এইবার, পথ শেষ হয়ে এল যেই,
হাঁক দেয় মাঝি—
“দারুণ ঝঞ্ঝার মাঝে ফেঁসে গেছে নৌকা এইবার…”
২২
নদীর কিনারে এক গাছের মতন এ জীবন;
কতদিন টিকে থাকবে দাঁড়িয়ে ওখানে?
যে কলস বানিয়েছ কাঁচা মাটি দিয়ে
কতদিন জল থাকবে তাতে?
২৩
তাঁর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে আমি পুড়ে যাই শরীরে শরীরে,
হাড়গুলি জ্বালানি কাঠের মতো হয়ে ওঠে যেন,
হা-ক্লান্ত হলেও আমি হাঁটি, চলি তাঁর অভিমুখে;
হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়েও এগোতে হবে
মাশুকের দিকে।
২৪
কাগা করঙ্গ ডান্ডোলিয়া সগল খায়া মাস
এয় দো নয়নাঁ মত্ ছুহাউ পির দেখন্ কি আস্
দেহ থেকে সব মাংস ঠুকরে খেয়ে গেছ তুমি কাক,
দয়া করে ছেড়ে দাও শুধু দুই চোখ,
এ-দু’টি দিয়েই আমি চেয়ে দেখি প্রিয়কে আমার…
২৫
গউর নিমানি সদ্ করে নাঘরিয়া ঘর আও
সর্ পর্ ম্যায়ঁ থে আউনা মর্নোঁ না ডরিয়ো
ডাক দেয় কবরের গভীর হৃদয়,
ঘরে ফিরে এসো তুমি বেঘর মানুষ,
জানি শেষে আসবে তুমি ঠিক,
মরণে কী ভয়? এসো এসো…
২৬
রোটি মেরি কাঠ্ দি লাওয়ান মেরি ভুখ
জিন্হাঁ খাদি ছোপরি ঘনে সহেঁগে দুখ
আমার খাবার রুটি কাঠের মতন,
খিদেই আমার কাছে লবন সমান,
যারা আজ মজে আছে সুষম খাবারে,
ঘন দুঃখ সইতে হবে তাদেরও কখনও।
২৭
সব্র এ সুয়াউ জে তুঁ বান্দা দির করা
ওয়াধ থি দারেয়াও তুত্ না থিভেঁ ওয়াহ্রা
গভীর অন্তরে তুমি অপেক্ষা ও ধৈর্য রাখ যদি,
ছোট কোনও খাঁড়ি নয়—
ক্রমে তুমি হয়ে উঠবে নদী…
২৮
রুত্ ফিরি ওয়ান (বন) কাঁবিয়া পত্ ঝড়ে ঝড়্ পায়েঁ
চারে কুঁদন ঢুঁন্ঢিয়া রেহ্ন্ কিথাওঁ নহেঁ
ঋতু বদলে যায়, বন কেঁপে কেঁপে ওঠে,
ঝরে যায় পাতা বৃক্ষ থেকে,
চারি দিকে কত খুঁজে ফিরি তবু হায়,
রহন না যায় কোনও খানে…
২৯
ফরিদা পড় পতোলা ধজ করি কম্ব্লারহি পহিরেও
যিন্হি ওয়াইসি সহো মিলাই সাঈ ওয়াইস করেও
ও ফরিদ, মিহিন কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছি আগেই,
এখন কম্বল গায়ে রাখি।
যে পোশাক সখা-মিলনের দিকে নিয়ে যাবে, শুধু
তাই-ই শুধু রেখেছি শরীরে।
এর পরেই রয়েছে গুরু নানকের সংযোজন–
কেন ছিঁড়ে ফেলবে তুমি পরনের মিহিন কাপড়?
কেন গায়ে দেবে রুক্ষ কম্বল তোমার?
এমনকী, ঘরে বসে সাহিবের সাথে হবে মিলন তোমার–
ও নানক, মন যদি থাকে যথাস্থিত।
৩০
ফরিদা কোঠে মন্ডপ মার্হিয়া উসারেদে ভি গয়ে
কুড়্হা সউদা কর কর গয়ে গোরী আ-য়ে পা-য়ে।
কুঠি আর মণ্ডপ-মিনার যারা বানিয়েছে কোনও এক দিন,
চলে গেছে তারা ;
মাটি দরদাম শুধু করেছে আসলে,
অন্তিমে এসেছে তারা সকলেই কবরের নিচে।
বাবা ফরিদের শ্লোকে একদিকে যেমন চরম বৈরাগ্য, জীবনের সব আকর্ষণ তুচ্ছ করে সংযমের কথা আছে, বারবার আছে মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা, তেমনই এসবের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করেছে পরম সত্তার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য অস্থিরতা। আছে প্রবল, প্রায় উন্মত্তের মতো নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার বাসনা— নিবেদন ছাড়া সব কিছুই যেন তাঁর তুচ্ছ মনে হয়, পণ্ড মনে হয়। কবরের জন্য তাঁর যেন এক অনড় আকর্ষণ— এক ধরনের ‘ডেথ ইনটক্সিকেটেড’ মত্ততা তাঁর আপাত স্থৈর্য এবং ধৈর্যের মধ্যে জাগরুক থাকে। দেহের আর অন্য কোনও তাৎপর্য নেই তাঁর কাছে—
যে চোখ দেখে না তাঁকে,
অন্ধ হয়ে যাক যে নয়ন;
যে মুখে ফোটে না তাঁর নাম,
মূক হয়ে যাক সেই মুখ।
যে কান শোনে না তাঁর স্তুতি,
যেন হয়ে ওঠে সে বধির।
যে দেহ লাগে না তাঁর সেবায় কখনও,
সে শরীর মৃত, তাকে নিয়ে যাক মরণ এখন।
ঈষৎ কর্কশ ঢঙে ফরিদ দেহের কাজকর্ম হাজির করেন তাঁর অন্তত দু’টি শ্লোকে। পরপর দু’টিই উল্লেখ করি–
৩১
ঘুম থেকে ওঠো হে ফরিদ,
হাত-মুখ ধোও আর ভোরের নমাজ পড়ে নাও।
যে মাথা ঝোঁকে না তাঁর কাছে,
নিজেই শরীর থেকে তাকে তুমি ছিন্ন করে দাও।
৩২
যে মাথা ঝোঁকে না তাঁর কাছে
তাকে নিয়ে কী করি এখন?
সে মাথা জ্বালানি আসলে, শোনো,
রাখো তাকে হাঁড়ির তলায়।
এই সূত্রে আরও এক সুফি কবির ছোট একটি লেখা উল্লেখ করতে চাই। শাহ আব্দুল লতিফ ভিট্টাই। ফরিদের প্রায় চারশো বছর বাদে সিন্ধ অঞ্চলের কবি। দেহ আর আত্মার সম্পর্ক নিয়ে অন্য সুফি ভাবুকদের মতো তিনিও চিন্তিত এবং কাতর ছিলেন। একটি গানে তিনি বলছেন,
এই দেহ জপের মালার মতো, মন তার কেন্দ্রে থাকা ফুল।
আর হৃদয় এক বীণা।
প্রেম অবিরাম
বাজিয়ে চলেছে এক মিলনের সুর সারা দেহতন্ত্র জুড়ে।
স্নায়ুরা গাইছে—
কেউ নেই, কেউ নেই তোমার মতন,
তুমিই রয়েছ শুধু, তুমিই সে এক।
ঘুমেও কী সুন্দর ওরা,
ঘুমও ওদের কাছে প্রণামের মতো জেগে থাকে।
ইবাদত, সমর্পণ নিয়ে ফরিদ যতটা কঠোর এবং নিষ্ঠুর, লতিফ তেমন নন। তাঁর ভাবনায় বরং হাল্লাজ আর রুমির একত্র উপস্থিতি।

সুফি কবিদের রচনায় ঈশ্বরের জন্য, আল্লাহ্র জন্য যে প্রেমার্ত নিবেদন লক্ষ করা যায়, সকলেই জানেন, সে বিষয়ে বারবার ওঠে ইশ্ক্-ই-মজাজি (লৌকিক প্রেম) এবং ইশ্ক্-ই-হকিকি (অলৌকিক প্রেম) নামক দুই ধারণার কথা। পৃথিবীর চেনা প্রেম, সাধারণত নারী-পুরুষের মধ্যে চেনা আকর্ষণের ছবি দিয়ে শুরু করলেও সুফি সন্তের আসল গন্তব্য মানব-অভিজ্ঞতা বহির্ভূত অলৌকিক প্রেম। সেখানে ঈশ্বর আর তাঁর বান্দার নিরন্তর মিলনাবস্থা। বারবার ভাষ্যকাররা তাই মনে করিয়ে দেন সাধারণ পাঠক-শ্রোতাকে, নিছক মানবিক আকর্ষণের আখ্যান হিসেবে এসব রচনা পড়া ভুল, এসব রূপক আসলে, অন্তরের মূল কথাটির দিকে যেন মন থাকে স্থির। এসব রচনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে শেখান তাঁরা। বৈষ্ণব রসতত্ত্বের ক্ষেত্রেও এমন সতর্কতা জারি থাকে সর্বদা, রাগাত্মিকা এবং রাগানুগা ভক্তির এলাকা পৃথক। শুরু করতে পারো তুমি ইশ্ক্-এ-মজাজি দিয়ে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ আসলে লোকজগতের ব্যাপার, এ কেবল সোপান। যেতে হবে হকিকির দিকে— হক্ হচ্ছে সত্য এবং ঈশ্বর। সেই সাধ্য— লক্ষ্য তোমার, সেই অলৌকিকের আলোই তোমার গন্তব্য।
কিন্তু অনেক সময়, ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন সমর্পনের অভ্যাস কবিকে টেনে নিয়ে যায় অলৌকিক থেকে লৌকিকের অভিমুখে। আল্লাহ্-ই লক্ষ্য, তাঁরই জন্য সব আয়োজন, উপাসনা, ধ্যান, নমাজ, কিন্তু সেই দিকে নিরবচ্ছিন্ন চলতে চলতে পুনরায় মানুষের মাঝখানে এসে দাঁড়ান কবি। নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, এক সার্বিক প্রেমের সামর্থ অর্জিত হয় তাঁর। সকলের জন্য প্রেম, সকলের জন্য আকুলতা। এ-প্রসঙ্গে গুরু গ্রন্থসাহিব বইতে সংকলিত ফরিদের শেষ কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করে এই কথা শেষ করব। ১২৯ এবং ১৩০ সংখ্যক শেষ দু’টি রচনা আদৌ ফরিদের জীবনের শেষ দিকে লেখা কি না, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। হয়তো, শিখ ধর্মগুরুদের হস্তক্ষেপে, তাঁদের পছন্দসই বিন্যাসের কারণেই এমন ঘটেছে। কিন্তু আমরা চমৎকৃত হব এইটে লক্ষ করে, মৃত্যুকে বরবেশে দেখলেন যে ফরিদ, তাকে কামনা করলেন তীব্র আকুলতায়, তার জন্য কান পেতে রইলেন তিনি, সেই ফরিদের শেষ পর্বের শ্লোকে এল এমন আবেদন…
ইক ফিক্কা না গালা-আয়ে সাভনা ম্যায় সাচ্চা ধনী
হাইআও না কইহী ঠাহি মানক সব আমোলভে।
বোলো না কখনও কোনও নিষ্করুণ কথা,
তোমারই প্রভু যে বসে রয়েছেন সবার ভিতরে—
মন যে অমূল্য রত্ন, কারো মনে দিও না আঘাত।
সব্না মন মানিক ঠাহন মূল মাচাঙওয়া।
জে তাও পিরিয়া দি সিক হাইও না ঠাহে কহি দা।।
হৃদয় সবার, শোনো, মানিকের মতো,
সইবে না আঘাত সেখানে।
প্রিয়কে কামনা করো যদি
অপরের হৃদয়ে আঘাত যেন কোরো না কখনও।
ঈশ্বরকে, আল্লাহকে যদি প্রিয় মনে কর তুমি, তাহলে ‘হৃদয়ে’ আঘাত দিও না। ফরিদের উত্তরসূরি বাবা বুল্লে শাহ্, সিন্ধি ও পাঞ্জাবি সাহিত্যের আর এক দিকপাল কবি এই প্রসঙ্গ বহুবার এনেছেন নিজের লেখায়। কাকে এবং কেন আঘাত তা বড় কথা নয় এক্ষেত্রে, আঘাতদাতা সর্বদাই নিজের কাজের উপযুক্ত যুক্তি তৈরি রাখেন, ‘আমি তো এমনি এমনি বলিনি, ও যা করেছে তার জবাব দিয়েছি কেবল’, কিংবা, ‘যে যেমন ভাষা বোঝে, তাকে সেই ভাষাতেই বলতে হবে’, কিংবা, ‘ও মা, ও যে অমন সব কাজ করেছে, তার কোনও পাল্টা দেব না?’— এসবই বহু বহু বছর ধরে আমাদের হিংসাত্মক কাজের সাফাই। আমার সাধ্য কী, এক নিমেষে এসব যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেব? আমি শুধু বলছি ফরিদের কথা, সুফি সন্ত ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই শকর-এর নিবেদন।
অন্যকে আঘাত কোরো না, এইটে খুব নতুন কথা নয়, ফরিদের আগে এবং পরে বহু মনীষী এবং মোটেই-মনীষী-নন, এমন মানুষ এই কথা বলেছেন। আমি লক্ষ করতে বলব, এর মাঝখানের ওই শর্তটির দিকে— ‘প্রিয়কে কামনা করো যদি’। এইটেই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘কাউকেই আঘাত করা উচিত নয়, কেননা সকলের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন’— এইটের বদলে এখানে আসলে বলা হয়েছে, যদি তুমি তোমার প্রিয়কে চাও, তাহলে অপরের হৃদয়ে আঘাত দিও না— If you desire your Beloved, then do not break anyone’s heart. কেন এমন কথা?
ফরিদ বিশেষজ্ঞরা নানান কথা বলেছেন, আমার মনে হয়, ওই আঘাত তোমার প্রিয় ঈশ্বরের গায়েই পড়বে— এইটুকুই শুধু নয়, ফরিদ এখানে ইঙ্গিত করেছেন, এতে তাঁকে কামনার যোগ্যতাটুকুই তুমি হারাবে, তাঁকে চাওয়ার অধিকার নষ্ট হয়ে যাবে।
আপনারা বলতে পারেন, খানিক জোর করে, আমার ইচ্ছামতো ফরিদকে ব্যবহার করছি এখানে। হবে হয়তো। কিন্তু এ আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, অপরের প্রতি আঘাত, অন্যের প্রতি ঘৃণা সে-ই অপরের যত না ক্ষতি করে, তার চেয়েও অনেক বেশি নষ্ট করে আমাকে। সে আঘাত এবং ঘৃণা প্রথমত এবং শেষত, আমাকেই খায়।
ফরিদ ধরিয়ে দিচ্ছেন, চাওয়াতেই কেবল তিনি আছেন, অন্য আর কোথাও নেই, কোনও স্বর্গে, কোনও পরলোকে, কোনও বেহেশতের কিনারায় পাতা নেই তাঁর সিংহাসন। যতক্ষণ আমি চাই, ততক্ষণ তাঁর স্থিতি। আমাদের বাংলা ভাষার এক মহাগ্রন্থ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-র এক শ্লোক উদ্ধার করি এইখানে, ঈশ্বরের জবানিতে সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমারে তো যে যে ভক্ত ভজে যেই ভাবে/ তারে সে সে ভাবে ভজি এ মোর স্বভাবে।।’ এর শাস্ত্রীয় এবং প্রতিষ্ঠান-স্বীকৃত ব্যাখ্যা হয়তো অন্য, কিন্তু এর মধ্যে একটি সারসত্য লুকনো আছে মনে করি— আমাকে যে ভাবে তুমি ‘চাও’, সেইভাবেই তোমাকে ধরা দিই— এইটি তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন নয়, এইটিই তাঁর স্ব-ভাব। অন্য কিছু করা তাঁর অসাধ্য। কেননা, তাঁর সমস্ত ক্রিয়ার আসল এজেন্সি আমার। আমার চাওয়াতেই কেবল মাত্র তিনি ‘থাকেন’। অপরের প্রতি আঘাতে, ঘৃণায় আমার সেই চাওয়াটি কোরাপ্ট হয়ে পড়ে। যদি তাঁকে না চাও তুমি, তাহলে কোনও বাধা নেই। ঘৃণায়, প্রতিশোধে ফুটতে ফুটতে এগিয়ে যেতে পার।

এই সূত্রে ফরিদের সমকালীন সুফি তাত্ত্বিক ও দার্শনিক আন্দালুসিয়ার বাসিন্দা ইবনুল আরাবি-র (১১৮৫–১২৪০) কথা উঠে পড়তে পারে। পরবর্তী সুফি দার্শনিকতার অনেকখানিই তাঁর অবদান। তাঁকে সামনে রেখে, তাঁর সঙ্গে তর্ক করে একাধিক সুফি মত বেড়ে উঠেছিল। ফরিদের সঙ্গে আরাবির কোনও বৌদ্ধিক যোগাযোগের খবর জানি না, তবে ভালবাসা নিজেই একটি সব-ছাপিয়ে ওঠা ধর্ম— এইটে ইবনুল আরাবি-র অন্যতম ঘোষণা ছিল। তাঁর মূল ভাবনা নিয়ে পরে আমাদের কিছু কথা বলতেই হবে। ফরিদের আর-এক সমকালীন কবি জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭-৭৩)। ফরিদের মৃত্যুর পর আরও আট বছর বেঁচেছিলেন তিনি। মুলতান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে বল্খ্ শহরে কেটেছে রুমির জীবনের বড় একটি পর্ব। দু-জনেই সুফি তরিকার অনুসারী, কিন্তু খুব সমধর্মা নন তাঁরা। সেই রুমির গজল থেকে একটি দ্বিপদী আপনাদের কাছে রেখে আজ বিদায় নিচ্ছি—
দার ইন খাক দার ইন খাক দার ইন মেজ়রাএ পাক
বেজোজ় মেহ্র বেজোজ় ইশ্ক্ দেগার তোখ্ম্ নকারিম্
এ মাটিতে এই মৃত্তিকায়,
এই শুদ্ধ, পবিত্র রূপের মাঝে তুমি
প্রেম ছাড়া, দয়া ছাড়া আর কিছু কোরো না রোপণ।
রুমির এই কথা বাবা ফরিদেরও কথা হতে পারত।


