জামাইকা ফেয়ারওয়েল, কৃষ্ণকলির খোঁজে
এমন আশ্চর্য উড়ানে আমি আগে কখনও চড়িনি, পরেও না। জামাইকার এয়ারলাইন্সের প্লেনটা যেমন রংচঙে, বিমানবালারাও সেরকম চনমনে। তাদের পোশাকে রঙের রায়ট, আর মেজাজেও। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, তারা কি সেই ২০০৭ সালের মতোই আমুদে আছে, না কি খটখটে ফরমাল হয়ে গেছে? আসলে পৃথিবীটা গত কয়েক বছরে এত বদলে গেছে যে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, সারল্যকে কেউ তারল্য ভেবে ফায়দা তুলবে না! কাগজে প্রায়ই খবর থাকে, এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করার জন্য যাত্রী আটক। সেবার লন্ডন থেকে কিংস্টন ফ্লাইটে বিমানসেবিকাদের মজাদার আচরণ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে দীর্ঘ ক্যারিবিয়ান্স ট্যুরে বুঝেছি, এঁদের জীবনযাপনটাই খুব সিদেসাধা, বর্ণময়, খোলামেলা। সেলিব্রিটি হোক কি আম-আদমি, হইহই করে বাঁচে। ‘সোশ্যাল ট্যাবু’ বলে কিছু নেই প্রায়।
নীনা গুপ্তা ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় সম্ভবত ক্যারিবিয়ানদের জীবনদর্শনের অনেকটাই বুঝেছিলেন। তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সম্পর্কে জড়িয়েছেন, মা হয়েছেন, কন্যা মাসাবাকে একাই বড় করেছেন। আবার ভিভের জন্য হৃদয়ের কোণায় জায়গাও রেখেছেন। সে যাই হোক, সামান্য একবোতল জল চাইলেও যেভাবে একমুখ হাসি নিয়ে গান গাইতে গাইতে, কোমর দোলাতে দোলাতে বিমানবালারা আসছিলেন, যাত্রীদের মন ভাল হতে বাধ্য। যদি না অবশ্য সাদা মনে কাদা থাকে!
আরও পড়ুন : ঐতিহাসিক লর্ডস আর খুনখারাপির সহাবস্থান যে লন্ডনে,
লিখছেন তপশ্রী গুপ্ত…
‘বাট আই অ্যাম স্যাড টু সে আই অ্যাম অন মাই ওয়ে/ ওন্ট বি ব্যাক ফর মেনি আ ডে/ মাই হার্ট ইজ ডাউন/ মাই হেড ইজ টার্নিং অ্যারাউন্ড/ আই হ্যাড টু লিভ আ লিটল গার্ল ইন কিংস্টন টাউন’— হ্যারি বেলাফন্টের সেই জাদু-গান জামাইকা ফেয়ারওয়েল সমানে পাক খাচ্ছিল মাথার ভেতর। এই সেই কিংস্টন টাউন বব মার্লে, ব্লু মাউন্টেনস, কফি আর রামের দেশ জামাইকার রাজধানী কিংস্টন! আর খেলাধুলোর কথা যদি বলেন, মাইকেল হোল্ডিং, উসেইন বোল্ট— আর কত নাম বলব!
ক্যারিবিয়ান্সের সব দেশই দ্বীপ, তাই এয়ারপোর্টগুলোয় নামতে খুব মজা লাগে। প্লেনের চাকা মনে হয় যেন, সমুদ্রের জল ছুঁয়ে গেল। আর সেই জলের রং এমন অনাবিল নীল যে, ইহজগতে পরিবেশ দূষণ বলে কোনও রাক্ষস সভ্যতাকে গিলে খাবে বলে হাঁ করে আছে— একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না।
ছোট বিমানবন্দর, ক্যারিবিয়ান কালচার মেনে কর্মীরা হাসিমুখ, ‘অতিথি দেবো ভব’। হোটেলে চেক ইন করে আমরা ঠিক করলাম, ডিনারে ভারতীয় খাবার খাব। অনেক দেশেই তখন আকবর’স রেস্তরাঁ চেন বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন তার হাজার গন্ডা প্রতিযোগী তৈরি হয়েছে। জেনে খুশি হলাম, ফোনে অর্ডার করলে খাবার পৌঁছে দেবে হোটেলে। তখন এই কনসেপ্ট কিন্তু আদৌ পরিচিত ছিল না ভারতে। গুগল বলছে, সুইগি-র সার্ভিস আমাদের দেশে চালু হয়েছে ২০১৪ সালে।
সেই ২০০৭-এ দশ ঘণ্টার ওপর বিমানযাত্রার ক্লান্তি নিয়ে (লন্ডন থেকে কিংস্টন) আর হোটেল ছেড়ে বেরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে আমার মতো শীতকাতুরে মানুষের জন্য বিরাট স্বস্তি, জানুয়ারিতেও কিংস্টনের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির আশপাশে ঘোরাফেরা করে। সদ্য বরফমোড়া লন্ডন থেকে মাত্র দশ ঘণ্টা পেরিয়ে ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ কী আরামের!
খাবার তো এল, কিন্তু বিল দিতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া। আটটা রুমালি রুটি আর দু-প্লেট ডাল মাখানির দাম ভারতীয় টাকায় হাজারের ওপর (সালটা ২০০৭, মনে রাখবেন)। আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, এযাত্রায় আর দেশের খাবারের ধারপাশে যাওয়া নেই, যেখানকার যা খাদ্য-অখাদ্য, তাই আমরা সোনামুখ করে খাব। আর সফরসঙ্গী তারকা রিপোর্টারের টিপস অনুযায়ী চিড়ে আর গুঁড়ো দুধ জলছিটে দিয়ে ‘রাবড়ি’ ভেবে গলাঃধকরণের অপশন তো আছেই। বিশ্বাস করুন, খারাপ না এই রেসিপিটা! উদয়াস্ত দৌড়োদৌড়ির মধ্যে পেটও ঠান্ডা থাকে।
পরদিন সকালে সেই সনাতনী ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওনা দিলাম সাবিনা পার্কের দিকে। যেতে যেতে এই স্টেডিয়াম সম্পর্কে বলছিলেন সফরসঙ্গী নামী ক্রীড়া সাংবাদিক। ১৯৩০ সালে টেস্ট অভিষেক দিয়ে শুরু এই স্টেডিয়ামের সিরিয়াস ক্রিকেট কেরিয়ার। তারপর বহু রেকর্ডের সাক্ষী সাবিনা ইংল্যান্ড টিমের অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যামের ত্রিশত রান থেকে স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫ নট আউট। আসন্ন বিশ্বকাপে ভারতের কোন ব্যাটসম্যান এই পিচে কেমন খেলতে পারেন, তাই নিয়ে ক্যামেরার সামনে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক। আমার মাথায় তখন ঘুরছিল, আসার পথে ক্যাব ড্রাইভারের কাছে শোনা সাবিনার গল্প। সাবিনা নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসী নাকি তার সন্তানকে খুন করেছিল, কারণ সে কিছুতেই চায়নি মায়ের মতো অত্যাচারের শিকার হয়ে জীবন কাটুক তার। সাবিনা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘শ্বেতাঙ্গ মালিকের জন্য অনেক খেটেছি, আমার সন্তানকে ওই অন্ধকারে ঠেলতে চাই না। তাই তাকে নিজে হাতে মেরে ফেলেছি।’
সাবিনার ফাঁসি হয়েছিল। তাকে নাকি এখানেই কোথাও কবর দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম সাবিনা পার্ক। ভাবা যায়, সুদূর গাঁয়ের এক ‘কৃষ্ণকলি’, যে কিনা জীবনে কখনও এতটুকু সম্মানের স্বাদ পায়নি, তার নাম কতবার উচ্চারিত হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধারাভাষ্যে, পরিচিত হয়ে যায় লাখো জনতার কানে। এটা মনে করে আমার গায়ে কাঁটা দিল।
আসলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে একসময় ছিল দাসব্যবসার রমরমা। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো, ফরাসি, স্প্যানিশ, বিশেষ করে ব্রিটিশরা উপনিবেশ তৈরির সময় দেদার ক্রীতদাস আমদানি করত আফ্রিকা থেকে। আখের ক্ষেতে কাজ করার জন্য দরকার পড়ত এদের। তাদের উত্তরসূরিরাই এখানকার বাসিন্দা হয়ে রয়ে গেছে। অল্প কিছু পরিবারে স্বাভাবিক নিয়মেই আফ্রিকা আর ইউরোপের রক্ত মিশে গেছে, যেমনভাবে ভারতে সৃষ্টি হয়েছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়। জামাইকা ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা পেয়েছে ব্রিটেনের থেকে। সবাই কমবেশি ইংরেজি বলতে পারে, সাহেবি কালচার বেশ প্রকট। তার অবশ্য আর একটা কারণ ক্রুজ ভর্তি করে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসা। বিলাসবহুল ক্রুজে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে ঘুরে বেড়ানো, উপরি পাওনা— অভিনব সব ওয়াটার স্পোর্টস। ক্যারিবিয়ান হলিডে ধনী সাহেব-মেমদের স্বপ্ন।
৫৬ নম্বর হোপ রোড। শুধু কিংস্টন কেন, গোটা জামাইকা দেশটার সবচেয়ে শ্রদ্ধার, সবচেয়ে আবেগের, সবচেয়ে ভালবাসার ঠিকানা। আহামরি কোনও স্থাপত্য নয়, বিশাল কোনও প্রাসাদ নয়, তবু এই বাড়িই বছরের পর বছর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বব মার্লের বাড়ি, এখন বব মার্লে মিউজিয়াম। সত্তরের দশকের রেগে মিউজিকের সুপারস্টার। সেইসঙ্গে পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। পৃথিবী তাঁকে অবশ্য মনে রেখেছে সঙ্গীতের জন্য। আর ক্যারিবিয়ানরা মনে রেখেছে কৃষ্ণাঙ্গ অস্মিতার প্রতীক হিসেবে। সাহেব বাবা আর কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান মার্লে তো শুধু হাইব্রিড রক গেয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেননি, প্রান্তিক জামাইকানদের কথা এমনভাবে গেঁথেছিলেন সুরে যে সাদা চামড়াদের মুখের মত জবাব হয়েছিল। মার্কিন মুলুকে তাঁকে নিয়ে নাচানাচির বোধহয় একমাত্র তুলনা মাইকেল জ্যাকসন। তাঁর গানকে বলা হত ‘আনকমপ্রোমাইজিং’— নুয়ে পড়ার কোনও জায়গা নেই। এই উদ্ধত, দুর্নিবার, দামাল সুরে আজও ভাসছে গোটা বিশ্ব। তাঁর বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ায় জীবনানন্দ দাশকে। ‘সাম পিপল ফিল দ্য রেন, আদারস জাস্ট গেট ওয়েট’। বৃষ্টিকে অনুভব করতে জানতেন মার্লে, ঠিক যেমন শিশিরের শব্দ শুনতে পেতেন রূপসী বাংলার কবি। বিশাল জটার মতো চুল ঝাঁকিয়ে যখন বব মার্লে গাইতেন ‘ওয়ান লাভ, ওয়ান হার্ট’, পাগল হয়ে যেত আট থেকে আশি। মার্লের ব্যান্ডের নামও ভারি অদ্ভুত— দ্য ওয়েলার্স, মানে রূদালি।
কালো মানুষের কান্না তাঁর গানে পেয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা। কারও স্মারক মিউজিয়ামে একইসঙ্গে সাজানো গিটার আর ফুটবল বুট, সচরাচর দেখা যায় না। বব মার্লে মিউজিয়ামে তাই আছে। জামাইকায় ফুটবল খেলার চল বাংলার মতোই। মার্লেও ছোটবেলা থেকে ফুটবলে লাথি মেরে বড় হয়েছেন। গানের মতো না হলেও ফুটবলেও কিন্তু মার্লে ছিলেন রীতিমতো পেশাদার। তাঁর ব্যান্ডের অন্য গাইয়ে-বাজিয়েরাও নিয়মিত ফুটবল খেলত। তাই মিউজিয়ামে ঢুকেই সোনার বুট দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিউজিয়ামে রয়েছে রেগে তারকার তিন-তিনটে লাইফ সাইজ হলোগ্রাম কাট-আউট, একেবারে জীবন্ত। রেকর্ডিং স্টুডিওতে ঢুকলে তো মনে হবে, এক্ষুনি মাইকের সামনে এসে দাঁড়াবেন রাফ অ্যান্ড টাফ মার্লে। সাজানো আছে প্রিয় পোশাক থেকে গ্র্যামি পুরস্কার সবকিছুই। আর বেডরুমে খাটের পাশে হেলান দিয়ে রাখা আছে মার্লের প্রিয় লে পল স্পেশাল গিটার। মাত্র ৩৬ বছর বেঁচেছিলেন মার্লে, তবে রামধনুর রঙে রাঙানো সেই অল্প ক’দিনের গল্প। একদিকে পরের পর গোল্ড, প্ল্যাটিনাম রেকর্ড, অন্যদিকে সারি দিয়ে সঙ্গিনী। তাঁদের সঙ্গে বারোটি সন্তানের জনক হওয়া। মার্লে বেঁচে থাকলে খুশি হতেন দেখে, বারোজনের মধ্যে ছ’জনই সংগীতকে পেশা করেছেন।
জানুয়ারিতেও রোদ বেশ চড়া। বিকেল পড়তে এলোমেলো ঘুরছিলাম কিংস্টন টাউনের পাড়ায় পাড়ায়। এখানকার মানুষ চড়া রঙের জামাকাপড় পরতে ভালবাসে। আসলে কিন্তু কালো রঙে আলো ছড়ায় গাঢ় গোলাপি, উজ্জ্বল হলুদ, ফ্লুরোসেন্ট সবুজ। দুপুরে একবার ব্যাঙ্কে ঢুকেছিলাম মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে জামাইকান ডলার নেব বলে। সত্যি বলছি, এত স্বল্পবসনা কর্মী আমি পৃথিবীর কোনও দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিসে দেখিনি। থাইল্যান্ডের কথাই ধরুন, সেখানে তো যথাসম্ভব কম পোশাক পরে রাজপথ ধরে হেঁটে যায় বহু মেয়ে, কিন্তু যে-কোনও অফিসে ঢুকে দেখুন, সবাই কম-বেশি ফর্মাল জামাকাপড় পরে রয়েছে। এখানে যে সুশ্রী, পদস্থ মহিলা বিষয়টা দেখছিলেন, তিনি এত খোলামেলা পোশাক পরে আছেন যে, আমাদের অনভ্যস্ত চোখে অস্বস্তি হচ্ছিল। ঠিক অফিস-অফিস ভাবটা আসছিল না।
একটু পরে মনে হল, আসলে আমাদের মনের ভেতর একটা এঁদোপুকুর আছে, অন্যরকম দৃশ্য, অচেনা গন্ধ হলেই তার বদ্ধ জলে আটকে পড়ে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ব্যাঙ্কের ওই স্বল্পবসনা সুন্দরী অফিসারটি অত্যন্ত দক্ষ, বেজায় স্মার্ট তো বটেই। পুরুষদের দেখলাম বয়স নির্বিশেষে কাজকর্মে তেমন মন নেই। মাঝবয়সিরা তাস পিটছে রাস্তায় বসে আর ছেলেছোকরারা হয় ফুটবল খেলছে নয় গিটার বাজাচ্ছে। নেশা ব্যাপারটা কিন্তু নারী-পুরুষ সব্বার খুব পছন্দ। দিনরাতের হিসেব কষার কোনও দরকার নেই। আড়াল-আবডালের প্রশ্নই ওঠে না। খুব মজা লাগল একটা ছোট্ট মেয়ের রিং ঘোরানোর কেরামতি দেখে। বিশাল বিশাল রঙিন গোটাতিনেক রিং পা থেকে ঘুরিয়ে বুক পর্যন্ত তুলছে শুধু কোমরের নাচনে। এরকম আগে দেখেছি সার্কাসে। আমি দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছি দেখে ওর মা হেসে এগিয়ে এলেন, ‘ইউ ওয়ান্ট টু ট্রাই হুলা হুপিং?’ পাগল নাকি, ওই খুদের কাছাকাছি তো দূরের কথা, ওর এক শতাংশ কোমর আমি নাড়াতে পারব?
তার থেকে ওই যে একটু দূরে আখের ক্ষেত, বিকেলের কনে দেখা আলোয় তার পাশে দাঁড়িয়ে টুক করে একটা ছবি তুলে নেওয়া অনেক সহজ!