একটি কুমির নদীপাড়ে রোদ পোহাচ্ছে। প্রকাশ্যে নিস্তেজ, নির্জীব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সতত চঞ্চল। এমতাবস্থায় আপনি কখনওই তার লেজে হাত দেবেন না। বলবেন না, ‘এই যা, নদীতে যা।’ কারণ কুমিরের লেজ খুব নমনীয়, সে মুহূর্তে ঘুরে আপনাকে আক্রমণ করতে পারে।
এই ছ’টি বাক্য পড়ে আপনার জীবনের গুণগত মানের কোনও পরিবর্তন হল? আশা করি নয়। হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু ‘রিল’-সভ্যতা আপনাকে গিলিয়ে দেবে এসব। শিখিয়ে দেবে বরফ ভাঙার কৌশল। কভার ড্রাইভের খুঁটিনাটি। কোন এক আশ্চর্য ভোজবাজির কৌশলে আপনি দেখবেনও সেসব! এই ম্যাজিক শো-এর পর্দা খুলে গিয়েছিল ১৯৮৩ সালের পয়লা জানুয়ারি। ইন্টারনেট বলছে সেদিনই ইন্টারনেটের জন্মদিন। কোন ১৯৮৩? আমাদের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়। কপিল দেবের হাসিমুখ। লর্ডসের বারান্দা। মাঠে ঢুকে পড়া দর্শক। হলুদ আলোর ম্লান দেশে উল্লাস। ক্রিকেট মানচিত্রে আমাদের সশব্দে পদার্পণ। দানবীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নিশ্চুপে চেয়ে থাকা। একের পর এক ছবি। আর কোন ১৯৮৩? প্রথম ইন্টারনেট। প্রথম মোবাইল ফোন। নেপচুনের অরবিটে ‘Pioneer 10’। অসমে প্রায় দু’হাজার বাংলাদেশি মুসলিমের হত্যা। আমাদের দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবী। এবং সে-বছর সুনীল মনোহর গাভাসকরের ব্যক্তিগত মাইলফলক। সেঞ্চুরি সংখ্যার নিরিখে টপকে যাওয়া ব্র্যাডম্যানকে। আমার জন্মের আগের সেই রেকর্ড, সেই ক্রিকেটের দিকে ফিরে তাকালে আমার চোখে পড়ে সমগ্র। কেবল ওই ম্যাচ, কেবল ওই সিরিজ নয়। তাই রেকর্ড বুক উলটে দেখে নেওয়া আমাদের বদলে যাওয়া ক্রিকেট সংস্কৃতিকেও।
কে ছিলেন স্যর ডন ব্রাডম্যান? বা সানি গাভাসকর? সহজ উত্তর, ক্রিকেটার৷ নিশ্চিত তাই। শুধু কি তাই? এই শতাব্দীর ক্রিকেট আর গত শতাব্দীর ক্রিকেটের মধ্যে খেলাটার প্রাথমিক নিয়ম ছাড়া আর মিল নেই কিছুরই। অমিল রয়েছে ক্রিকেটারদের মস্তিষ্কে এবং শরীরী ভাষায়। দর্শকদের চাহিদাও বদলে গেছে এই শতাব্দীতে৷ ব্র্যাডম্যানের অভিষেক হচ্ছে ১৯২৮ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। পরাধীন দেশগুলো ম্যারাথনের শেষ ল্যাপের দৌড় দৌড়চ্ছেন স্বাধীনতার জন্য। এমন বারুদগন্ধতেও নরম রোদ এসে পড়ছে নিয়মমাফিক ঋতুবদলে। গাভাসকর প্রথম ব্যাট হাতে নামছেন আরও ৪৩ বছর পর। ১৯৭১। আরও উত্তাল সময়। মানুষ বুঝে নিতে চাইছেন তাদের স্বাধীনতা। গলিতে, রাজপথে মানুষ।
আমি দু’জনেরই ব্যাটিং দেখিনি। দেখা বলতে, খেলার অংশবিশেষ কিছু। আর আছে গল্পকথা। এবং প্রবাহিত স্মৃতি সম্বল। চল্লিশ বছরের ব্যবধানে তাদের খেলার ধরনের হয়তো পার্থক্য ছিল কিছু। কিন্তু বোধ করি ক্রিকেট দর্শনের পার্থক্য ততটা প্রবল নয়। টেস্ট ক্রিকেটের মূল স্তম্ভ যে অপেক্ষা, তা তাঁরা বুঝেছিলেন। তাঁরা অপেক্ষার সামনে নতজানু হতে পেরেছিলেন। সেই সময়ের ঝকঝকে আকাশ আর রিনরিনে বিশুদ্ধ বাতাস তাদের পুষ্টি জুগিয়েছিল। সেই সময়ের যে নিবিড় সততা তা তাদের নিশ্চিত প্রভাবিত করেছিল। টেস্ট ক্রিকেট কোনও ‘মাদারি কা খেল’ নয়। কোনও বুল ফাইট নয়। এমন নয় যে, দর্শক উল্লসিত হতে চাইবেন আর আমি তাদের উল্লাস ছুড়ে দেব। টেস্ট ক্রিকেট এক শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠান। যাতে আলাপ আছে। ধীরে-ধীরে বিস্তারের পর ঝালা। অকারণ দ্রুততা নেই। সেই সময়ের ক্রিকেটে আলগোছে জীবনকে দেখা ছিল। এই মায়াবী নীল গ্রহ তখনও মলিন হয়ে যায়নি। ওই তো সবুজ গালিচার মতো মাঠে দু’জন ক্লিন শেভেন পুরুষ নামছেন। যাদের ঋষিতুল্য অপেক্ষার তপস্যা আছে। আর দিনশেষের এলিয়ে থাকা সূর্যালোকের আলোয় তাদের দীর্ঘ ছায়া পড়ছে ক্রিকেট ইতিহাসে।
১৯৮৩ সালের জুন মাস। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ২৫ জুন। আমাদের প্রথম ওয়ার্ল্ড কাপ জয়। যা প্রায় কেউ ভাবেনি। কপিল পরে ইন্টারভিউতে বলেছেন, তাঁরা অনেকেই ইংল্যান্ড থেকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর টিকিট কেটে রেখেছিলেন। কারণ তাদের ধারণা ছিল ভারত বেশি দূর এগোবে না। তবে সবাইকে হতবাক করে জয়। বিশ্বকাপ জয়। এ কি নিছক অঘটন? না কি ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি ছিল? না কি ঐশ্বরিক শক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে তাদের ভরাডুবি? কারণ হতে পারে বিবিধ। তবে এ-জয় মধুর। তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সেই বোধহয় আমাদের স্বপ্নের উড়ান। ক্রিকেট নিয়ে জন-উন্মাদনার সেই বোধহয় সিলমোহর।
এর মাসচারেক পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল ভারত সফরে। ফাইনালে হারের ক্ষত নিয়ে টগবগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দল। তাদের প্রতিভার শনশনে হাওয়ার দাপট তারা নিজেরাও নিশ্চয়ই টের পেতেন। বহু জল্পনা এই সিরিজ নিয়ে। ভারত জয়ের রানওয়ে থেকে আরও দীর্ঘ উড়ান দেবে কি না, সে-নিয়ে বিস্তর আলোচনা। প্রথম টেস্ট কানপুর। শোচনীয় পরাজয় ভারতের। গাভাসকর প্রথম ইনিংসে শূন্য। পরের ইনিংসে সাত। দু-বারই উইকেট শিকারি সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার। ম্যালকম মার্শাল।
যদিও এ-কথা বললেও ওই টেস্ট নিয়ে কিছুই বলা হয় না। এই সেই ম্যাচ, যে-ম্যাচে গাভাসকরের ব্যাট ছিটকে যায় হাত থেকে। দ্রুত গতির মার্শালের বল সামলাতে পারেননি গাভাসকর। কেবল ব্যাট ছিটকে যাওয়া তো নয়, অহং ছিটকে পড়েছিল লিটল মাস্টারের। স্তব্ধ গ্যালারি, নিশ্চুপ গাভাসকর। এর উত্তর মিলেছিল পরের টেস্টে। দিল্লি টেস্ট। মার্শালের বাউন্সার। ডাক নয়। ব্যাট চালালেন সানি। যে পুল হুক তিনি বেশ কিছু বছর সরিয়ে রেখেছিলেন, হাতিয়ার হল সেই শট। পুল হুককে তিনি মনে করতেন, ‘high risk, low return shot’। আস্তিনে রাখা সেই শট হল তার হাতিয়ার। ফলস্বরূপ ৩৭ বলে অর্ধশতরান। এবং ৯৪ বলে শতরান। তার দ্রুততম শতরান। ২৯তম শতরান। আক্রমণাত্মক গাভাসকর বুঝতে পারেননি তার শতরান পূর্ণ হয়েছে। বেঙ্গসরকার বলেন, ‘Bloody! you have leveled with the don!’
ভারতীয় ক্রিকেটের তৎকালীন ডন শতরানের এক আসনে বসলেন স্যর ডনের। সেই ইনিংসে মার্শাল ২৪ ওভারে ১০৫ রান দিলেন। বিনিময়ে এক উইকেট। গাভাসকর তাঁর আক্রমণের পথ থেকে সরে আসেননি তার পরের টেস্টেও। ঝোড়ো ৯০ করলেন আমেদাবাদে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শতরান এল না। অপেক্ষায় দেশবাসী। খেলার ধরন বদলেছেন গাভাসকর। যা হয়নি এর আগে কখনও। আক্রমণ এবং আক্রমণ। লক্ষ্যের কেন্দ্রে মার্শাল।
তবু যিনি গ্রেট, অনিয়ন্ত্রিত হন তিনিও। লক্ষ্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছনো যায় না। আসে না শতরান। সিরিজ হার ভারতের। সিরিজের শেষ টেস্ট মাদ্রাজে। অধুনা চেন্নাই। গাভাসকর ওপেন করছেন না। তিনি নামবেন চারে। অথচ শূন্য রানেই ফিরে যান দুজন। প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে অংশুমান গায়েকওয়াড়। পঞ্চম বলে বেঙ্গসরকার। প্রথম ওভারের ষষ্ঠ বল খেলতে মাঠে নামেন সুনীল। বল হাতে মার্শাল। হ্যাটট্রিক বল। ডনকে পেরিয়ে যেতে প্রয়োজন একটি শতরান। অনন্ত চাপে তার দল। স্কোরবোর্ডে কোনও রান নেই। উইকেট দু’টি। সুনীল গাভাসকর টিকে থাকেন। ওভার শেষ হলে ভিভ রিচার্ডস বলে উঠলেন ‘No matter what number you bat man, the score is still zero.’ এই স্লেজিং প্রজন্মের পর প্রজন্ম রয়ে গেছে। এই গল্প এখন কিংবদন্তি। কিন্তু এবার, এই ম্যাচে গাভাসকর চঞ্চল নন। তিনি স্থির। লক্ষ্যে অবিচল। একাকী। নিমগ্ন। অকারণ আক্রমণ নয়। তার হাতিয়ার চিরপরিচিত ধৈর্য। অপেক্ষা। এবং সেঞ্চুরি। ৩০তম সেঞ্চুরি। লিটল মাস্টার টপকে গেলেন স্যর ডনকে। সুনীল কেরিয়ারের সর্বোচ্চ রান করলেন। ২৩৬। সে কোনও আক্রমণের পথে নয়। নিজের কক্ষপথ থেকে চ্যুত হয়ে নয়। ফিরে এলেন নিজের চেনা ছন্দে। হয়তো তার অহং-এর থেকে বড় হয়ে দাঁড়াল অনুশীলনের শ্রদ্ধাবোধ। ব্যক্তির চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল ক্রিকেট। আর সর্বকালের বড় হয়ে দাঁড়ালেন সুনীল মনোহর গাভাসকর।
জীবনের দিকে ফিরে চাইলে আশ্চর্য হতে হয়। ঠিক যখন অমোঘ সুখে আচ্ছন্ন হতে থাকে মানুষ, জীবনদেবতা আচম্বিতে এলোমেলো করে দেন সব। সুখ এবং সাফল্যে সামিট করার আগেই কণ্টকময় পথ। যেমন পারেননি ব্রাডম্যান। জীবনের শেষ ইনিংসে চার রান করলে অ্যাভারেজ হত ১০০। ব্র্যাডম্যান আউট হলেন শূন্য রানে। তার এভারেজ ৯৯.৫। বিশ্বকাপ জয়ের পরের সিরিজেই পতন এবং মূর্ছা। কেবল হার নয়। টিম বিদ্ধ হয়েছিল বিতর্কে। কপিল হারের জন্য দায়ী করেছিলেন কিছু সিনিয়র প্লেয়ারকে। সেই ’৮৩-র টিমের দুই সিনিয়র প্লেয়ারের অন্তর্গত লড়াই সর্বজনবিদিত। জীবনের কক্ষপথ এমনই। সরল রাস্তা থেকে হঠাৎ মহাজাগতিক ঝড়। তখন ধরে থাকো জীবনের হাল আর নিশ্চুপ অপেক্ষা। যে অপেক্ষায় থাকেন একজন টেস্ট ক্রিকেটার। ছটফট নয়। ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। যিনি জানেন কখন বলের লাইন থেকে সরে আসতে হয়। লোভ নয়। যিনি জানেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ইনিংসের গোড়ায় হেলায় যেতে দিতে। এক ঔদাসীন্য মাখা রাজকীয় মন তার। অকারণ আগ্রাসন নয়। নিজের অনুশীলনের প্রতি আত্মবিশ্বাস। না পারায় আত্মসমীক্ষা।
ক্রিকেট বদলে গেছে। বদলে গেছে সময়। সভ্যতা। দ্রুততা যার চালিকাশক্তি এখন। ঢিমেতালে দেখে নেওয়া নয়, গতি চাই। একদিনের ম্যাচ। সেখান থেকে কুড়ি-বিশ। অধুনা টি-টেন। এতেও ফয়সালা না হলে সুপার ওভার তো রইলই। আমাদের অক্ষরবৃত্ত ছন্দের টেস্টের শরীরে ঢুকে পড়ছে দলবৃত্ত ছন্দের চঞ্চলতা। জো রুটের মতো সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার বদলে ফেলছেন খেলার ধরন। প্রথম বল থেকে আক্রমণ। তবু আমাদের ক্রিকেট ইতিহাস বারবার মনে করায় সংযমের কথা।
গাভাসকর চলে যাওয়ার পর আসবেন আর এক মারাঠি তরুণ। ২০০২-’০৩ সালে তিনি খেলবেন অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে খেলবেন ২৪১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। সেই ইনিংসে তার প্রিয় শট কভার ড্রাইভ একটাও থাকবে না। কারণ তিনি বার বার কভার ফিল্ডারের হাতে তালুবন্দি হচ্ছেন। সেই তরুণের নাম, শচীন রমেশ তেন্ডুলকর। যিনি কালের নদী বেয়ে উৎসমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ধীরে-ধীরে পেরিয়ে গেছেন সবাইকে। রানের রংমশাল জ্বেলেছেন সব ধরনের ক্রিকেটে। এই আমাদের উত্তরাধিকার। সংযমের উত্তরাধিকার। অনুশীলনের উত্তরাধিকার। মনে পড়ে, ডিভিলিয়ার্সের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ বাঁচানো ৩৩ রান। যা এসেছিল ২২০ বল খেলে। টেস্ট ক্রিকেটে রান করা মানে কেবল রঙের বিস্ফোরণ নয়। চিত্রকর বারে বারে দাঁড়াবেন সাদা ক্যানভাসের সামনে । নৃত্যশিল্পী তাল-ছন্দের অলিগলি বেয়ে গেলেও ফিরে আসতে জানবেন সোমে। তাই প্রতিটা নতুন সেশন নতুন শুরু। প্রতিটা বল নতুন বল। হাওয়ার বিরুদ্ধে ডানা ঝটপট নয়। দু’ডানা স্থির রেখে ভাসমান। দ্রুত বদলে যাওয়া এই শতাব্দীতে বিলুপ্তপ্রায় সেসব সাবেক টেস্ট খেলোয়াড়। পড়ন্ত বিকেলে খেলা শেষের আলোয় পড়ে থাকে তাদের অতীত ইতিহাস। সেই মিঠে আলোয় উদ্ভাসিত স্যর ডন ব্র্যাডম্যান এবং সুনীল গাভাসকর। আর তাদের প্রান্তিক উত্তরাধিকার।
তথ্যঋণ: তৃণাঞ্জন সেনগুপ্ত