আমার এক বন্ধু মফস্সল (কলকাতা মেট্রো অঞ্চলের বাইরে আজকাল যে কোনও জায়গাকেই তা বলা হচ্ছে দেখছি) থেকে একলা কলকাতায় এসেছে, কী সব কাজকর্মের খোঁজে। আমি তাকে একদিন চায়ের আড্ডার বাহানায় জিজ্ঞেস করলাম, কী করবি কিছু ঠিক করলি? উত্তরে সে বলল, তার আইডল লাগবে। প্রথমটা উদ্ধার করতে পারিনি, ওর ঠিক কী লাগবে।
গোড়ায় ভাবলাম, এটা বোধহয় এই প্রজন্মের একটা বিশেষ সমস্যা। আমার প্রজন্মকে আমাদের আগের প্রজন্ম একটা ঢালাও ছাঁচে ফেলে দিয়েছেন বটে, কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে আমার গুলিয়ে যায়, ‘এই প্রজন্ম’ ঠিক কোনটা। আমার বয়সের একটা ভাগকে দেখি মোবাইল গেমে টাকা বাজি রাখতে ব্যস্ত, অন্য একটা ভাগ বড্ড হতাশ, কিন্তু তার কারণটা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছে না। অন্য আর এক ভাগ, যারা বইখাতা নিয়ে পড়াশোনা করছে, তারা মুখে-মুখে তর্ক করা আর ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন করার জন্য মা-বাবার কাছে বকা খাচ্ছে।
একটু ভাবতেই বুঝলাম, ও বিশেষ ভুল বা অবান্তর কিছু বলেনি। কারণ ইদানীং, একজন আইডল বা রোল মডেল, মানে এমন একজন মানুষ, যিনি অনুপ্রেরণা জোগাতে পারেন— তাঁর বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগেও যে এই চাহিদা ছিল না তা নয়, তবে এখন একটু বেশি। কারণ কেউ যদি বিখ্যাত হয়ে পড়ে, আর একটা বড় টিভি চ্যানেলে তার ইন্টারভিউয়ের বন্দোবস্ত হয়ে যায়, তখন একজন আদর্শ মানুষের থেকে খুব খানিক অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা বলা অত্যন্ত আবশ্যক। এসব শেখা হয়েছে আমাদের অবশ্য ওই মোবাইল দেখা অনুষ্ঠান থেকেই।
কিন্তু আমার বন্ধুর সমস্যাটা আরও গুরুতর। ও বহু দরজায় কড়া নেড়েও এমন কোনও ঠাঁই পায়নি, যেখানে এমন একজন মানুষ আছেন, যিনি ওর হাজার হেরে যাওয়ার গ্লানিগুলো ভুলিয়ে রেখে, আগামীর জন্য চেষ্টা করতে বলবেন। সব সময়ে তা তিনি বলবেন তাঁর কথা, বকুনি বা বাণী দিয়ে নয়, তাঁর নিরন্তর কাজকর্ম দিয়েও।
ঠিক এইখান থেকেই ওর মুশকিলটা আমি ধরতে পেরেছি। আমার আশেপাশের পৃথিবীতে আমি প্রচুর মিথ্যে আইডল দেখি। বা দিশাহারা বন্ধু দেখি, যারা অবধারিত ভাবে কোনও এক ভণ্ড আইডলের সান্নিধ্যে এসে নিজের সব শ্রদ্ধা অপাত্রে দান করেছে। তাই শুধু এই প্রজন্মকে গালাগাল দিয়ে লাভ হবে না। গন্ডগোল হয়েছে অনেক আগেই। যে বাবা কাকা জ্যাঠা দিদি পিসি কাকিমা মাসিমাদের অনুকরণ করার কথা ছিল, তাঁদেরই আপাদমস্তক জীবনযাপনের মধ্যে কোনও শিক্ষার প্রতিফলনের চিহ্ন নেই, জীবনটাকে কোনও ক্ষেত্রে নিবেদন করার কোনও লক্ষণ নেই। বছরের পর বছর শুধু পড়া জ্ঞান, শোনা রবীন্দ্রসঙ্গীত, দেখা দুটি কথাকলির নাচের অনুষ্ঠান, আর চায়ের আড্ডায় সত্যজিৎ বিশ্লেষণ ছাড়া, প্রাত্যহিক জীবনে তাঁরা এমন কোনও কাজ করেন না, যা দেখেশুনে আমাদের শ্রদ্ধা তৈরি হয়। বা মনে হয়, এঁকে অনুসরণ করা যেতে পারে। বা অন্তত মনে হয়, এই কাজটা আমি করতে পারব না বটে, কিন্তু এঁর কাজ সমাজের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই এই নিষ্ঠাটা অন্তত শিখে নিই।
সেই জন্যই আমার অনেক বন্ধু আইডল হাতড়াচ্ছে। বলছে, এমন এক দাদা বা দিদি চাই, যার কাজ আমাকেও কাজ করতে প্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করবে।
আমার কাছে এই সার্চ মিশনের কোনও সাপ্তাহিক তথ্য নেই। তবে আমি নিজের চারপাশে, থিয়েটার ও পড়াশোনার জগতে অনেক আইডল দেখতে পাই। সেই মানুষগুলো অবশ্য জানেন না, তাঁরা আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার নিরিখে আইডল হওয়ার গুণাবলি পোষণ করেন কি না। তাঁরা নিজেদের অন্তরের তাগিদে কাজ করে যান, দিনের পর দিন।
সে রকম আমার কিছু দাদা-দিদি প্যানডেমিকের সময় ১০০ দিন টানা ভ্যান চালিয়ে জায়গায় জায়গায় খাবার পৌঁছেছেন, নিজেরাই নৌকো টেনে নাম-না-জানা গ্রামে স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ বা ছোট্ট অজানা ভাইয়ের কাজের সন্ধানে বহু কিলোমিটার পায়ে হেঁটেছেন। আমার বন্ধুটিকে এঁদের কথা বলব ভাবছি। এঁরা ওর আইডল হতে পারেন কি না, ও ভেবে দেখুক।