একা এবং কয়েকজন
সাতের দশকের গোড়ায় কয়েক বছর নিয়মিতভাবেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে যাওয়া শুরু করলাম। প্রায় প্রতি শনিবার শ্রীরামপুর থেকে কফি হাউস যেত সমবয়সি বন্ধু পল্লব, পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বেলাভূমি’ নামে যে পত্রিকা বের করত; ওর সঙ্গেই কফি হাউস যেতাম আমি। ওই সময়ে কফি হাউসেই, আমাদের সময়ের, অর্থাৎ যাদের সত্তর দশকীয় কবি বলা হয়, তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। মনে আছে, কাছাড় থেকে কলকাতায় চলে এলেন রণজিৎদা, মভ রঙের বুশ শার্ট ছিল তাঁর পরনে। কফি হাউসের দরজা দিয়ে ঢুকেই দুটি টেবিল জোড়া লাগিয়ে বসতাম আমরা। শীতকালে এসেছিলেন কমলদা (চক্রবর্তী), পরনে ছিল পেতলের বোতাম-সাঁটা নাবিকদের কোট। হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার পর যে তিন মাস রেজাল্টের অপেক্ষার ছুটি, তখন ঢের-ঢের বার কফি হাউসে গিয়েছি। তখন ভাবতাম, কলকাতায় এই অঞ্চলে কলেজে ভর্তি হওয়া গেলে তোফা! তবে এরপর গ্রামগঞ্জে ঘোরাঘুরিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে লাগলাম। তাও তখনও মাসে একবার কি দু’বার কফি হাউস। কফি হাউসের অদূরে সূর্য সেন স্ট্রিটে ছিল এক টুকরো স্বর্গ, ‘অধুনা’, কৃষ্ণগোপাল মল্লিক নামে যেন এক গ্রহান্তরের মানুষের গড়া প্রকাশনালয়; সেখান থেকে বের হত ‘গল্পকবিতা’ নামের আশ্চর্য কাগজটি।
আরও পড়ুন: কলেজ স্ট্রিটে গোধূলিবেলায় দুটো বোমা ফাটার শব্দ হল, কফি হাইসে কোনও হেলদোল হল না! সংবাদ মূলত কাব্য-র তৃতীয় পর্ব…
আমি তখন উত্তরপাড়া কলেজের ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। দেবু, মানে আমার বন্ধু দেব গঙ্গোপাধ্যায়, যে কিনা বহুকাল নিখোঁজ, তখন ওই শিয়ালদা গোয়েঙ্কা কলেজে পড়ত, আমার চেয়ে উঁচুতে। সে কৃষ্ণগোপালকে চিনত। দেবু অধুনা থেকে কিনে এনেছিল ভাস্করদার (চক্রবর্তী) ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’, তুষার রায়ের ‘শেষ নৌকো’, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য’। আমরা সবাই হই হই করে পড়তাম। দেবু আমাকে বলেছিল, ‘গল্পকবিতা’য় কবিতা দিয়ে দে। পাঠিয়েছিলাম।
সে-কবিতা ডাকে ফেরত আসে। দেখি, সে-লেখার কোণে ‘চলতে পারে’ লিখে সই করেছেন কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। পাশে ‘আর একটা কবিতা চাওয়া যাক’ লিখে সই করেছেন দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দুজনকে দেখতে আমি কলেজ স্ট্রিটে রওনা হই। দেবু আমাকে সাবধান করে বলে দিয়েছিল কৃষ্ণগোপাল নতুন কাউকে দেখলে গালাগাল দিয়ে শুরু করেন। তুমুল খিস্তিই তাঁর সম্বোধন! আমি প্রস্তুত ছিলাম। ফলে এইরকম শুরু হয়—
কৃষ্ণগোপাল: ***
আমি : *** ***
এরপর সহাস্যে বয়স্ক কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের সঙ্গে সদ্যতরুণ আমার সখ্য জমে ওঠে। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা ছেড়ে কৃষ্ণগোপালদা ‘গল্পকবিতা’ বের করছিলেন, সঙ্গে অধুনা নামের সেই প্রকাশনী। চমৎকার গদ্য, গল্প লিখতেন কৃষ্ণগোপাল। দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আমার অগ্রজ হলেও, আমাদের সমসময়ের কবি। আমি গালিগালাজে কৃষ্ণগোপাল মল্লিককে টক্কর দেওয়ায় দেবপ্রসাদদার চোখেমুখে সত্তর দশকীয় গর্বের ঝলক লাগে। এরপর ‘গল্পকবিতা’য় আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এই অধুনা থেকেই তৎকালে বের হয়েছিল ‘অসীম রায়ের গল্প’, উদয়ন ঘোষের ‘অবনী বনাম শান্তনু’— এসব অসামান্য বই, যা বিনোদনের সাহিত্যের বিপরীতধর্মী। (পরে অবশ্য একটি বাণিজ্যিক পাক্ষিক ছেপেছিল অসীম রায়ের অতিবিখ্যাত একটি গল্প ‘অনি’)। উদয়ন ঘোষ আসানসোলে অধ্যাপনা করতেন, তাঁর ‘অবনী বনাম শান্তনু’ টানা গদ্যে যতিচিহ্নহীন দীর্ঘবাক্যে রচিত মারকাটারি ভাষার খেলা! বলব কী, আমরা এসব পড়ে বড় হয়েছি, মানে প্রাপ্তবয়সে পৌঁছেছি।
এক দুপুরে হল কী, দেখা গেল, সূর্য সেন স্ট্রিটে পুঁটিরামের অদূরে অধুনা-র সামনে পোস্টার উঁচিয়ে ধরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ধর্নায় বসে, সঙ্গে কয়েকজন তরুণ-তরুণী। মিটিং, মিছিল, পথসভার কলকাতা তখন। লোক জমে গেল, বিকেলে খবর পেয়ে আমরাও; তৎকালে আমাদের বলা হত ‘ছোটরা’, উঁকি দিলাম ভিড়ে। দু’একজন পুলিশকর্মীও উঁকি দিচ্ছিলেন। ব্যাপারটা কী? দেখা গেল, সেই মৌন ধর্না-অবস্থানে সন্দীপনদাদের পোস্টারে লেখা, লেখক তাঁর বই বিক্রির প্রাপ্য রয়ালটি পাচ্ছেন না। সম্ভবত সারাদিন কৃষ্ণগোপাল মল্লিক তাঁর প্রকাশনী-সংলগ্ন গৃহে ছিলেন না। সন্ধ্যায় তিনি ফিরতে, বোধ করি আলোচনায় বিষয়টি মিটে যায়। তবে এর পরের সংখ্যা ‘গল্পকবিতা’-য় বের হল সম্পাদক কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের একটি বিজ্ঞপ্তি: অধুনা দপ্তরের সামনে অশান্তি সৃষ্টির জন্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দুই সহযোগী তুষার রায়, ভাস্কর চক্রবর্তীকে গল্পকবিতা থেকে এক্সপেল করা হল।
তখন, সেই তখন, মফস্সল শহরগুলিতে লিটিল ম্যাগাজিনগুলির উদ্যোগে কবিসম্মেলন হত। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর ‘ছেঁড়া তমসুক’ চলচ্চিত্রটিতে এরকম একটি কবিসম্মেলন রেখেছেন। শ্রীরামপুরে ‘শীর্ষবিন্দু’ পত্রিকাটি ১৯৬৮ সালে বের হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর শীতে একটি কবিসম্মেলনের আয়োজন হত শ্রীরামপুরের গোলোকধাম নামে একটি সাবেকি বাড়ির ঠাকুরদালানে। বাড়ি না বলে প্রাসাদোপম অট্টালিকাই বলা উচিত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়— অনেকেই এসেছেন ওই কবিসম্মেলনে। তাঁদের অগ্রজ কবি অরুণ মিত্রও এসেছেন, এসেছেন শান্তিকুমার ঘোষ। কখনও তুষার রায়, ভাস্কর চক্রবর্তী, কালীকৃষ্ণ গুহ। এখনও গঙ্গার ধারে নেতাজি সুভাষ রোড (আমার বাবা বলত কুইন্স স্ট্রিট, ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার নামে নাম ছিল রাস্তাটির) গোলোকধামের ফটকের সামনে রোয়াকটি দেখে মনে পড়ে ওই তো ওই রোকাকে বসে শক্তি সিগারেট ফুঁকছিলেন, সামনে দাঁড়িয়ে অমিতাভ দাশগুপ্ত… সবই ঝাপসা, এখন সবই ঝাপসা।
১৯৭০ সালে, বছরটা আমার মনে আছে, আমি তখন সবে একাদশ শ্রেণিতে উঠেছি, সামনে আমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, ওই বছর ‘শীর্ষবিন্দু’র কবিসম্মেলনে এসে আমার অগ্রজ, কিন্তু সমসময়ের কবি ধূর্জটিদা, ধূর্জটি চন্দ আমার কবিতার খাতা থেকে নিয়ে গেলেন আমার সাতটি কবিতা। ১৯৭১ সাল, যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন, সেই ১৯৭১ সালটিতে আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনবার পিছিয়ে হবার পর হয়। রেজাল্ট বের হতে বাবা আমাকে কিছুতেই কলকাতার কলেজে ভর্তি হতে দিল না। কলেজগুলিতে নকশালপন্থী ছাত্র-রাজনীতির কারণে, অভিভাবকোচিত ভীতিতে। বরিশালের ভাষায় যারে কয়, ‘ঘেটি ধইরা হাজির করন’, সেই ভঙ্গিতে বাবা আমাকে হাজির করাল উত্তরপাড়া প্যারীমোহন কলেজে, তার পরিচিত বইরশ্যাইলা অধ্যক্ষ কিরণ গুপ্তের কাছে। ভর্তি হয়ে গেলাম উত্তরপাড়া কলেজে।
আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বন্ধুহীন, নিঃসঙ্গ আমি প্রথমদিন উত্তরপাড়া প্যারীমোহন কলেজে যাওয়ার আগে শুনলাম আমাদের পাড়ার বাবার এক বন্ধুর মেয়ে, কৃষ্ণা সরকার, তাকে আমি কৃষ্ণদি বলতাম, সেও উত্তরপাড়া কলেজে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। বাবা, মা’ও বলল, ‘ওই তো কৃষ্ণার সঙ্গে যাবি, আসবি।’ কলেজে যাওয়ার প্রথমদিন মুখ গোমড়া করে কৃষ্ণাদির সঙ্গে রওনা হলাম। ওই কলেজ যেতে ট্রেনে শ্রীরামপুর থেকে বালি পৌঁছতে হয়। তারপর খালপাড় দিয়ে হেঁটে জি টি রোডে উঠে বাঁ-দিকে খালের সড়কসেতুটি পেরোলেই ডান হাতে উত্তরপাড়া কলেজ (অধুনালুপ্ত ৩ নং বাসেও যাওয়া যেত)। আমরা খালপাড়ের সড়কসেতুটি সবে পেরিয়েছি, কানে এল, উচ্চস্বরে কেউ কবিতা পড়ছেন: ‘ইটাক খিটাক বাজে নার্ভে হ্যান্ডলুম…’
আরে! এ তো আমারই কবিতা! উত্তরপাড়া কলেজের পিচ-সড়কটি ছেড়ে আমি সম্মোহিতের মতো খালপাড়ের বট গাছটির তলে এসে আমাদের কলেজে সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীদের দঙ্গলের পিছনে দাঁড়ালাম। পিছনে-পিছনে এসে দাঁড়াল কৃষ্ণাদিও। বটতলার বেদিটির ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছিলেন এক সিনিয়র দাদা। তাঁকে ঘিরে সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রী আঠারো-কুড়িজন। দূর থেকেই আমি বুঝলাম, ধূর্জটিদার ‘এবং’ পত্রিকাটি বের হয়েছে। সিনিয়র দাদা ওই কবিতাই পড়ছেন। ফিস ফিস করে কৃষ্ণাদিকে বললামও সে-কথা।
কিছুক্ষণ পর কবিতাপাঠ শেষ করে সেই সিনিয়র দাদার নজর পড়ল আমাদের ওপর। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ওই দাদা বললেন, ‘নতুন ছেলে, শুনলে কবিতা? তোমার বয়সি একটা বাচ্চা ছেলে লিখেছে, এই যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও রয়েছে!’ লালবর্ণ মলাটের পত্রিকাটি আমার সামনে মেলে ধরলেন তিনি। আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কৃষ্ণাদি মুখ চেপে হাসছিল।