কফিহাউসের টেবিল, দূরের সন্ধে
আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে আমার তো ‘মোমবাতি’ নামে কবিতা বেরিয়ে গেল। তখন ক্লাস এইটে পড়ি, ১৯৬৭ সাল। স্কুল ম্যাগাজিন বের হওয়ার কয়েকদিন পর আমাদের ক্লাসের গোবিন্দ (পদবি বৈরাগী, অকালপ্রয়াত) বলল, ‘আমাদের পাড়ার দাদারা তোকে খুঁজছে, আজ ছুটির পর ওখানে চ, ওরা ক্ষেত্র শা স্ট্রিটের মোড়ে আড্ডা দেয়।’
শুনে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার মুখচোখ দেখে গোবিন্দ বলল, ‘আরে আরে, কাঁচুমাচু হলি কেন, ওরা তোর কবিতাটা পড়ে তোকে খুঁজছে।’
সেদিন স্কুল ছুটির পর ক্ষেত্র শা স্ট্রিট ও বি.পি. দে স্ট্রিটের মোড়টিতে গিয়ে দেখি, আমাদের চেয়ে বেশ বড় বড় দাদারা একটি বাড়ির, অট্টালিকাই বলা উচিত, তার সামনের সিমেন্টের বেঞ্চে (তখন অনেক বাড়ির সামনেই এরকম বেঞ্চ থাকত মুখোমুখি দু’টি) বসে আড্ডা দিচ্ছেন, তাঁরা কেউ কেউ কলকাতায় কলেজে পড়ছেন, কেউ শিক্ষা শেষ করেছেন, দু’-একজন সদ্য চাকরিতে ঢুকছেন। তাঁদের নাম সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, সমর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব বসুরায়, মুকুল বসু, গৌতম মজুমদার (সকলে প্রয়াত), সুহাস মুখোপাধ্যায়, নরেন দে এইসব। তাঁরা সকলেই কবিতা লিখতেন। আমাকে ওই পয়লা দিনেই খুব খাতির করলেন তাঁরা, খাওয়ালেন মুড়ি, আলুর চপ। হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন তাঁরা, সেজন্য আমার কবিতা চাইলেন তাঁরা। মাসে মাসে বের হত। গোবিন্দ বলল, ‘দে দে, তোর কবিতার ডায়রিটা দেখা।’ সোমনাথদা সেই ডায়েরি থেকে বেছে বেছে কয়েকটি কবিতা চাইলেন। তখনই ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে তাঁকে দিয়ে দিলাম। অদূরে লাইটপোস্টে ঝুলছিল তাঁদের হাতে লেখা পত্রিকা— ময়লা কাগজের বাক্স। সবে সন্ধে নামছে তখন, স্ট্রিট-ল্যাম্পের আলো ঝলকাচ্ছিল সেই পত্রিকায়।
মাসে মাসে ওই হাতের লেখা পত্রিকা ‘ময়লা কাগজের বাক্স’-তে আমার কবিতা বের হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে এই দাদারা ঠিক করলেন, মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশ করা হবে। বের হল ‘শীর্ষবিন্দু’ পত্রিকাটি। সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ও মুকুল বসুর সম্পাদিত ‘শীর্ষবিন্দু’ লিটল ম্যাগাজিনেই, ওই ১৯৬৮ সালে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ‘লোভী কুকুরেরা’, মনে আছে এখনও কবিতার নামটি, তবে কবিতাটা আর নেই। এছাড়া ওই বছর পুজোর সময় আমাদের শহর থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত স্থানীয় সংবাদ সাপ্তাহিকী ‘পল্লীডাক’-এর সম্পাদক ইন্দুভূষণ মুখোপাধ্যায় আমাকে ডেকে শারদ সংখ্যা ‘পল্লীডাক’-এর জন্য কবিতা নিয়ে ছেপেছিলেন।
আমিও ওদের সঙ্গে আড্ডায় তখনকার কবিতা সম্পর্কে জানতে বুঝতে শুরু করলাম। ওদের সঙ্গে যোগাযোগে আমি শ্রীরামপুর শহরে ওদেরও অগ্রজ শৈলেনদা, শৈলেনকুমার দত্তর সঙ্গে পরিচিত হলাম। শৈলেনদা তখন ছোটদের ছড়া লিখে রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আমাকে ইউরোপ-আমেরিকার কবিদের নানা বিষয়াদির গল্প বলতেন। আর রমাদি, সোমনাথদাদের চেয়ে ঈষৎ ছোট রমা ঘোষ আমাদের পাড়ায় থাকেন, তাঁর কবিতার তখন সবে বই বের হয়েছে। দেবারতি মিত্র ছিলেন রমাদির বন্ধু। রমাদি নিয়মিত লিখতেন অরুণ বসুর সম্পাদিত, নবদ্বীপ থেকে প্রকাশিত ‘অজ্ঞাতবাস’ পত্রিকাটিতে। চমৎকার সেই লিটিল ম্যাগাজিনটি আমাকে পড়তে দিতেন।
শ্রীরামপুরের ইএসআই হাসপাতালে চাকরিসূত্রে আসেন সুনীল মিত্র (অকালপ্রয়াত)। তিনি ছিলেন রঙিন মানুষ, তিনি বের করেন ‘বিভিন্ন কোরাস’ নামের লিটল ম্যাগাজিন। আমদের দলে তখন যোগ দিয়েছে আমার সময়বয়সি পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবু, দেব গঙ্গোপাধ্যায়। পল্লব আর আমি মিলে বের করেছিলাম ‘বেলাভূমি’ নামে একটি পত্রিকা, দেবু কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বের করেছিল ‘তারপর’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন। (অনেক পরে নয়ের দশকের শেষদিকটায় আমার বন্ধু দেবু, দেব গঙ্গোপাধ্যায় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। আর ওই সময়ই পল্লব মারা গিয়েছে, এই কয়েকদিন শুনলাম পল্লবের স্ত্রী রত্নাও মারা গেছে। অকালমৃত্যু, অকালমৃত্যু!)।
ওই ১৯৬৮-’৬৯-’৭০ সাল আমার কবিতা প্রয়াসের সূচনাকাল। আমি এসব পত্রিকায় লিখতে শুরু করি। ১৯৭০ সালে আমি যখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি, সোমনাথদা, সোমনাথ মুখোপাধ্যায় আমাকে প্রথম কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে নিয়ে এসেছিলেন। আমার খুব বুক দুরদুর করছিল, আমার ভয় হচ্ছিল যে, সব লিটল ম্যাগাজিনে আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল (তখন সবে ৩/৪টি), তা নিয়ে হয়তো কবিরা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন! প্রশ্ন করবেন হয়তো ছন্দ নিয়ে, শব্দচয়ন নিয়ে, ভয় করছিল সেসব নিয়ে। যাই হোক, তা ঘটেনি।
এর ঠিক একটু পরেই কফিহাউসে বিদ্যুতের ঝলক ঢুকল যেন, যেন ভাসমান, এভাবে একজন উড়ে গিয়ে বসলেন একটি টেবিলে। স্ফূর্তির লহর উঠল ওই টেবিল ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলির ভেতর। আমার পাঁজরে হালকা কনুইয়ের গুঁতো মেরে সোমনাথদা বললেন, ‘বাঙাল, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, তুষার রায়!’
সোমনাথদা আমাকে নিয়ে গিয়ে বসালেন যে টেবিলে, তখন একাই বসেছিলেন একজন, সোমনাথদা আলাপ করিয়ে দিলেন সেই পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের সঙ্গে। এরপর একে একে এই টেবিলে আসতে লাগলেন নিশীথ ভড়, ধূর্জটি চন্দ, সমরেন্দ্র দাস, অলোকেশ ভট্টাচার্য, দু’টি টেবিল জোড়া লাগল এরপর, এলেন আরও কয়েকজন। আমাকেও গ্লাসে ঢেলে দেওয়া হল ব্ল্যাক কফি। আমি চুপচাপ বসে কাছের একটা টেবিলে বসে তুমুল তর্করত পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ডান হাতের আঙুলদু’টির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, ওই আঙুলদু’টি দিয়েই কলম ধরে ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’ লিখেছেন তিনি! দেখলাম, তাঁর টেরিলিনের ফুলশার্টের বাঁ-কাধের ধারে একটু ছেঁড়া। সেকালে ছেঁড়া, ময়লা শার্ট-প্যান্ট পরা ছিল মধ্যবিত্ত তরুণদের প্রলেতারিয়েত হওয়ার সাধনা। আমি নিজে অন্তত সপ্তাখানেক একই জামাপ্যান্ট পরে ঘুরতাম। অদূরে আরেক টেবিলে দেখলাম উজ্জ্বল হলদে রঙের বুশশার্ট পরা ভাস্কর চক্রবর্তীকে, তাঁর ‘শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণা’ কাব্যগ্রন্থটি তখনও বের হয়নি, কিন্তু বাতাসে তখন ঘুরছিল তাঁর কবিতার লাইন— ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যরিডন আছে।’ ( স্যরিডন কি এখনও পাওয়া যায়? মাথা ধরার নিরাময়ের ট্যাবলেট)।
গুম! গুম! দু’টি বোমা ফাটার শব্দ হল তখন, বাইরে কলেজ স্ট্রিটে, গোধূলিবেলায়। কিন্তু কফিহাউসে কোনও হেলদোল হল না।
এর ঠিক একটু পরেই কফিহাউসে বিদ্যুতের ঝলক ঢুকল যেন, যেন ভাসমান, এভাবে একজন উড়ে গিয়ে বসলেন একটি টেবিলে। স্ফূর্তির লহর উঠল ওই টেবিল ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলির ভেতর। আমার পাঁজরে হালকা কনুইয়ের গুঁতো মেরে সোমনাথদা বললেন, ‘বাঙাল, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, তুষার রায়!’
আমি দেখলাম বিদ্যুতের ঝলকটিকে। প্রথমেই চমকিত নজর পড়ল তাঁর চোখ দু’টিতে। আয়তচক্ষু, দৃষ্টি একেবারে অন্তর্ভেদী, এক্স-রে আইজ়! আর সে-সময়ের রীতিতে ঘাড় পর্যন্ত কেশরাশি, তাঁরও ওই যুগোপযোগী ধূলিধূসর পোশাকআশাক, কিন্তু তিনি ঝলসে ওঠা বিদ্যুৎ!
সবিস্ময়ে আমি তুষার রায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।