ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ৫৫


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (May 4, 2024)
     

    পুজোর আড়ালে

    এখন মে মাস এলেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যজিৎ-পুজোও সাড়ম্বরে, কিন্তু যারই পুজো শুরু হয়েছে তার সম্পর্কেই যে মেঘ সেমিনার-ঘরের সিলিঙে ঘনায়মান: তার কাল কি গিয়েছে? রবীন্দ্রনাথ কেউ পড়ে না আমরা জানি, কিন্তু সত্যজিৎও কি কেউ দ্যাখে না? এর ঠিক উত্তর দিতে গেলে সমীক্ষা করতে হবে, যা কেউ করেনি, কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়ের হাবভাব দেখে মনে হয় না, তাদের সত্যজিতে কিছু এসে যায়। হয়তো তাঁর এক-আধটা ছবি তারা দেখেছে, কিন্তু সবকটা দেখে ফেলা, বা অন্তত অধিকাংশ দেখে ফেলাকে কেউই কর্তব্য বলে মনে করেনি, এবং তাদের কাছে সত্যজিতের ছবি দুর্ধর্ষ উত্তেজক বলে মনেও হয়নি। সত্যজিৎ তাদের আড্ডা-আলোচনার লিস্টিতেও পড়েন না। সন্দেহ নেই, তারা সব্বাই সত্যজিৎকে প্রাণপণ শ্রদ্ধা করে, করবেই, কারণ বাবা-মা বলেছে, ঠাকুর নমো করো, তাছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতি ঘাড় আপনি নুয়ে আসে না এমন মানুষ কে জন্মেছে, কিন্তু স্ট্যাচু পরিষ্কার আর মাল্যদানের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক বাধ্যতামূলক নয়। তবে ব্যাপার-স্যাপার দেখে বিস্মিত হওয়ার কিচ্ছু নেই, ধৃতিমান তাঁর এক সত্যজিৎ-সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা কি প্রমথেশ বড়ুয়া নিয়ে আলোড়িত থেকেছি? সত্যিই তো, আমরা প্রত্যেকে নিজের যুগে নিজের প্রিয় শিল্পী খুঁজে নিই ও আপ্লুত হই। কোনও সন্দেহ নেই, কিছু চর্চাকারী থাকবেনই, যাঁরা এখনও কালিদাসকে নিয়ে মেগা-উদ্বেল, বা সোফোক্লিস দিয়ে না আঁচিয়ে দিন শুরু করেন না, কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে অধিকাংশের কথা। বাঙালি জাতি এখনও সত্যজিৎকে নিয়ে ম্যারাপ বাঁধছে, কারণ পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকজন তা করতে আগ্রহী। কুড়ি-পঁচিশ কোনওদিনই ‘ওগো টেরোড্যাকটিল কী পেল্লায় পাখি আছিল’ রবে কুহর কাটেনি, নিজস্ব টিয়া বা চড়াইকে কোলেকাঁখে পেলেছে। একটা লোক যত অসামান্য শিল্পই রচুক, তার শিল্প জনতার মধ্যে স্পন্দমান বেশিদিন থাকে না, কিন্তু দীক্ষিতদের মধ্যে বহুযুগ রয়ে যায়। সত্যজিৎ নিশ্চয়ই বারংবার দেখে চলবে চলচ্চিত্র-রসিকরা, যাদের সংখ্যা হয়তো একশো বা চুয়াল্লিশ, কিন্তু ভিড় আর তাঁকে নিয়ে আদিখ্যেতা করবে না। 

    এই শুনলেন কমলকুমারের গদ্যকে প্রণতি জানাচ্ছে, ওই শুনলেন জঘন্য গদ্যকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে। এই বলল ভাস্কর চক্রবর্তী ওয়াও, সেই শ্বাসেই অকথ্য কবির নাম উচ্চারিয়ে জাত সুপার-খোয়াও। রুচির রেঞ্জ খুব চওড়া। তার ওপর আকাশ থেকে বেহ্মতালুর ডগায় এই অনবরত শিল্প-হুড়মুড়, ফলে পেল্লায় কেজি খারাপ জিনিস দেখেশুনে ব্রেন আজি পানসে চাউমিন, যার রেডার-এ ঠিকঠাক সিগনাল আর ধরাই পড়ে না। সত্যি বলতে এই যুগের একটা প্রধান লক্ষণই হল: বহু শিল্পী ও শিল্পবস্তুর খ্যাতি, এবং ক্ষণস্থায়ী খ্যাতি।

    সেটা যে বিরাট ক্ষতি তা-ও নয়, হয়তো লাভই, কারণ শেষ অবধি মহৎ শিল্পীর স্থান তো সেই কতিপয়ের মস্তিষ্কে, যারা মনোযোগী ও রসিক। জীবৎকালে সত্যজিৎ প্রায় কিংবদন্তি হয়েছেন, যা পুরস্কার পাওয়ার ঝেঁটিয়ে পেয়েছেন, এবং সর্বোপরি নিয়মিত নিজশর্তে শিল্পসৃষ্টি করার সুযোগ পেয়েছেন, আর তা থেকে আনন্দ আহরণ করেছেন। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী? শিল্পীর অবসানের পর শিল্প যদি বেঁচে থাকে, তা ঢোল-শহরতের ওপরভাসা শোরগোলে বাঁচার বদলে মুষ্টিমেয় অনুভূতিপ্রবণের লকেটে নিভৃত চিরপ্রিয় হয়ে ঝিকোলেই ভাল। আসলে আমাদের হাহাকার ঘটে, কারণ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমরা যাঁকে নিয়ে নিরন্তর বিস্ময়-স্তম্ভিত থেকেছি, তাঁকে উপেক্ষা করারও কাল এসে গেল! কিন্তু কালের নিয়মের সঙ্গে আরও একটা কাণ্ড অনুধাবনযোগ্য: সাম্প্রতিক কাল এই গ্রহে আগত অন্য সকল কালের তুলনায় বেশি দৃষ্টি-ব্যস্ত। এক গড় মানুষ দিনে মোবাইলে টিভিতে কম্পিউটারে বোধহয় পাঁচ-ছশো ভিডিও দেখেন। মিম, রিল, গান, খবর, সিনেমার ট্রেলর, নেতার বক্তৃতা, বেড়ালের পড়ে যাওয়া, শিশুর গাজর খাওয়া, ননদের সেলফি, ওয়েব সিরিজ, সিরিয়াল, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন। আপনাকে পাতে দুশো খাবার বেড়ে দিলে আপনি বুঝবেন কী করে কোনটা স্বাদু, আর বুঝলেই বা কতক্ষণ সে স্বাদ আপনি রোমন্থন করবেন, পরবর্তী পদ তো হাতছানি দিচ্ছে! এমনিতেই বাঙালি জাতি মুড়ি-মিছরির তফাত বোঝে না। এই শুনলেন কমলকুমারের গদ্যকে প্রণতি জানাচ্ছে, ওই শুনলেন জঘন্য গদ্যকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে। এই বলল ভাস্কর চক্রবর্তী ওয়াও, সেই শ্বাসেই অকথ্য কবির নাম উচ্চারিয়ে জাত সুপার-খোয়াও। রুচির রেঞ্জ খুব চওড়া। তার ওপর আকাশ থেকে বেহ্মতালুর ডগায় এই অনবরত শিল্প-হুড়মুড়, ফলে পেল্লায় কেজি খারাপ জিনিস দেখেশুনে ব্রেন আজি পানসে চাউমিন, যার রেডার-এ ঠিকঠাক সিগনাল আর ধরাই পড়ে না। সত্যি বলতে এই যুগের একটা প্রধান লক্ষণই হল: বহু শিল্পী ও শিল্পবস্তুর খ্যাতি, এবং ক্ষণস্থায়ী খ্যাতি। হু-হু করে প্রতিদিন নয়া গান ছবি চুটকি সিরিজ বিখ্যাত হচ্ছে, আবার সে-ব্যাচের চাটনি চাটা শেষ হতে না হতে পরের ব্যাচের লোক চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তাই একজন চলচ্চিত্রকার বহু বছর ধরে শীর্ষে থাকবেন, কঠিন। এই পরিবেশে সত্যজিৎ দর পেলে অপমানিতও বোধ করতে পারতেন। 

    বাঙালি পরিচালকদের অধিকাংশের মধ্যেই এতটুকু সত্যজিৎ-চিহ্ন দেখা যায় না, সত্যজিতের চিত্র-যত্ন বা চিত্রনাট্য-দড়তা, অনুপুঙ্খের প্রতি নজর, নাটকীয়তা-পরিহার-প্রবণতা অনুপস্থিত থাকে। তার কারণ আর যা-ই হোক, এখনকার ছবি-করিয়েদের প্রখর মৌলিকতা নয়। ঠিকই, সত্যজিৎ বাংলা সিনেমার প্রথা ভেঙে অনন্য।

    ক’বছর আগে সত্যজিতের একশো বছর পূর্তিতে তাঁকে নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি আলোচনা ও লেখা দেখেই সাইরেন বেজেছিল, কারণ তাতে উচ্ছ্বাস ছিল, ভক্তি ছিল, বিশ্লেষণ ছিল না। অর্থাৎ তাঁকেও ভগবান বানানো শুরু হয়ে গেছে। টেক্সটবইয়ে পদ্য ঢুকলেই যেমন নিশ্চিত হয়ে যায়, সেই পদ্যের রস কেউই কখনও উপলব্ধি করবে না, এবং সম্ভবত কবিটিকেও অন্তর থেকে ঘৃণা করবে, তেমনি এই জাত কাউকে বেদিতে বসিয়েছে মানে তার শিল্পের একমেটে উপাসনা চালু। তবে এতে সন্দেহ নেই, এভাবে এত বড় এক শিল্পীর মুছে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক, কারণ তাঁর শিল্প-প্রকরণ ও শিল্পবোধ, তাঁর পর্যবেক্ষণ ও ব্যবচ্ছেদ, তাঁর কৌতুকবোধ ও দরদ আমাদের কাছে এখনও অধরা। এ খুব আশ্চর্য যে বাংলা ছবির ধারা সত্যজিৎ-অনুসারী হয়নি। বাঙালি পরিচালকদের অধিকাংশের মধ্যেই এতটুকু সত্যজিৎ-চিহ্ন দেখা যায় না, সত্যজিতের চিত্র-যত্ন বা চিত্রনাট্য-দড়তা, অনুপুঙ্খের প্রতি নজর, নাটকীয়তা-পরিহার-প্রবণতা অনুপস্থিত থাকে। তার কারণ আর যা-ই হোক, এখনকার ছবি-করিয়েদের প্রখর মৌলিকতা নয়। ঠিকই, সত্যজিৎ বাংলা সিনেমার প্রথা ভেঙে অনন্য। বাংলা সিনেমা এমনিতে অতিকথন-ভারাক্রান্ত, আবেগপ্লাবন-নির্ভর, বুদ্ধিকে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে-দেওয়া। সত্যজিৎ একেবারে উল্টো। কিন্তু সাধারণত এমন অসামান্য শিল্পী একটা সংস্কৃতিতে এলে, তাঁর স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ অনুসৃত হয়, অন্তত কিছুটা গোঁয়ারের মতো, টুকলিবাজির তোড়ে হলেও। যেমন গোদারের জাম্প-কাটকেও মূলস্রোতের ব্যবসা-সর্বস্ব ছবি আয়ত্ত করে নিয়েছে। যেমন সুমন আসার পর মেনস্ট্রিম ছবির গান লেখাও কিছুটা বদলেছে। এখনকার বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের কাজ দেখে মনে হয় না, তাঁরা সত্যজিতের কাছে আদৌ কিছু শিক্ষণীয় আছে বলে মনে করেন। বা হয়তো প্রতিভা এত কম যে সত্যজিতের বৈশিষ্ট্য নেড়েঘেঁটে আত্মীকরণের ক্ষমতাই নেই। যেটাই সত্যি হোক, এমন একটি ব্যাটসম্যান আহত ও অবসৃত হলে তা শোকের ব্যাপার। শেখা বাকি থেকে গেছে, এমন অবস্থায় মাস্টারমশাই বদলি হয়ে গেলে মুশকিল। সেই মাস্টারের ছবিতে মালা দেওয়ার জন্যে হাঁপাহাঁপি করলে হাসি চাপাও খুব মুশকিল।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook