‘সকলের তরে সকলে আমরা,/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’
‘সুখ’, কামিনী রায়।
এৎসুকো মাঝ বয়সে এসে স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তিনি যখন জাপান ছেড়ে বহু বছর আগে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তাঁর মনে আশা ছিল নতুন জীবন সুন্দর হবে। তা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু তিনি সেদিনও জানতেন এবং পরবর্তী কালে সেটা প্রমাণিতও হয় যে, বড় মেয়ে কিকো ইংল্যান্ডের জীবনে খুশি হবে না। কিকো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল এমন পর্যায়ে যে, সারাদিন নিজেকে সে ঘরবন্দি রাখত। সে শুধু ডিনার টেবিলে রাখা খাবারটুকু নিতে ঘরের বাইরে আসত আর তারপরেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। বহির্জগতের সঙ্গে এর চেয়ে বেশি কোনও সম্পর্ক সে রাখেনি। এৎসুকো বুঝেছিলেন, মেয়ে তাঁর থেকে অনেক দূর চলে গিয়েছে। কিন্তু এই দূরত্বের কী কারণ, কেন এমন কিকো করত, তার হদিশ এৎসুকো পাননি।
আরও পড়ুন: সমপ্রেম আইনসিদ্ধ হওয়া যেমন জয়, তেমন সামাজিক ট্যাবু-র বিরুদ্ধে লড়াইও জারি রাখতে হবে!
কাজুও ইশিগুরো রচিত ‘আ পেল ভিউ অফ হিলস’ উপন্যাসে এৎসুকোর বড় কন্যা কিকো সবার থেকে দূরে যেতে-যেতে, শেষে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল। আত্মহত্যা কি এমনই? এৎসুকোর মতো আমরাও কি কখনও টের পাই না আমাদের প্রিয়জনেরা কেন নিজেদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়? যে-কোনও ব্যক্তির আত্মহননের অনেক কারণ থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা তো থাকেই, সঙ্গে জীবনের নানা ব্যর্থতা, মানসিক আঘাত, দুর্ব্যবহার, আর্থিক অনটন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ আমাদের এত দীর্ণ, বিচ্ছিন্ন করে দেয় যে, আত্মহত্যা ছাড়া একটি মানুষের আর কোনও পথ থাকে না। যেমন, ভারতে একজন যৌনসংখ্যালঘু মানুষ ছোটবেলা থেকে অপব্যবহারের শিকার হন। তাঁকে বিভিন্ন ধরনের টিটকিরি, হেনস্থা, অত্যাচার এমনকী খুনের হুমকির মধ্যে দিয়েও যেতে হয়। কেন? কারণ, তিনি বিসমতান্ত্রিক সমাজে সমকামী। কারণ, তিনি জন্মের সময় পাওয়া লিঙ্গপরিচয়ে খুশি নন, তিনি সে-অবস্থার রূপান্তর চান। এই সেদিন পর্যন্ত এ-দেশে যৌনসংখ্যালঘু মানুষেরা ছিলেন আইনের চোখে অপরাধী।
অধুনা বিলুপ্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৭, সমকামী-রূপান্তরকামী সহ সকল সমান্তরাল লিঙ্গযৌনতার মানুষদের, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করত। এখন সে-আইন উঠে গেছে বটে কিন্তু আজও বৃহত্তর সমাজে যৌনসংখ্যালঘু মানুষেরা ঘৃণার শিকার নন কি? যাঁদের জীবন এমনিতেই নরক করে রাখার চেষ্টা করে সমাজ ও রাষ্ট্র, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য, তাঁদের অনটন আর তাঁদের আত্মহনন নিয়ে সেই সমাজ আর রাষ্ট্র আদৌ চিন্তিত হবে কি?
সমীক্ষা বলছে, যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের মধ্যে শতাংশের বিচারে প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ জন মানুষ জীবনে অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন! শুধুমাত্র নিজেদের লিঙ্গ ও যৌনপরিচয়ের জন্য তাঁরা বাড়ির লোকের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, কখনও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, গৃহহিংসার বলি হয়েছেন, স্কুল-কলেজ-কোচিং-এ যৌনহেনস্থা সহ নানা রকম হিংসার মধ্যে দিয়ে যেতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন— যার জন্যে অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি, আবার সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক কাজ বা কর্মক্ষেত্র অনেকে পাননি কেবলমাত্র সমকামী-রূপান্তরকামী বলেই। একটা অদৃশ্য বয়কট যেন তাঁদের ঘিরে থেকেছে। এক্ষেত্রে সমকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের ওপর চলা নিঃশব্দ অত্যাচার খানিকটা ভিন্ন হলেও হিংসার বাস্তবতাটা সমান। সমকামী-উভকামী মানুষরা বহু ক্ষেত্রে তাঁদের যৌনপরিচয় আড়াল করতে বাধ্য হন সামাজিক বয়কট থেকে বাঁচতে। এতে তাঁদের মানসিক চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আবার রূপান্তরকামী মানুষদের রূপান্তরের লড়াই যেহেতু তাঁদের শরীরেই দৃশ্যমান, সেহেতু তাঁরা প্রথম থেকেই রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে হিংসা-হেনস্থার শিকার হয়ে থাকেন। তাঁদের উত্যক্ত করা, হাসির পাত্র বানানো, তাঁদের ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা করে যুগপৎ অসম্মান ও অপমান করা এ-হেন জীবনগুলোয় পাহাড়প্রমাণ মানসিক চাপ ও বিষাদ বয়ে আনে। এসব কারণে তাঁদের মধ্যে বেড়ে যায় আত্মহননের প্রবণতা। কিন্তু এই আত্মহত্যার বিরূদ্ধে আমরা যদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি তবে সুষ্ঠু সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন কি একেবারে জালিয়াতি মনে হবে না? আমাদের প্রিয়জনেরা কেন তাঁদের লিঙ্গ-যৌনপরিচয়ের জন্য আমাদের মধ্যে থেকে নিজেদের সরিয়ে নেবেন? কেন তাঁরা ঘৃণিত হবেন? কিন্তু সেই শুশ্রূষা আর সাহচর্যের সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলব কীভাবে? বলা হয়, আত্মহননের পথ বেছে নেবার আগে একজন মানুষ তাঁর কাছের, চারপাশের লোকগুলোকে সংকেত দেন। হয়তো পুরোটা বলতে পারেন না কিন্তু নিজেকে চিরতরে সরিয়ে নেবার আগে তিনি জানাতে চান তাঁর আশাহীন, উপায়হীন অবস্থার কথা। কিন্তু আমরা যদি এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি যেখানে একটি একক মানুষ কিংবা একটি গোষ্ঠীর অনেকগুলো মানুষ ইতিমধ্যেই নানা রকম বৈষম্যের সম্মুখীন তবে কোন সাহচর্যের হাত আমরা বাড়িয়ে দিতে পারব? এক্ষেত্রে চাই সমানতা। একজন যৌনসংখ্যালঘু মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির মত সকল অধিকার পান, যদি কোনও কিছু থেকে বঞ্চিত না হন, তবে এই মানুষগুলোকে অবসাদের অন্ধকার থেকে বাঁচানো সম্ভব। সমাজটা কেবল বিসমকামী মানুষদের নয়। সব লিঙ্গযৌনপরিচয়ের মানুষদের। তাই বিবাহ, সন্তান-পালন, সম্পত্তি হস্তান্তরের অধিকার শুধু বিসমকামী মানুষরা পাবে, এমন বৈষম্য চলতে পারে না। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কর্মক্ষেত্রে আইন করে সুরক্ষা দিতে হবে। আর সরাসরি উত্যক্ত করা তো বটেই সমাজ মাধ্যমেও যদি কেউ কারও লিঙ্গ-যৌনপরিচয় টেনে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে, অপমানিত করে (যাকে সাইবার বুলিইং বলে) তাহলে সেই অপরাধের বিরূদ্ধেও সঠিক আইন প্রণীত হওয়া দরকার। লিঙ্গ-যৌনপরিচয়ের পাশাপাশি একজন নাগরিকের আরও যেসব পরিচয় থাকে জাত-ধর্ম-বর্ণ সংক্রান্ত, সেগুলিও রক্ষা করতে হবে। ধরা যাক, একজন তথাকথিত, জন্মকালে-ন্যস্ত নারী পরিচয়ের মানুষ রূপান্তর চাইছেন পুরুষ লিঙ্গে, তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির। এ-দেশে তাঁর লিঙ্গ, যৌন ও ধর্ম পরিচয় এবং আর্থিক অবস্থান যদি সুরক্ষিত রাখতে হয়, তবে সেই সদিচ্ছা সরকারকে পোষণ করতে হবে। এমন অনেক বহুস্তরীয় পরিচয় নিয়ে ভারতের যে-কোনও নাগরিক জীবন যাপন করতে পারেন এবং একমাত্র সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সব রকম বৈষম্য নির্মূল হতে পারে। আর বৈষম্যই যদি না থাকে, তাহলে দেশের যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি অন্যায়, অবিচার, হেনস্থা-হিংসা কিংবা কোনও রকম অত্যাচার ঘটতে পারে না। অবসাদের অন্ধকারের ডুবে আমাদের প্রিয়জনদের আর আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয় না। গত ১০ সেপ্টেম্বর ছিল আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। আমাদের আপনজনেরা যাতে কখনও অকালে হারিয়ে না যান আমাদের তা সব সময়ে খেয়াল রাখতে হবে।