ভৌগোলিক দিক থেকে অনেক আলাদা হলেও, আইরিশ ও বাঙালিদের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মিল উল্লেখযোগ্য। বাংলা ও আয়ারল্যান্ড তুলনামূলকভাবে ছোট জনগোষ্ঠী হয়েও, অনেক বেশি প্রভাবশালী ও গুণসম্পন্ন সাহিত্য নিয়ে এসেছে। আয়ারল্যান্ড বিশ্বকে দিয়েছে চারজন সাহিত্যে নোবেলজয়ী। বাংলা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে—প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নোবেলজয়ী। দু’টি অঞ্চলই দীর্ঘদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই দু’জায়গাতেই একসময়ে সাহিত্য ছিল রাজনৈতিক চেতনা, জাতীয় পরিচয় আর সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র।
আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস যেমন গ্যালিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনে, জাতীয়তাবাদী আবেগকে সাহিত্যের মাধ্যমে নতুন করে গড়ে তোলেন, তেমনি বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার ভেতরে, জাতীয় আত্মার এক শিল্পিত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। উপনিবেশ-পরবর্তী যুগেও আইরিশ ও বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা জাতির আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ভাষার ভেতরে লুকিয়ে থাকা শ্রেণি-সংগ্রাম নিয়ে সচেতন থাকেন। আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিক গোঁড়ামি, বা বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সামাজিক অনুশাসন— এই নৈতিক কাঠামো দু’জায়গাতেই তৈরি করেছে সামাজিক বিভাজন, যা সাহিত্যে বারবার ফুটে উঠেছে। বহু জোয়ার-ভাটা পেরিয়ে এই দুই সাহিত্য-সংস্কৃতি বর্তমানে ভিন্ন গতিপথে। আইরিশ সাহিত্য যেখানে বলিষ্ঠ ভাবে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিচ্ছে, আধুনিক বাংলা সাহিত্য যেন সেই পথ থেকে অনেকটাই দূরে।
আরও পড়ুন: গুগির মতে, কাজের কোনও নারী-পুরুষ হয় না!
লিখছেন অমৃতা সরকার
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, বিশেষ করে গদ্য সাহিত্যে, আইরিশ সাহিত্য নীরব অথচ গভীর এক পুনর্জন্মের সাক্ষী। এই পুনরুজ্জীবন শুধু নতুন লেখকের আগমন বা বিষয়বস্তুর আধুনিকতার জন্য নয়— বরং তা ভাষা, কাঠামো, সংবেদন এবং সামাজিক আত্মসচেতনতার একটি যৌথ বিবর্তনের ফল। এই পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্রে রয়েছেন ক্লেয়ার কিগান, স্যালি রুনি, সারা বাউম, মাইক ম্যাককরম্যাক, ডোনাল রায়ান, পল মারে এবং নাইম ক্যাম্পবেলের মতো লেখকেরা। তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে, ধর্মীয় নিপীড়নের ছায়া, শ্রেণিগত টানাপোড়েন, যৌন রাজনীতি, অভিবাসনজনিত দ্বন্দ্ব এবং নিঃসঙ্গতার মনস্তত্ত্ব। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই বিষয়গুলো উঠে আসে সংযত, গভীরভাবে পরিমিত ভাষায়, যা আগের আইরিশ সাহিত্যের শব্দচাতুর্য-নির্ভর ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে, এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করে।



উদাহরণস্বরূপ ক্লেয়ার কিগানের ‘Small Things Like These’ একটি বাহুল্যবর্জিত গল্প হলেও, তার সামাজিক আর রাজনৈতিক ভাষ্য এতটাই গভীর যে সেটা অল্প সময়েই আধুনিক আইরিশ গদ্যের সংযমী চেতনার এক স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’-র শ্রেণিসংগ্রামকেই যেন আধুনিক সময়ের বয়ানে লেখা। সেরকমই স্যালি রুনির Normal People বা Conversations with Friends উপন্যাসগুলোতে প্রথাগত বয়ান-পদ্ধতির ঝরঝরে আধুনিকতা। তবুও এই গদ্য স্যামুয়েল বেকেটের মতোই, ভাষাহীনতাকে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করে—যেখানে সোজা, নিরাসক্ত বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, প্রবল সামাজিক অসাম্য ও অনুভূতির প্রকাশ। অথবা নতুন সাহিত্যে বিন্যাস নিজেই হয়ে উঠেছে সাহিত্যচর্চার জায়গা। মাইক ম্যাককরম্যাকের ‘Solar Bones’ একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস যা একটানা এক বাক্যে লেখা— কোনও সংলাপচিহ্ন বা পরিচ্ছেদ বিভাজন নেই। এই ধরনের গঠনগত সাহসই প্রমাণ করে, আইরিশ সাহিত্য আজ শুধু যে নতুন গল্প বলছে তা না, নতুনভাবে গল্প বলারও পথ খুলছে।


বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেও এটাই দেখা যাবে— যেসব সাহিত্যিক যুগান্তকারী কাজ করেছেন, তাঁরা কোনও না কোনওভাবে নিজের ভাষাকে পুনরায় নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা, জীবনানন্দের প্রতিসরণধর্মী কাব্যভাষা, অথবা হাঙ্গরিয়ালিস্ট আন্দোলনের প্রতিরোধমূলক চেতনা— সবই বাংলা ভাষাকেই যেন নতুন স্বর দিয়েছে। কিন্তু বিংশ শতকের শেষভাগে এসে বাংলা সাহিত্য এক ধরনের নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিয়েছে। সমকালীন সাহিত্যের কেন্দ্রে উঠে আসে, শহর-কেন্দ্রিক চিন্তাশীলতা। নকশাল আন্দোলন, দেশভাগ, হাংরি আন্দোলনের অস্থিরতার পর সেভাবে বাংলা সাহিত্যের পুনর্গঠন দেখা যায় না। অবশ্যই এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছে—সুবিমল মিশ্র তাঁর কোলাজ ও দৃষ্টিকোণ-বিন্যাসে ভাঙলেন প্রচলিত আখ্যানপদ্ধতি; নব্বইয়ের দশকে জয় গোস্বামী তাঁর ‘উন্মাদের পাঠ্যক্রম’ কাব্যগ্রন্থে বা ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ কাব্য-উপন্যাসে একটি আত্মগত অথচ সাংগঠনিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বাংলা কাব্যচর্চার নতুন অধ্যায় শুরু করলেন।
কবিতার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের বিশাল ঐতিহ্য এবং সক্রিয় কাব্যচর্চা— আজও বিশ্বসাহিত্যে অনন্য। যেখানে আইরিশ সাহিত্যে সাম্প্রতিক নবজাগরণ মূলত গদ্যনির্ভর, সেখানে বাংলা কবিতা একদিকে যেমন শক্তিশালী মৌখিক ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি তা নাগরিক, পরাবাস্তব এবং রাজনৈতিক কণ্ঠের দিক থেকেও গভীর ও বিস্তৃত। জয় গোস্বামী-শ্রীজাতর হাত ধরে যে বিভিন্ন কণ্ঠ ও কাঠামো নিয়ে পরীক্ষামূলক পদ্য, তা আজ নতুন কবিদের মধ্যেও দেখা যায়— যেমন বিকাশ গায়েন বা নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়। এর নজির আইরিশ শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যেও খুব সীমিত। বাংলা কবিতার সংযত, সংকেতময় নীরবতা— যেমন শঙ্খ ঘোষ, বিনয় মজুমদার বা প্রারম্ভিক পর্বে জয় গোস্বামীর লেখায় দেখা যায়— তা অনেকটা মিলে যায় আধুনিক আইরিশ কথাসাহিত্যের গুছিয়ে রাখা শোক, সংহত বেদনাবোধের সঙ্গে। একরকম যেন কাব্যিক সংকোচনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা গদ্য।
২০০০ সালের পরের বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে মূলধারায়, যেন দুই মেরুর টানাপোড়েনে আটকে আছে। একদিকে আছে নান্দনিক নস্টালজিয়া— গ্রামীণ উপকথা, রবীন্দ্র অনুরণন; অন্যদিকে শহুরে কাহিনি, বিশেষত ধারাবাহিক উপন্যাসে। রাজনৈতিক লেখালেখি হয় সোচ্চার, তাই সূক্ষ্মতা হারায়; নয়তো সম্পূর্ণভাবে মৌন। দেশভাগ অথবা সাতের দশকে বাংলাদেশের দগদগে ইতিহাসের প্রভাব, বাংলা সাহিত্যে যতটা দীর্ঘসূত্রী সমকালীন আইরিশ সাহিত্যে তা অনেকটাই বেশি। লিঙ্গ-রাজনীতি বা মাতৃত্বের জটিল সামাজিকতা নিয়ে তিলোত্তমা মজুমদার বা কিছু অংশে সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর, সেরকম বলিষ্ঠ লেখার ধারাবাহিকতা কি বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায়?
আইরিশ সাহিত্যে সাম্প্রতিক নবজাগরণ মূলত গদ্যনির্ভর, সেখানে বাংলা কবিতা একদিকে যেমন শক্তিশালী মৌখিক ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি তা নাগরিক, পরাবাস্তব এবং রাজনৈতিক কণ্ঠের দিক থেকেও গভীর ও বিস্তৃত।
অপরদিকে, আইরিশ সাহিত্যিকরা তাঁদের বিংশ শতকের উত্তরাধিকারকে শ্রদ্ধা করেও, তার সীমা অতিক্রম করেছেন। তাঁরা ইয়েটস বা হিনি হয়ে ওঠার চেয়ে, কিগান বা রুনি হওয়াকে বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁরা ঐতিহ্যকে বহন করছেন না, বরং তাকে প্রশ্ন করে নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছেন। জেমস জয়েস যেখানে ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন আর শেমাস হিনি, ভাষাকে মাটির মতো উলটে-পালটে নেন। নতুন আইরিশ লেখকরা শল্যচিকিৎসকের মতো পুরোনো ক্ষতের গভীরে ছুরি চালান। অর্থাৎ, তাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে যেমন গর্ব করেন, তেমনি তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন থাকেন। বাংলা সাহিত্যে এই দ্বৈত অবস্থান আজ প্রায় নেই। হয় উত্তরাধিকারকে গৌরবের জায়গায় বসিয়ে রাখা হচ্ছে, নয়তো সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পালটে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। এর মাঝের জায়গাটা নতুন দিকের খোঁজ দিতে পারে।
আইরিশ সাহিত্যিকদের এই সাহসিকতা শুধুমাত্র কাব্যিক বা গদ্যরীতির সীমায় আবদ্ধ নয়, বরং তা সমাজ, রাজনীতি এবং ধর্মীয় গূঢ়তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনাকেও স্পর্শ করে। এখানেই তাঁদের সাহিত্যিক শক্তি— বিরাটকে উচ্চারণ না করেও, ছোটকে গভীরভাবে বলার ক্ষমতা। এই তুলনা থেকে একটি বড় বিষয় উঠে আসে— ভাষা ও কাঠামো নিয়ে সাহিত্যে সাহস দেখানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আইরিশ সাহিত্যিকরা সাহিত্যের গঠনকে ভেঙে ফেলছেন, ছোট-ছোট বাক্যে, সাদা কাগজে স্পেস রেখে, অথবা চুপ করে থেকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাইছেন। তারা জানেন— শব্দ না বললেও পাঠক অনুভব করবে। এখানে পাঠকের ওপর আস্থা রাখা হয়— তাঁরা যেন এই নতুন সাহিত্য-চেতনার গ্রাহকই শুধু নন, একরকম স্রষ্টাও। বাংলা গল্প ও উপন্যাস তুলনায় অনেক বেশি মুখরতায় বিশ্বাসী, অনুভবের জায়গা অনেক সময় শব্দ দখল করে রাখে।


আইরিশ ও বাংলা সাহিত্যকে পাশাপাশি রাখলে বিশ্লেষণ করা যায় যে, সাহিত্যে কণ্ঠস্বরের নীরবতা, পুনর্জন্ম, ও রাজনৈতিক চেতনার ভিন্ন প্রকাশ। আজকের আইরিশ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, একটি সংস্কৃতি টুকরো-টুকরো হয়ে নিজেকে ভেঙে কীভাবে নতুনভাবে গড়ে তুলছে— অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিক জিজ্ঞাসা, আর ভাষার আঙ্গিক। এটা দীর্ঘদিনের বহুমুখী প্রচেষ্টার ফল। ইংরেজি ভাষার সাহিত্যজগতে আয়ারল্যান্ড তার আকারের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে— এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সহায়তা (Arts Council Ireland), ইংরেজি ভাষার বৈশ্বিক বিস্তার এবং ব্রিটিশ প্রকাশনা জগতের পেশাদারিত্ব। দেশের মধ্যে হিন্দি ও কন্নড় সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার ফলে যে, আন্তর্জাতিক মানের লেখা উঠে আসে তা সম্প্রতি দেখা গেছে। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বিপুল হলেও, প্রতিষ্ঠানগত স্থবিরতা এখন বড় সমস্যা। বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের পরিকাঠামো দুর্বল, পারিশ্রমিক সামান্য, আর বাংলা শিক্ষার ক্ষয়ের ফলে, স্কুলস্তর থেকেই ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে সচেতন পাঠকশ্রেণি। প্রতিভাবান বাঙালি লেখকদের অনেকেই আজ ইংরেজিতে লিখছেন, কিংবা কলকাতার সাহিত্যমহলের কেন্দ্রবিন্দু থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন।
মূলস্রোতের সাহিত্য পত্রিকার থেকে যদি কাঠামোগত ভাঙচুর বা ভাষার পরীক্ষানিরীক্ষার প্রেরণা আসে তাহলে নতুন সাহিত্যভঙ্গির বিকাশ হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব আইরিশ সাহিত্য অতিক্রম করেছে— সমাজের নানা স্তর থেকে আসা নতুন লেখক-কবিদের সুযোগ দিয়ে। লিটল ম্যাগাজিনে বা ইন্টারনেট-ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখা যায় যে বাঙালির সাহিত্য-চর্চা ও সেরকমই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি লেখকদের ভেতরে যে প্রবাহ আছে— প্রয়োজন কেবল তাকে নতুন কাঠামো, নতুন প্রকাশভঙ্গি এবং নতুন পাঠকচেতনার সঙ্গে যুক্ত করা।