বন্দরের তথ্য-ভাষা
আমার সঙ্গে ‘পরিবর্তন’ অফিসে দেখা করতে আসা ওই তিন নাবিকের নাম আমার মনে নেই। তবে তিনজন রানাঘাটের। এখানে টুক করে বলে নিই, এই লেখাটি, ধারাবাহিকভাবে এই ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ আমি লিখে চলেছি একেবারে স্মৃতিনির্ভরতায়, কোনও কাগজপত্র না দেখে। ‘পরিবর্তন’ পত্রিকার কোনও কপিও এখন আর আমার কাছে নেই। তবে বাল্যকাল থেকে এই অবধি আমার স্মৃতি চলচ্চিত্রের মতো। লিখতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না। প্রয়োজন হলে কখনও সাল-তারিখগুলি একটু দেখে নিচ্ছি, এই যা। সে যাক গে, ওই তিন নাবিক, তখন যাঁরা আমার সামনে বসেছিলেন, তাঁদের দেখাচ্ছিল খুবই কাতর। মাসের পর মাস তাঁরা ছিলেন বেকার। অনিশ্চিত তাঁদের জীবিকা। এসব কথা তাঁরা সংবাদপত্রে সেই চিঠিতে লিখেছিলেন, আমার কাছে বিশদে বললেন।
ব্যাপারটা কিছুটা বুঝিয়ে বলি। সাতের দশকের শেষ/আটের দশকের ওই সময়টায়, বিশ্বে মালবাহী জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার বলতে গেলে শেষ বেলাটি। যাত্রীবাহী জাহাজ তার আগেই সারা দুনিয়ায় প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তবু খিদিরপুর বন্দরটিতে যতদূর মনে পড়ছে, ক্লানলাইন, ব্রোকেলব্যাঙ্ক এসব বিদেশি বেসরকারি মালিকানার জাহাজ আসত পণ্য পরিবহনের। নাবিকেরা যাঁরা সরকারি ইন্ডিয়ান শিপিং কর্পোরেশনে কাজ করতেন, তাঁরা ছিলেন স্থায়ী চাকরিতে। এছাড়া বিদেশি বেসরকারি জাহাজগুলিতে অস্থায়ীভাবে এক-একটি বন্দর থেকে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ হত নাবিকদের। খিদিরপুর বন্দরে বিদেশি বা দেশি বেসরকারি জাহাজে কাজ পাওয়ার জন্য রোজই খোঁজখবরে আসা নাবিকদের জমে যেত ভিড়। প্রকৃত অর্থে তাঁরা ছিলেন ভাসমান।
‘এমভি হর্ষবর্ধন’ ও ‘এমভি নিকোবর’ নামে দুটি যাত্রীবাহী সরকারি জাহাজ যেত আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার; পরে ‘এমভি আকবর’ নামে আর একটি যাত্রীবাহী সরকারি জাহাজও কলকাতা থেকে আন্দামান যাতায়াত শুরু করে। এখনও আন্দামানের ওই জাহাজগুলি যাতায়াত করে বলে শুনেছি। এমভি মানে মোটর ভেসেল। তখনও মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে সিঙ্গাপুরে একটি যাত্রীবাহী জাহাজ যাতায়াত করত, শুনতাম সেটি ছিল বিলাসবহুল জাহাজ। উচ্চ ভাড়ার। এখন আর নেই। সিংহল তখনও শ্রীলঙ্কা হয়নি। দক্ষিণে কন্যাকুমারী থেকে যাত্রী পরিবহনের একটি লঞ্চ যেত সিংহলের জাফনায়। জাফনা থেকে ট্রেনে যাওয়া যেত কলম্বো। আমার বন্ধু ফরিদ, বাংলাদেশের কবি ফরিদ কবির ওই সময়ে, ওই ’৭৮/’৭৯ সালে ভারতে ঘুরতে এসে চলে গিয়েছিল কন্যাকুমারী। দেখে সমুদ্রতীরে চেয়ার-টেবিল পেতে সিংহলের ভিসা দিচ্ছেন একজন। ছাড়ছে লঞ্চ। ভিসা নিয়ে ভারতীয় ২৮ টাকায় লঞ্চের টিকিট কেটে ফরিদ পৌঁছে যায় জাফনা। তারপর ট্রেনে কলম্বো। এখন আর ওই লঞ্চ চলাচল করে না।

আমি মাসখানেক খিদিরপুর বন্দরে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। আমার সঙ্গে আলোকচিত্রী দীপক ভট্টাচার্য যেতেন। খিদিরপুরে নাবিকদের একটি সংগঠন ছিল ফরোয়ার্ড সিমেনস ইউনিয়ন। বামপন্থী ফরোয়ার্ড ব্লক দলের সংগঠন। আশু ব্যানার্জি ছিলেন। তখনকার লব্জ অনুযায়ী গোড়াতেই ওই দাপুটে নেতা বলে বসলেন, ‘আপনারা বুর্জোয়া প্রেস। কিচ্ছুটি লিখতে পারবেন না। পোর্ট ট্রাস্টকে গাল দিলেন, খিদিরপুর বন্দরকে কেন্দ্র শুকিয়ে মারছে।’ আমি বললাম, ‘বলে যান, বলে যান।’ নোট নিতে লাগলাম। ঘটনাচক্রে আশু ব্যানার্জি ছিলেন জীবনবিমায় আমার বাবার সহকর্মী। চাকরি ছেড়ে ট্রেড ইউনিয়ন করছেন। ফলে বিস্তর কথাবার্তা চলল তাঁর সঙ্গে। খিদিরপুর বন্দর তখন সত্যিই শুকিয়ে আসছিল। কমে যাচ্ছিল বন্দরে আসা জাহাজের সংখ্যা। ফরোয়ার্ড সিমেনস ইউনিয়নেই আলাপ হল জিয়াদ আলির সঙ্গে। আমাদের সময়ের কবি, সে-সময়ে সুপরিচিত ছিলেন; তিনি ছিলেন ওই নাবিক সংগঠনে। তবে তিনি নাবিক ছিলেন না। ওই সময়ে খিদিরপুর বন্দরে থামা একটি গ্রিক জাহাজ ঘুরে-ঘুরে দেখেছিলাম। দীপক ছবি তুলেছিলেন। নাবিকদের দুর্দশার সেই প্রচ্ছদকাহিনিতে আমার বাবার সহকর্মী আশু ব্যানার্জি খুশি হয়েছিলেন।
মাস ছয়েক পর সেই তিন নাবিকের দু’জন ‘পরিবর্তন’ অফিসে এসে আমাকে এক বাক্স রঙিন স্কেচ পেন, বেশ কিছু পিকচার পোস্টকার্ড উপহার দিয়েছিলেন। জাহাজে কাজ পেয়ে তাঁরা জাপানের নাগোয়া বন্দরে গিয়েছিলেন। নাবিকদের নিয়ে ওই প্রচ্ছদকাহিনির বিস্তারিত কিছু বলার এখন আর দরকার নেই। তবে সেই আমলে জাহাজ সমুদ্রে থাকার সময়ে ওই জাহাজের অফিসার কেউ মারা গেলে, সেই মৃতদেহ নিকটবর্তী বন্দরে থামিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে বিমানে দেশে ফেরত পাঠানো হত। সাধারণ নাবিক মারা গেলে মাঝসমুদ্রেই কফিনে ভাসিয়ে দেওয়া হত। ‘পরিবর্তন’-এ সে-কথা লিখেছিলাম। ডায়মন্ড হারবারের তৎকালীন সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু বিষয়টি সংসদে তুলেছিলেন। এই নিয়ম এরপর বদলেছিল। এরপর থেকে মাঝসমুদ্রে কোনও সাধারণ নাবিক মারা গেলে, তাঁর মৃতদেহও দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা বলবৎ হয়।

নাবিকদের ভেতর ঘোরাঘুরির সময়ে তাঁদের মুখে নানান কাহিনিও শুনেছি। আরবভূমি ছাড়িয়ে আফ্রিকার উপকূলভাগে মালবাহী জাহাজগুলিতে মাঝেমধ্যেই সে-সময়ে ঘটত জলদস্যু জলযানের উৎপাত। আর একটি আশ্চর্য কথা, লাইবেরিয়া দেশটির বিরুদ্ধে সে আমলে গ্রিস-সহ কয়েকটি দেশ অভিযোগ তুলত, লাইবেরিয়া জাহাজচোর। সমুদ্রে ভিনদেশের জাহাজ দখল করে লাইবেরিয়ান দস্যুজাহাজ নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে খোলনলচে বদলে, রং বদলে নিজেদের জাহাজ করে দেয়। ওই সময়ে, ওই ১৯৭৮-’৭৯ সালে, কেরলের বন্দর থেকে যাওয়া একটি ভারতীয় জাহাজ আফ্রিকার কাছে মাঝসমুদ্র থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার ক্যাপ্টেন, নাবিকদের কোনও খোঁজ মেলেনি। তখনও অভিযোগ উঠেছিল উত্তর আফ্রিকার ওই লাইবেরিয়া দেশটির বিরুদ্ধে। জাহাজের ক্যাপ্টেন, অফিসার ও নাবিকদের বিস্তর টাকা দিয়ে ইউরোপ পাঠিয়ে লাইবেরিয়া নাকি ওই জাহাজের রং বদলে, নয়া নাম দিয়ে নিয়ে নিয়েছে। তখনকার দিনে জাহাজ পরিবহনে সারা দুনিয়ায় শীর্ষস্থানীয় দেশ ছিল উত্তর আফ্রিকার সাদামাটা দেশ লাইবেরিয়া। ‘পরিবর্তন’-এ নাবিকদের নিয়ে আমার লেখার সঙ্গে বক্সনিউজ, মানে সংযোজনী বিশেষ লেখা হিসেবে বের হয়েছিল ওই ভারতীয় জাহাজ মাঝসাগরে গায়েব হওয়ার ঘটনাটি।
নাবিকদের কথা উঠলই যখন, তখন বলি, আমাদের সমকালীন অগ্রজ কবি জলধি হালদার বনগাঁয় থাকেন, তিনি নাবিক ছিলেন। নামটি তাঁর পিতৃদত্ত নাম। এমন সার্থকনামা ব্যক্তি আর দেখিনি। জলধি মানে সমুদ্র, সমুদ্রের হালদার। আশ্চর্যজনক নাম! ১০/১২ বছর আগে জলধিদার একটি কাব্যগ্রন্থ বাংলা আকাদেমিতে প্রকাশ করেছিলেন ফরোয়ার্ড সিমেনস্ ইউনিয়নের আশু ব্যানার্জি, তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ছয়ের দশকে তখনকার পূর্বপাকিস্তান থেকে তরুণ নাবিক বেলাল চৌধুরী খিদিরপুর পৌঁছে কলকাতায় সুনীলদা, শক্তিদা, তারাপদদা, শরৎদাদের ‘কৃত্তিবাস’-এর দলে ভিড়ে কয়েক বছর ছিলেন। তাঁর কবিতা লেখার সূত্রপাত তখনই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে যান। ১৯৮৬-তে আমি যখন প্রথমবার বাংলাদেশে যাই, শুনে শক্তিদা বললেন, ‘ঢাকায় তুমি অবশ্য-অবশ্য বেলালের সঙ্গে দেখা করবে।’ তারপরই আক্ষেপের গলায় বললেন, ‘ইশ, জানো তো, বেলাল বিয়ে করে ফেলেছে!’ অতীনদা, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন নাবিক। দুনিয়া ঘুরেছেন জাহাজে-জাহাজে। অতীনদার কথা বলব, আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল ‘যুগান্তর’-এর কথা বলব যখন।

সে-বছর পুজোর সময়ে শারদ সংখ্যা ‘পরিবর্তন’-এ স্থির হয় ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে বাংলায় কালীঘাট, বীরভূমের তারাপীঠ, নলহাটির নলাটেশ্বরী, আসামের কামাখ্যা মন্দির ও আরও কয়েকটি পীঠ নিয়ে লেখা বের হবে। তারাপীঠ নিয়ে লেখার দায়িত্ব পাই আমি। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময়ে সতীদেহ মাথায় তুলে শিবঠাকুরের প্রলয়নৃত্য বিশ্বে সংকট জাগায়। মহাদেবকে থামাতে নারায়ণ সুদর্শনচক্র ছুড়ে সতীদেহ খণ্ড-খণ্ড করেন। সতীর দেহখণ্ড অবিভক্ত ভারতবর্ষে যেখানে-যেখানে পড়েছিল, সেগুলি শক্তিপীঠ। শক্তিপীঠগুলির মন্দির হিন্দুদের পবিত্র ধর্মস্থান। তারাপীঠের মন্দির স্থাপিত হয় সুদূর অতীতে; বার বার সংস্কার হয়ে চলেছে। বলা হয়, এখানে সতীর তৃতীয় নয়নটি, নয়নতারা পড়েছিল। তারাদেবী পূজিতা হন দেবী কালিকারূপে। নানা কিংবদন্তি আছে এই মন্দির ও দেবীমূর্তি নিয়ে। কিংবদন্তি, বশিষ্ঠ মুনি তিব্বত থেকে এই মন্দিরে নিয়ে আসেন মূল মূর্তিটি। সেটি পাথরের। তবে খোদিত নয়, আকারবিশিষ্ট, স্বয়ম্ভূ। দেখলে মনে হয় সন্তানকে স্তন্যদানরতা মাতৃমূর্তি। কিংবদন্তি, প্রলয়নৃত্যের সময়ে শিবকে শান্ত করতে সতীও দুধপান করিয়েছিলেন। এই প্রস্তরমূর্তিটি ঢাকা থাকে স্বর্ণনির্মিত দেবীমুখে। মাঝরাতে কোনও-কোনও সময়ে ওই সোনার দেবীমুখটি সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য প্রস্তরমূর্তিটি দেখানো হয়। আমি দেখেছিলাম।

ওই বশিষ্ঠ কিন্তু রামায়ণের বশিষ্ঠ নন। নানারকম কিংবদন্তি, গল্পস্বল্প আছে, সেসব এখানে বলার নয়। বরং যে-কিংবদন্তি রয়েছে ইতিহাস ছুঁয়ে, সংক্ষেপে বলি সেটি। সপ্তম শতাব্দীতে যখন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ককে আক্রমণ করেছেন হর্ষবর্ধন, তাঁকে মদত দিতে পুবদিক থেকে এগিয়ে এসেছেন আসামের রাজা ভাস্করবর্মা; তিব্বতের সম্রাটের সেনারাও ঢুকে পড়ল উত্তর থেকে রাজ্যদখলে। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সংঘাতে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল তান্ত্রিক আচারের হইহট্টগোল। ওই সময়ে এক সাধক নাগার্জুন, রসায়নশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন তিনি, তিব্বতে গেলেন পাহাড়পর্বত ডিঙিয়ে। ওই শিবকে স্তনদানরতা সতীর বৌদ্ধ মাতৃমূর্তিটি বাংলায় নিয়ে এলেন নাগার্জুন। তিব্বত থেকে জবা গাছও আনলেন তিনি। ওই প্রস্তর বৌদ্ধ মাতৃমূর্তিটি ক্রমে হয়ে গেল কালিকা। কালী তারা ব্রহ্মময়ী। আর জবা? ‘মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’। নাগার্জুনই লোকমুখে হয়ে গেলেন বশিষ্ঠ মুনি। একটি মতে, এই হল তারাপীঠ মন্দিরের গোড়াপত্তন।
বের হল পরিবর্তনের সেই পুজো সংখ্যা। এর পর শীতের মুখে ধীরেনদা, ‘পরিবর্তন’-এর সংযুক্ত সম্পাদক ধীরেন দেবনাথ বললেন, তোমাকে চম্বলে যেতে হবে। সে-সময়ে মালখান সিং আর ফুলন দেবী তখন চম্বলের বেহড়ে বন্দুক উঁচিয়ে সবে উদিত হয়েছেন।


