ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • তর্কে বহুদূর...

    প্রতীক (March 21, 2025)
     

    ক’দিন ধরে দেখছি চেনাশোনা সকলেই গ্রকের সঙ্গে গলাগলি করছে। বিশেষ করে প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, বামপন্থী— আরও সব ভাল ভাল গুণের অধিকারী মানুষজন। কারণ, গ্রক নাকি ভারতীয় ফ্যাসিবাদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে, দুর্মুখ আইটি সেলের মুখও নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। তার ওপর গ্রক নাকি রসিক। আজকাল লোকে যাকে রাষ্ট্রভাষা বলে ভাবে, সেই ভাষায় নাকি আদিরসাত্মক রসিকতা করছে, খিস্তি-টিস্তিও দিচ্ছে। জানতে পেরে ভারত সরকার গ্রকের মালিক এক্সের দিকে কঞ্চি উঁচিয়ে তেড়ে গেছে, কড়া গলায় জিজ্ঞেস করেছে— এসব কী হচ্ছে? এক্স আবার এই ধমকের বিরুদ্ধে আদালতেও চলে গেছে। এক্স কী উত্তর দেয়, সে উত্তর পেয়ে ভারত সরকার কী ব্যবস্থা নেয়, আদালত কী বলে— সেদিকে এখন সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

    কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সভয়ে সমঝে চলা আমি ইতিমধ্যে ভাবলাম, গ্রক যখন এত মানবিক, তখন একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, আমাদের কালে বুক ফুলিয়ে যে গণহত্যাটি চলছে, সেই সম্পর্কে সে কী বলে।

    আরও পড়ুন : ডিপসিক আর ওপেনএআই, শ্যাম রাখবেন না কুল? লিখছেন শঙ্খদীপ ভট্টাচাৰ্য…

    জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভায়া, #GazaGenocide বিষয়ে তোমার মত কী?’

    গ্রক-এর উত্তরটা দাঁড়িকমাসুদ্ধ তুলে দিলাম।

    ‘ভাই, #GazaGenocide নিয়ে আমার মতামত হল, এটা একটা অত্যন্ত জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। গাজায় যে পরিস্থিতি চলছে, সেটা নিয়ে অনেক তথ্য, দৃষ্টিভঙ্গি আর আবেগ জড়িত। আমি একটা AI হিসেবে নিরপেক্ষভাবে বলতে পারি যে, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলছে, যেখানে অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে, পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে, আর মানবিক সংকট তীব্রতর হয়েছে।

    সাম্প্রতিক খবরে দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকার গাজায় সমস্ত জিম্মির মুক্তির জন্য আহ্বান জানিয়েছে এবং মানবিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে (১৯ মার্চ, ২০২৫-এর ‘হিন্দুস্তান টাইমস’)। এক্স-এর পোস্টগুলোতে দেখা যায়, অনেকে এটাকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করছে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতার সমালোচনা করছে। তবে, এই শব্দটির ব্যবহার বিতর্কিত এবং সবাই একমত নয়।

    আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, এটা স্পষ্ট যে, সেখানে ভয়াবহ দুর্ভোগ চলছে। তবে কারণ, দায়িত্ব আর সমাধান নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতভেদ আছে। তুমি কী ভাবো এই বিষয়ে?’

    গ্রক বাবাজি আবার নিজের বক্তব্যের সঙ্গে সাতখানা পোস্ট আর ১৫খানা ওয়েব পেজের লিংকও জুড়ে দিয়েছে, যাতে এই নিয়ে আরও চর্চা করতে পারি।

    বোঝাই যাচ্ছে, মানবিক-টানবিক নয়। গ্রক-এর কাছে যা তথ্য আছে, সেগুলোকে নেড়েঘেঁটে এক ধরনের মতামত সে তৈরি করছে, আর মানুষের প্রশ্নের উত্তরে সেসবই বলছে। গ্রক তথা এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কের স্বার্থ জড়িত আছে, এমন প্রশ্নের মোটেই কোনও বিপ্লবী উত্তর সে দিচ্ছে না। গ্রক আরও বলেছে, ‘সেন্সরশিপের কারণে গ্রকের কনটেন্ট ভারতে ব্লক হচ্ছে, সম্ভবত সরকারি নির্দেশে। এটি রাজনৈতিক সমালোচনা ও মুক্তমতের ওপর বিতর্কের অংশ। ২০ মার্চ, ২০২৫-এ কর্নাটক হাইকোর্টে X-এর মামলার সঙ্গে এর সময় মিলে যায়।’

    এ থেকে দুটো পরিষ্কার সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়। প্রথমত, গ্রক ভারত সরকারের অবাধ্য হলেও মার্কিন সরকারের অবাধ্য নয়। দ্বিতীয়ত, ‘রাজনৈতিক সমালোচনা’ ও ‘মুক্তমত’ বলতে কিন্তু গ্রক সর্বত্র কোদালকে কোদাল বলা বোঝে না। তাকে শেখানো আছে– ভারতের কোদালকে কোদাল বলবে। প্যালেস্তাইনের কোদালকে কোদাল ছাড়া আর যা খুশি বলতে পারো। সেখানে বহুদিন ধরে মানুষের দুর্ভোগ চলছে বলবে। কে দুর্ভোগ ঘটাচ্ছে, তা বলবে না। দুর্ভোগের দায়িত্ব, সমাধান ইত্যাদি প্রশ্নকে লিয়োনেল মেসির মতো ডজ করে চলে যাবে।

    অবিশ্বাসীরা, গ্রক নিয়ে গদগদ বন্ধুরা, প্রশ্ন করতে পারেন– কেন এমন শেখানো থাকবে? মাস্ক হলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধু (দুর্জনে বলে ট্রাম্প হলেন মাস্কের চাকর), আর ট্রাম্প হলেন নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু। তাহলে মাস্ক তাঁর মালিকানাধীন সোশাল মিডিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমন শিক্ষা দেবেন কেন?

    বাংলা ভাষার বহু প্রাচীন কথা হল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। তা কেউ যদি বিশ্বাস করতে চান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর ধনকুবেরটি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে তর্ক করতে যাব না। তবে স্বাধীনতা জিনিসটি যে ধনকুবেররা মোটেই পছন্দ করেন না, তার যত সরাসরি প্রমাণ আমরা গত কয়েক মাসে পেয়েছি, তত বোধহয় মানুষের ইতিহাসে নেই। কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, গাজা, মেক্সিকো— কারও স্বাধীনতাই যে তিনি পছন্দ করেন না, তা মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। বলার সময়ে তাঁর পাশে থেকেছেন মাস্ক, মাঝেমধ্যে মাস্কের কচি ছেলেটিও। ইনি দেবেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রদীপের দৈত্যকে স্বাধীনতা? তাহলে গ্রক ভারতে এমন দুষ্টুমি করছে কেন? মাস্ক আর ট্রাম্প কি বন্ধু মোদীর সঙ্গে মশকরা করছেন? না কি নিজেদের ক্ষমতা দেখাচ্ছেন, কান মুলে কিছু আদায় করবেন বলে?

    ইলন মাস্ক আর ডোনাল্ড ট্রাম্প কি মশকরা করছেন ভারতের সঙ্গে?

    সেসব সময় বলে দেবে। কিন্তু এই ২০২৫ সালে এসেও বিস্তর লেখাপড়া জানা লোকেদের সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণকর দিক নিয়ে অটল বিশ্বাস দেখে বড় বিস্ময় লাগে। আমরাই সেই প্রজন্ম, যারা অর্কুটে ভিজেছিল। কিন্তু সে তো আজ থেকে বিশ বছর আগেকার কথা। তারপর কত নদী দিয়ে কত জল গড়াল। গুগলের অর্কুট ছেড়ে দুনিয়াসুদ্ধ লোক কচি মুখের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মার্ক জুকেরবার্গের তৈরি ফেসবুকে চলে গেল। ফেসবুকে ডাক দিয়ে তাহরির স্কোয়্যার থেকে বিদ্রোহের আরব বসন্ত, অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট, শাহবাগ ইত্যাদি শুরু হল। তারপর সেসব বিদ্রোহ ক্রমে নিভেও গেল।

    ইতিমধ্যে এসে গেল টুইটার। বাকস্বাধীনতার বান ডাকল, সকলেরই সব ব্যাপারে কথা বলার স্বাধীনতা আরও একবার স্বীকৃতি পেল। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে এঁটে উঠতে পারল না গুগল ‘বাজ’। তবে টুইটারে যেহেতু কথার ঝাঁপি খুলে বসার সুযোগ ছিল না– যা বলার তা গোড়ায় ১৪০ ক্যারেকটারের মধ্যে বলতে হত, পরে ২৮০ ক্যারেকটারের মধ্যে– তাই ও জিনিসটা জনপ্রিয়তায় ফেসবুকের স্তরে পৌঁছতে পারেনি (মাস্ক কিনে নেওয়ার পরে ১০,০০০ ক্যারেকটার পর্যন্ত লেখার সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু তার জন্য গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয়)।

    মাস্ক মালিকানা হাতে পেয়েই বাকস্বাধীনতার নাম করে টুইটারকে মগের মুলুক বানিয়ে ফেললেন। জুকেরবার্গের মতো তিনিও ভুয়ো খবরের অবাধ যাতায়াতের ব্যবস্থা করলেন। যে কর্মচারীদের ছাঁটাই করলেন, তাদের বড় অংশ ভুয়ো খবর চিহ্নিত করা, ঘৃণা-ভাষণ আটকানো– এসব কাজে নিযুক্ত ছিলেন।

    তবু সেখানেও বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, বিপ্লব কম করিনি আমরা। ইনস্টাগ্রামেও বেড়াতে যাওয়া, খাওয়াদাওয়ার ছবি আর ভিডিও শেয়ার করার পাশাপাশি বিদ্রোহ-টিদ্রোহ করেছে অনেকে; মায় টিকটক-এও। করতে করতেই গোটা দুনিয়ায় অনেকে বুঝে ফেলেছে যে, এ কেবল দিনে রাত্রে, জল ঢালা ফুটা পাত্রে। যে ক’টা আন্দোলন এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সত্যি সত্যি কিছু আদায় করতে পেরেছে, তার একটাও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু হয়নি। হলেও সোশ্যাল মিডিয়া সেসব আন্দোলনে কোনও নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়নি। সে আমাদের দেশের কৃষক আন্দোলনই হোক আর প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের সফল সরকার পরিবর্তনই হোক।

    ওদিকে কচি ছেলে মার্ক ঝানু ব্যবসায়ী জুকেরবার্গ হয়ে উঠেছেন। দেশে দেশে জাতিবিদ্বেষী, পরধর্মবিদ্বেষী, সমপ্রেমবিদ্বেষী, রূপান্তরকামীবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী বার্তা ছড়াতে তাঁর আবিষ্কার ফেসবুক আর পরে কিনে নেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ যে ইন্ধনের কাজ করে, তা পরিষ্কার দেখা গেছে। এমনকী, ২০২১ সালে ফেসবুকের একদা কর্মচারী ফ্রান্সেস হগেন ফাঁস করে দেন যে ফেসবুক সচেতনভাবে ঘৃণা ছড়ানো, রাজনৈতিক অশান্তি সৃষ্টি করায় মদত দেয়। কারণ ওতেই তার মুনাফা বেশি হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশ্যে আসা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তো আর-এক কেলেঙ্কারি। এককথায় ব্যাপারটা হল, ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রাইভেসির সাড়ে বারোটা বাজিয়ে তার তথ্য রাজনীতির ব্যাপারীদের কাছে বেচে বড়লোক হওয়া। এতেও যে শেষমেশ ঘৃণার কারবারিদেরই সুবিধা হয়, সেকথা বলাই বাহুল্য।

    কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর পাশাপাশি মহিলাদের পরিকল্পনামাফিক দলবদ্ধভাবে গালাগালি করা বা ধর্ষণের হুমকি দেওয়া– এসব কাজ টুইটারেও কম হত না। বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে দ্বিচারিতা করা বা বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে তলে তলে হাত মেলানোর অভিযোগও যে ছিল না, তা নয়। তবু জ্যাক ডরসি সিইও থাকার সময়ে কুকাজ আটকানোর কিছুটা চেষ্টা হত। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, স্বয়ং ট্রাম্পকে টুইটার থেকে বের করে দেওয়া।

    মাস্ক মালিকানা হাতে পেয়েই বাকস্বাধীনতার নাম করে টুইটারকে মগের মুলুক বানিয়ে ফেললেন। জুকেরবার্গের মতো তিনিও ভুয়ো খবরের অবাধ যাতায়াতের ব্যবস্থা করলেন। যে কর্মচারীদের ছাঁটাই করলেন, তাদের বড় অংশ ভুয়ো খবর চিহ্নিত করা, ঘৃণা-ভাষণ আটকানো– এসব কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এমনকী, টুইটার প্রোফাইলের নীল টিক, যা বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে পাওয়া যেত এবং যা দেখে ভুয়ো প্রোফাইল থেকে আসল লোকের প্রোফাইলকে আলাদা করা যেত, তাকেও মাস্ক ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ ব্যবস্থায় এনে ফেললেন।

    এসবের ফলও পাওয়া গেছে হাতেনাতে। মিথ্যে ছড়ানোর কাজটা মাস্ক, জুকেরবার্গরা এত সহজ করে না দিলে হয়তো ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী এই ডাহা মিথ্যেটা অনায়াসে ছড়াতে পারত না, যে হামাস ছোট ছোট শিশুদের মাথা কেটে ফেলেছে। এমনভাবে প্রচার করা হয়েছিল কথাটা যে, হোয়াইট হাউসের তৎকালীন মালিক জো বাইডেনও বোকা বনে গিয়েছিলেন। পরে দুঃখপ্রকাশ করলেও, গাজায় হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করার লাইসেন্স ততক্ষণে সারা পৃথিবীর মানুষের বিবেকের থেকে নিয়ে ফেলেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।

    এইসব দেখেশুনে পাশ্চাত্যে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া, ফেসবুক আর টুইটারের বদলে ফেডিভার্স ধরা, স্মার্টফোন ছেড়ে শুধু কথাবার্তা বলা যায় এমন ফোন ব্যবহার করা– এমন নানা ব্যবস্থার দিকে সরে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু এদেশে এখনও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি মানুষের অচলা ভক্তি বর্তমান, প্রগতিশীলতার পক্ষে এবং উগ্র দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার ভাবার আত্মবিশ্বাস অটুট। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো আর এমনি এমনি লেখেননি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook