সময় নাচছে
বাক্স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বারবার আবৃত্ত হয়: বাক্স্বাধীনতা মানে, আমার অপছন্দের বাক্য অন্যের বলার অধিকার স্বীকার করা। তাহলে বলতে হয়, আর কিছু না হোক, বাক্স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ বাংলায় ধড়াস আবির্ভূত, কারণ কিছুদিন আগেও টিভি চ্যানেলে এসে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো যেত না। নিজস্ব বৈঠকখানা বা চায়ের দোকানে ‘অমুক সম্প্রদায়ের সব্বাই নোংরা’, ‘তমুক সম্প্রদায়ের প্রত্যেকে খুনি’ আওড়ালেও, প্রকাশ্যে এ-গোত্রীয় উচ্চারণ অভাবনীয় ছিল, কারণ স্পষ্ট ‘ঘেন্নাবাজ’ তকমা পড়ে গেলে সমাজ নীচুচোখে দেখবে। এখন চ্যানেলে-চ্যানেলে এবং অবশ্যই সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বিষ সরাসরি ও সাড়ম্বরে বমনের বহর দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাপারটা অনেকের কাছে গৌরবের উষ্ণীষ। মানে, আমি ওই সম্প্রদায়ের লোকদের ঠেঙিয়ে থেঁতলে দেওয়ার পক্ষপাতী— এ-কথা বললে উচিত-ঠোঁটকাটা, ট্রোল-পরোয়াহীন ও মহাবীর নিজসম্প্রদায়প্রেমী হিসেবে আত্ম-ইমেজ রটাতে পারি। যাঁরা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে নিজেদের দেখেন, তাঁদেরও অনেকে তীব্র প্রতি-ঘৃণা উগরে কর্তব্য সারছেন, কিন্তু এও মানতেই হবে, বহু মানুষ সুসংবদ্ধ যুক্তি দিয়ে এই দ্বেষ-প্লাবন রোধ করার চেষ্টা করছেন, এমনকি টিভি চ্যানেলের তর্কেও প্রায়ই সুস্থ ও ঠান্ডা মাথার স্বর শোনা যাচ্ছে। যেমন কিছু মানুষ মনে করেছে, ক্যামেরা বা মাইকের সামনেও আর ভদ্রতা সৌজন্য রক্ষার কোনও দায়ই নেই, যে কোনও কদর্য আবেগ আছড়াতে পারি, তেমন কিছু মানুষ এই ইতরতার তুঙ্গপ্লাবনেও মূর্ছিত হননি, ‘এর উত্তর দেওয়ার স্তরে আমার শিক্ষা ও রুচি এখনও নামেনি’ বলে উলটোপথে হনহন লাগাননি। তাঁদের কাছে এই ধরনটা আপনাআপনিই অ-গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। সদর্থে বললে, বাঙালির বাক্য-সহিষ্ণুতা অনেক বেড়ে গেছে।
আরও পড়ুন: আজ অতি বিপদের দিনে, যখন প্রায় কোনও জাগ্রত বাঙালি বিশ্বাস করে না যে বাংলার উত্থান ঘটবে, তখন রাজনীতির লোকেরা নিজেদের বদলাবার অঙ্গীকার করতে পারেন না? লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…
এ একরকম উলটো তত্ত্ব প্রচার হল, কারণ এই কুনাট্য রঙ্গের বাড়বাড়ন্তের হেতু: সমাজে সহিষ্ণুতা অনেক কমে এসেছে। নিত্যদিনে নিত্যস্থানে অভদ্রতা দেখেশুনে গা-সওয়া। তাই লোকে অনায়াসে বলতে পারছে, ঝাড়েবংশে পেটাও। এবং তা সাদরে গৃহীত হচ্ছে। এ ভাল লক্ষণ নয়। (এ থেকে দাঙ্গাও উস্কানি পেতে পারে, তবে তা রোধ করা প্রশাসনের সদিচ্ছা সক্ষমতা ও দায়বোধের ব্যাপার)। কিন্তু অশিক্ষার এমন উদ্দাম রমরমার দিনে, অসহিষ্ণুতার ঢালাও সার্কাসে, আমরা গোঁয়ার্তুমি করে পড়ে নিতে পারি যা-খুশি-তা বলার বাধ্যতামূলক অনুমোদনের ক্ষণ, যা শেষ অবধি বাক্স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের ঈপ্সিত স্বর্গ। কোনও সন্দেহ নেই, কয়েকজন টেলিভিশন-অনুষ্ঠান-সঞ্চালক এবং বহু অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতানেত্রীর যত্নলালিত সন্তান এই সংস্কৃতি। যেখানে বিগত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে দায়িত্ববান মঞ্চ থেকে মানুষকে তেড়ে অপমান করা হয়েছে। কোনও বিখ্যাত মানুষকে যাচ্ছেতাই বলতে কারও বাধেনি, অখ্যাত মানুষকে তো নয়ই। কোনও জাতির নামে, সংগ্রামরত সমষ্টির নামে, বিপন্ন ও আর্ত গোষ্ঠীর নামে কুচ্ছিত কথা হানতে জিভে স্ব-সেন্সরের কাঁটা বেঁধেনি। প্রথমটা জনগণ একটু বোমকে ছিল, তারপর সামাজিক মাধ্যম এসে তারও আড় ভেঙে দিয়েছে, সহস্র মিম সত্তায় ডিম পেড়েছে। সাধারণ লোক সেলেব্রিটিকে তুলে আছাড় মেরেছে। তাই আজ উগ্রপন্থী হানা হলে আগল খুলে সবাই যেমন খোলাখুলি দাঙ্গাব্রতী, তেমনই রাজনৈতিক পাণ্ডাকে তার সাম্প্রতিক কুকথা বা কুকাজের জন্য কুচিকুচি কাটতেও কারও বাধে না। এ-ই প্রধান ভরসা: তাদের জন্ম দেওয়া মনস্টার আজ তাদের বিরুদ্ধেও নাগাড়ে লেলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। তাতে বহু বেনোজল ঢুকছে, যে-কোনও যুগসন্ধিক্ষণে ও প্রযুক্তি-কাম-ধারণা সুনামি-কালে ঢুকবেই, কিন্তু হতেই পারে, এই অসভ্যতার পরিব্যাপ্ত হু-হা কেটে যাওয়ার পর, পড়ে থাকবে স্বর্ণগুঁড়ো: অতি অপছন্দের মতামতও দাপিয়ে প্রকাশের স্পর্ধা।
এ-যুগ চলে যদি না-ও যায়, যদি ক্রমশ আরও বিকৃত হয়ে ওঠে আমাদের চারপাশ, তাহলেও এই অর্জন কম নয়। ট্রোল করার মধ্যে যে ভয়ানক ধর্ষকাম আছে, তাকে ধিক্কার জানিয়েও কেন চিনে নিতে পারব না এক-সময়ের অধরা ভিআইপি-দের টেনে নামানোর কপিকল? আমাদের সমাজ শান্ত শালীন ভব্যিযুক্ত ছিল, তার মধ্যে অলিখিত অনুশাসন এও ছিল: আর যা-ই করো রবীন্দ্রনাথ বা রামকৃষ্ণ, মার্ক্স বা নেতাজি, কলকাতা বা কফি হাউসের নিন্দে মচাতে পারো না। এখন, জঘন্য সমাজে, সবকিছু নিয়েই কথা বলা যাচ্ছে, হ্যাঁ, মহাপুরুষদের নামে কিছু বললে (রবীন্দ্রসংগীতে চার-অক্ষর সেঁধালে) ‘মুন্ডু লাও’ হাঁকা হচ্ছে, কিন্তু সত্যি দাঁতালো করাত নিয়ে কেউ ধেয়ে আসছে না, ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপে খিস্তি ঢেলেই ক্ষান্ত দিচ্ছে। এই পবিত্র বেদীর ধ্বংস মন্দ নয়, কারণ তা একইসঙ্গে ক্ষমতার মৌরসিপাট্টাও গুঁড়িয়ে দেয়।
কাশ্মীরে উগ্রপন্থী হানার পর প্রতি মুহূর্তে উগ্রতর পন্থার অকুণ্ঠ প্ররোচনা ও প্রতিজ্ঞা দেখে আতঙ্ক তৈরি হতেই পারে। একটা জনপিণ্ড ‘যুদ্ধ চাই যুদ্ধ কই’ লাল ফেলতে-ফেলতে লাফাচ্ছে, দেখলে দেশপ্রেমের বদলে দেশঘৃণা জাগাও স্বাভাবিক। তেমনই মনে রাখতে হবে, এই একই ‘তুই কী ভাবলি কেয়ার করি না’ পন্থায় একটা রক্ষণশীল সমাজের সামনে সমকামকে সমর্থন করার, তার নাকের ডগায় গে প্রাইড মিছিল বের করার স্পর্ধাও গড়ে উঠেছে।
মান্ধাতা থেকে মেহুল চোক্সী— কেউ কামানের আওতার বাইরে থাকে না। ক’যুগ আগে, যখন টিভি চ্যানেল বলতে ছিল দূরদর্শন, মোবাইলও আবিষ্কৃত হয়নি যে হরিদাস পালও তুলে নিতে পারবে অপরাধের চকিত ফুটেজ, গণমাধ্যমে শাসক দলকে তেমন উগ্রতায় আক্রমণই করা হত না। প্রথমত ওই ভারী ক্যামেরা ও ভ্যান নিয়ে সর্বত্র ছুটে যাওয়াও ছিল শক্ত, গেলেও ততক্ষণে রক্ত ধুয়ে ফেলা ছিল জলের মতো সহজ। তারপর বক্তৃতা বা নিজেদের মুখপত্রে ‘উহা মিথ্যা সংবাদ’ বিবৃতি দেওয়া তো হাতের পাঁচ। এখন প্রযুক্তি এসে, ঘুষ খাওয়া অবধি প্রত্যক্ষ ধরে রাখছে। তাই, তা সত্ত্বেও ঘুষখোরকে দল থেকে বহিষ্কৃত না-করার অনাচার যেমন ঘটছে, তেমন সবাই মিলে ঘুষখোরকে দাপিয়ে বিদ্রুপও জারি। তার চেয়ে বড় কথা, সেই সময় গণমাধ্যমের বে-তোয়াক্কা মানসিকতাও তেমন ছিল না, অনেক বুঝেশুনে, বহু সীমা ও বদ্ধতা মেনে, তবে বিরুদ্ধ-কথা বলা হত। সাধারণ মানুষের তো স্বরের অস্তিত্বের কথাও কেউ ভাবেনি। এই ভদ্র ও শান্ত গুঞ্জরণের উদ্যানে জনপিণ্ড অপেক্ষাকৃত প্রশমিত থাকত বটে, কিন্তু শাসকও অনেক নিশ্চিন্ত থাকত, ফি সপ্তাহে তার কাপড় খুলে যাওয়ার অবস্থা হত না। এখন প্রযুক্তি এসে যেমন হাজারটা চ্যানেল ও লাখকোটি ভ্লগ ও ফেসবুক-মতের জন্ম দিয়েছে, তেমনই রইরই এনে ফেলেছে পথচারী বা দোকানদার অ্যাক্কেরে এই মুহূর্তে মহানিয়ন্তা সম্পর্কে কী ভাবছেন, তা রাখঢাকহীন দেখা-শোনা-পড়ার পরিসর।
কোন দল কোথায় কীভাবে আন্দোলনকারীদের পেটাচ্ছে, বা কোন দলের পেটোয়া গুন্ডা পেটো হাতে প্রিসাইডিং অফিসারকে ভয় দেখাচ্ছে, তা যদি মানুষের চোখের সামনে চলে আসে, তবে একটা ব্যাকরণগত সমীহর অভ্যাস আপনা থেকেই খসে যায়। তাছাড়া বিশ্বময় এত মতামত বার্তা পরামর্শের বিস্ফোরণের মধ্যে পড়ে, ‘ও বাবা, সবই বলা যাচ্ছে তাহলে’ বিস্ময় এবং অনুসরণেচ্ছারও জন্ম হয়। সব মিলিয়ে, ক্রমে লোকের সর্বরঙের শেকল শিথিল হয়েছে। তাতে তার মন ও জিভের সংযম অন্তর্হিত হয়ে কাশ্মীরে উগ্রপন্থী হানার পর প্রতি মুহূর্তে উগ্রতর পন্থার অকুণ্ঠ প্ররোচনা ও প্রতিজ্ঞা দেখে আতঙ্ক তৈরি হতেই পারে। একটা জনপিণ্ড ‘যুদ্ধ চাই যুদ্ধ কই’ লাল ফেলতে ফেলতে লাফাচ্ছে, দেখলে দেশপ্রেমের বদলে দেশঘৃণা জাগাও স্বাভাবিক। তেমনই মনে রাখতে হবে, এই একই ‘তুই কী ভাবলি কেয়ার করি না’ পন্থায় একটা রক্ষণশীল সমাজের সামনে সমকামকে সমর্থন করার, তার নাকের ডগায় গে প্রাইড মিছিল বের করার স্পর্ধাও গড়ে উঠেছে। বাংলা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে মন্ত্রীসান্ত্রিকে হাসির খোরাক করার সাহস তৈরি হয়েছে, বিশাল বেনিয়ার ছেলের প্রাক-বিয়েতে উচ্চণ্ড ঘটাপটা দেখে রকের ছেলেমেয়ে ঘোষিত খ্যাঁকখ্যাঁকে পেট চেপে গড়িয়ে পড়েছে। ঠিকই, বক্তিমে শুনতে যত উত্তেজক, দুনিয়া তেমন রংরঙিন মোটে নয়, বাস্তবে ভাল হচ্ছে কোটিকে গুটিক আর খারাপ রচছে সাতমহলা বুটিক, কিন্তু তাতে এই বিশাল ঢেউয়ের ব্যবহার-সম্ভাবনা ছোট হয়ে যায় না।
অনবরত ঘৃণাবিস্তারের অনন্ত সুযোগে সারা দেশে ছড়াচ্ছে মৌলবাদের সমর্থন, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়িঘর ভাঙা বা জীবন নিয়ে নেওয়ার চূড়ান্ত অন্যায়ও হাততালি পাচ্ছে। হুট করে মনে হতে পারে, এই বদ স্বরগুলোকে চাপা দিতে পারলেই ভাল হত। এদের বাকপ্রয়োগের অধিকারের টুঁটি টেপাই নীতিসম্মত। বরং ফেসবুক আর টিভি চ্যানেল কদিন নিষিদ্ধ হোক বাবা। কিন্তু তা কখনও কাম্য নয়। যদি সংজ্ঞা মানি, তবে এ-ই হল গণতন্ত্রের প্রাণভোমরার প্রকৃত ভনভন। যদি অধিকাংশ মানুষ হিংস্রতাকে বীরত্ব মনে করে, হননাকাঙ্ক্ষাকে শ্রেয় মনে করে, তবে সে-দেশের বা সে-রাজ্যের কথাপ্রকাশের এলাকায় দাঁত-ঝলকানো পতাকাই উড়বে। কিন্তু তাতে না ঘাবড়ে, এই স্বাধীনতার উত্তাল হাওয়াকে ব্যবহার করে, ডেসিবেল-উচ্চতায় না হোক, যথাসম্ভব দৃঢ়তায় এই অঞ্চলকেই ব্যবহার করে বলতে হবে, ‘যে মারে, সে উগ্রপন্থীই হয়, উগ্রপন্থার ফাঁদেই পা দেয়।’ দেশের জল্লাদ-লগ্নে এই মত অকুণ্ঠায় বলতে পারার বেড়াহীন ময়দান এই সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমই দিয়েছে। উদ্যত তরোয়ালের সামনে এতগুলো সামান্য লোকের শুভবোধ ঝলকাবার সুযোগ তো অভূতপূর্ব, সভ্যতার ইতিহাসে কোনওদিন কেরানি হকার গৃহবধূ বক্তব্য প্রকাশের এই সমানাধিকার ভোগ করেননি। ‘এই হিংস্র দেশকে ভালবাসি না’ বলার সাহসও এই হট্টমেলারই দান। বিকট দুঃসময় আমাদের নিদ্রার দফারফা করেছে বটে, কিন্তু জাগ্রত থাকার অস্ত্রও এই সময়েরই ভাঁড়ারে থরে থরে উজ্জ্বল।