হননকাল
উত্তরপাড়া কলেজে ক্লাস করতে যাওয়ার প্রথম দিনটিতেই খালপাড়ের বটতলায় কাঁচুমাচু হয়ে থাকা আমার জুটে গেল বিপুল সমাদর। উঁচু ক্লাসের দাদা আমার কবিতা পাঠের পর বেদি থেকে নেমে এসে যেই শুধোলেন, ‘দেখো, দেখো, তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে লিখেছে…’, হাসতে হাসতে কৃষ্ণাদি বলে ফেলল, ‘ও-ই তো মৃদুল…।’
ব্যস, আমার বুকের দু’দিকে ধরে আমাকে তুলে ধরলেন উঁচু ক্লাসের ওই দাদা। হিলহিলে রোগা ছিলাম, আমাকে তুলতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। আর আমাদের ঘিরে ধরে হইহই করতে লাগল উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দঙ্গল। কেউ একজন গাল টিপেও দিল আমার! বটগাছে পাখিরা অবাক হয়ে কিচকিচ করতে লাগল।
এবার আমার ঘাবড়ে যাওয়ার পালা! আত্মপরিচয় দিলেন ওই সিনিয়র দাদা। বললেন, তিনি উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা অনার্সে থার্ড ইয়ারে পড়েন। সবিস্ময়ে আমি তাঁর নামটা অস্ফুটে উচ্চারণ করলাম, ‘উ জ জ্ব ল ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়!’ তারপর হতচকিতের মতো দু’হাতে তাঁর ডানহাতের তালুটি জাপটে ধরে থাকলাম।
‘গল্পকবিতা’ ও কৃষ্ণগোপাল মল্লিক: পড়ুন আগের পর্ব…
১৯৭০ সালে পশ্চিমবঙ্গে শরৎকালে যত লিটল ম্যাগাজিনের শারদ সংখ্যা বের হয়েছিল, সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছিলেন শিবাজি গুপ্ত আর উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর তৃতীয় স্থানটিতে অজয় নাগ। এই তিনজনের অনেক পরে অজয় সেন, তারপর শ্যামলকান্তি দাশ, চতুর্থ ও পঞ্চম। উঁহু, গুণমানে নয়, অবস্থানে। তাঁরা সকলে সাতের দশকের সূচনাকালীন কবি।
শিবাজিদা কোথায় আছেন, জানি না, বহুদিন দেখিনি তাঁকে। অজয়দা কলেজ স্ট্রিটের কাছাকাছি থাকেন। কখনও কখনও দেখা হয়। তাঁর কবিতার বইয়ের নাম— ‘তিনটি বেড়াল এবং আমি’। ‘সুন্দর’ নামে চমৎকার একটি কবিতাপত্র প্রকাশ করেছিলেন অজয়দা। উজ্জ্বলদা কলেজে পড়ার সময় বালিতে থাকতেন, এখন থাকেন বাগবাজারে। কখনও কচ্বিৎ দেখা হয় উজ্জ্বলদার সঙ্গে।
সম্প্রতি সত্তর দশকীয় বাংলা কবিতার একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, আমাদের সময়ের দুই কবি দীপক রায় ও সুজিত সরকারের সম্পাদনায়। অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন আমাদের এই দুই বন্ধু, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ‘অবিনশ্বর সাতের দশক’ নামের মহাসংকলনটি বের হয়েছে শুভদীপ-মৌমিতা সেনশর্মাদের ‘আলোপৃথিবী থেকে। অসামান্য কবিতা সংকলন। তবু এই সংকলন থেকে বাদ পড়েছেন শিবাজি গুপ্ত, উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, তা বড় অঘটন। মফসসল বাংলার দিকদিগন্ত থেকে তখন, সেই তখন, আমার সময়ের কবিতাপ্রয়াসীরা উঠে আসতে থাকেন, সমাজের সব শ্রেণি থেকে। কারণ, ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকে নগরগুলির কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসতে থাকেন গ্রামঘরের সন্তানরা, সত্তরের সূচনায় নগর উপচে পড়ে। এমনি এমনি তো মহাসময়ে, সেসময়ে ঢেউ জাগেনি। দিগদিগন্তের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে ফুটে উঠতে শুরু করেন আমাদের বন্ধুরা, সারা বাংলায়। ওই সময়ের স্লোগান ছিল, গ্রাম দিয়ে নগর ঘেরা। মাও সে তুংয়ের উক্তি। রাজনীতিতে এদেশে তা সম্ভব হয়নি। তবে আমি বলবই, আমার বন্ধুরা বাংলা কবিতায় তা সম্ভব করেছেন। সেসময়ের কবিতায় কলকাতার আধিপত্য চূর্ণ হয়েছিল। ভাষাক্ষেত্রেও নাগরিক পরিশীলন তছনছ হয়েছিল।
সত্তর দশকের কথা যখন উঠল, উত্তাল ওই সময় সম্পর্কে দু’-একটি কথা সংক্ষেপে সেরে নিই। বিস্তারিত বলার দরকার নেই, বিষয়টি বহুচর্চিত। সাতের দশকের ওই সূচনা-সময়ে, ওই ১৯৬৭-’৬৮-’৬৯-’৭০ সালে, আমরা যারা কিশোর থেকে তরুণ হয়েছি, আমাদের প্রজন্ম এক আহত প্রজন্ম। দেখে হয়তো বোঝা যায়নি, এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত। সংক্ষেপে বলছি বলে, দু-এক কথা, একটি-দুটি উদাহরণে বলি :
যাই হোক, আমরা আহত, ক্ষতবিক্ষত প্রজন্ম। উত্তাল নৃত্যরত সময় আমাদের দুলিয়ে দুলিয়ে ছন্দিত করেছে, আবার আঁচড়ে-কামড়েও দিয়েছে, আগুনের ছ্যাঁকাও লেগেছে। ১৯৭১ সালে শ্রীরামপুরের ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে আমরা যারা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিই, অনেক পরে আমাদের কয়েকজন সহপাঠী ‘ইউনিয়ন ৭১’ নামে আমাদের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। প্রতি বছর জানুয়ারির দ্বিতীয় রবিবার শ্রীরামপুরের গঙ্গাতীরে ঢেউখেলানো ব্রিটিশ আমলের জলকলের মাঠে বা কোনও বড় পার্ক, উদ্যানে সারাদিন খাওয়াদাওয়া, হইহল্লা করি। আমাদের সবাই নানাদিকে ছিটকে গিয়েছে, বিদেশেও কেউ কেউ আছে। তবু ওই নির্দিষ্ট দিনটি তারা প্রায় সকলেই আসে, আসে বিদেশ থেকেও। এবারও জানুয়ারিতে আমাদের এই সমাবেশ হল। ইউনিয়ন ৭১-এর ২৪তম সম্মেলন। আমাদের এখনকার গড় বয়স ৬৯।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমাদের সহপাঠী বন্ধু তন্ময়কে শ্রীরামপুরের গঙ্গাতীরে গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। আমার বাবার এক সহকর্মীর ছেলেকে হাওড়া স্টেশনে পুলিশ গুলি করে মেরেছিল, অল্পবয়সে অসুখে ছেলেটির মুখ গিয়েছিল বেঁকে। পুলিশ তাকে অসীম চট্টোপাধ্যায় সন্দেহে মেরে ফেলে।
যে-কথা বলব বলে এই স্কুলের বিষয়টির অবতারণা, এই ২৪ বছরে, প্রতিবার আমাদের সম্মেলন শুরু হয় দু’মিনিট নীরবতা পালনে। প্রতি বছর আমাদের এই বন্ধু-দলটির কেউ না কেউ দলছুট হয়ে মিলিয়ে যায়। গঙ্গায় একপেগ মদিরা ঢেলে দিই তার স্মৃতিতে। গত দু-এক বছরে যারা মারা গিয়েছে, তাদের মৃত্যুকালে বয়স ছিল ওই, ৬৮, ৬৯। কিন্তু ২৪, ২৫, ২৬ বছর আগে যারা মারা গিয়েছে, তারা তো তখনও ৫০ ছোঁয়নি। মৃত্যুকালে তাদের বয়স ছিল ৪৪, ৪৫, ৪৬! অকালমৃত্যু! অকালমৃত্যু!
কয়েক বছর আগে আমি এই সহপাঠীদের এই অকালমৃত্যু নিয়ে ভাবতে বসি। আচম্বিতে আমার সত্তর দশকীয় বন্ধু-দলটির কথা ভাবতে থাকি। আমাদের ভেতর অতি অল্প বয়সে, সবে তখন তার বিয়ে হয়েছে, মারা যায় অনন্য, অনন্য রায়। এরপর অলোকেশ ভট্টাচার্য, তুষারদা, তুষার চৌধুরী, বীতশোকদা, বীতশোক ভট্টাচার্য, নিশীথদা, নিশীথ ভড়, ফল্গু বসু, অন্যমন দাশগুপ্ত, অনিন্দ্য চাকী, জহরদা, জহর সেনগুপ্ত, নবারুণ ভট্টাচার্য, সন্দীপ দত্ত, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, গৌতম, গৌতম বসু, ধূর্জটি চন্দ, ঘঞ্চু, ঘনশ্যাম দাস, যে কিনা সোমক দাস ছদ্মনামধারী হয়েছিল, তারপর সোমনাথদা, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু রক্ষিত— সব, সব অকালমৃত্যু! আমাদের অগ্রজ ভাস্করদা, তুষারদা, তুষার রায়েরও মৃত্যুর বয়স হয়নি। এমনকী, বাংলাদেশেও আমাদের সমকালীন আবিদ আজাদ, রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ, ত্রিদিব দস্তিদার অকালে মারা গিয়েছে। এদের অধিকাংশ মদিরাসক্ত ছিলেন, অনন্য শুনেছি জিভে সাপের ছোবলও নিত। কিন্তু ধূর্জটিদা, গৌতম বসু, বীতশোকদা তো এসব থেকে ছিল দূরে। কেন তারা অকালে মারা গেল?
অনেক ভেবে আমি এক সিদ্ধান্তে এসেছি। সময়, ওই ঘুরপাক দেওয়া সময়, ১৯৬৭-’৬৮-’৬৯-’৭০ সাল, মানবদেহের বিকাশের সময়টিতে, আমাদের কৈশোর ও সদ্য-তারুণ্যকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। মারণ-থাপ্পড় মোকাবিলা বা যোঝার ক্ষমতা নেই আমাদের। মনে হয়, টোকা লাগলে, আমরা কেউ কেউ, ঝরে যাব।