বৈভবের শহর
‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই দুবাই?’
বিশ্বাস করুন, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় কুসুমকে বলা শশীর এই বহু-চর্চিত সংলাপ আমার মনে এসেছিল দুবাইতে পা দিয়ে। চারপাশে শুধু বৈভব আর বৈভব। মনের হদিশ পাবেন না। পায়ের তলায় সর্ষে হওয়ার তাড়নায় পৃথিবীর কম শহর তো ঘুরিনি! কমবেশি সব ক্ষেত্রেই শহরের ভেতরে আর-একটা শহর থাকে। কলকাতা, নিউ ইয়র্ক, ব্যাংকক, সিডনি সব্বার। সেই হৃদমাঝারের সন্ধান পেতে গেলে, সেখানকার বাসিন্দা হতে হবে তার মানে নেই। দুই-তিন-চারদিনেও ঠিক টের পেয়ে যাবেন ‘ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায়’ লুকিয়ে থাকা সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, প্রবঞ্চনার ছবি। দুবাইপ্রেমীরা এতক্ষণে আমার ওপর রেগে গেছেন নিশ্চয়ই। ভুল ভাববেন না, আমি একবারও বলিনি দুবাই খারাপ জায়গা। বরং ভরপুর মস্তি, যদি পকেটে থাকে রেস্ত। তা, আমি কেন একাধিকবার গেছি দুবাই? ইউরোপ, আমেরিকার গেটওয়ে হিসেবে বলতে পারেন। শেষবার, মানে ২০২২ সালে লাস ভেগাস যাওয়ার পথে একটু বেশিই থাকা হয়ে গেল ট্রানজিট পয়েন্ট দুবাইতে। উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়ার মাঝরাস্তায় সহকর্মীদের সঙ্গে মন্দ কাটেনি সেই ছোট্ট অবকাশ। দরকারও ছিল খুব। কারণ জানতাম, আমেরিকায় পা রাখামাত্র কী অসম্ভব চাপে কাটবে ক’টা দিন।
মানুষের পক্ষে পার্থিব জগতে যা কিছু বিস্ময়কর তৈরি করা সম্ভব, তা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দুবাই। বিশাল মরুভূমিটা অবশ্য প্রাকৃতিক। আমার তো মনে হয়, প্রয়োজনে অরণ্য, পর্বত, নদী, সব তৈরি করে ফেলতে পারে এই দেশটা। অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০২৪ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছিল মরু শহর। তাজ্জব বনে গেছিল সবাই। তখন গুজব রটেছিল, দীর্ঘ অনাবৃষ্টি কাটাতে দুবাই সরকার কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করে পরে আর সামলাতে পারেনি। গুজব বললাম এই কারণে যে, এবিষয়ে সেদেশের সরকারি বক্তব্য কখনও জানা যায়নি। তাই এই আমীরশাহীতে কোনও ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দিলখোলা তারিফ করার আগে জেগে উঠবে হিসেবি মন, প্রশ্ন করবে, ‘এটা কি আসল?’ গিনেস বুকে নাম তোলার ব্যাপারে জুড়ি নেই এ’শহরের। সবচেয়ে উঁচু বাড়ি থেকে সবচেয়ে গভীর সুইমিং পুল, অবাক হওয়ার অথৈ পানি দুবাইতে।
‘মারহাবা!’ সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে দুটো জাম্বো সাইজের খেজুর এগিয়ে দিল ধবধবে সাদা কান্ডুরা পরা তরুণ এক শেখ। পরে জেনেছিলাম আরবি ভাষায় মারহাবা মানে স্বাগত আর শেখরা যে সাদা জোব্বা পরেন, তাকে বলে কান্ডুরা। মাথায় কালো ব্যান্ড দিয়ে আটকানো সাদা স্কার্ফ ঘুটরা। এয়ারপোর্টে নেমে হাঁটতে-হাঁটতে এমন অভ্যর্থনা পেয়ে খুশি হব কি না বুঝতে পারছিলাম না। খেজুরটা নিতে ইতস্তত করছি দেখে সুদর্শন তরুণটি ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে বললেন, ‘রোজা চলছে। দিনের বেলা আমরা উপোস করে আছি। কিন্তু অন্যকে খাওয়ালে পুণ্য হয়।’ সেই খেজুরটা আমার খাওয়া সেরা খেজুর। মনে হল যে, ডিউটি ফ্রি স্যুভেনির শপের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটি মিনে করা বিশাল থালা থেকে খেজুর বিলি করছে, সেটা তাদেরই। দুবাই এয়ারপোর্ট এত বিরাট, এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে লিফট, এসকালেটর, এমনকী মেট্রোর মতো ট্রেন, সবকিছু চড়া হয়ে যায়। এতগুলো তলা সেখানে, এত চোখধাঁধানো দোকানপাট যে, কেউ পুরোটা দেখতে পেরেছেন বলে শুনিনি। উটের দুধের চকোলেট থেকে শুরু করে মহার্ঘ পারফিউম, লাখ-লাখ টাকা দামের সুরা থেকে শুরু করে বিখ্যাত দুবাই গোল্ডের গয়না (শুনেছি শুল্কমুক্ত বলে নাকি কিছুটা শস্তা), যা চান কিনতে পারেন। তবে স্মরণে রাখবেন সেই আপ্তবাক্য ‘নো মানি, নো হানি’। প্রায় ভবা পাগলার পর্যায়ের এই বাণীটি দিয়েছিলেন ব্যাংককের এক পথসুন্দরী। আমাকে নয় অবশ্যই, আমার সঙ্গের এক উৎসুক পুরুষবন্ধুকে।
আগের পর্বেই বলেছিলাম ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেও কীভাবে বিদেশ বিভুঁইয়ে আম ভারতীয়ের উদ্ধারকর্তা হতে পারেন কিং খান। এখানে একটা ছোট্ট নিদর্শন, পরে অন্য দেশে এর থেকে অনেক বড় উদাহরণ দিতে পারব। দুবাইয়ে তো শাহরুখ খান প্রায় ভগবান। এখানকার জুমেইরা বিচ রিসর্টে তাঁর বাংলো আছে, সেটা দেখতে যান ট্যুরিস্টরা। যেমন রোজ ভিড় জমে মুম্বইয়ের মন্নতের সামনে। জানা কথা, বছরে বিশেষ দু-একটি দিন ছাড়া তারকার দেখা পাওয়া যায় না, তবু বান্দ্রার ল্যান্ডস এন্ডের বাড়িটির গেটের সামনে সেলফি, গুফি চলতেই থাকে ভক্তদের। দুবাইয়ের জুমেইরার জন্নত বাংলো ব্যতিক্রম নয়। রীতিমত গাইড নিয়ে নানা দেশের পর্যটকরা যান সেটি দেখতে। এমনই যাঁর অতিলৌকিক ক্যারিশমা, তাঁর ঘায়ে কুপোকাত হবেন এক ট্যাক্সি ড্রাইভার, তাতে আর আশ্চর্য কী! বাঙালির যা স্বভাব, হোটেল থেকে বেরিয়েই দরাদরি শুরু করেছি সামনে দাঁড়ানো ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে। ইংরেজিতে কথা শুরু হলেও উনি যে মুহূর্তে জানালেন উনি পাকিস্তানি, আমার সহকর্মীরা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দিতে শিফট করল। ভারত থেকে গেছি শুনে প্রথম প্রশ্ন, ‘শাহরুখ খানকে দেখেছো?’ দেখেছি তো বটেই, পর্দায়। কায়দা করে আমাদের মধ্যে একজন কমবয়সি ছেলে এমনভাবে বর্ণনা করছিল মন্নত, যে মনে হচ্ছিল ও খান পরিবারের সঙ্গে ডিনার করে। আর বেশি বাড়াবাড়ির আগেই ওকে থামানো হল। অবশ্য ততক্ষণে চালক ভাইজান বেশ ডিসকাউন্ট দিয়ে দিয়েছেন। আমরা ওঁর সঙ্গে ঘুরব দুবাই।

ড্রাইভার যখন পাকিস্তানি, রেস্তরাও হবে তাঁর ভাই বেরাদরের, সেটাই স্বাভাবিক। একপেট খিদের মুখে বাদশাহী মশলার সুগন্ধ আমাদের পাগল করে দিল। বিরিয়ানি আর অ-বিরিয়ানি, দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা। আমি শেষের দলে কারণ সৌরভ গাঙ্গুলিসহ (এটা কি সত্যি না মিথ?) আরও অনেক বাঙালির মতো আমারও বিশ্বাস, কলকাতার আলু দেওয়া বিরিয়ানিই সেরা। আমরা খেলাম চেনাশুনো শোয়ার্মা রোল। পাতলা রুটির মধ্যে চিকেন আর স্যালাড দিয়ে মোড়ানো। কলকাতার লেবানিজ খাবারের দোকানে পাওয়া যায়। শেষপাতে মোমোর মতো দেখতে একটা মিষ্টি, খেজুরের রসে চোবানো। ঠিক হল, অনেক কিছুই আমরা দেখব পথচলতি, নামব না। জুলাই মাসে এত গরম, পা রাখা যাচ্ছে না রাস্তায়। সোজা গিয়ে থামব জুমেইরা বিচে। ততক্ষণে রোদ পড়ে আসবে। পারস্য উপসাগরে সূর্যাস্ত দেখব। এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে আরব সাগরের। ভাবা যায়, একসময় নাকি ছোট একটা জেলেদের গ্রাম ছিল দুবাই। সমুদ্রে ঝিনুক সেঁচে মুক্তো খোঁজাই ছিল বড় কাজ। ষাটের দশকে তেলের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই ঘুরে গেল ভাগ্যের চাকা। সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর সাত রত্নের সেরা কোহিনুর হয়ে উঠল দুবাই। মাঝেমাঝেই গাড়ি থামিয়ে আমাদের এটা সেটা দেখাচ্ছিলেন চালক, কখনও বিচিত্র স্থাপত্যের বাড়ি (যেটা দুবাইতে প্রচুর), কখনও বা চোখধাঁধানো শপিং মল, কখনও অভিজাত পাড়া। চোখ টানল দুবাই ফ্রেম। আটচল্লিশ তলা উঁচুতে আছে অবজারভেশন ডেক, যেখানে দাঁড়ালে গোটা দুবাই শহরটা ফ্রেমবন্দি হয়ে ধরা দেয় চোখে। তবে বুর্জ খলিফার ওপরে ওঠার পরিকল্পনা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা এখানে ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল’ হয়েই চলে যাবেন। তবে তারিফ করার মতো দুবাই ফ্রেমের আর্কিটেকচার, বিশেষ করে সোনালি-রুপোলিতে মেশা এর ঔদ্ধত্য। শেষ দুপুরের রোদে একেবারে যেন খাপখোলা তলোয়ার!

যত পশ্চিমে যাওয়া, বেলা যেন ফুরোতেই চায় না। যাই-যাই করেও একটুকরো রোদ ঝুলে থাকে আকাশের কোণে। ফটো তোলার সময়ে ঠিক টুক করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লেন্সে। অমনি ঝলমলে হয়ে ওঠে মুখগুলো। ঠিক সে-রকম হয়ে আছে এখন জুমেইরা বিচ। দেদার ছবি তুলে, বালিতে হেঁটে, সাগরে পা ভিজিয়ে, ঝিনুক কুড়িয়ে, দূরে জুমেইরা বুর্জ আল আরব মোবাইল ক্যামেরায় জুম করে দেখেও সে আলো ফুরলো না। বরং কনে দেখা আলো এসে ভরিয়ে দিল ‘মন কেমনের দিস্তা’। এমন সুযোগ ছাড়া যায়! আরও একপ্রস্থ ফটো সেশন হল সবাই মিলে। বুর্জ আল আরব বুর্জ খলিফার মত বিখ্যাত না হলেও, স্থাপত্যের দিক থেকে কম কিছু নয়। সৈকত থেকে একটু দূরে সমুদ্রের ভেতরে তৈরি করা দ্বীপে একটা সাততারা হোটেল। ড্রাইভার সাহেবের কাছে শুনলাম, কোন ম্যাজিকে বালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এত উঁচু বাড়ি। অনেকটা নীচে কংক্রিট পাইল করে, ওপরের জমিতে পাথর আর কংক্রিট দিয়ে বেঁধে তবে দাঁড় করাতে হয়েছে স্থাপত্যের এই বিস্ময়কে। শুনে নতুন করে আর অবাক হলাম না যে, এই হোটেলে আছে আন্ডারওয়াটার রেস্তরা। বলেছিলাম না, দুবাই খোদার ওপর খোদকারি করতে ওস্তাদ! সব তৈরি করতে পারে। জুমেইরা পাম হল কৃত্রিমভাবে তৈরি দ্বীপ। চেন অফ রেস্তরা যেমন হয়, তেমন এই কোম্পানির তৈরি আইল্যান্ড চেন। তারই কে ফ্রন্টে আছে শাহরুখ ফ্যানেদের ফ্যান্টাসি বাংলো জন্নত। মুম্বাইয়ের মন্নতের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা নিশ্চয়ই। এবার ড্রাইভার সাহেবের উৎসাহ দেখে কে! পুরো খেলার মাঠের ধারাবিবরণী। ‘এই বিলাসবহুল দোতলা বাংলো শাহরুখকে উপহার দিয়েছেন নাখিল বলে দুবাইয়ের এক ডেভেলপার। চোদ্দ হাজার স্কোয়্যার ফুট জমিতে তৈরি হয়েছে বাড়ি। গৌরী খান থাকতে আর কেই বা এর অন্দরসজ্জা করতে পারেন! অবশ্যই সরাসরি সৈকতে যাওয়া যায় এই বাংলো থেকে। ছ-ছটা বেডরুমের এই বাড়িতে কিং খানের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা বারান্দার এককোণে একটা চেয়ার যেখানে বসে নীল অতলের দিকে তাকিয়ে উনি কফি খান।’ ইত্যাদি-ইত্যাদি। আমার মেয়ে ও তার বয়সি সহকর্মীরা মনে হল জাদুহত। কিন্তু হায়, মন্নতের মতোই জন্নতও ‘দূর গগনের তারা’। একটু উকিঝুঁকির বাইরে বাকিটা অধরা।
অন্য সব সৈকতের মতো এখানেও রয়েছে প্রচুর ক্যাফে, সি ফুড রেস্তরা, স্যুভেনিরের দোকান। আমরা বসলাম একটা ক্যাফের সামনের খোলা জায়গায়। সাগরছোঁয়া দমকা হাওয়ায় গরমটা কমলেও, লক্ষ করলাম, পায়ের নীচ থেকে হল্কা উঠছে, যেটা কিন্তু রাত দশটা পর্যন্ত একইরকম ছিল। এই গরমে পাগলে কফি খাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু আমি ভাবলাম। আরবিয়ান কফি না চেখে যাই কীভাবে! অন্যরা অবশ্য আমাকে সঙ্গ দিল না। তাতে কী? কিং খান স্টাইলে আমি নীল নির্জনে সুগন্ধি আরবি কফির মৌতাতে ডুবে গেলাম। এই তো জীবন কালীদা!