ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মেডিসিনারি : পর্ব ৬

    শ্যামল চক্রবর্তী (February 26, 2025)
     

    একটি হত্যা ও আমার ডাক্তারিজীবন

    ১৯৮৯ সালের ঘটনা। তখন আমি সবে গাইনিতে মাস্টার্স শেষ করে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। প্রথম দিন একজনমাত্র রোগী এসেছেন। দ্বিতীয় দিন একজন রোগীকে দেখে আমি মশা-মাছি তাড়াচ্ছি, বসে আছি রোগীর অপেক্ষায়। গম্ভীরভাবে বসে, সামনে একটা জার্নাল রাখা। হঠাৎই একজন প্রবেশ করলেন ঘরে। আমি তাঁর দিকে না তাকিয়েই লেটারহেডটা টেনে নিয়ে রাশভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাম?’

    উত্তর এল, ‘পেশেন্টঅ নয় পেশেন্টঅ নয়, ঠাকুরঅ অছি!’

    আমি এবার ভাল করে তাকালাম লোকটির দিকে। দেখি, একটা হলুদ ধুতি, আর ধবধবে সাদা গেঞ্জি, বাঁ-কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। হাতে একটা সাজি, যেমনটা থাকে উড়ে পুরুতদের কাছে।

    ভদ্রলোক আবারও বললেন, ‘গণেশঅ অছি?’

    আমি কী উত্তর দেব, বোঝার আগেই আবার ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল— ‘আমারঅ অছি।’

    আরও পড়ুন : সত্যজিৎ রায়কে আইসিইউ বেড থেকে একজন ডেকে উঠলেন মানিকদা বলে! শান্তনু নন্দীর কলমে মেডিসিনারি পর্ব ৫…

    ভদ্রলোক এবার ঝোলা থেকে একটি রংচটা গণেশ ঠাকুর বের করে আমার হাত জড়ো করে তার ওপর সেই ঠাকুরটি রেখে, আমাকে রীতিমতো প্রদক্ষিণ করে কীসের একটা বেশ জল ছেটাতে ছেটাতে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। আমি স্টেথো হাতে বিস্ময়ারূঢ় দাঁড়িয়ে। সেই মন্ত্রর মধ্যে একটি আমার মনে আছে, ‘প্র্যাকটিসায় নমঃ!’ আর যেটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা হল— সিদ্ধিদাতায় নমঃ!

    মন্ত্র পড়া শেষ হলে আমার হাত থেকে গণেশকে নিয়ে, আমাকে একরকম মুক্ত করে ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবং তার পরেই একটি আশ্চর্য প্রশ্ন করলেন।

    ‘ডেলি হব, না মান্থলি হব?’

    আমার আবারও বিস্মিত হওয়ার পালা! লোকটা বলে কী!

    আমিও খানিক আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলাম, ‘কীসের? ট্রেনের?’

    আবারও উত্তর এল, ‘যাত্রা অছি যাত্রা অছি! সামনে বিরাটঅ যাত্রা অছি! শুনো, ডেলি করিলঅ, গোটে (একজন) পেশেন্টেরঅ ফিজ দিবা! মান্থলি করিলঅ, সাতটো পেশেন্টেরঅ ফিজ দিবা!’

    বুঝলাম, ব্যবস্থাটা অনেকটা ট্রেনেরই মতো। যতদূর মনে পড়ে, তখন আমি তিরিশ টাকা ফিজ নিতাম। দেখলাম, মান্থলিটাই সুবিধেজনক। সেকথা জানালাম।

    এরপর ভদ্রলোক যা করলেন, তা আরও আশ্চর্য! আমার গলা থেকে স্টেথোটা নিয়ে, নিজের বুকে তার চেস্টপিসটা বসিয়েই, তৎক্ষণাৎ, আবার সেটা খুলে ফেলে বললেন, ‘ধাঁই কিরি করি ধাঁই কিরি কিরি মেশিনঅ চলিলা!’ অর্থাৎ কিনা, খুব তাড়াতাড়ি মেশিন চলল। একথা বলেই, একটি স্টিলের বাটি থেকে শ্বেতচন্দনের একটি টিকা আমার গলায় দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করে তিনি বেরিয়ে চলে গেলেন। সেই আমার প্রথম রোগীর বদলে, ঠাকুরদর্শন।

    এরপর থেকে মান্থলির জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন তিনি আসতেন। আর সপ্তাহে আসতেন বড়জোর দু’দিন, যেহেতু ব্যাপারটা মান্থলি। অর্থাৎ কিনা, বিনা টিকিটে যাত্রীকে অনুমতি দেওয়া হবে না।

    এটা যেমন একেবারে মজার একটা অভিজ্ঞতা, তেমন একটি মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাও হয়েছিল।

    এই ঘটনার ঠিক দু’বছর পরের ঘটনা। তখন আমার প্র্যাকটিস বেশ জমে উঠেছে। আমি ঠিকই করেছিলাম, সরকারি চাকরি করব না। সেই সময় বছর ২১-এর একটি মেয়ে আসত আমার কাছে। নাম, পাপড়ি গুহ (নাম পরিবর্তিত)। মেয়েটিকে আমি নিজের বোনের মতোই আপন করে নিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে ওর স্বামীও আসত। খুব ব্যক্তিগত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েই গিয়েছিল।

    মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হল। একদিন মেয়েটির স্বামী তাকে নিয়ে এল, কারণ মেয়েটির তখন ব্লিডিং হচ্ছে ক্রমাগত। ডাক্তারি পরিভাষায়, একে বলে, ‘থ্রেটেনড অ্যাবরশন’। অর্থাৎ, গর্ভপাতের আশঙ্কা আছে। ওষুধপত্তর বিশেষ দিলাম না। কারণ, এইসময় বিশ্রাম নেওয়াটাই জরুরি।

    তক্ষুনি এসে ঢুকলেন এক বয়স্ক মানুষ। ভদ্রলোকের নাম এখনও মনে আছে, প্রশান্ত বসু। একাত্তরে সর্বহারা হয়ে ওপার থেকে তিনি চলে এসেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সীমান্ত পার হতে গিয়ে ‘রাজাকার’-দের অত্যাচারে নিহত হয়েছিলেন। পাপড়ি ছিল অনাথ, ওকে তিনিই মানুষ করেছিলেন। আমার ঘরে ঢুকে, ‘ডাক্তারবাবু, আমার মেয়েকে ওরা খুন করেছে’— একথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন সেই বৃদ্ধ।

    আমি তখন পার্টটাইম একটা চাকরি করি, ১২টা থেকে ৪টে অবধি। সেই চাকরি করে বাড়ি ফিরছি বাইকে করে, হঠাৎ মেয়েটির স্বামী এসে ধরল। বলল, ‘এখনই চলুন ডাক্তারবাবু! পাপড়ি কেমন করছে।’ মেয়েটির বাড়ি ছিল আমার বাড়ির কাছেই। বড়জোর বিশ-তিরিশ গজ দূরত্ব হবে হয়তো। আমি চলে গেলাম। আমি ধরে নিয়েছিলাম, হয়তো মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। তাই ব্লিডিং বেশি হচ্ছে। কিন্তু ঘরে ঢুকে যা দেখলাম, তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দেখলাম, পাপড়ি একদিকে কাত হয়ে শুয়ে। মাথাভর্তি জল, মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। আমি যেতেই মেয়েটির স্বামী, ভাসুর, শাশুড়ি— তিনজনেই কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘কিছু করুন, কিছু করুন’ বলে হাতে-পায়ে ধরে প্রায়, যেন ধরেই নিয়েছে তারা, কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।

    আমার ডাক্তারি চোখ কিন্তু যা বলল, তাতে বুঝলাম, এই রোগীকে আমার ছোঁয়াই উচিত নয়। একটা ট্যাক্সি ডেকে তৎক্ষণাৎ মেয়েটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। তখন কলকাতা জুড়ে হলুদ-কালো ট্যাক্সি চলে।

    মেয়েটি হাসপাতালে চলে গিয়েছে, আমিও বসে আছে চেম্বারে। কিছুক্ষণ পর একটা ফোন এল লোকাল থানা থেকে। আমাকে ফোন করে জানানো হল, যে রোগীকে আমি হাসপাতালে পাঠিয়েছি, সে ‘ব্রট ডেড’। মানে মৃতাবস্থাতেই নাকি তাকে হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছনো হয়েছে।

    পরিস্থিতিটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম, অফিসারের কথায় নিশ্চিত হলাম। তিনি আমাকে খুব স্পষ্টভাবে বললেন, ‘আমাদের না জানিয়ে কিন্তু আপনি কোনও স্টেপ নেবেন না।’

    তক্ষুনি এসে ঢুকলেন এক বয়স্ক মানুষ। ভদ্রলোকের নাম এখনও মনে আছে, প্রশান্ত বসু। একাত্তরে সর্বহারা হয়ে ওপার থেকে তিনি চলে এসেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সীমান্ত পার হতে গিয়ে ‘রাজাকার’-দের অত্যাচারে নিহত হয়েছিলেন। পাপড়ি ছিল অনাথ, ওকে তিনিই মানুষ করেছিলেন। আমার ঘরে ঢুকে, ‘ডাক্তারবাবু, আমার মেয়েকে ওরা খুন করেছে’— একথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন সেই বৃদ্ধ।

    ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘আমি থানা থেকেই আসছি।’ থানায় ওঁর করা অভিযোগের নথি আমাকে দেখালেন। সেটা দেখেই, যা বোঝার আমি বুঝে গেলাম।

    আমি আর ওঁকে কী সান্ত্বনা দেব! পাপড়িকে তিনিই বড় করেছেন, গ্র্যাজুয়েট করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। অনেক আশাভরসা ছিল তাঁর পাপড়িকে ঘিরে। ওঁর জগৎটা শূন্য হয়ে গেছে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় কিছু কুচো, মেজ, ছোট, মাঝারি নেতাদের ফোন আসা শুরু হল। আমার ল্যান্ডলাইন সেদিন বেজেই চলেছে। ‘ডাক্তার, ডেথ সার্টিফিকেটটা দিয়ে দাও! তোমারই তো পেশেন্ট!’ প্রায় হুমকির সুরে কথাগুলো এসে পৌঁছল। আমি যদিও নিজেকে স্থির, সংযত রাখলাম। উত্তর না দিয়েই ফোনটা রেখে দিচ্ছিলাম।

    এরপর থানা থেকে আরেকটা ফোন এল। সেই ফোনে আমাকে অফিসার বললেন, ‘আপনাকে কারা কারা ফোন করছে, নামগুলো নোট করে রাখুন। মাথায় রাখবেন, এটা কিন্তু গৃহবধূ হত্যা মামলা।’

    তখন গৃহবধূ হত্যার ঘটনা খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখা হত।

    সেই অফিসার আরও বললেন, ‘লালবাজারের অ্যান্টি মার্ডার স্কোয়াড থেকে আপনাকে যোগাযোগ করা হবে। আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু চেম্বারের শাটারটা আজ নামিয়ে রাখবেন। আমরা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

    পাড়ার ডাক্তার, ফলে কথা তো আর চাপা থাকে না। বাবা ঘুরে এসে বলল, ‘পাড়া একেবারে থমথমে হয়ে গিয়েছে।’

    সন্ধে ছ’টার সময় লালবাজার থেকে কয়েকজন অফিসার এলেন। একেবারে সিনেমার মতোই ধোপদুরস্ত, পেশিবহুল। তাঁরা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। এই কেসটা দাঁড় করানোর জন্য ইউ আর দ্য অনলি পার্সন।’ তারপর আমার জবানবন্দি নেওয়া হল। ওঁরা আমাকে আশ্বস্ত করলেন, ওঁরাই সিকিউরিটি দেবেন, আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবি আঁকার আর্টিস্ট এল। মৃতদেহ কীভাবে ছিল, কোনদিকে কাত হয়েছিল ইত্যাদি প্রশ্ন করে একটি ছবি আঁকা হল। সেই ছবি ব্ল্যাক ফেল্ট মাইক্রোটিপ পেন দিয়ে আমি আবার সংশোধন করলাম। পুলিশ চলে গেল। উল্লেখ্য, এর মাঝে কিন্তু সেসব নেতারা হাওয়া!

    মধ্যরাত তখন। ঘুম আর আসতে চায় না। একটি মেয়েকে সকালে দেখেছি, রাতের মধ্যেই সে মৃত! এসবের মাঝেই পুলিশের গাড়ি পাড়া কাঁপিয়ে এল। এবং পাপড়ির স্বামী, ভাসুর, শাশুড়িকে নিয়ে গেল গাড়ি করে।

    ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট হয়েছিল কি না খেয়াল নেই এখন, তবে মনে আছে, কোর্টে দাঁড়িয়ে ওই তিনজনকে আমি শনাক্ত করেছিলাম। পাপড়ির স্বামী যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই রক্তচক্ষু, সেই হাড়হিম করা দৃষ্টি আমি কোনওদিন ভুলব না। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওদের যাবজ্জীবন হয়েছে। ২০ বছরের কারাবাস।

    এখনও ভাবলে গর্ব হয়, অন্তত সেদিন সত্যর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook