সংবদ মূলত কাব্য: পর্ব ১৭

Representative Image

আমার ‘পরিবর্তন’

স্কুলে মাস ছয়েক পড়িয়েছিলাম। সে-সময়েই কলকাতা থেকে ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনী নামে একটি প্রতিষ্ঠান ‘শিলাদিত‍্য’ নামে একটি সাহিত‍্যপত্রিকা বের করেছিল। সে-সময়ে ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনী পরিচিত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল, কারণ, এই প্রকাশনী থেকেই বের হত তখনকার খুব জনপ্রিয় খেলার পত্রিকা ‘খেলার আসর’। ওই সময়ের বালক, কিশোর, তরুণদের কাছে ‘খেলার আসর’ পত্রিকাটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। ‘খেলার আসর’ সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল, ‘শিলাদিত‍্য’ ছিল মাসিক, পরে বোধহয় পাক্ষিক পত্রিকা হয়েছিল। আর-একটি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা, নাম ছিল ‘পার্সপেক্টিভ’, বের হত ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনী থেকে। ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীর মালিক ছিলেন অশোক চৌধুরী। তিনিই ছিলেন সব ক’টি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।

আরও পড়ুন: উৎপলকুমার বসু যেদিন বিদেশ থেকে ফিরে যেদিন কফিহাউসে এলেন, ওঁকে দেখে নিরাশ হয়েছিলাম! মৃদুল দাশগুপ্তর কলমে সংবাদ মূলত কাব্য পর্ব:১৬…

আমাদের শ্রীরামপুরের সোমনাথদা (মুখোপাধ‍্যায়), রমাদি (ঘোষ) ‘শিলাদিত‍্য’-তে দু’-একবার কবিতা লিখেছিলেন। ওঁরা আমাকে বললেন ‘শিলাদিত‍্য’-তে কবিতা পাঠাতে। সোমনাথদা আমাকে বললেন, বাঙাল, লেখা পাঠা। টাকা দেয়।
‘শিলাদিত‍্য’-তে আমার কবিতা বের হয়ে গেল। ওয়েলিংটনের কাছে ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীর অফিস। ওর কাছাকাছিই সোমনাথদার ইএসআইয়ের অফিস। সোমনাথদাই আমাকে নিয়ে গেলেন; ‘শিলাদিত‍্য’, ‘খেলার আসর’-এর ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীর অফিসটি দেখিয়ে দিয়ে সোমনাথদা ঢুকে পড়লেন তাঁর নিজের ইএসআই অফিসে। আমি ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীতে ঢুকলাম ‘শিলাদিত‍্য’-র লেখক কপি আর সাম্মানিক নিতে।

একটি কাউন্টারে যাওয়া মাত্রই আমার নাম দেখে দিয়ে দেওয়া হল ‘শিলাদিত‍্য’ পত্রিকাটি। কাউন্টারের ভদ্রলোকটি বললেন, সাম্মানিকের জন‍্য মিনিট ১৫ অপেক্ষা করতে হবে, অন‍্য একটি কাউন্টার দেখিয়ে তিনি বললেন, ওই কাউন্টারটি ১২টায় খুলবে।

রিশেপশনে সোফায় বসে আমি ‘শিলাদিত‍্য’ পত্রিকাটি উল্টে-পাল্টে দেখলাম। সেটি আমার ঝুলিতে সযত্নে রেখে, বের করলাম সুনীল মিত্র সম্পাদিত ‘বিভিন্ন কোরাস’ পত্রিকাটি, সদ‍্য প্রকাশিত সংখ‍্যাটি আমার ঝোলায় ছিল। ‘বিভিন্ন কোরাস’ পত্রিকাটিও উল্টে-পাল্টে দেখে আবার ব‍্যাগে ঢোকাতে যাচ্ছি, পাশে বসা একজন বললেন, পত্রিকাটি একটু দেখব? আমি তাঁর হাতে দিলাম ‘বিভিন্ন কোরাস’। আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখা অরি বারব‍্যুসের চিঠিটি পড়তে থাকলেন, আমার অনুবাদ। ছোট চিঠি, ছাপায় দেড়পাতা। সময় লাগল না। পড়া শেষ করে ভদ্রলোক বললেন, আপনি অনুবাদ করেছেন? ‘বিভিন্ন কোরাস’-এ প্রচ্ছদের কোণটিতে নিজের নামটি লিখেছিলাম। আমি বললাম, হুঁ। ভদ্রলোক এবার উঠে দাঁড়ালেন, আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, টাকা নিতে যাব এবার ওই দিকের কাউন্টারে। ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি একবার আমার সঙ্গে ওপরে আসবেন? আমি বললাম টাকাটা আগে নিয়ে নিই? তিনি বললেন বেশ। তুলে নিন, আমি অপেক্ষা করছি।
২০ টাকা পেলাম। তখনকার দিনে যথেষ্ট। এবার ওই মানুষটি আমাকে নিয়ে গেলেন ওপরের তলায়। ওপরের তলায় একটি হলঘর, ছোট আকারের সেখানে কয়েকটি ঝকঝকে নতুন টেবিল-চেয়ার সাজানো। তবে কেউ বসে নেই। একধারে পার্টিশন করে একটা অফিস ঘর, সেখানেও চেয়ার টেবিল। ওই অফিস ঘরের চেয়ারটিতে বসে, মুখোমুখি চেয়ারে আমাকে বসিয়ে ভদ্রলোক ড্রয়ার থেকে বেশ কিছু কাগজ আমাকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো ঝরঝরে বাংলায় অনুবাদ করে এক সপ্তাহ পর আমাকে এনে দেবেন? হেডিং-ও দিয়ে দেবেন। আমরা সেজন‍্য টাকা দেব। তখন আমার বয়স ২২/২৩, আমি ভাবলাম, বেশ মজা তো!

তখনই ভদ্রলোক আমাকে জানালেন নতুন একটি বাংলা নিউজ ম‍্যাগাজিন বের হবে এই ইত‍্যাদি প্রকাশনী থেকে। সাপ্তাহিক। তারই প্রস্তুতি চলছে। আমি দেখলাম আমাকে যে টুকরো-টুকরো কিছু কাগজ দেওয়া হয়েছে, তা দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ থেকে বেরনো ন‍্যাশনাল ইংলিশ নিউজপেপার থেকে ছোট-ছোট খবর কেটে নেওয়া, যাকে বলা হয়, নিউজপেপার কাটিংস। যে-সব খবর আকর্ষণীয়, চমকপ্রদ, তারই কাটিংস।

ভদ্রলোক আমাকে জানালেন তাঁর নাম ধীরেন দেবনাথ। দেখে আমি ভাবলাম, আমাদের সোমনাথদার বয়সী, ৩০/৩২।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিল সাহাদের তাঁত কারখানা। সেই তাঁতবোনার শব্দে পুলকিত আমি কিশোর বয়সে কবিতায় লিখেছিলাম— ইটাক খিটাক বাজে নার্ভে হ‍্যান্ডলুম। ধীরেন দেবনাথের দেওয়া নিউজ পেপার কাটিংসগুলিও আমাকে সেইরকম পুলকিত করে দিল। বাড়িতে বসে সেসব মজাদার টুকরো খবরগুলির অনুবাদ করে ফেললাম আমি। ইন্দোরে এক চোর এক সংগীতশিল্পীর বাড়িতে কেবল বাদ‍্যযন্ত্রগুলি চুরি করে নিয়ে গেছে। তখনকার হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় একটি গান থেকে আমি এই খবরটির হেডিং করলাম— চুরালিয়া হ‍্যায়…। মালকানগিরির গ্রামে মড়ক ছড়িয়ে পড়েছে হাঁসের মৃত‍্যুর। ঘরে-ঘরে মারা যাচ্ছে হাঁস, সেই টুকরো খবরের শিরোনাম করলাম-হংস বংশ ধ্বংস।
এক সপ্তাহ বাদে আবার গেলাম ইত‍্যাদি প্রকাশনীতে, ধীরেন দেবনাথকে দিলাম ওই পেপার কাটিংসের অনুবাদ। সেগুলি খুটিয়ে পড়লেন ধীরেন দেবনাথ। তারপর মুখ তুলে বললেন, আপনি আমাদের পত্রিকায় জয়েন করবেন? এসব ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা।

কাজে-কর্মে ওই আগস্ট মাসে কয়েকবার ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনী যেতে হয়েছিল খুচরো খবরের অনুবাদ ধীরেনদাকে দিতে ওই প্রকাশিতব‍্য সংবাদ পত্রিকার জন‍্য। সে-সব খুচরো খবরে পত্রিকাটির রাজ‍্যে-রাজ‍্যে, দেশে-দেশে এবং জেলায়-জেলায় বিভাগ চালু হয়েছিল। এক-এক পাতার ওই তিনটি বিভাগের দায়িত্ব ধীরেনদা আমার হাতে দিয়েছিলেন।
স্কুলে দশম একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই আমার সাংবাদিক হওয়া বাসনা ছিল। খবরের কাগজের পোকা, বরাবর রেডিওর খবর শোনায় আমি ছিলাম নেশাগ্রস্ত। আর ওই সময় থেকেই হাওয়া-বাতাস ছিল খবরে-খবরে আলোড়িত। সে-কারণেই সম্ভবত কয়েক বছর পর বিষ্ণু দে লিখে ফেলেছিলেন, ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য।’

স্কুলে দশম একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই আমার সাংবাদিক হওয়া বাসনা ছিল। খবরের কাগজের পোকা, বরাবর রেডিওর খবর শোনায় আমি ছিলাম নেশাগ্রস্ত। আর ওই সময় থেকেই হাওয়া-বাতাস ছিল খবরে-খবরে আলোড়িত। সে-কারণেই সম্ভবত কয়েক বছর পর বিষ্ণু দে লিখে ফেলেছিলেন, ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য।’

স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৮-এর ১ সেপ্টেম্বর আমি ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীর ‘পরিবর্তন’ পত্রিকাটিতে যোগ দিই। ওই দিনই ‘পরিবর্তন’ নামের সংবাদ সাপ্তাহিকটির প্রথম সংখ‍্যা বের হয়। সে-সময়ে বেশ কয়েকটি বাংলা, ইংরেজি সংবাদ পত্রিকা প্রকাশিত হত। পরিবর্তনের আগে এ-ধরনের সংবাদ পত্রিকা বের হয়েছিল, মনে পড়ছে ‘ধ্বনি’-র কথা, লন্ডনের ‘টাইম’ ম‍্যাগাজিনের আদলে হলেও বেশিদিন চলেনি। তবে ট‍্যাবলয়েড বাংলা সাপ্তাহিক ‘দর্পণ’ খুব চলত, আর-একটি সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’-এরও অনেক পাঠক ছিলেন। টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের সঙ্গে রবিবারে দেওয়া হত ‘সানডে’ ম‍্যাগাজিন। সমর সেনের সম্পাদনায় বের হত ইংরেজি ম‍্যাগাজিন ‘ফ্রন্টিয়ার’। বাংলার বাইরে থেকে বেরনো ইংরেজি পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি, রিডার্স ডাইজেস্ট— এসব পত্রিকার পাঠক এ-রাজ‍্যেও অনেক ছিল। এক কথায়, তখন মানুষ বই পড়ত, পত্র-পত্রিকা পড়ত।

ওই প্রথম সংখ‍্যাটি থেকেই ‘পরির্বতন’-এ থাকত একটি প্রচ্ছদ কাহিনি। ধীরেনদার ভাবনায় সমসাময়িক বিষয়াদিতে চমকপ্রদ এবং সাড়া জাগানো প্রচ্ছদ কাহিনি দ্রুত পরিবর্তন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সে-সব কথা পরে, আগে বলি ওই ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরটিতে কী ঘটল!

দিব‍্যি আমি ট্রেনে চেপে হাওড়া যাই, হাওড়া স্টেশন থেকে সরকারি লাল বাসে ৮ পয়সার বাসে ওয়েলিংটনে ‘ইত‍্যাদি’ প্রকাশনীর ‘পরিবর্তন’ অফিসে যাই। সেপ্টেম্বরের তিনটি সংখ‍্যা ‘পরিবর্তন’ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে, চতুর্থটি মাসের শেষ সংখ‍্যা প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ‍্যায় বাড়ি ফেরার পথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। নেটে দেখছি সেই তারিখটি ১৯৭৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। বাড়ি ফিরে আর ঘুরতে, আড্ডা দিতে বেরতে পারলাম না। সে কী বৃষ্টি! সে কী বৃষ্টি!
এ-রাজ‍্যে দক্ষিণবঙ্গে, উত্তরবাংলাতেও বন‍্যার অভিজ্ঞতা অনেকের আছে। বছর-বছর বৃষ্টি মানেই বন‍্যা, এমন অঞ্চলও আছে বাংলায়। কিন্তু ১৯৭৮-এর বন‍্যা কলকাতা ও তার চারপাশের শহুরে অঞ্চল ও জেলাগুলিকে যেভাবে জলমগ্ন করেছিল, তা ভয়াবহ, ভয়ংকর। ৭দিন ধরে বিরতিহীন বৃষ্টি। টানা বৃষ্টিতে মনে হত, থামবে তো। আমাদের বাড়ি একতলা, চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে তার অর্ধেক ডুবে গিয়েছিল। বৃষ্টির কারণে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঁচু সিঁড়িতেই বসে বসে ছিলাম। ওই সিঁড়িতেই জাদুকৌশলে তোলা উঁনুনে আমার মা রোজই তখন খিচুড়ি রাঁধত। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে তাঁত কারখানা মালিক মিহিরলাল সাহার দোতলা বাড়ি, আশপাশের দোতালা বাড়িতে অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের পাশের বাড়ির বুড়ি, যার ভালো নাম সুপ্রীতি, তাকে সাপে কামড়েছিল। পরে জানা যায়, ঢোড়া সাপ, নির্বিষ, কিচ্ছুটি হয়নি। তবে সলিল, কী আশ্চর্য নাম ছিল তার, আমার বন্ধু সলিলের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, জলে ভাসছিল। ডাক্তারি পড়ত সে। সপ্তাহখানেক আগে তার কলকাতার বন্ধুরা লিটিল ম‍্যাগাজিন করবে বলে সলিল আমার একগুচ্ছ কবিতা নিয়েছিল। সলিলের মৃত‍্যুর পর কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছেলেমেয়েরা যে স্মরনিকা প্রকাশ করে, তাতে কবিতাগুলি সলিলের নামে প্রকাশিত হয়।

ট্রেন বাস সমস্ত পরিবহন (নৌকা ও জলযান ছাড়া) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৩ নন্বর বেসরকারি বাস ছিল হুগলির গর্ব। ডাকবুকো ও অকুতোভয় এই বাস প্রতি ৫ মিনিটে একটি বাস, এভাবে শ্রীরামপুর -বাগবাজার যাওয়া আসার। চতুর্থদিনে তুমুল বৃষ্টির ভেতরে ৩ নং বাস ঘোষণা করে বসল। স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বাসস্ট‍্র‍্যান্ডের কাছেই আমাদের বাড়ি। ‘পরিবর্তন’-এ আমার নতুন চাকরি। রাজ‍্যে-রাজ‍্যে, দেশে-দেশে-র লেখা আমার ড্রয়ারে চাবি দেওয়া আছে। অতীব ভাবনায় আমি ৩ নং বাসে চড়ে বসলাম। আমার মত গুটিকয় মরিয়া নাছোড় যাত্রী নিয়ে গঙ্গাতীরের জিটি রোড ধরে সে বাস ভাসল। যেন কখনও স্টিমার, কখনও মুহূর্তকালের ডুবোজাহাজটি।